#বিপরীতে_হিত
#পর্ব-১১
“এই আদি!”
সুমনার মিষ্টি কন্ঠ শুনে আদি ঘুরে তাকালো। ওফ্ফ! মাথা নষ্ট ম্যান! ওকে এতো সুন্দর লাগছে কেন আজ? আদির আবার ঘোর আসার আগেই আদি মাথা ঝাঁকালো। সে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো, আজ পুব দিকেই উঠেছে তো! নাহ, সূর্য তো ঠিকই তার জায়গায় আছে? তবে এই শয়তান মেয়ে কেন ওকে ডাকছে? সেদিনের তেলাপোকা আর টিকটিকি থেরাপিতে কি ভয় পেয়েছে নাকি? আর আজ এতো সুন্দর করে সেজেই বা এসেছে কেন? ওর আবার কোনো খারাপ মতলব নেই তো?
“এই আদি! কি ভাবছিস এতো? তুই তো দেখি ভাবতে ভাবতে বুড়ো হয়ে যাবি? চুল দাঁড়ি সব পাকিয়ে ফেললি তো?”
“হ্যা। না কি আর চিন্তা! তুই বল হঠাৎ আমায় ডাকলি যে?”
সুমনা আদির দিকে তাকিয়ে দু’তিন বার চোখ পিটপিট করে মুখ বেঁকিয়ে ওর দিকে এগিয়ে এলো-
“তুই না খুব সুইট একটা ছেলে, আমি শুধু শুধু তোর সাথে ঝগড়াঝাটি করছি। কতদিন পরে তোর সাথে দেখা হলো, কোথায় তোর সাথে বসে পুরনো স্মৃতি ঝালাই করবো! তা না করে কেবল ঝগড়া করে যাচ্ছি।”
“এএএহহহহ! হ্যা মানে আমিও তো তোকে তাই বোঝাতে চাচ্ছি সেই কবে থেকে। তুই ই তো কিছু বুঝতে চাইছিস না?”
মুখে এসব বললেও মনে মনে আদি প্রমোদ গুনলো। ও কি সুমনার ফাঁদে পা দিচ্ছে নাকি? সুমনা এগিয়ে এসে আদির আরো একটু কাছে দাঁড়ালো-
“চল না আজ মাঠে বসে গল্প করি। তোর তো ক্লাস শেষ তাই না?”
একের পর এক চমক যেন আদিকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। আদি দিশেহারা বোধ করছে। সত্যি সত্যি কি সুমনা তাকে একসাথে বসে গল্প করার প্রস্তাব দিচ্ছে? যে মেয়ে একটু কথা বলতে চাইলে ভাব দেখায় সে কিনা নিজে সেধে গল্প করার অফার দিচ্ছে? আদির বিশ্বাস হতে চাইছে না। সে হা হয়ে সুমনার দিকে তাকাতেই সুমনা ওকে জোরে একটা চিমটি কাটলো, আর আদি ‘আহ’ শব্দ করে দূরে হটে গেলো।
“সরি! তোর বিশ্বাস হচ্ছিল না তাই চিমটি দিলাম। আমিই বলছিরে বাবা, বিশ্বাস না হওয়ার কি আছে? চল না কোথাও বসি?”
“উহু, তোর সাথে আমাকে দেখলে মামুন রাগ করবে। আমি আর ওকে রাগাতে চাই না। আমি বরং যাই।”
সুমনা দৌড়ে এসে আদির হাত ধরলো-
“কিচ্ছু বলবে না, চল তো? আর তাছাড়া মামুনকে পাচ্ছিস কোথায়? তার আজ বিশেষ কাজ আছে, সে গেছে ধানমন্ডি। আয় আমার সাথে। ”
আদি আবার চমকিত হলো। মামুনের আজ কাজ আছে এটা এই মেয়ে কিভাবে জানলো? ওর কাজেই কি মামুনকে বিজি রাখছে নাকি? বেশিক্ষণ এই ভাবনা ভাবতে পারলো না আদি। তার আগেই সুমনা ওকে টানতে শুরু করলো। আদি কিছুতেই সুমনার হাতের বাঁধন খুলে চলে আসতে পারলো না। কোথায় ভেবেছিলো মেয়ে মানুষের হাত হবে নরম, কাঁদার মতো তা না কি শক্ত হাত রে বাবা! মনেহচ্ছে লোহা পিটানো হাত। আদি বলেই ফেললো-
“তোর হাত এতো শক্ত কেন রে? মেয়েদের হাত এতো শক্ত হয় জানা ছিলো না!”
“তুই তো কিছুই জানিস না! এই হাত শক্তও করতে পারি আবার নরমও, বুঝলি?”
“হুম।”
দু’জনে এসে মাঠে এসে দাঁড়ালো। আশেপাশে একটু দূরে দূরে ছেলেমেয়েরা ঝটলা পাকিয়ে বসে আছে। আদি অনেক কষ্টে সুমনার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে মাটিতে লেঠা মেরে বসলো।
“এবার বল, এতো আদর সোহাগ করে ডেকে আনলি কেন?”
“তুই খুব খারাপ আদি, খুব খারাপ! সবাইকে নিজের মতো ভাবিস কেন? আমি তো বলছি যে তোর সাথে গল্প করতে চাইছি, ব্যাস। তবুও তোর বিশ্বাস হচ্ছে না কেন?”
কপট অভিমানে ভরা কন্ঠে সুমনা আদিকে জবাব দেয়। আদি মাথা চুলকে ভাবলো সুমনা মনেহয় সত্যি সত্যি আজ গল্পই করতে চাইছে। সে মনে মনে প্রচন্ড খুশি হয়ে গেলো। আচ্ছা তাহলে করি না হয় ওর সাথে একটু গল্প!
“আচ্ছা বল তবে, তুই স্কুল ছাড়লি কেন? এতোটুকু দুষ্টুমিতে কেউ স্কুল ছেড়ে দেয়?”
“ওটা এতটুকু দুষ্টুমি ছিলো? তুই জানিস আমার ন্যাড়া হতে হয়েছিল?”
“সত্যি? আমি কিন্তু এতোকিছু ভেবে করিনি রে। তোর জন্য কিন্তু আমার পা ভেঙে গেছিলো! সেই তুলনায় কিন্তু চুল কাটা বা ন্যাড়া হওয়া কমই!”
“হুম, তুই তো তা বলবিই। তুই তো আর জানিস না, মেয়েদের কাছে চুলটা কতো বড় জিনিস?”
“সরি রে, আমি সত্যি বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা এতো সিরিয়াস হয়ে যাবে। আমি মন থেকে সরি বলছি তোকে। ইনফ্যাক্ট, আমি তোকে এই সরিটা ছয় বছর আগেই বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুইতো একেবারে হারিয়ে গেলি। আবার এখানে দেখা হলো, কিন্তু আমাদের পুরোনো গিটই খুললো না। তোর সাথে আবার প্যাচ লেগে গেলো। আর তুই তো আমার কোনো কথাই শুনতে চাস না। সরি টা বলবো কিভাবে শুনি?”
“আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি তোর সদিচ্ছা। এখন তোর সরি আমি গ্রহন করতে পারি একশর্তে।”
“কি শর্ত বলতো?”
“চোখ বন্ধ কর পাঁচ মিনিটের জন্য তাহলে বলবো। আমার আবার এসব কথা বলতে লজ্জা লাগে। তুই তাকিয়ে থাকলে তো আরোই বলতে পারবো না।”
সুমনা লজ্জা লজ্জা মুখে তাকালো। আদি ভেবে পেলো না সুমনার কি এমন কথা যেটা বলতে ওর লজ্জা লাগবে। আদি আমতা আমতা করে।
“ওহ বুঝেছি,তুই আসলে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিস না। আজ তোর জায়গায় তোর বন্ধু মামুন থাকলে আমার এতো কথা বলাই লাগতো না। আমি বলার সাথে সাথে মামুন চোখ বন্ধ করে ফেলতো।”
“মামুন তো আর ঠিকঠাক জানে না যে তুই কত সেয়ানা?”
মনেমনে বিরবির করে আদি সুমনার কাঁদো কাঁদো কন্ঠ শুনে। মুখে বললো-
“আচ্ছা যা কাঁদিস না। আমি চোখ বন্ধ করছি আর কান খোলা রাখছি, তুই কি বলবি বলে ফেল।”
আদি চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে। সুমনার খুশি আর দেখে কে। ওর তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে, শেষ পর্যন্ত আদিটা ফাঁদে পা দিয়েছে বলে। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করলো- এখন না সুমনা, এখন না। আগে কাজ শেষ কর তারপর আনন্দ কর। নিজেকে ধমক দিলো সুমনা। ব্যাগ থেকে হ্যান্ড গ্লাভস বের করে পড়লো তারপর আঠার কৌটা বের করে পুরো আঠা দু’হাতে ঢেলে নিয়ে আদির মাথায় ম্যাসাজ করলো-
“দোস্ত, তোকে মাফ করে দিলাম রে। আর তোর মাথাটা আঠা দিয়ে ভালো মতো ম্যাসেজ করলাম। তুই তো ছেলে মানুষ না! ন্যাড়া হলে তো কোনো সমস্যা নেই, তাই না?”
আদির কানের কাছে ফিসফিস করলো সুমনা। সুমনার ফিসফিস শুনেই আদি চোখ খুলে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সুমনার দিকে তাকালো । সুমনা আদির দিকে তাকিয়ে যে হাসিটা দিলো, আদির সুমনার হাসিকে মনেহলো কোনো পিশাচিনী হাসছে। আদির মুখের ভাষা যেন কেড়ে নিয়েছে কেউ। সুমনা হাতের গ্লাভস খুলে আদির চোখের সামনে নাচিয়ে ওর পায়ের কাছে ফেললো-
“দোস্ত, তোর চুলগুলো এখনই তো কটকটা হয়ে যাচ্ছে? তাড়াতাড়ি যা, আর একটু শুকালে তুইই ব্যাথা পাবি। দেখ সময় মতো ন্যাড়া হওয়া যায় কি না?”
বলেই হো হো করে হাসলো সুমনা-
“দোস্ত, খুবই মজা লাগছে বুঝলি? তোর টাক মাথা কল্পনা করেই হাসি পেয়ে গেলো। তোকে খুববই হ্যান্ডসাম লাগবে, দেখিস?”
সুমনা হাসতে হাসতে উঠে দৌড় লাগালো। আদি মাথায় হাত দিতেই হাতে আঠা ভরে গেলো। সেই সাথে কিছু চুল হাতে আঁটকে গেলো। চুল হাত থেকে ছাড়াতে না পেরে টান দিতেই মাথার চামড়া ছিড়ে কিছু চুল এলো। ব্যাথায় আদি আহ শব্দ করে চিৎকার দিলো-
“সুমনার বাচ্চা! তুই আবার শুরু করলি? নকলবাজ ছুড়ি, সবসময় আমার বুদ্ধি নকল করিস কেন? নিজের কোনো বুদ্ধি নেই?”
সুমনা দূর থেকে হাসতে হাসতে জবাব দিলো-
“হিসাব বরাবর না হলে নতুন বুদ্ধি বের করবো না। তোর গুলোই তোর উপর এপ্লাই করবো। বুঝলি?”
“আমি কিন্তু সরি বলে সব মিটমাট করতে চেয়েছিলাম?”
আদিও চিল্লিয়ে জবাব দিলো।
“তোর সরি তোর কাছে রাখ, আমার ওটা এখন দরকার নেই। ভালো থাক, গেলাম। বাই!”
“সুমনা! খুব খারাপ করলি কিন্তু? নতুন করে শত্রুতা না করলে কি হতো না?”
“নাহ, তোর হচ্ছিল না তো! আমার পিছনে পড়েছিলি শুধু শুধু। এখন কেমন লাগে?”
উত্তর দিয়ে ছুটে ক্যাম্পাসের বাইরে সুমনা। আজ এই আদি বদের পিছনে অনেক সময় নষ্ট করেছে। এদিকে আদি রাগে ফেটে পড়ছে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে এতো বড় ধোঁকা দিলো সুমনা তাকে? আসলে, মেয়েরাই খারাপ! সবসময় মিষ্টি কথার ফাঁদে ফেলে কাজ উদ্ধার করে! শয়তান্নী সুমনা, ছাড়বো না তোকে।আমার সাথে মামদোবাজি! দেখে নেবো!
আদি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ক্যাম্পাসের অনেকেই আড়চোখে ওকে দেখছে আর মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি আড়াল করার চেষ্টা করছে। মেজাজ খারাপ করে আদি বাড়ির পথ ধরলো।
চলবে—–
©Farhana_Yesmin