#ধারাবাহিকগল্প
#কলঙ্কের বোঝা
পর্ব-নয়
মাহবুবা বিথী
মিনারা বেগম মেয়ে জামাইয়ের ম্যারেজ ডে উপলক্ষে পোলাও রোস্ট খাসির রেজালা কাবাব বানিয়েছে। সেজান আবার গুড়ের পায়েস খুব পছন্দ করে। সেটাও খুব যত্ন করে মিনারা বেগম বানিয়েছে।
টেবিলে খাবার বেড়ে মেয়েকে মিনারা বেগম ডাকলেন,
—-শায়লা খেতে আয়।
—-আম্মু অসুস্থ শরীরে তোমার এতো ঝামেলা করার কি দরকার ছিলো?
—-ঝামেলা বলছিস কেন?সেজান কতদিন আসে না এইজন্য একটু বেশী করে রান্না করলাম। আমি ভেবেছিলাম ও দু,দিন থাকবে।
—–আমি তো আছি মা। আমি খাব। তোমার হাতের পোলাও রোস্ট আমার সবচেয়ে প্রিয়।
—শায়লা সেজান কি তোকে বলেছে চিটাগাং থেকে ও কবে ফিরবে?দুএকদিনের মধ্যে ফিরলে ডিপে ওর জন্য খাবার রেখে দিবো।
—-না, আম্মু বলেনি। তবে ওর জন্য খাবার রাখার দরকার নেই। যখন আসবে তখন আবার জোহরাকে দিয়ে রান্না করিয়ে নিবে।
মা মেয়ে দুজনে ডিনার শেষ করলো। শায়লা ওর মাকে বলে রুমে চলে আসলো। আদৌ সেজান কবে আসবে শায়লা নিজেই জানে না। শায়লার কেন জানি খুব কান্না পাচ্ছে। এক বছরের মধ্যে সেজানের ভালবাসাটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। প্রথম ম্যারেজ ডে। সেজান কি করে ভুলে গেলো? বুকের কিনারে অনেক অভিমান নিয়ে একসময় শায়লা ঘুমিয়ে পড়লো।
হঠাৎ মাঝরাতে প্রচন্ড ঝড় শুরু হলো। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে শায়লার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তারপর জোরে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। জানালাগুলো সব লাগিয়ে দিলো। বৃষ্টির ছাঁট আসছে। মনে হয় আশ্বিনী ঝড়। ওর বুকের গহীনেও কিসের যেন ঝড় বইছে। এখন অক্টোবর মাস। এর পরেই হয়ত একটু ঠান্ডা পরবে। কদিন এতো গরম পড়েছিলো। বৃষ্টি হওয়া খুব দরকার ছিলো। শায়লা আবার মোবাইলটা খুলে দেখলো। না,সেজান কোন মেসেজ পাঠাইনি। হৃদয়ের ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়লো। শায়লা মায়ের ঘরে এসে দেখলো,ওর মা ঘুমের মধ্যে কাঁপছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখলো প্রচন্ড জ্বর আসছে। শায়লা আলমারী থেকে কাঁথা বের করে মিনারা বেগমের গায়ে দিয়ে দিলো। জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। জানালার গ্লাসগুলো লাগিয়ে দিলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত তিনটা বাজে। মাকে ডেকে একটা নাপা ট্যাবলেট খাইয়ে দিলো।
বাকী রাতটা জেগেই কাটিয়ে দিলো। ফজরের আযান দিচ্ছে। ওজু করে নামাজ পড়ে নিলো। সকাল হওয়ার পর অফিসে মায়ের অসুস্থতার কথা জানিয়ে দুদিন ছুটি নিলো। তারপর নিজে নাস্তা করে মাকে জোর করে একটু খাইয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। মা যেন খুব দ্রুত নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। আজকে আট বছর ধরে ওর মা এই মারণ রোগের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। এতো কেমো এতো ঔষধ শরীর যেন আর নিতে পারছে না।
এরপর মাকে নিয়ে শায়লার কঠিন লড়াই শুরু হলো। এর মাঝে সেজানকে ওর মায়ের অসুস্থতা জানিয়ে মেসেজ দিয়েছিলো। সেজান অফিসের কাজের বাহানায় হাসপাতালে আসেনি। তবে শায়লা একটুও অবাক হয়নি। এই পৃথিবীতে আল্লাহপাকের সৃষ্টিজগতের সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সবচেয়ে বেশী রং পাল্টায়। একটা মুখোশের আবরনে মানুষ নিজেদের ঢেকে রাখে। বাইরের অবয়বের সাথে ভিতরের অবয়বের অনেক তফাৎ থেকে যায়। মাঝে মাঝে সেজানের সাথে ফোনে কথা হয়। দায়সারা ভাবে কিছু কথা বলে সেজান ফোন রেখে দেয়। শায়লা বুঝে উঠতে পারে না সেজান কেন এমন করছে। ওতো জানেই শায়লার মার শায়লা ছাড়া আর দেখার কেউ নেই। এটা জেনেই তো সেজান ওকে বিয়ে করেছে।
ওর মা একটু সুস্থ হলে বাড়িতে নিয়ে আসে। মিনারা বেগম সেজানকে দেখতে চায়। শায়লা নানারকম বাহানা দিয়ে মাকে বুঝ দেয়। এর মাঝে সেজানের বাবাও স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হয়। উনি এখন আইসিইউ তে ভর্তি আছেন। শায়লাকে ওর শ্বশুর খুব ভালবাসতো। ওনার অসুস্থতার খবর পেয়ে হাসপাতালে দেখতে যায়। শায়লা হাসপাতালে পৌছে সেজানকে জিজ্ঞাসা করে,
—- সেজান বাবা এখন কেমন আছেন?
—-তেমন ভালো না। শায়লা ফোনেই তো খোঁজ নিতে পারতে। রুগী ফেলে কষ্ট করে হাসপাতালে আসার দরকার ছিলো না।
সেজানের কথা শুনে শায়লার মনে হলো,ও হাসপাতালে এসে যেন অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছে।
—না, আমার কোনো কষ্ট হয়নি। মা এখন কিছুটা সুস্থ। মাকে বাসায় রেখে অফিস শুরু করেছি।
তারপর শাশুড়ীকে বললো,
—-মা আপনার শরীর কেমন?
উনি কোন উত্তর দিলেন না। মায়ের হয়ে মেয়ে রিমি বললো,
—-ভাবি মার শরীর মন দুই খারাপ। তুমি মায়ের সাথে এখন কথা বলো না।
রিমির হাসব্যান্ড রায়হান বললো,
—-ভাবি বাড্ডায় কবে আসছেন?দেখেন না এদিকে আবার শ্বশুর আব্বা অসুস্থ হলেন। শাশুড়ী মা একা সবদিক সামলাতে পারছেন না।
—-ভাই এখনও বলতে পারছি না। আমারও মা পুরোপুরি সুস্থ হননি। আমি ছাড়া আমার মাকেও দেখার কেউ নেই। এক কাজ করুন রিমিকে কিছুদিনের জন্য মার কাছে পাঠিয়ে দিন। আপনি কিছুদিন আপনার সংসারটা একাই সামলে নিন।
শাশুড়ী ননদের শায়লার কথাটা পছন্দ হয়নি।
শায়লা এটা বেশ বুঝতে পারছে। একমাস ধরে ও কল্যাণপুরে আছে। বাড়ির সব কাজ এখন ওর শাশুড়ীকে করতে হচ্ছে। শাশুড়ী একটু ঝাঁঝ নিয়ে বললেন,
—–আমার সংসার নিয়ে কাউকে মাথা ঘামাতে হবে না।
শায়লা জানে, রিমি বাসায় থাকলেও ওর মাকে খুব একটা সাহায্য করে না। এজন্য অবশ্য শাশুড়ী অনেকটা দায়ী। নিজের মেয়েকে দিয়ে কাজ করাতে কষ্ট হয়। পরের মেয়ের বেলায় কোন সমস্যা নাই। বরং কাজ করতে না পারলে পরের মেয়ে অনেক দোষে দোষী হয়।
শায়লা মনে মনে একটু আহত হলো। সেজান যেন এ কয়দিনে অনেক পাল্টে গিয়েছে।
ওখানে ওর শাশুড়ি ননদ কেউ ওর সাথে তেমন একটা কথা বলেনি। সেজানও বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। নিজেকে শায়লার অনাহুতের মতো লাগলো। তারপরও কিছুটা সময় হাসপাতালে ওদের সাথে কাটিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলো। আসার সময় শাশুড়ীকে বললো,
—-মা,আমি তাহলে যাই।
খুব বিষন্ন মনে শায়লা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসলো।
সেজানও ওকে উবারে তুলে দিতে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসলো। শায়লা সেজানকে বললো,
—-তোমার সময় হলে মাকে একবার দেখে এসো। মা তোমাকে দেখতে চেয়েছেন।
সেজান হ্যা,না কিছু বললো না।
সেজান শায়লাকে উবারে উঠিয়ে দিয়ে কেবিনে ফিরে আসলো।
রিমির বর রায়হান সেজানকে বললো,
—-ভাইয়া আপনার এখন ও বাড়িতে না যাওয়াই উচিত। কারণ ভাবি এতোদিন পরে হাসপাতালে এসে সবার খোঁজখবর নিলো। আমার ব্যাপারটা ভালো লাগেনি। হয়ত টাকার দরকার আছে। উনার মায়ের চিকিৎসা খরচ অনেক। এটা সামাল দেওয়া খুব কঠিন। এদিকে আবার বাবাও অসুস্থ। আপনার এখানেও অনেক খরচ আছে।
সেজান বললো,
—-শায়লা আজ অবধি ওর মায়ের চিকিৎসা বাবদ আমার কাছে কোনো টাকা নেয়নি। ও নিজেই সবটা সামলিয়েছে।
সেজান এখন বুঝতে পারছে জীবনে যত সহজে মেনে নেওয়া বলা যায় কিন্তু জীবনের পরতে পরতে সবার সাথে মানিয়ে চলতে আসলেই অনেক লড়াই করতে হয়। তারউপর কেউ ওকে বুঝতে চায় না। না মা ওকে বুঝতে চায় না শায়লা বুঝতে পারে। শায়লারও কিছু করার নেই এই মূহুর্তে এটাও সেজান জানে। মাঝে মাঝে জীবনের সময়গুলো কেমন হয়ে যায়। কারো যেন কিছুই করার থাকে না।
সেজানের মা বললো,
—-নেয়নি,নিতে কতক্ষণ। জামাই ঠিক বলেছে। তোমার এখন ওবাড়িতে বুঝে শুনে যাওয়া উচিত।
শায়লা বাসায় ফিরে আসার পর ওর মা ওকে বললো,
—-সেজান আসলো না?
শায়লা একটু রেগে গিয়ে মাকে বললো
—-আচ্ছা মা,সেজানের কি তোমার এখানে আসা ছাড়া আর কোনো কাজ কর্ম নেই। ওর বাবাও তো আইসিইউতে ভর্তি। ওরও তো অনেক ব্যস্ততা। একদিকে অফিস সামলান আবার হাসপাতালে ডিউটি করতে হচ্ছে।
—–ওর বাবা যে এতো অসুস্থ তুই তো আমাকে আগে জানাসনি।
—-তোমার নিজেরতো শরীর ভাল না। আর একজনের খবর শুনে শরীরটা আরও খারাপ করে লাভ কি?
শায়লার সেজানের উপর অনেক অভিমান জমা থাকলেও মায়ের সামনে পুরোটাই আড়াল করে রাখলো। ওর মা যদি জানতে পারে ওর সম্পর্কের টানাপোড়েনের কথা মা অসুস্থ হয়ে যাবে। মাকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে যাবে। যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে ওর মাকে চাই। মা ছাড়া ও এই পৃথিবীতে কিভাবে বাঁচবে?আর সেজানের উপর অভিমান হবে নাই বা কেন ও আজও ওর মাকে বুঝাতে পারলো না। বুঝানোর দায়িত্ব ওর। অথচ ওর মা উল্টাপাল্টা যাই বলুক ও কখনও প্রতিবাদ করে না। কেন যে করে না এটাও শায়লা বুঝে উঠতে পারে না।
চলবে