নীরবতা #নাইমা_জাহান_রিতু #পর্ব_১১_১২_১৩

0
295

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১১_১২_১৩

খানিক্ষণ ঘরের ভেতরে পায়চারী করে বিছানায় শরীর মেলে দিল মেসবাহ। তবে এপাশ ওপাশ করেও ঘুমের দেখা পেল না। রাগ তার কিছুটা কমে এলেও মনের ভেতরটা অস্থিরতায় ছটফট করছে। সে কি ঠিক করলো কাজটি? ভয় পায় মেয়েটি একা ঘরে ঘুমোতে। গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে উঠা একটি মেয়ের পক্ষে এমনটাই কি স্বাভাবিক নয়? তাছাড়া মেয়েটির বয়সও তার একবার বিবেচনায় আনা উচিৎ ছিল। অস্থির মনে বিছানা ছেড়ে উঠে ডাইনিংয়ে এসে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে গিলে ফেললো মেসবাহ। তারপর লম্বা একটি দম ছেড়ে একটি চেয়ার টেনে বসে পড়লো তাতে। কী এমন হবে মেয়েটির পাশে ঘুমোলে? নিজেকে সংযত রাখতে পারবে না সে? তাহলে তার এবং কোনো পশুর মাঝে পার্থক্য থাকলো কি? বাচ্চা একটি মেয়ের পাশে শুয়েই যে ব্যক্তি নিজেকে সংযত রাখতে ব্যর্থ হবে, বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে নানান আজেবাজে চিন্তাভাবনা করবে, সে আর যাই হোক কোনো মানুষ নয়। পশু সে.. নীচু স্তরের এক নিকৃষ্ট পশু। ভাবামাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। নীরব পায়ে এগুলো উল্লাসীকে একা ফেলে রেখে আসা ঘরের দিকে।

বিছানায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো উল্লাসীর। তবে সেদিকে চোখ তুলে তাকাবার মতো সাহস হলো না তার। যদি অদ্ভুত সেই চেহারার মানুষগুলো হয়? তখন কী করবে সে? এক দৌড়ে এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার সকল পথই যে বন্ধ!
-“উল্লাসী… এই উল্লাসী?”
হঠাৎ মেসবাহর ডাক কানে আসতেই মাথা উঠালো উল্লাসী। অবিশ্বাস্য চোখে একবার মেসবাহর দিকে তাকিয়েই ঝাপিয়ে পড়লো তার বুকে। অপরদিকে খানিক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর এক হাত উঠিয়ে উল্লাসী মাথায় রাখলো মেসবাহ। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত গলায় বললো,
-“খুব ভয় পেয়েছিলে?”
মেসবাহর বুকে মুখ ডুবিয়ে উল্লাসী নাক টেনে জবাব দিল,
-“হু…”
-“এত ভয় কিসের বোকা মেয়ে? দেখো চারপাশের দরজা জানালা সব কিছুই তো বন্ধ। এর ভেতর কেউ কি আসতে পারবে এই ফ্ল্যাটে?”
-“উহু…”
-“তাহলে এত কিসের ভয় তোমার?”
-“জানিনা…”
-“আজ কি তোমায় জানিনা রোগ হয়েছে? সব প্রশ্নেরই এক উত্তর করে যাচ্ছো! জানিনা জানিনা আর জানিনা।”
শরীরের কাঁপুনির সঙ্গে কান্নার বেগ খানিকটা কমে এল উল্লাসীর। ভেজা গলায় সে বললো,
-“আপনার যদি ভাল্লাগেনা রোগ হতে পারে তাহলে আমার জানিনা রোগ হলে দোষ কী?”
-“আমি তো ডক্টর। নিজের রোগ হলে নিজে চিকিৎসা করে তা সারিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু তুমি? তোমার এই রোগ কে সারাবে শুনি?”
-“কেনো? আপনি সারাবেন। আপনি আমার স্বামী না?”
জবাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেসবাহ। অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে উল্লাসী। কান্নার দরুন আর শরীর কেঁপে কেঁপেও উঠছে না তার। হয়তো কিছুক্ষণের মাঝে একদম ঠিকঠাকও হয়ে যাবে সে।
-“চলো.. শুয়ে পড়ি।”
মেসবাহর বুক থেকে মাথা উঠালো উল্লাসী। অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো,
-“আমার তো আজ জ্বর নেই। আমি নিচে শুই? আর আপনি এঘরেই বিছানায় ঘুমোন?”
-“উহু.. আমি তুমি, আমরা দুজনেই আজ একসাথে ঘুমোবো। এবং তা বিছানায়। নাও দেখি তোমার বালিশ একপাশে রাখো।”
খানিক্ষনের জন্য বিস্মিত হলেও উল্লাসী ঠোঁটে ফুটলো মিষ্টি হাসি। সত্যিই এই মানুষটিকে বোঝা বড় দায়!

বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ একনাগাড়ে বেঁজে যাচ্ছে কলিংবেল। তবে দরজার কাছে একবার গিয়ে তা খোলার সাহস করে উঠতে পারছে না উল্লাসী। গতকাল দুপুরে বারবার তাকে দরজা খুলতে নিষেধ করে দিয়েছে মেসবাহ। তবে এভাবে একজন অপরপাশ থেকে ডেকে যাচ্ছে অথচ সে তার ডাকের সাড়া দিচ্ছে না। কাজটি অসভ্যের মতো হয়ে গেলো না? তাছাড়া একা বাসায় থাকতে তার নিজেরও ভালো লাগছে না। ভয় লাগছে, দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। কী এমন হবে দরজা খুলে ওপাশে আসা মানুষটির সঙ্গে দুটি কথা বললে? উল্টাপাল্টা প্রশ্ন না করলে না হয় আবারও জানিনা বলে কাটিয়ে দেয়া যাবে! তাতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও তো কারো সঙ্গ পাওয়া যাবে! আড়ষ্ট পায়ে দরজার দিকে এগুলো উল্লাসী। সময় না নিয়ে দ্রুত দরজা খুলতেই দেখতে পেলো গতকালের সেই মহিলাকে।
-“কী করছিলে? কতক্ষণ যাবৎ বেল বাজিয়ে যাচ্ছি! দেখো ঘেমে টেমে একাকার অবস্থা!”
বলেই মুন্নি সরকার এগুলো ড্রইংরুমের দিকে। ফ্যান ছেড়ে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে বললো,
-“দেখি এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়াও তো..”
দরজা বন্ধ করে মুন্নি সরকারের কথামতো বরফ শীতল পানি এনে তার দিকে বাড়িয়ে দিল উল্লাসী। নরম গলায় জানতে চাইলো,
-“আপনি ভালো আছেন?”
পুরো পানি শেষ করে আরাম করে আবারও সোফায় বসে সে বললো,
-“আছি কোনোরকম! তুমি ভালো আছো?”
-“হ্যাঁ…”
-“সকালে খেয়েছো?”
-“হ্যাঁ..”
-“কী খেলে?”
-“রুটি আর আলু ভাজি।”
-“সব তুমি করেছো? দেখি একটা রুটি আর আলুভাজি নিয়ে এসো তো। খেয়ে দেখি কেমন হয়েছে!”
-“রুটি তো নেই। তবে আলুভাজি আছে। ওটা আনবো?”
-“যাও.. আনো।”
উৎসাহের সাথে উল্লাসী রান্নাঘরের দিকে এগুতেই নিজের মনকে আবারও বোঝালো মুন্নি সরকার। আজ এমন তেমন কোনো প্রশ্ন নয়! আজ সহজ ভাবে কথা বলতে হবে উল্লাসীর সাথে। যাতে কাল হঠাৎ করেই তার পরিবর্তনের কারণটি ধরতে পারে সে। তাছাড়া মেয়েটির মাথায় পাগলামো আছে কিনা, চরিত্র ঠিকঠাক কিনা তাও তো দেখতে হবে!

-“বাহ! বেশ ভালো হয়েছে তো।”
মুন্নি সরকারের কথায় হাসি ফুটলো উল্লাসীর ঠোঁটে। পানির গ্লাস তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“রুটি খেতে চাইলে কাল আপনার জন্য বানিয়ে রাখবো।”
-“ঠিকাছে। রেখো। তা আর কী কী রাধতে পারো তুমি?”
-“গরুর মাংস, মুরগির মাংস, মাছ, শাক ভাজি, পটল ভাজি…”
উল্লাসীকে কথার মাঝে থামিয়ে দিল মুন্নি সরকার। খুশি মনে বললো,
-“সব পারো?”
-“মোটামুটি..”
-“তা কাল তোমার কী হয়েছিল? আমি তো বাবা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!”
-“দরজা খুলে আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপনাকে দেখে।”
যাক! মেয়েটি তাহলে পাগল নয়। গ্রামের মেয়ে, শহরের রীতিনীতি আর কতটুকুই বা জানে! তাছাড়া একা বাসায় অচেনা কেউ এলে ছোটো এক মেয়ের পক্ষে ভয় পাওয়ারই কথা। ভয়েই হয়তো উলোটপালোট কিছু বলে ফেলেছে! একে এত আমলে নেবার দরকার নেই! ভেবে সামান্য হাসলো মুন্নি সরকার। বললো,
-“আমাকে দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি পাশের ফ্ল্যাটেই থাকি। দরজা খুললেই যে ফ্ল্যাটটি দেখো না? ওটিই আমাদের। তোমার ভাই সারাদিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তো, তাই কথা বলার মানুষ পাইনা। একা একা প্রচুর বোর হই।”
-“অহ..”
-“তাই তোমার সাথে গল্প করতে আসা। জানো, তোমাকে বেশ ভালো লেগেছে আমার? বেশ সুন্দর তুমি। যেনো আল্লাহ নিজ হাতে গড়েছে তোমায়। আর আমাকে দেখো? বিয়ে হয়েছে চার বছর। বাচ্চাকাচ্চাও এখনো হয় নি। অথচ এখনি শরীরের ফুলে কলাগাছ!”
বলেই হেসে উঠলো মুন্নি সরকার। যেনো নিজের এই স্বাস্থ্য নিয়ে দারুণ খুশি সে!

বেশ সময় নিয়ে নানান গল্পগুজব করে প্রায় অনেক বিষয়েই তথ্য বের করলো মুন্নি সরকার। তবে মেসবাহর ঠিক কেমন বোন হয় উল্লাসী তা জানতে একরকম ব্যর্থ হলো সে। উদ্বিগ্ন মনে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরেই সে কল দিয়ে বসলো তার স্বামীকে হাসান সরকারকে। আপাতত তার মনের কথাগুলো তাকে জানাতে হবেই হবে।
-“বলো..”
-“কী করছিলে তুমি?”
-“তেমন কিছু না। কিছু বলবে?”
-“হ্যাঁ.. আমার শীতল ভাইয়ের জন্য উল্লাসীকে খুব পছন্দ হয়েছে।”
-“উল্লাসী কে?”
-“ওই যে! মেসবাহর বোন। কাল রাতে যে তোমায় বললাম! আজই ভুলে গেছো?”
-“অহ হ্যাঁ! কিন্তু মেয়েটা তো ছোট। প্রাপ্ত বয়স্ক নয়।”
চোখমুখ কুঁচকে মুন্নি সরকার বললো,
-“ছোট আর কই? পিরিয়ড হলেই একটা মেয়ে বিয়ের যোগ্য হয়ে পড়ে। সে হিসেবে উল্লাসীও হয়েছে।”
-“তবুও। আমার মতামত চাও তো আমি বলবো, অন্য মেয়ে দেখতে। তাছাড়া তোমার ভাইও তো বেকার।”
-“হ্যাঁ, তা তো বলবেই! নিজের ভাই না তো। তাই তোমার ওর উপরে কোনো মায়া দয়াও নেই। নিজের ভাই হলে ঠিকই গ্রামের সাধাসিধা মেয়েকেই ঘরে আনতে। যাতে তাকে দিয়ে সংসারের সব কাজ করিয়ে আবার মায়ের দেখাশোনায়ও লাগিয়ে দিতে পারো।”
-“তো তোমার উদ্দেশ্যও কী সেটা নয়?”
হালকা কেশে গলা ঠিক করলো মুন্নি সরকার। দাপুটে গলায় বললো,
-“মোটেও নয়.. মেয়েটিকে প্রথম দেখাতেই আমার পছন্দ হয়েছিল। যাকগে আমার ভাইকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আমার ভাইয়েরটা আমিই বুঝবো। রাখছি।”
কান থেকে ফোন নামিয়ে রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুন্নি সরকার। মাঝেমাঝে হাসানের উপর তার খুব বেশি রাগ হয়। বেশ অরসিক একজন মানুষ তিনি। কোনো বিষয়ে রসিকতা তো নেইই সাথে মুখ ভর্তি উজানী কথায় ভর্তি। এই লোক কবে মানুষ হবে কে জানে! অবশ্য এই বয়সে আর তাকে মানুষ করাও সম্ভব নয়। বয়সটা তার উল্লাসীর কাছাকাছি হলে তাও একটা সুযোগ থাকতো মানুষ করার। আসলে এই বয়সী ছেলেমেয়েরা কিছুটা কাদার মতো। সামান্য শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো গড়িয়ে নেয়া যায় তাদের। উল্লাসীকেও ঠিক সেভাবেই গড়িয়ে নেবে সে। তাছাড়া মেয়েটি যথেষ্ট শান্তশিষ্ট। কাজকর্মেও যথেষ্ট পাঁকা। এর চেয়ে গুণী মেয়ে সারা দুনিয়ায় খুঁজলেও তার ভাইয়ের জন্য পাবে না সে। ওদিকে শীতল ভাইয়ের বাউন্ডুলের মত ঘোরাফেরা, বাজী ধরে টাকা উড়ানো দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এমতবস্থায় একটি বিয়ে করলে ঘরে লাল টুকটুকে সুন্দর একটি বউ আসলে হয়তো ঘরে মন বসবে তার। আর সেইসাথে হাসানকে বলে না হয় ছোটোখাটো কোনো চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে। অপরদিকে মারও বয়স হয়েছে। সব কাজকর্ম নিজের হাতে সামলানো তার একার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। উল্লাসী গিয়ে সংসারের হাল ধরলে না হয় মা এসব থেকে ছুটি নেবে। সেই সাথে ছেলের বউয়ের হাতের সেবাশুশ্রূষা তো রয়েছেই। তবে সব থেকে বড় যে কারণে উল্লাসীকে নিজের ভাইয়ের জন্য নির্বাচন করেছে সে, তা হলো বাপের বাড়িতে তার অধিপত্য ধরে রাখা। নইলে আজকালকার যুগের যা বৌ, তাতে ননদের মুখোমুখি হতেও নারাজ তারা। বাড়িতে অধিপত্য চালানো তো দূরের কথা! এক্ষেত্রে উল্লাসীকে এই ব্যাপারে নিরাপদ মনে হয়েছে তার। মেয়েটিকে এই তিনদিনে যতটুকু চিনেছে সে, তাতে নিজস্বতা বলতে কিছুই নেই তার মাঝে। একটু বুঝিয়ে শুঝিয়ে তাকে যেভাবে চালানো যাবে বিনাপ্রশ্নে সে সেদিকেই ধাবিত হবে।

(চলবে)

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১২

-“কথা বলবি না আমার সাথে? সত্যিই কথা বলবি না?”
অপরপাশ থেকে অনার কোনো জবাব না পেয়ে উদ্বিগ্ন হলো চৈতালি। অনা তার উপর রাগ করেছে তা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে ঠিক কী কারণে? গতকাল মুবিন যাবার পর মন ভালো না থাকায় আজ সারাদিন এবাড়িতে আসাও হয় নি তার। এরমাঝে কী এমন হলো যে একদম কথাবার্তায় বন্ধ করে দিল অনা? বোধগম্য হলো না চৈতালির। নিজের দু’হাতে দু’কান ধরলো সে। তারপর আবারও অসহায় গলায় বললো,
-“আমি কী করেছি এটা তো আমায় বল! না বললে বুঝবো কী করে? এই অনা? এদিকে একটু তাকা। দেখ তোর রাগ ভাঙ্গাতে তোর চিতৈই পিঠা কান পর্যন্ত ধরেছে।”
একনজর চৈতালিকে দেখে আবারও মুখ ঘুরিয়ে নিল অনা। তারপর তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
-“আমি কারোর উপর কোনো রাগ করিনি।”
-“তাহলে কথা বলছিস না কেন?”
-“কথা বলতে ইচ্ছে না করলেও কথা বলতে হবে কেন?”
-“তো কথা বলতে ইচ্ছে করবে না কেন?”
-“নাই করতে পারে। তুই যা তো এখন।”
-“কেনো যাবো? আমি আজ আরও আসলাম তোর সাথে রাতে থাকবো বলে!”
-“যা তো তুই। বিরক্ত করিস না।!”
হঠাৎ অনার চিৎকারে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো চৈতালি। মন অসম্ভব খারাপ হয়ে এল তার। এরকম কেনো করছে অনা ভেবে পেল না সে। অনা খানিকটা জেদি স্বভাবের। তবে কখনোই সে নিজের জেদ বন্ধুত্বের মাঝে আনেনি। মনোমালিন্য হওয়া তো দূরের কথা। তাহলে আজ হঠাৎ করেই কী এমন হলো যে তার সঙ্গে এতটা দুর্ব্যবহার করছে অনা! খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর সদর দরজার দিকে পা বাড়ালো চৈতালি। তবে মাঝপথে এসেই থেমে আরও একবার ধরা গলায় বললো,
-“সত্যিই চলে যাবো?”
-“হ্যাঁ, যা…”
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি বলে চোখ জোড়া বন্ধ করলো অনা। চৈতালি তার ছোটবেলার বন্ধু। সবচেয়ে কাছের মানুষ। অথচ তার জীবনের এতবড় একটি সত্য কী করে লুকিয়ে রাখলো সে? তাও তার ভাইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে! কী দুর্দান্ত অভিনয় তাদের! যেনো একে অপরকে চেনে জানেই না! নাম মনে রাখা তো দূরের কথা। কিভাবে পারলো তারা এসব করতে? এভাবে কয় বছর যাবৎ তারা এ অভিনয় অভিনয় খেলছে কে জানে! কী এমন হতো তাকে সবটা জানালে? সে কী চৈতালির শুভাকাঙ্ক্ষী নয়? তারপরও কেনো চৈতালি জানালো না তাকে? লম্বা করে দম ছেড়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আলমারি খুলে ছবির একটি অ্যালবাম বের করলো অনা। তারপর তার এবং চৈতালির সকল ছবি বেছে আলাদা করে একটি মোম জ্বালিয়ে পোড়াতে শুরু করলো ছবিগুলোর একপাশ থেকে চৈতালিকে।

ল্যাবএইডে সন্ধ্যার পর বসার কথা থাকলেও উল্লাসীর কথা ভেবে চেম্বারে বসলো না মেসবাহ। বিকেল থাকতেই বাড়ি ফিরে সময় নিয়ে গোসল সেরে টেলিভিশনের সামনে বসলো সে। তারপর উল্লাসীকে ঢেকে চা চাইলো এক কাপ। স্বামীর আদেশ পাওয়ামাত্র উল্লাসী পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে। চুলোয় গরম পানি বসিয়ে ঝটপট চা বানিয়ে কাপে ঢেলে তা নিয়ে এগুলো ড্রইংরুমের দিকে।

-“তুমি খাবে না?”
-“উহু.. আমি খাই না।”
কথা বাড়ালো না মেসবাহ। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আবারও টেলিভিশনের পর্দায় দৃষ্টি দিল সে। অপরদিকে মেসবাহর দিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকার পর উল্লাসী উৎসাহী গলায় বললো,
-“আজও উনি এসেছিলেন।”
-“কে?”
-“ওই যে উনি। মুন্নি ভাবি।”
চোখমুখ কুঁচকে গেল মেসবাহর। টেলিভিশনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উল্লাসীর দিকে তাকালো সে। কড়া গলায় বললো,
-“তুমিও আজও দরজা খুলেছিলে?”
-“হ্যাঁ.. উনি বেল বাজিয়েই যাবে আর বাজিয়েই যাবে! আর আমি ভেতরে থেকেও সাড়া দিব না?”
-“না, তুমি দেবে না। তোমাকে নিষেধ করিনি আমি?”
মেসবাহর মেজাজ খারাপ হচ্ছে বুঝতে পেরে মুখ ছোট হয়ে এল উল্লাসীর। মেঝের দিকে চেয়ে সে ধীর গলায় বললো,
-“আমার একা বাসায় ভয় করলে একটু সময় উনার সাথে কথা বললে কী এমন হবে?”
-“একা বাসায় তোমার ভয় করবে কেন? একা তো একা। ভয় দেখানোর মতো কেউ আছে কি?”
জবাব দিল না উল্লাসী। এক বেলা তরল তো এক বেলা কঠিন। এই লোককে বোঝা সত্যিই বড় দায়!
-“তাছাড়া দিনের বেলায় আবার কিসের ভয়? পৃথিবীর সব ভুতপ্রেত কি নিজেদের সব কাজকর্ম ফেলে সারাদিন তোমায় ভয় দেখানোর চাকরি নিয়ে রেখেছে?”
-“হ্যাঁ, আপনার চাকরি যেমন ডাক্তারগীরি করা তেমন ওদের চাকরিও ভুতগীরি করা।”
হঠাৎ উল্লাসীর এমন কথায় থেমে গেল মেসবাহ। একদন্ড নীরব থেকে ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“ভুতগীরিটা কী?”
-“কেনো জানেন না? ভুতগীরি হলো ভয়দেখানো। ভুতের একমাত্র কাজ। আমাদের ভয় দেখাতে সফল হলেই তো ওদের সরদার খুশি হয়ে ওদের টাকা দেয়।”
উল্লাসীর ভুতগীরির সঙ্গা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মেসবাহ। এই মেয়ে পারেও বটে!
-“আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন না?”
ঠোঁট চেপে হাসি থামানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হাসতে হাসতেই মেসবাহ জবাব দিল,
-“করি তো।”
-“তাহলে শুধুশুধু হাসছেন কেনো?”
-“কোথায় হাসছি? হাসছি না তো!”
-“এই তো.. এই যে হাসছেন!”
হাসির বেগ আরও কয়েক ডিগ্রী বাড়িয়ে দিল মেসবাহ। মেয়েটি অদ্ভুত সুন্দর এক সঙ্গা দিয়েছে ভুতগীরির!

-“এই মেসবাহ.. এই দাঁড়াও।”
সিগারেট কিনতে নিচে এসেছিল মেসবাহ। হঠাৎ পেছন থেকে মহিলা কন্ঠের কারো ডাক শুনে থেমে গেল সে। ভ্রু কুঁচকে পেছন ফিরতেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ভেসে উঠলো তার সামনে লিমনের ভাষ্যমতের ভুড়িওয়ালা ভাবির ছবি। খানিকটা অস্বস্তি হলো তার। এই মহিলা কেনো ডাকছে তাকে? উল্লাসী আবার উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলেনি তো!
-“কেমন আছো?”
-“জ্বি, ভালো। আপনি ভালো?”
-“আছি কোনোরকম! জানোই তো.. একদম সময় দেয় না তোমার ভাই আমায়।”
কী বলবে ভেবে পেল না মেসবাহ। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
-“আপনি এখানে কেনো? কোনো কাজে এসেছেন?”
-“হ্যাঁ.. মাসের বাজার নিতে এসেছিলাম। শফিক আছে না? ওর দোকান থেকেই নেই। তা তুমি কোত্থেকে নাও?”
-“ওখান থেকেই।”
-“ভালো করো। ছেলেটা বেশ ভালো।”
-“হুম..”
মেসবাহর দিকে কিছুটা এগিয়ে এল মুন্নি সরকার। গলা খানিকটা নামিয়ে বললো,
-“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। এখানে দেখা হয়ে ভালোই হয়েছে। আসলে সব কথাই তো আর উল্লাসীর সামনে বলা যায় না!”
জোর করে ঠোঁটে হাসি ফোঁটালো মেসবাহ। হালকা মাথা নেড়ে বললো,
-“জ্বি..”
-“আমার ভাইকে তুমি তো দেখেছো। কেমন লেগেছে উনাকে তোমার?”
ঠিক মনে করতে পারলো না মেসবাহ। তবুও এক গাল হেসে সে বললো,
-“খুবই ভালো।”
-“আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে তো সব হয়েই গেলো। উল্লাসীর সঙ্গে…”
কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ মাঝপথে হাসান সরকার এসে থামিয়ে দিল মুন্নি সরকারকে। তার কাঁধে হাত রেখে হাসান সরকার বললো,
-“তুমি যে চুলোয় তরকারি দিয়ে বেরিয়েছিলে তা তো পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে। কী একটা অবস্থা! তাড়াতাড়ি চলো..”
-“আমি তরকারি কখন চড়ালাম? তুমি ভুল ফ্ল্যাটে ঢুকে যাওনি তো? আমি ফেইসবুকে একটি ভিডিও দেখেছিলাম। ফোন টিপতে টিপতে কোনো হুশ না পেয়ে অন্যের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছিল এক লোক!”
-“না না.. তুমি এসো তো। মেসবাহ তুমি যাও। পরে দেখা হবে।”
একরকম জোরপূর্বক মুন্নি সরকারকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরলো হাসান সরকার। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“এক গ্লাস পানি দাও।”
-“বিষ দিব বিষ? বিষ খাবা?”
-“আপাতত পানি…”
-“তোমার পানির মাইরে বাপ। তুমি মিথ্যে বলে আমাকে নিয়ে আসলে কেনো?”
-“তো কী করতাম? দেখা নেই শোনা নেই! দুইদিনের দেখায় একটি মেয়েকে কিভাবে নিজের ভাইয়ের জন্য ঠিক করো তা আমার মাথায় আসে না!”
ফুঁসে উঠলো মুন্নি সরকার,
-“যথেষ্ট দেখাশোনা হয়েছে। এই মুন্নি সরকারের চোখ একবার দেখেই সব বুঝে ফেলে। তুমি আসলে আমার ভাইয়ের সুন্দরী একটা বউ হোক তা চাওনা! কারণ কী বলো তো? আবার নিজেই উল্লাসীকে বিয়ে করার পায়তারা করছো না তো!”
কপাল চাপড়ে সোফায় শরীর মেলে দিল হাসান সরকার। তারপর ঠান্ডা গলায় বললো,
-“চাইলেই বা ক্ষতি কী? অন্তত পাগলের হাত থেকে তো বাঁচা যাবে!”

(চলবে)

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_১৩

রাতের আকাশে তারারা দল বেধে ছোটাছুটি করছে। যেনো নিকষ কালো আঁধার আকাশে তাদের মেলা বসেছে। বাড়ি থাকতে এমন তারাভরা রাতের আকাশ সুহাকে নিয়ে প্রায়ই উপভোগ করা হতো। তবে আজ পাশে নেই সুহা। একাকী বসে তারার দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা কামড়ে ধরছে কেউ৷ কী করছে সুহা? ছোটমা খোকনের মতোই আদর করে কি সুহাকে? হয়তো না। তবে যে কথা দিয়েছিল ছোটমা!
-“কী করছো একা বসে বসে?”
মেসবাহর গলার স্বরে ঘোর কাটলো উল্লাসীর৷ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মেসবাহকে বসার জায়গা করে দিতেই বাধা দিল সে। নরম গলায় বললো,
-“তুমি বসো.. আমি আরেকটা চেয়ার আনছি ভেতর থেকে।”
তবুও বসলো না উল্লাসী। ঠাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো মেসবাহর জন্য। লোকটি মাঝেমাঝে খুব বকে তাকে, আবার মাঝেমাঝে খুবই ভালোবাসে। যেমনটা তার মা বেঁচে থাকতে তার মাকে ভালোবাসতো তার বাবা…
ব্যালকনিতে চেয়ার এনে তাতে বসলো মেসবাহ। তারপর উল্লাসীর দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,
-“বসে পড়ো.. এত সম্মান দেখাতে হবে না।”
দু’কদম এগিয়ে চেয়ারে বসলো উল্লাসী। তারপর উদাস গলায় বললো,
-“বাবা মাকে যতটা ভালোবাসতো আপনিও কি আমায় ততোটাই ভালোবাসেন?”
বুকের ভেতরটা টিপটিপ করে উঠলো মেসবাহর। বাতাসে সজোরে একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাঙ্গা গলায় সে বললো,
-“ভালোবাসার মানে বোঝো?”
-“উহু.. তবে এটুকু জানি বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীকে দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসতে হয়।”
-“কে বলেছে এসব?”
-“ছোটমা বলেছে। আপনাদের বাড়িতে আসার পর অর্পা আপাও বলেছে।”
-“আর কী বলেছে?”
-“ছোটমা না অর্পা আপা?”
-“বড় আপা..”
-“উনি তো অনেক কথাই বলেছেন। এই যেমন আপনার সামনে সবসময় সেজেগুজে থাকতে বলেছে, আপনার সামনে শাড়ি আঁচল ঠিকঠাক ভাবে নিতে নিষেধ করেছেন। এমন ভাবে নিতে বলেছেন যাতে কোমর এবং বুক দুই-ই দেখা যায়।”
হালকা কেশে উঠলো মেসবাহ। প্রসঙ্গ পালটাতে বললো,
-“তুমি আজ মুন্নি ভাবিকে উলোটপালোট কিছু বলো নি তো? ভাবি আজ আমায় কিছু একটা বলতে চাইছিল।”
-“উহু.. তেমন কোনো কথাই আমি বলিনি। তাছাড়া উনি কালকের মতো তেমন কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। করলে আবারও জানিনা জানিনা বলে কাটিয়ে দিতাম।”
মৃদু হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মেসবাহ। বললো,
-“চলো, শুয়ে পড়ি। রাত অনেক হয়েছে।”
-“আরেকটু থাকি?”
-“না.. চলো চলো।”
একরকম জোর করেই উল্লাসীকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে এল মেসবাহ। তারপর উল্লাসীকে বিছানা গোছাতে বলে সে এগুলো ওয়াশরুমের দিকে। বড় আপা বাচ্চা এক মেয়েকে এসব অশ্লীলতা কিভাবে শেখায় তা মোটেও মাথায় আসছে না তার।

-“আম্মা, চৈতালি কী আজ এসেছিল?”
-“না, আসে নাই। শোন, তোর আব্বা তোরে বলতে বলছে…”
মোরশেদা বেগমের কথা উপেক্ষা করে দ্রুত তার ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো অনা। পা বাড়ালো চৈতালির বাড়ির উদ্দেশ্যে। কাল রাতে ভেবেছে সে। চৈতালির সঙ্গে তার করা ব্যবহার নিয়ে অনেক ভেবেছে। ছবি পুড়িয়ে একজনকে নিজের পাশ থেকে সরিয়ে ফেললেই নিজের জীবন থেকে তার উপস্থিতি মুছে ফেলা যায় না। তাছাড়া কেনোই বা চৈতালিকে নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলবে সে? মুবিন ভাই এবং তার সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু জানায়নি বলে? তাহলে নিজের একাজের বাচ্চামো ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নাম খুঁজে পাচ্ছে না সে। হয়তো এখানে চৈতালির কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে যেমনটা তাকেও জুড়ে দিয়েছে এমাদ। যার কারণে মন সারাক্ষণ আনচান করলেও কিচ্ছুটি মুখ ফুটে বলতে পারছেনা সে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ চৈতালিকে। হয়তো তার ক্ষেত্রেও মুবিন ভাই নিষেধ করেছে, বোনের সামনে অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে বলে! তবে সে অপেক্ষা করবে। নিজে থেকে চৈতালি যেদিন মুখ ফুটে সবকিছু জানাবে তাকে সেদিনই নিজের বন্ধুত্বের এই রাজত্বে চৈতালিকে জয়ী করে তার হাতে তুলে দেবে একটি উপহার। এবং যেটিই হবে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পায়ের গতি বাড়ালো অনা। কাঠফাটা রোদের মাঝে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে হেঁটে ঘামে পুরো শরীর ভিজে উঠেছে তার। সূর্যর প্রখর তাপে খানিকক্ষণ পরপর শরীর জ্বলে জ্বলে উঠছে।

সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ। আকাশে প্রচুর মেঘও ধরেছে। মুশলধারে বৃষ্টি হবে হয়তো। চিন্তা হচ্ছে উল্লাসীর জন্য। কিন্তু উপায়ও নেই। সন্ধ্যার আগে না হোক তার খানিক পরেই বাড়ি তাকে ফিরতেই হবে। টানা তিনজন রোগীকে সময় নিয়ে দেখলো মেসবাহ। স্নায়বিক সমস্যা বাংলাদেশে খুব প্রচলিত সমস্যাগুলোর মধ্যে না হলেও এতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এবং সপ্তাহের পাঁচদিনেই রোগী দিয়ে ভর্তি থাকে সিরিয়ালের খাতা। লম্বা কিছু দম ছেড়ে রায়হানকে ডাকলো মেসবাহ। ক্লান্ত গলায় বললো,
-“বাইরে আরও কতজন আছে?”
-“আছে স্যার বেশ কিছু।”
-“আমার শরীরটা আজ ভালো লাগছে না। আজ আর পেশেন্ট দেখবো না। উনাদের নিষেধ করে দাও।”
-“স্যার, বেশি খারাপ লাগতেছে কী?”
-“না, তুমি গিয়ে একটা রিকশা ডাকো। আমি আসছি।”
রায়হান বেরিয়ে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। হাত ঘড়িতে সময় দেখে উঠে পড়লো চেয়ার ছেড়ে। ডাক্তারী পেশায় নতুন এলেও চারিদিকে যেভাবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে তাতে সামনে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তার। তবে এভাবে উল্লাসীর জন্য কাজে গাফলতি দিলে সেই সুনাম দুর্নামে পরিবর্তন হতেও সময় লাগবে না। কিন্তু এপরিস্থিতিতে ঠিক কী করনীয় তার? দিনটুকো সমস্যা না হলেও সন্ধ্যার পর থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত উল্লাসীকে কারো কাছে রেখে আসতে পারলে সবচেয়ে ভালো হত। তবে কার কাছেই বা রেখে আসবে? তাছাড়া প্রতিদিন এভাবে অন্যের বাড়িতে রাখা তারাই বা কিভাবে নেবে! উদ্বিগ্ন মনে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে গেইটের দিকে এগুতেই তার নজরে এল দল বেধে কয়েকটি মেয়ে পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে ঢুকছে কিছুদূরের আদর্শ নামের এক কোচিং সেন্টারে। সাথেই সাথেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মেসবাহর। লেখাপড়ার ব্যপারে না উল্লাসী কিছু বলেছে তাকে আর না সে নিজে উল্লাসীর কাছে কিছু জানতে চেয়েছে। নানান কিছুর ভীড়ে লেখাপড়ার ব্যপারটি মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল তার। তবে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো মেসবাহ। পা বাড়ালো লিফটের দিকে। বিকেল পাঁচটা থেকে রাত্রি নয়টা.. যতটুকু সময় সে রোগী দেখবে ততটুকু সময় না হোক কোচিং সেন্টারেই সময় কাটাক উল্লাসী। বাদবাকি রইলো স্কুল। তা নয় ধীরেসুস্থে খোঁজ খবর নেয়া যাবে। বছরের মাঝামাঝিতে এসে কোনো স্কুলে উল্লাসীকে ভর্তি করানো যাবে কিনা তা অবশ্য জানা নেই তার।
-“এই মেসবাহ.. আরে এই মেসবাহ।”
কলিংবেল চাপার আগেই পাশ থেকে মুন্নি সরকারের গলার আওয়াজ থামিয়ে দিল মেসবাহকে। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে পাশ ফিরে সে জবাব দিল,
-“জ্বি ভাবি, বলুন।”
-“টায়ার্ড মনে হচ্ছে!”
-“জ্বি, তা তো একটু আকটু।”
-“সমস্যা নেই। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিলেই ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তা কাল যা বলছিলাম!”
বিরক্তর সীমা ছাড়িয়ে গেলেও ভদ্রতার খাতিরে চুপচাপ ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো মেসবাহ। চোখমুখে হাসির রেখা ফোটাতে ব্যর্থ হয়ে সে অস্পষ্ট গলায় বললো,
-“বলুন..”
-“তুমি তো উল্লাসীর ভাই। দুঃসম্পর্ক হও বা কাছের.. ভাই তো ভাই-ই। তো যা বলছিলাম, উল্লাসীর বাবামা যেহেতু তোমার ভরসায় ওকে এখানে পাঠিয়েছে সেহেতু ওর বর্তমান গার্ডিয়ান তুমিই। তাই আরকি তোমার কাছেই বলা! উল্লাসীর সঙ্গে শীতল ভাইয়ের বিয়ের কথা ভাবছিলাম। তোমার কী মত এতে?”
মুন্নি সরকারের কথা ঠিক বোধগম্য হলো না মেসবাহর। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কী বললেন?”
-“আরে আমার ভাই আছে না শীতল? ওর সাথে উল্লাসীকে নিতে চাই আমরা। মেয়েটি দারুণ মিষ্টি। প্রথম দেখাতেই আমার মনে ধরে গিয়েছিল।”
চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো মেসবাহর। হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইলো মুন্নি সরকারের মুখ বরাবর।
-“আমার ভাই মাশাল্লাহ ব্যবসাপাতি ভালোই করে। তোমার ভাই চাকরি নিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আমার ভাই কোনোভাবে তা কানেই নেয় না। আসলে ও আমাদের এলাকায় সফল এক ব্যবসায়ী তো। তাই ব্যবসা ছাড়তে চায় না। আমি বলি চাকরি, ব্যবসা দুইটাই তুমি করো। তুমি তো আবার মাল্টিট্যালেন্টেড.. ঠিক বলেছি না?”
ওপাশ থেকে মেসবাহর জবাব না পেয়ে কপাল কুঁচকে গেল মুন্নি সরকারের। গলা উঁচিয়ে সে ডেকে উঠলো মেসবাহকে।
-“কী হলো? বললে না তোমার মত কী এতে?”
বিস্ময় যেনো কাটছেই না মেসবাহর। মহিলার মাথায় এমন কিছু খেলবে তা মনের ভুলেও কখনো মাথায় আসেনি তার। মহিলা তো মহিলা নয়.. আস্ত গরুর গবর। উভয়ের কাজই মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা। নিজেকে কোনোরকম সামলে নিল মেসবাহ। জোর গলায় বললো,
-“অসম্ভব!”
-“অসম্ভব কেনো?”
একদন্ড ভেবে মেসবাহ বললো,
-“অসম্ভব কারণ, উল্লাসী ছোট। ওর বিয়ের মতো বয়স হয়নি।”
-“খুব হয়েছে। যে মেয়ের পিরিয়ড শুরু হয়েছে, সে মেয়ের বিয়ের বয়সও….”
কথা শেষ করার আগেই জিহবা কামড়ে নিজেকে সামলে নিল মুন্নি সরকার। কথার মোড় ঘোরাতে দ্রুত বলে উঠলো,
-“ভাই হিসেবে তুমি চাওনা তোমার বোনের ভালো জায়গায় বিয়ে হোক?”
চোখমুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে মেসবাহ জবাব দিল,
-“উল্লাসী ছোট৷ আপনি দয়া করে আর এসব কথা তুলবেন না।”
-“কেনো? সমস্যা কোথায়? আজ বিয়ে দাও বা দশ বছর পর, আমার ভাইয়ের চেয়ে যোগ্য ছেলে কখনোই পাবে না।”
-“আশ্চর্য! আপনি এক কথা বারবার কেনো বলছেন?”
-“তুমি শুধুশুধু ক্ষেপছো কেনো? যাকগে! তুমি দুঃসম্পর্কের ভাই, দূরেই থাকো। দেখি ওর বাবা মা কারো ফোন নাম্বার দাও। বা যোগাযোগ করার কোনো ওয়ে বলো। উনারা নিশ্চয় অমত করবে না! মেয়েকে অন্যের বাসায় ঝিগিরি না করিয়ে বিয়ে দেয়াটাই কি বেটার অপশন না?”
-“বললাম তো বিয়ে দিব না। আপনি প্লিজ যানতো।”
ক্ষুব্ধ গলায় কথাগুলো একদমে বলেই পকেট থেকে চাবি বের করে সদর দরজা খুললো মেসবাহ। তারপর দ্রুত পদে ভেতরে ঢুকেই মুন্নি সরকারের মুখের উপর বন্ধ করে দিল দরজা।

-“আপনি আজ এত দেরিতে এসেছেন কেনো? আমি যে একা ভয় পাই তা আপনি জানেন না?”
-“একা কোথায় থাকো তুমি? আমি যাবার পরপরই যে ওই ভুটকি মহিলাকে বাসায় ডেকে আনো, তা আমি বুঝি না মনে করেছো?”
-“ভুটকি মহিলা কে?”
-“এখন তো চিনবাই না! অথচ সারাদিন তার সাথে ঘুরঘুর করো। ইচ্ছে করেই নিজেকে তার সামনে এভাবে প্রেজেন্ট করো যাতে উনি…”
দাঁতে দাঁত চেপে হাত থেকে ব্রিফকেস বিছানায় ছুড়ে ফেললো মেসবাহ। তারপর ক্রুদ্ধ গলায় আবারও বললো,
-“বাচ্চা একটি মেয়ে.. যে না আমার হাটুর সমান বয়স! তার আবার একটা বিয়ে করে হয় না। আরো বিয়ে করার শখ জাগছে মনে.. না?”
হতবাক চোখে মেসবাহর দিকে তাকিয়ে রইলো উল্লাসী। ভুটকি মহিলা, হাটুর সমান বয়স, বিয়ে.. এর কোনোটির অর্থই বুঝে উঠতে পারছে না সে। তবে এটুকু বুঝতে পারছে বকাবকি শোনার সময় ঘনিয়ে এসেছে তার।
-“ছ্যাঁচড়া মহিলা, ভুড়িওয়ালা মহিলা, চামার মহিলা, জল্লাদ মহিলা, রাক্ষস মহিলা… আমার বউয়ের বিয়ে ঠিক করে! কেন রে? আমার বউকে আমি খাওয়াতে পড়াতে পারবো না যে অন্য ব্যাটার সাথে তার বিয়ে দেব আমি? বলো, পারবো না?”
ঢোক গিলে উল্লাসী জবাব দিল,
-“হু.. পারবেন?”
-“তাহলে জ্বলে কেনো ওই ভুটকির? আবার যদি দেখছি তুমি ওই মহিলার সাথে মেলামেশা করছো, তাহলে তোমাকে পুরো একরাত এই বাসায় একা রেখে আমি হসপিটালে গিয়ে থাকবো। তারপর সেই রাতে তুমি বুঝবা ভুতগীরি কী আর কত প্রকার!”
বলেই হন্যে পায়ে পাশের ঘরের দিকে এগুলো মেসবাহ। না মুন্নি সরকার না উল্লাসী, কারোর উপর রাগ হচ্ছে না তার। রাগ হচ্ছে নিজের উপর। সে মানুক আর নাই মানুক, উল্লাসী তার স্ত্রী। এবং তীক্ত হলেও এটি সত্য। তাহলে কেনো বেশি বুঝে উল্লাসীকে দুঃসম্পর্কের বোন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে তার?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here