তবু_সুর_ফিরে_আসে ৩৭ পর্ব

0
613

#তবু_সুর_ফিরে_আসে
৩৭ পর্ব

হেরা জীবনে একটা সময় অনেক কষ্ট ,অনেক দুঃখ ভোগ করেছে বলেই হয়তো জীবন ওকে দুহাত উজাড় করে দিচ্ছে। যে হেরাকে এক সময় বুকে আগলে রাখতো ওর নানাভাই আজ ন‌ওশাদ তাকে স্বামীর আদরে, ভালোবাসায়, স্নেহে , আহ্লাদে ভরিয়ে রাখে। তার থেকে অর্ধেক বয়সের ছোট একটা মেয়ে বলেই ন‌ওশাদ ওকে দ্বায়িত্বের চেয়ে প্রশ্রয় দিতে পছন্দ করে। কিন্তু মেয়েরা স্বামীর নামের মানুষটার উপর অধিকার বোধ ফলাতে সবচেয়ে বেশি পারদর্শী হয়। হেরা ন‌ওশাদকে রীতিমতো শাসন করে। ওর জন্যেই হাজার কাজ থাকলেও রাত আটটার ভেতরে অফিস থেকে এসে পড়তে হচ্ছে। কিছুদিন কাজ বেশি করতে হচ্ছে বুবুর ওখানে যাবে বলে। একদিন অফিস থেকে এসে একটু অসুস্থ বোধ করছিল ক্লান্তিতে । হেরা তারপর থেকে তুলকালাম করে ফেলে আটটা বেজে গেলেই। একদিন তো নিশালকে নিয়ে অফিসের নিচে চলে এলো ন‌ওশাদ কে নেয়ার জন্য। সন্ধ্যা থেকেই হাজার বার ফোন দিবে কখন আসবেন বলেন। দেরি করলে গাল ফুলিয়ে রাখবে। সেই অভিমান ভাঙ্গাতে ন‌ওশাদের অনেক সময় ব্যয় করতে হয়।
নিশাল ও তার মামনির পক্ষ নিবে। ছুটিতে এসে সে পুরো মামনির ছেলে হয়ে গেছে।
সকালে ঘুম ভেঙ্গে ন‌ওশাদ দেখে হেরা বিছানায় নেই । ও একটু অবাকই হলো। ঘুম কাতুরে হেরা ছুটির দিনে উঠে গেছে সকাল সকাল ! কিন্তু ন‌ওশাদের আজ খুব আলসেমি ভর করে আছে । তার ইচ্ছে করছে না উঠতে । বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে দেখেই হয়তো আরও বেশি আলসেমি ভর করে আছে।
হেরা কোথায় তুমি ? মনে মনে ভাবছে ন‌ওশাদ। ভাবতে ভাবতে অবার চোখ লেগে গেল ঘুমে। মিনিট দশেক পর ঘুমটা আবার ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখে শুভ্র সাদা জামিনে নীল পাড়ের একটা শাড়ি পড়ে হেরা ওর সামনে। চুল গুলো পুরো পিঠ ময় ছড়ানো। কপালে নীল টিপ । হাত ভর্তি চুড়ি ।
কি ব্যাপার ! এই পরী টা কোথা থেকে এলো সাত সকালে ?
কোথায় ?
আমার সামনে এই যে , আজ কোন বিশেষ দিন হেরা ?
কিছু না তো।
তাহলে আমার মাথা নষ্ট করার জন্য এই সাজ কেন !
মাথা নষ্ট করার জন্যই। হাসছে হেরা।
ন‌ওশাদ উঠে বসলো সত্যি কিন্তু মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোথাও যাচ্ছো তুমি ?
না আপাতত যাচ্ছি না কোথাও কিন্তু কেউ আমাকে কোথাও নিয়ে গেলে যেতে রাজি আছি।
সেই কেউ টা কি আমি ?
যে কেউ হতে পারে ।
কি যে কেউ হলেই যাবে , ও আমি আরো মনে মনে খুশি ই হচ্ছিলাম ব‌উ কে নিয়ে ঘুরতে চলে যাই আজ কোথাও ।
যখন যাওয়ার তখন যাওয়া যাবে এখন উঠেন প্লিজ।
আমার হাত ধরে তুলো।
আবার হাত ধরতে হবে কেন ?
আমার হাত ধরলে দেখো কি ম্যাজিক হয় ধরে দেখো !
ম্যাজিক হবে , ঠিক আছে দেখি হেরা ন‌ওশাদের হাত টা ধরলো।
ন‌ওশাদ হাত ধরার সঙ্গে সঙ্গে টান দিয়ে বুকের কাছে নিয়ে এলো । এত সুন্দর লাগছে তোমাকে মনে হচ্ছে সারাক্ষণ তাকিয়ে দেখি। হেরার কানের পিছনে ঠোঁট ছোয়ালো ন‌ওশাদ।
আমি জানতাম এই ম্যাজিক ই হবে !
প্লিজ ফ্রেশ হয়ে নিচে আসেন , আব্বা অপেক্ষা করছে খাবার টেবিলে।
ঠিক আছে আসছি যাও। কিন্তু আসল ম্যাজিক টা তো দেখালাম ই না তোমাকে হেরা।
আমি জানি কি ম্যাজিক দেখাবেন , সব ম্যাজিক পরে দেখব এখন নিচে আসেন তাড়াতাড়ি।
হেরা নিচে চলে গেল।

ন‌ওশাদ নিচে নেমে দেখে বাসার সবাই কিছু একটা নিয়ে কানাঘুষা করছে। ঘটনা যা শুনলো সে খুবই অবাক হলো !
আজ হেরার জন্মদিন হতে পারে। হেরা কাউকে বলেনি এলিন ধারণা করলো।
নিশাল মন খারাপ করছে আগে জানলে কত কি করা যেত।
এলিন নিশালের কানে কানে বলল, চলো ও যখন বলছে না নাটক করছে আমরা ওকে সারপ্রাইজ দেই ।
কিভাবে?
কেক -টেক নিয়ে আসি , পার্টি করি।
তুমি শিওর তো আজ মামনির জন্মদিন ফুপি ?
শিওর দাদাকে সালাম করতে দেখেছি রুমের ভেতরে । খালি খালি সালাম করবে কেন?
পাপাকে জিজ্ঞাসা করি ।
ন‌ওশাদ জানে না কিছু । সে নিজেও অবাক হেরাকে দেখে।
নিশাল থাক তোমার মামনি যতক্ষণ না বলে আমরা চুপচাপ থাকি তোমাদের কোন প্ল্যান থাকলে তোমরা করো ও আনন্দ পাবে।
তুমি জিজ্ঞেস করো না পাপা ?
বলবে না ।
খাওয়ার টেবিলে বসে ন‌ওশাদ মুচকি মুচকি হাসছে হেরার দিকে তাকিয়ে ।
হাসছেন কেন ? হেরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো ।
কেন হাসলে জরিমানা করবে ?
কারণ ছাড়া হাসলে করব ।
মামনি তুমি যে কারণ ছাড়া এত সুন্দর করে সেজে বসে আছো আমাদের কিছুই বলছো না তার জন্য কি জরিমানা হবে বলো?
কারণ টা কিছুই না সকালে উঠে মনে হলো এই শাড়িটা পড়ি এতটুকুই!
ন‌ওশাদ বলল, ঠিক আছে বলতে হবে না । হেরা তুমি আমাদের লাগেজ বের করে গোছগাছ শুরু করো আর তো মাত্র কয়দিন । ন‌ওশাদ কাজ আছে লান্চের আগেই চলে আসব বলে বের হয়ে গেল।
একটুপর এক এক করে নিশাল, এলিন, নাহিন‌ সবাই বাহিরে চলে গেল। হেরা খুব অবাক হলো ! কারণ ছুটির দিনে সকালে সবাই বাসায়‌ই থাকে ।‌ হেরা মন খারাপ করে নিজের ঘরে বসে র‌ইলো কিছুক্ষণ।
আসলে আজকে তার জন্মদিন । কিন্তু কোন দিন জন্মদিনে বিশেষ ভাবে কিছু করেনি। কাউকে বলতে তার খুব অস্বস্তি লাগছে।‌ আগে সকালে উঠে সে নানা কে সালাম করতো ।‌নানা তাকে কিছু টাকা দিতো সেটাই ছিল তার জন্মদিনের পাওয়া বিশেষ কিছু। আজ সকালে উঠে গোসল করে নতুন একটা শাড়ি পড়েছে ।‌ সুন্দর করে সেজেছে । শ্বশুর কে সালাম করেছে ।‌ শ্বশুর বলল, আজকে কি ঈদ বৌমা ?
না আব্বা !
এমনি মনে হলো আপনাকে সালাম করি !
বুঝেছি আজ তোমার জন্মদিন । তোমার শ্বাশুড়ি ও এভাবে জন্মদিনের দিন সালাম করতো । ওর জন্মদিন পহেলা শ্রাবণ ।
পহেলা শ্রাবণ এলে মনে করিয়ে দিও আমাকে ।
জ্বী আব্বা।
আর আমাদের বিবাহ বার্ষিকী পনের আষাঢ়। আষাঢ় মাসে কারো বিয়ে হয় বলো ! কিন্তু আমাদের হয়েছিল । অনেক বৃষ্টি ছিল বিয়ের দিন রাতে ।
হেরা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ শুনলো শ্বশুরের কথা । কত ভালোবাসেন মৃত স্ত্রী কে গল্প শুনেই বোঝা যাচ্ছে।
একটু পর আনারের মায়ের সঙ্গে তিন তলায় গিয়ে স্টোর রুমে ঢুকলো হেরা , সঙ্গে পারুল ।
আম্মা এখানে এক সাথে দুইটা স্টোর রুম প্রথমে শুধু সুটকেস রাখার‌ই একটা ঘর । কত ধরনের সুটকেস যে আছে এখানে আপনে কোন টা নিবেন কন । সব নামায় দিব।
ভেতরের ঘরটা তে কি ?
আম্মা ঐখানে সব পুরাতন জিনিস। আগের আম্মার কাপড় রাখা আছে এক আলমারিতে । উনার ছবির ফ্রেম আছে । স্যার আর উনার ছবির এলবাম। উনার ব্যবহার করা জিনিস পত্র। সুন্দর ক‌ইরা গুছায় রাখা এই ঘরে।
হেরা ঘর টাতে ঢুকলো । আলমারি খুলে গীতির শাড়ি , থ্রী পিস সুন্দর করে টাঙ্গিয়ে রাখা ছুঁয়ে দেখলো সে। গীতি আর ন‌ওশাদের ছবির এলবাম । হেরা এলবাম গুলো খুলে দেখলো কিছুক্ষণ। নিশালের ছোটবেলার ছবি তার মায়ের সঙ্গে। ফর্সা সুন্দর একটা ছোট বাচ্চা কোলে ন‌ওশাদ । দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিশাল। ওদের তিন জনের ছবি ফ্রেমে বাঁধানো।
এগুলো এখানে কেন আনারের মা ?
আম্মা মারা যাওয়ার পরও সব ওয়ালেই টাঙ্গানো আছিন । একদিন বড় এক হুজুর ক‌ইলো মারা যাওয়া মানুষের ছবি টাঙ্গায় রাখলে তার কষ্ট হয় । তারপর স্যার সব খুলছে। যেদিন ছবি গুলা খুলছে সেদিন স্যারের কি মন খারাপ আছিন আম্মা ! নিজে যত্ন ক‌ইরা তুইলা রাখছে এইখানে। তারপর ফিসফিস করে বলল, আম্মার মৃত্যু বার্ষিকী র দিন স্যার এই ঘরে ঢুকে সব কিছু নিয়ে বসে থাকে । ছবি দেখে। আলমারির ভেতরে চিঠিপত্র ও আছে স্যার ব‌ইসা পড়ে চোখের পানি ফেলে ।
চলেন আম্মা বাইর ‌হ‌ই এই ঘরটাত ঢুকলে দম বন্ধ লাগে আমার, এত জিনিষ এক জায়গায়।
চলো। হেরা নিশাল আর ন‌ওশাদের ছবিটা সঙ্গে নিয়ে এলো। এত সুন্দর একটা ছবি । ছোট্ট নিশাল একটা লাল গেঞ্জি পড়ে তার পাপার বুকের উপর শুয়ে আছে তার পাপা খালি গায়ে জড়িয়ে ধরে আছে ছেলেকে।‌ হেরা মনে মনে ভাবছে তাদের যখন একটা বাবু হবে এভাবেই পাপার কোলে শুয়ে একটা ছবি তুলবে তারপর দুটো ছবি পাশাপাশি টাঙ্গিয়ে রাখবে তাদের ঘরে। হেরা ছবিটা তার আলমারির ড্রয়ারে রেখে দিলো।
অনেকক্ষণ পর নিজের ঘর থেকে বের হয়ে নিচে নেমে অবাক!
সবাই ওর জন্য কেক নিয়ে হাজির। নিশাল কানের কাছে বাঁশি ফুঁ দিয়ে বিকট শব্দ করে বলল, তুমি না বললেও আমরা বুঝেছি আজ তোমার বার্থডে মামনি !
মোটেও না !
ঢং করো না তো বৌমনি ,নাহিন বলল।
এলিন নাহিনদের যেসব বন্ধুদের সঙ্গে হেরার খুব ভাব তারাও এসেছে । হেরা ওদের ছেলে বন্ধুদের সাধারণত এড়িয়ে চলে । তবে আগের মত এতটা ভয় আর জড়তা নেই এখন । ওরাও এসেছে কয়জন।
মাহাদি এগিয়ে এসে বলল, হ্যাপি বার্থডে লজ্জাবতী ফুল।
হেরা তাকিয়ে শুধু হাসলো।
ছেলেটা প্রথম দিন থেকেই তাকে লজ্জাবতী ফুল বলে দুষ্টামি করে। ওর খুব অস্বস্তি লাগে । কিন্তু নাহিনের খুব ভালো বন্ধু সে। একটা জিনিস খেয়াল করেছে ছেলেটা দুষ্ট কিন্তু সবাইকে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে সাহায্য করে। সেটা বন্ধু হোক কিংবা ক্যাফেটেরিয়ার মামা। একদিন এক মামা খুব অসুস্থ হয়ে গেল । মাহাদি নিজের বাইকে করে সেই মামাকে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনে দিলো। সবার সঙ্গে ফাজলামি, দুষ্টামি করলেও হেরার সঙ্গে করে না । শুধু দেখা হলে বলবে, লজ্জাবতী ফুল।
তোমার বাসাটা খুব সুন্দর লজ্জাবতী !
ধন্যবাদ। আপনি বসুন ।
হুঁ।
হেরা নিশালের কাছে গিয়ে দাড়ালো । তোমার পাপা কোথায় বাবা ?
পাপার খবর তো জানি না ! ফোন দিব ?
না থাক লাগবে না।
একটুপর নিশাল এসে বলল, পাপার আসতে সময় লাগবে চলো কেক কাটো মামনি ।
আসুক পাপা ।
ফোন দিয়ে বলল দেরি হবে আমাদের বলেছে কেক কেটে খাওয়া দাওয়া করতে।
অগত্যা হেরাকে ছেলেকে খুশি করতেই ন‌ওশাদকে রেখে কেক কাটতে হলো। অন্য সবাইকে নিয়ে খাওয়া‌ও খেতে হলো। নিশাল মাহাদির সঙ্গে বসে গিটার বাজালো।
ভাইয়া আপনি তো দারুন বাজান !
সবার জন্য দারুন বাজাই না তোমার মামনির জন্য বাজালাম আজকে। বলেই মাহাদি হেরার দিকে এমন ভাবে তাকালো হেরার খুব অস্বস্তি বোধ হলো। ওর দৃষ্টিতে কেমন একটা ভাষা আছে হেরা ঐ ভাষাটা কে ভয় পায়। ঐ ভাষায় কামনা থাকলেও এতটা ভয় লাগতো না কিন্তু হেরার কেন যেন মনে হয় মাহাদির চোখের ভাষায় অন্য কিছু আছে যেটা হেরা ন‌ওশাদ ছাড়া আর কারো দৃষ্টিতে দেখতে চায় না তার জন্য।
সবাই খুব করে ধরেছিল গান গাইতে সে কোন ভাবেই রাজি হয়নি। ন‌ওশাদ সামনে নেই তার ইচ্ছে নেই গান গেয়ে অন্যদের মনে আনন্দ দিতে। তার সকল গান এখন শুধু ঐ মানুষটার জন্য।
কিন্তু মানুষটা কোথায় গিয়ে বসে আছে হেরা বুঝতে পারছে না ।
সবাই সন্ধ্যা হ‌ওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে গেছে। হেরা এবার একটু মন খারাপ করলো, ন‌ওশাদ লান্চের কথা বলে গেছে কিন্তু সন্ধ্যা হ‌ওয়ার পরেও খবর নেই।
নিজের ঘরে অভিমান করেই বসে র‌ইলো সে।
ন‌ওশাদ যখন ফিরেছে তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে গেছে শহরে।
হেরা চুপচাপ ব‌ইয়ের পাতায় ই মনোযোগ রাখার অভিনয়ে ব্যস্ত।
ন‌ওশাদ ঘরে ঢুকেই ওর কাছে এসে দাঁড়ালো , হাতে দারুন একটা ফুলের তোড়া আচ্ছা আজ কি কারো জন্মদিন ছিল?
জানি না!
অনেক বেশি রাগ করে আছো নাকি অল্প একটু ?
হেরা ব‌ইয়ের থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, অনেক রাগ করে থাকলে কি হবে ?
অনেক বেশিবার সরি বলব !
থাক সরি বলার দরকার নেই। আমি রাগ করে নেই । আপনি লাঞ্চ করবেন বলে গেলেন আর এখন এসেছেন আপনি তো এরকম কখনো করেন না !
হুম আজকে যখন করেছি নিশ্চয়ই কারণ আছে । শুনবে না কারণ টা কি ?
না থাক নিশ্চয়ই বড় কোন কারণ আমার শোনার দরকার নেই ।
ন‌ওশাদ বুঝতে পারছে মুখে না বললেও বোঝা যাচ্ছে অভিমানে বুক ভার হয়ে আছে হেরার। হাত ধরে সোফা থেকে টেনে সামনে দাঁড় করালো হেরাকে । জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা তোমাকে ! তারপর হেরার কপালে চুমু খেলো । অনেক দোয়া রইল তোমার জন্য। আচ্ছা আগে বললে কি হতো আজ তোমার জন্মদিন।
আসলে আমার জন্মদিন টা কখনো কারো কাছে বিশেষ কোন দিন নয় তাই আগ বাড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করেনি।
কিন্তু আমার কাছে তো তোমার জন্মদিন বিশেষ একটা দিন। তুমি আগে বললে আমার কষ্ট একটু কম হতো।
কি কষ্ট করলেন আপনি ? হেরা অবাক হয়ে তাকালো!
তাহলে চোখ বন্ধ করে রাখো , সারপ্রাইজ কি তুমি একা দিতে পারো আমিও পারি একদম চোখ বন্ধ করে কোন নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে থাকবে যতক্ষণ না আমি চোখ খুলতে বলব।
ঠিক আছে।
ন‌ওশাদ হাঁটুর উপর ভর দিয়ে হেরার পাশে বসলো । তারপর হেরার কমড়ে খুব সুন্দর একটা চেইনের মত চিকন মিনার কারুকাজ করা সোনার সাউথ ইন্ডিয়ান কমড়পাট্টা পড়িয়ে দিলো। এগুলোর মতো আরও জাঁকজমক পূর্ণ টাকে বাংলায় বিছা বলে।
হেরা অবাক হচ্ছে!
তাকাবে না হেরা ।
তাকাচ্ছি না কিন্তু হচ্ছে টা কি ?
একটু অপেক্ষা করো ,হুম এখন দেখো কি হলো।
ও আল্লাহ ! হেরা হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
হাসছো কেন ?
আপনি এই জিনিস কোথায় পেলেন ?
আমার কত পরিশ্রম গিয়েছে জানো এই জিনিস খুঁজতে !
এটা কি ?
এটা সাউথ ইন্ডিয়ান মেয়েরা কোমড়ে পড়ে। এটা একমাত্র গয়না আমি জীবনে এক কি দুইবার মেয়েদের পড়তে দেখেছি এবং আমার খুব ভালো লাগে । সত্য কথা বলব একটা !
হুম বলেন।
তখন ভার্সিটিতে পড়ি আম্মাকে নিয়ে চেন্নাই গিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য ওখানে সব বিবাহিত মেয়েরা এই জিনিস পড়ে। কোন মেয়ে দেখলেই আমার চোখ চলে যেত ওদের কোমড়ে । জিনিস টা এত সুন্দর চোখের আর কি দোষ বলো তখন বয়স কম ছিল বলেই কথাটা ন‌ওশাদ হাসা শুরু করলো। বাঙালি মেয়েরা এই জিনিস পড়ে না ।
হেরা বলল, ভাগ্যিস পড়ে না । তাহলে আপনার চোখ কোথায় থাকতো অনুমান করছি ।
ওরে মেয়ে জেলাস ।
অবশ্যই ।
আমি অবশ্য এই জিনিস পড়ার জন্য সুন্দর কোমড়‌ও দেখি না ।
আপনার চোখ মেয়েদের কোমড়ে যায় বুঝি ! হেরা হাসতে হাসতে বলল।
হঠাৎ হঠাৎ তো যায়ই পুরুষ মানুষ না আমি।
বুঝলাম।
তোমার পছন্দ হয়েছে?
খুব , কিন্তু কেমন সুরসুরি লাগছে ।
হেরা এটা তুমি শুধু আমার সামনে পড়বে এই ঘরের বাহিরে পড়ে যাবে না।
তাই , কেন ?
আমি চাইনা কারো চোখে পড়ুক।
পজেসিভনেস ।
খুব।
ঠিক আছে।
আমি তখন‌ই একটা কিনে এনেছিলাম গীতির জন্য কিন্তু ওকে যদি বলতাম এটা আমি চেন্নাই এ মেয়েদের পড়তে দেখেছি আমার খুব ভালো লেগেছে ও আমাকে মেরেই ফেলতো। ও খুব সেনসেটিভ ছিল আমার বিষয়ে। হাসলো ন‌ওশাদ।
তারপর দেননি উনাকে এই জিনিস।
না ও পছন্দ করতো না ।
এটাই কি সেটা ?
না । ওটা হারিয়ে গেছে অনেক আগেই । কোথায় রেখেছিলাম মনেই নেই। আজ অনেক গুলো জুয়েলারি শপ ঘুরে এটা পেলাম।
থ্যাংকস আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আপনার উপহার গুলো আপনার মত‌ই বেতিক্রম।
তোমার জন্য আরো একটা উপহার আছে । আমার মনে হয় এটা দেখলে তুমি আরো বেশি খুশি হবে।
কি দেখি ?
ন‌ওশাদ একটা খাম বের করে হেরার হাতে তুলে দিলো।
জিনিস টা দেখে হেরা চুপ হয়ে গেল । ওর চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু হলো ।
নানাভাইয়ের ছবি ! আপনি কোথায় পেলেন ।
আনালাম তোমার বাড়ি থেকে । এটা যাকে দিয়ে আনালাম ঢাকা আসতে তার দেরি হয়ে গেল তাই আমারও বাসায় আসতে দেরি হয়ে গেল।
হেরা ন‌ওশাদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। এরচেয়ে ভালো গিফট আর হতেই পারে না আমার জন্মদিনে। আপনি এত ভালো কেন বলেন তো ।
আমি মোটেও ভালো ন‌ই দেখলে না মেয়েদের কোমড়ের দিকে তাকাই বলেই ন‌ওশাদ হো হো করে হাসছে।
হেরা ন‌ওশাদকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলছে।
এই বোকা মেয়ে কান্না বন্ধ করো আমি কেক নিয়ে এসেছি চলো কেক কাটি দুইজন।
দুইজন কেন নিশাল কে ডেকে আনি ।
আমি আর তুমি কাটি । তোমার আমার সেলিব্রশন হোক।
না ছেলেও থাকুক।
ঠিক আছে যাও নিয়ে আসো ওকে।

পরদিন বিকেলে হঠাৎ বীথি ল্যান্ড ফোনে ফোন দিয়ে হেরার খোঁজ করল । আনারের মা ফোন ধরেছে।
আনারের মা হেরা কোথায়?
আম্মা আছে নিজের ঘরে ,দিতাম।
হ্যাঁ দাও।
আনারের মা ছুটে এসে ফোনটা হেরার হাতে দিয়ে গেল।
কে?
বীথি খালাম্মা।
জ্বী বীথি আপু বলেন।
নিশাল কোথায় ?
ঘুমাচ্ছে ডেকে দিব ?
না ডাকতে হবে না। হেরা তুমি ছেলেটাকে কি বোঝাচ্ছো বলো তো ?
বুঝলাম না আপু কি বলতে চাইছেন?
নিশালকে আমার বাসায় আসতে বললে আসছে না , দুপুরে খেতে বললাম বলল কাজ আছে!
আমি কি বোঝাব আপু আপনার বোনের ছেলে আপনি এত বছর বড় করেছেন !
কিন্তু এখন তো দেখছি সে তোমার কথায় উঠছে বসছে !
আমার সেরকম কোন ইচ্ছে নেই যে নিশালকে আমার কথায় উঠা বসা করাব। আপনি ভুল ভাবছেন ।
দুলাভাই তো তোমার হাতের মুঠোয় ঢুকে গেছে তাই না।
দেখুন আপু আমার হাজব্যান্ড আমি হাতের মুঠোয় রাখব না মাথায় রাখব এটা আমাদের বিষয় এটা নিয়ে আপনি দয়া করে কথা বলবেন না। আপনার যা বলার নিশালকে বলবেন ও ঘুম থেকে উঠলে আমি ফোন দিতে বলছি ।
খুব কথা জানো তো দেখছি মেয়ে।
এতদিন আপনার কথা শুনেছি এখন মনে হচ্ছে কিছু কথা আপনার ও শোনা এবং বোঝা উচিত। রাখছি ভালো থাকবেন ।
হেরা লাইন কেটে দিল। ওর খুব খারাপ লাগছে । কিসের এত আক্রোশ উনার হেরা বুঝতে পারে না ।

তিনদিন পর ওরা চার জন এয়ার পোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জে বসে আছে । ন‌ওশাদ তার আব্বাকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত এই বয়সে এত দূর প্লেনের জার্নি করতে কষ্ট হবে কিনা ভাবছে।
হেরা নিশালের সঙ্গে গল্প করছে। মোবাইল এ ছবি তোলার সময় হেরা খেয়াল করলো মাহাদির মেসেজ।
এই ছেলেটাকে সে ফ্রেন্ডলিস্টে নিতে চায়নি, এত চালাক ছেলেটা সেদিন নিশালের সামনে বলে উঠলো, আমি তোমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি হেরা একসেপ্ট করো !
হেরা যখন বলল পরে করব ।
সঙ্গে সঙ্গে বলে এখন কি সমস্যা ?
নিশাল তখন বলে উঠলো করো মামনি ! আমার সঙ্গেও ভাইয়া আছে ফেসবুকে।
অগত্যা হেরাকে করতেই হলো ! কেন জানি ছেলেটা এক কি দুইবার দেখা হ‌ওয়াতেই নিশালকে খুব পটিয়ে ফেলেছে। ওর কথায় , কাজে নিশাল খুব মজা পায় ।
এমনিতেই এই ফেসবুক সে এতটা বুঝে উঠতে পারেনি এখনও। নিশাল‌ই ওর ছবি আপলোড করে দেয়। তার দুই তিনজন ক্লাসমেট, এলিন , নাহিনদের বান্ধবীরা যারা ওর‌ও বন্ধু শুধু তারাই। এখন এই মাহাদির মেসেজ দেখে এই মুহূর্তে ওর কেমন অস্বস্তি হচ্ছে।
মেসেজ অন করে দেখে । ওর জন্মদিনের দিন তোলা ওর একটা ছবি পাঠিয়েছে । কখন তুলেছে মাহাদি সে জানে না। নিচে লিখেছে, ‘ মানুষ এত সুন্দর হয় কিভাবে? সৃষ্টিকর্তা কারো প্রতি এত উদার আর আমাদের প্রতি এতটা কৃপণতা করলো ?’
হেরা মেসেজ টা দেখেই মন খারাপ করে ফেলল। ছেলেটা কি চায় ?
হেরা একবার ভাবলো নিশালকে বলবে ওকে লিস্ট থেকে বাদ কিভাবে করব দেখিয়ে দাও ‌তারপর চিন্তা করলো এটা বললে নিশালকে ব্যাখ্যা করতে হবে কেন ?
ভালো বিপদ হয়েছে এখন ! অসহ্য।
ইমিগ্রেশন এর ফর্মালিটিজ শেষ করে ন‌ওশাদ ওর পাশে এসে বসলো । কি ব্যাপার কাঠবিড়ালী তোমার মুড অফ কেন ?
মুড অফ না ।
এখন বলো মন খারাপ কেন ?
হেরা মাহাদির মেসেজ টা দেখালো ন‌ওশাদকে ।
ন‌ওশাদ মেসেজ টা পড়লো, হুম কি সমস্যা ?
ঐ ছেলে এই মেসেজ কেন পাঠাবে ?
আমি তো কোন সমস্যা দেখছি না। বন্ধু বন্ধুর প্রশংসা করেছে এতে মন খারাপ করার মত কি দেখলে ?
এসব লিখার কি দরকার বলেন ?
হেরা ছেলেটা তোমাকে বন্ধু ভেবে লিখেছে আমি এখানে দোষের কিছু দেখছি না । তুমি খালি খালি আপসেট হচ্ছো ! বন্ধুর প্রশংসা করে কত সুন্দর কয়টা লাইন লিখেছে। তুমি ধন্যবাদ লিখে দাও। শেষ।
ধন্যবাদ লিখে দিব?
হুম দিবে।
না কিছু লিখব না আমি ।
আচ্ছা কিছু লিখার দরকার নেই । এখন মুড ঠিক করো। এক জায়গায় যাচ্ছি মন খারাপ করে থাকলে ভালো দেখায় বলো ?
হেরা ন‌ওশাদের হাত ধরলো আমি জীবনে কখনো ভাবিনি আমেরিকা যাব জানেন!
জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটে যা আমরা কখনো কল্পনাও করি না। কিন্তু ঐ যে আকাশে একজন আছেন তিনি সব লিখে রেখেছেন তার প্ল্যানিং এ সব চলে।
সেটাই তিনিই তো আপনাকে পাঠালেন আমার জন্য ! আর আমার জীবন টা বদলে গেল ।
ন‌ওশাদ চশমা টা খুলে হেরার দিকে তাকালো ।‌ আমাদের জীবন আরো বদলে যাবে দেখো ।
হ্যাঁ।
নিশাল তার দাদাভাইকে হুইলচেয়ারে ঠেলে নিয়ে এলো ওদের কাছে।
পাপা চলো একটা সেলফি তুলি আমরা চারজন ।
ঠিক আছে তুলো।

( চলবে )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here