অতিথি
পর্ব:১৪
লেখা: মিশু মনি
.
মিশু আত্মহত্যা করেছে।
মিশুর মা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।সকলে কাঁদছে।
মর্ম মিশুর লেখা চিঠি টা নিয়ে পড়ে আছে।মিশু লিখেছে,”মর্ম,আমি জানিনা তুমি আমাকে খারাপ ভাবছ কেন? বিশ্বাস করো আমি কারও সাথে প্রেমালাপ করিনি।খুব সহজ ভাবেই কথা বলেছি।ভাবিনি তুমি কষ্ট পাবে।আমি তোমার অপমানজনক কথা গুলা সহ্য করতে পারছি না।চলে গেলাম।”
মর্ম চিঠি পড়তে পড়তে ডুকরে কেঁদে উঠল। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
এমন সময় ঘুম ভেঙে গেল মর্ম’র। ও বিছানায় উঠে বসল।তারমানে এটা দুঃস্বপ্ন ছিল।কিন্তু এরকম স্বপ্ন কেন দেখলাম?
মর্ম চোখ মুছল।স্বপ্নেই খুব কেঁদেছে ও।সামান্য একটা স্বপ্ন দেখে চোখ ভিজে গেছে।তাহলে মিশু নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে।
বিছানায় বসে ভাবছে মর্ম- মিশু তো তেমন কোনো অপরাধ করেনি।ও সহজ সরল মনে না হয় কিছু ছেলের সাথে কথাই বলেছে।তাতে কি এমন হয়ে গেল? আমি নিজেই তো অনেক মেয়ের সাথে চ্যাট করি। অযথা মিশুকে অপমান করলাম।খুব কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।
একে একে রাতের সব কথা মনে পড়ে গেল মর্ম’র।খুব উত্তেজিত হয়ে মিশুকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করা হয়েছে।ভাবতে ভাবতে মর্ম’র মনে অপরাধবোধ জেগে উঠল। হয়ত এমন হত না,কিন্তু এই দুঃস্বপ্ন টা দেখেই মিশুর প্রতি এক ধরনের মায়া কাজ করছে।যা কালকে অব্দি ছিল না।অবচেতন মনের একটা স্বপ্ন ই মিশুর জন্য অনেক ভালোবাসার জন্ম দিয়ে দিলো।মিশুর কিছু হলে সত্যিই খুব খারাপ লাগবে।
বারবার স্বপ্ন টার কথা মনে পড়তে লাগল।বাধ্য হয়ে মর্ম উঠে পড়ল। এইমুহুর্তে মিশুর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।নয়ত মনে অশান্তি কাজ করছে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাড়ে তিন টা বাজে।যত রাত ই হোক,মিশুকে ঘুম থেকে তুলে মাফ চাইতে হবে।কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
ভাবতে ভাবতে মর্ম মিশুর ঘরের দিকে ছুটল।
.
মিশুর রুমের দরজা খোলা দেখে মর্ম অনেক অবাক হয়ে গেলো।দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই বুকের ভিতরে বড় একটা ধাক্কা এসে লাগল।
মিশু কেমন অচেতন অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে।মেঝেতে বমি করেছে,মিশুর মোবাইল টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে।মর্ম বিছানার কাছে এসে থমকে দাড়ালো।মিশুর ভেজা চুল এলোমেলো হয়ে আছে,চোখের কোনে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
মিশুকে দেখে খুব মায়া লাগল মর্ম’র।মেয়েটাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছে।
কৌতুহল বশত কপালে হাত দিয়ে দেখল ভয়ানক জ্বর। মর্ম’র মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল।সবকিছুই কেমন যেন হয়ে গেছে।মিশু স্বাভাবিক নেই।
মর্ম কি করবে বুঝতে না পেরে ওর মাকে ডেকে নিয়ে আসলো। মা মিশুকে দেখে কেঁদে ফেললেন। কেউ মেয়েটার খেয়াল রাখেনি।এই অবস্থায় পড়ে আছে মেয়েটা।
মা মিশুর মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করলেন। ততক্ষণে বাড়ির সবাই জেগে গেছে।সকলেই মিশুর রুমে এসে দাড়িয়ে আছে।কেমন যেন একটা সহানুভূতিতে মন ছেয়ে গেছে সবার।
মা মিশুর মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে মর্মকে জিজ্ঞেস করলেন,ওর এই অবস্থা কখন থেকে?
– জানিনা আম্মু।
– এতরাতে তুই ওর ঘরে কেন?
মর্ম বিব্রত হয়ে বলল,মিশুকে রাতে বকেছিলাম।একটু আগে স্বপ্নে দেখলাম মিশু মারা গেছে..
মা রাগ হয়ে বললেন, কি সব বাজে কথা বলছিস।দুয়া কর যাতে তাড়াতাড়ি মেয়েটা ভালো হয়ে যায়।ও অসুস্থ শুনলে ওর আব্বু আম্মু ভেঙে পড়বে।
মর্ম বলল,স্বপ্ন টা দেখে আমার খারাপ লাগছিল।তাই ভাবলাম মিশুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই।সেজন্যই এসেছিলাম। এসে দেখি এই অবস্থা।
– এসেই ভালো করেছিস।কিন্তু কি এমন বলেছিলি যে ক্ষমা চাইতে হবে?
মর্ম মিশুর দিকে তাকিয়ে আছে।মেয়েটাকে দেখে মায়া লাগছে।
মর্ম’র মা বললেন, ওর মোবাইল ভেঙেছে কে?
– মিশু নিজেই হয়ত। আমি এটা জানিনা।
– ওর আব্বুকে কল দাও একজন।
.
মৈত্রীর বাবা মিশুর বাসায় কল দিয়ে মিশুর অসুস্থতার কথা জানালেন।দুজনেই চিন্তায় পড়ে গেলেন।
.
বাকি রাত টা কেউই আর ঘুমায় নি।সকালবেলা ডাক্তার এসে প্রেসক্রিপশন করে দিলেন।
ওষুধ খাবার পর মিশুর জ্বর আশ্চর্যজনক ভাবে কমে গেলো।
মাত্রার বাবা অবাক হয়ে মিশুকে জিজ্ঞেস করলেন,এখন কেমন লাগছে?
মিশু বলল,ভালো। এত চিন্তা করতে হবেনা।আমার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি।ওষুধ খেলেই কাজ হয়ে যায়।দুই ডোজ খেলেই সুস্থ হয়ে যাবো দেখবেন।
– হুম।দুয়া করি মা,সুস্থ হও।এখন বলোতো মোবাইল ভেঙেছ কেন?
মিশুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। আবারো রাতের কথা গুলা মনে পড়ে যাচ্ছে।
আংকেল বুঝতে পেরে উঠে বাইরে আসলেন।
মর্মকে ডেকে বললেন, তুমি মিশুকে কি বলছ?
মর্ম মাথা নিচু করে রইলো। বাবা রেগে বললেন, মেয়েটা আব্বু আম্মুকে ছেড়ে এখানে এসে আছে।আর তোমরা ওর সাথে খারাপ আচরণ করো? ওর মত মেয়ে হয়? কত বিশুদ্ধ একটা মন মেয়েটার।
মর্ম নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হচ্ছে।বাবার কথা শুনে আরও খারাপ লাগছে।
বাবা বললেন,মিশুর আব্বু বলেছে ওকে নিয়ে একটা লং জার্নিতে গেলেই ও সুস্থ হয়ে উঠবে।তুমি ওকে নিয়ে বেড়াতে যাও।
– মিশুর তো জ্বর।
– মেয়েটা ঘুরতে বড় ভালবাসে।অনেক দূর ঘুরতে নিয়ে যাও।ওর ভালো লাগবে।আসার পর থেকে তো বাসা থেকে বের হয়নি।
মর্ম মনে মনে অনেক খুশি হলো।এটাই সুযোগ, মিশুর রাগ ভাঙাতে হবে,ক্ষমা চাইতে হবে।
মর্ম বলল ঠিক আছে যাচ্ছি।কখন যাবো?
– মিশুকে জিজ্ঞেস করে শুনে নাও ও কখন যেতে চায়।আর মিশু যেখানে যেতে চায়,সেখানেই নিয়ে যেও।গাড়ি নিয়ে যেও কিন্তু।
– আচ্ছা আব্বু।
.
মর্ম’র খুব আনন্দ হচ্ছে।আজ মিশুর সাথে ঘুরতে যেতেই হবে।
মর্ম মিশুর রুমে ঢুকতেই মিশু মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
মর্ম বলল,সরি মিশু।
মিশুর চোখে পানি এসে গেল।
মর্ম ওর বিছানার কাছে বসে বলল,আমার কাল অনেক রাগ হচ্ছিল তাই কিসব বলে ফেলেছি।প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।
মিশু কিছু না বলে চুপ করে আছে।
মর্ম বলল,আমার ভুল হয়ে গেছে বাবা।আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম।
– ভুল বুঝার কিছু নাই।ঠিক ই বলেছ।আমি বোকা,আমি ফালতু, আমি বেয়াদব। আমার একসাথে অনেক গুলা ছেলে লাগে।দুই টা ছেলেকে দিয়ে হয়না।
মর্ম জিহ্বায় কামড় দিলো।এই কথাগুলোই কাল সে মিশুকে বলেছে।খুব ভুল হয়ে গেছে।
মিশু বলল,আমি আসলেই বোকা।আমি মনে করি সবাই আমাকে ভালবাসে।কিন্তু ভুল টা আমার ই,আমি তো বোকা তাই বুঝতে পারিনা কেউ সত্যিকারে আমায় ভালবাসে না।
মর্ম ‘র খারাপ লাগছে।এই কথাগুলো সে কিভাবে মিশুকে বলতে পেরেছে সেটা ভেবেই খারাপ লাগছে।
.
মর্ম বলল,আমার ভুল হয়ে গেছে মিশু।প্লিজ মাফ করে দাও।প্লিজ,
মিশুর হাসি পেল মর্ম’র ক্ষমা চাওয়া দেখে।ও মর্ম’র দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো।
মর্ম’র ভিতর টা কেপে উঠল। মনে হচ্ছে এই হাসিতেই সে মিশুর প্রেমে পড়ে গেছে।
ও মিশুকে বলল,তুমি সত্যিই খুব ভালো মিশু।খুব ভালো একটা মেয়ে।
মিশু বলল,তোমার পাতলা পায়খানা সেরেছে?
– হ্যা।পুরোপুরি সুস্থ আমি।তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ তো?
মিশু হেসে বলল,মিশুর অত ফালতু এটিচিউড নেই।আমি কারও উপর রাগ করতেই পারিনা।
– গুড গার্ল।শোনো, তুমি আর আমি লং জার্নিতে যাবো। কবে যেতে চাও বলো?
মিশু উতফুল্ল হয়ে বলল,আজ ই।এক্ষুনি যাবো।
– তোমার তো জ্বর।
– তবুও যাবো। এক্ষুনি যাবো প্লিজ।
মর্ম’র ভালো লাগল।মিশু এভাবে তাকে ক্ষমা করে দিবে এটা সে কল্পনাও করেনি।
বলল,ওকে।রেডি হয়ে নাও।
– আচ্ছা।তোমার মোবাইল থেকে আম্মুকে একটা কল দাও তো। কথা বলবো।
মর্ম নিজের ফোনটা মিশুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসলো। তার জন্যই মিশু রাগ করে মোবাইল ভেঙে ফেলেছে।নিজের উপর রাগ হচ্ছে মর্ম’র।
.
মিশু সেজেগুজে বসে আছে।মর্ম বাসায় নেই।মিশুকে রেডি হতে বলে কোথায় চলে গেল কে জানে!
মিশু বারবার আয়নায় নিজেকে দেখছে আর অপেক্ষা করছে কখন বেড়াতে যাবে।
.
মর্ম এসে মিশুকে দেখে হাসল।খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে মিশুকে! মেয়েটা যে অসুস্থ,সেটা বোঝাই যাচ্ছে না।
মিশু রেগে বলল,কই ছিলা? কখন থেকে বসে আছি।
– মার্কেটে গেছিলাম।
– কেন!
– তোমার জন্য।
বলেই ব্যাগ টা মিশুর দিকে এগিয়ে দিলো।
দেখেই মিশুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল! মিশু হা করে তাকালো মর্ম’র দিকে।
মর্ম বলল,পছন্দ হয়েছে?
মিশু অবাক হয়ে বলল,এত সুন্দর মোবাইল টা আমার জন্য!
– হ্যা। আমার উপর রেগে তুমি মোবাইল ভেঙেছ।তাই তোমার জন্য এটা নিয়ে আসলাম।
মিশুর চোখে বিস্ময়! এত সুন্দর মোবাইল টা তার জন্য!
মিশুর চোখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে- কত দাম নিলো?
– ১৬ হাজার।
– কি! ১৬ হাজার! এত দামি মোবাইল আমার জন্য! বিশ্বাস ই করতে পারছিনা।
মর্ম মিশুকে একটা চিমটি দিয়ে বলল,বিশ্বাস হচ্ছে এবার?
– হুম।কিন্তু কি দরকার ছিল বলোতো?
মর্ম দুহাতে নিজের কান ধরে বলল,ফরগিভ মি প্লিজ।
মিশু হেসে বলল,হুম।ক্ষমা করেছি।এখন চলো।
.
মর্ম নিজেই গাড়ি চালাবে শুনে মিশুর মজা লাগছে।
মর্ম গাড়ি স্টার্ট করতেই মিশু হাত তালি দিতে লাগল।
মর্ম বলল,কোথায় যেতে চাও ম্যাম?
– গাজীপুর।
– কেন? অন্যকোথাও যাই?
– উহু।আমি নুহাশ পল্লীতে যাবো।
– আচ্ছা।
.
মর্ম খুব জোড়ে গাড়ি চালাচ্ছে।মিশুর জ্বর আরও কমে গেছে।খুব আনন্দ হচ্ছে দুজনের ই।
মিশু বলল,আজ আমার সর্দিও আছে,বমিও আছে।দিবো নাকি শার্ট এ করে?
– এই না না।
– আমি তোমার নানা নই,নানী।
– হা হা।তাই নাকি? তা নানী,রাত্রে বৃস্টিতে ভিজেছিলেন?
– হুম।এক ঘণ্টা ভিজেছি।খুব কষ্ট দিয়েছ আমাকে।
– জানি।সেটা দূর করার চেষ্টা করছি।
– আস্তে গাড়ি চালাও।
মর্ম বলল,তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।ঠিক রাস্তার পাগলীদের মত।
মিশু প্রথমে হাসতে যাচ্ছিল।কিন্তু পরে পাগলীর সাথে তুলনা করাতে হাসি বন্ধ হয়ে গেল।
মিশু বলল,তাহলে আর তাকাবা না আমার দিকে।আমি বেয়াদব মেয়ে।
– আহা! রাগ করোনা মিশু।
– যা সত্যি তাই বললাম।
– ঝগড়া করলে কিন্তু গাড়ি থামাবো মিশু।
মিশু বলল,তাহলে আমার বমি খাওয়াবো তোমায়।
মর্ম গাড়ি থামিয়ে বলল,ওয়াক থু।কিসব পচা কথা।
– হ্যা।কারন আমি ফালতু মেয়ে।গাড়ি থামালে কেন?
– বমি খাওয়ার কথা বললা কেন? ওয়াক,আমার নিজের ই বমি আসছে।
মিশু হঠাত নাক ঝেড়ে মর্ম’র শার্ট এ মুছে দিলো।
মর্ম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,ছিঃ মিশু।এটা কি করলা?
মিশু বলল,গাড়ি চালাও।স্টার্ট…
মর্ম ক্ষেপে আছে।বলল,টিসু দিয়ে সর্দি মুছে দাও।
– বয়েই গেছে।
– মিশু,নিজের সর্দি নিজেই মুছে দাও বলছি।
মিশু মুখ বাকিয়ে বলল,দিবো না।গাড়ি স্টার্ট দাও।
মর্ম রেগে বলল,আমিও দিবো না।মিশু টিসু কোথাকার।
– ওই আমি টিসু?
– হ্যা তুমি টিসু।ফেসিয়াল টিসু নয়,টয়লেট টিসু।
মিশু রেগে বলল,ঝগড়া লাগাবা না বলছি।
মর্ম চুপ করে গেল।কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।
মর্ম আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
মিশুর জয় হলো এবার।মিশু হাসছে আর নতুন মোবাইল বের করে বিভিন্ন স্টাইলে সেলফি তুলতে লাগল।
মর্ম হাসছে।
মিশু বলল,মর্ম দেখি একটু এদিকে আসো, একটা ছবি তুলি।
মর্ম গাড়ি থামিয়ে মিশুকে জাপটে ধরল।আর ওর শার্ট এ লেগে থাকা সর্দি মিশুর গলায় লেগে গেল।
মর্ম দাত কেলিয়ে হাসছে- এইবার ঠিক হইছে।এবার কেমন লাগে?
মিশু মুখ বাকিয়ে টিসু বের করলো।
( চলবে…)