#লীলাবালি🌺
#পর্ব_২৯
আফনান লারা
.
কুসুম সবার মুখটা বাংলার পাঁচের মতন হয়ে আছে দেখে সোজা অর্ণবের রুমের দিকে গেলো।গিয়ে দেখলো রুমের যাচ্ছেতাই অবস্থা।কিছুক্ষণ আগে যে সাজানো বাসরটা সে দেখেছিল সেটার কিছুই আর অবশিষ্ট রইলোনা।পাশেই অর্ণব মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।চোখ পানিতে টইটুম্বুর।কুসুম রুমটা দেখা শেষে অর্ণবের দিকে তাকালো এবার।অর্ণব সঙ্গে সঙ্গে মুখটা ফিরিয়ে হাত দিয়ে মুছে ফেললো।অর্ণবের রুমে যে সুন্দর ফুলদানিটা কুসুম দেখেছিল এতদিন, যেটাতে সে আজ নিজের হাতে ফুল রেখে সাজিয়েছিল, সেই ফুলদানিটা ফ্লোরে পড়ে চুরমার হয়ে গেছে।কুসুম নিচে বসে একটা টুকরো তুলে পেছনে তাকালো আবার।অর্ণবের কোনো নড়চড় না দেখে একটা একটা করে টুকরো তুলতে লাগলো সে।এসব কে করেছে মাথায় ঢুকছেনা।
আমচকা উনার বান্ধুবী এসে কেনোই বা রুমটা তছনছ করবেন?তাহলে নিশ্চয় উনি করেছেন।আমাকে পছন্দ করেননা ঠিক আছে।কিন্তু এভাবে ফুলের সাথে রাগ দেখানোর মানে কি।ফুল কি দোষ করেছে?
টুকরোগুলোকে পাশের ঝুড়িতে ফেলে ফুল সব এক এক করে নিয়ে টেবিলে রাখছে কুসুম।অর্ণব চলে গেছে।কোথায় তা জানেনা কুসুম।কেউই জানেনা।মৃদুল আর মম দুপুরের খাবার খেয়ে তারাও চলে গেছে।কুসুমের বাবা মা মার্কেট করতে গিয়েছিলেন বলে এই পুরো ঘটনার ব্যাপারে জানলেননা।কুুসুমকে সবাই খেতে ডাকলো।কিন্তু অর্ণবের এমন ব্যবহার দেখে তার খাওয়া উঠে গেছে।কিচ্ছু মুখে তুলতে মন চাইছেনা।বাবা অর্ণবকে কল করেও পেলেন না। বাড়ি ফিরে কুসুমের মা ওকে জোর করে নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দিয়ে কলিকে নিয়ে চলে গেছিলেন বিকেলের দিকে।কুসুম বারান্দায় এসে অর্ণবের অপেক্ষা করছিল।অর্ণবের বাবা নামাজ পরে বাসায় ঢোকার সময় ওকে এভাবে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফোন নিয়ে আবারও কল করলেন কিন্তু এবার অর্ণবের ফোনই বন্ধ বলছে।
সন্ধ্যা হতেই বাগিচা থেকে শতে শতে মশা এসে ঘরে ঢোকা শুরু করলো।কিছু আক্রমণ করে বসেছে কুসুমকেও।কিন্তু তার নড়চড় নেই। সে অর্ণবের রকিং চেয়ারটাতে বসে অপেক্ষা করে যাচ্ছে ওর ফেরার।
হাতে পায়ে মশা কামড়ে ফুলিয়ে ফেলার পরেও কুসুমের মাঝে কোনো পরিবর্তন আসলোনা।
মিশু ভাবী এসে রুমের আলো জ্বালিয়ে কুসুমকে চা খেতে ডাকলেন।কিন্তু সে সাড়া দিলোনা।
ভাবী আর ডাকেননি।সাগর ভাইয়ার ফোন এসেছিল বলে তার রুমে চলে গেছিলেন তাড়াহুড়ো করে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে।দশটা বাজে তখন।কুসুম রকিংচেয়ারে বসে ঘুমোচ্ছিল।ঠাস করে দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে জেগে গেলো সে।উঠে দাঁড়িয়ে রুমের ভেতরে তাকালো।অর্ণব কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা বিছানার মাঝখানে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে।কুসুম অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওকে দেখলো।চিৎ হয়ে শুয়েছে বলে মুখটা দেখা হলোনা।রাগ হলো অনেক।তাই সোজা রুম থেকে বের হয়ে গেলো সে।যাবার সময় দরজাটা জোরে আটকে গেলো।অর্ণব চমকে মাথা তুলে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এটা কুসুমের কাজ।তাও না দেখার ভান করে আগের মতন শুয়ে পড়েছে সে।দরজার বিকট শব্দ মা বাবাও শুনেছেন।
—
-‘অর্ণবের গালে থাপ্পড় মারতে পারলে আমার শান্তি হতো”‘
-‘ও যখন ঐ মেয়েটাকে পছন্দই করে আমাদের বলতে পারতো।কাল তো ওর জোর করাতেই আমরা বিয়েটা দিলাম”
-‘আমার ও মাথা ধরছেনা।এখন এত রাতে এসে আবার রাগ দেখাচ্ছে!কুসুমটা কিছু মুখে দেয়নি।যাও ওদের দুজনকে ডেকে খাইয়ে দাও।আমি গেলে আমার হাত চলবে!’
অর্ণবের মা রুম থেকে বেরিয়ে অর্ণবের রুমের কাছে এসে ওকে ডাকলেন দুবার।এরপর ও এসে দরজা খুলে বললো,’দরজা তো খোলাই।ভেতরে আসতে পারো’
-“কুসুম কোথায়?’
-“আমি কি জানি!’
-“তুই কি জানিস মানে?এত নাটক কেন করছিস?ওরে বিয়ে করবার সিদ্ধান্তটা তোর ছিল, তাহলে কেন এমন করছিস?ওকে কষ্ট দেবার জন্যই কি তাহলে তোর বিয়েটা করার?অন্য মেয়েকে যখন ভালোই বাসছিস তবে কুসুমকে বিয়ে কেন?ঐ মেয়েটা কি দোষ করেছে?দুপুরবেলা বেরিয়ে রাতের দশটায় ঘরে ফিরলি।মেয়েটা তোর অপেক্ষায় ছিল জানিস?’
-‘ওকে আমি অপেক্ষা করতে বলেছিলাম?’
-‘এখন যা ওকে ধরে এনে ডাইনিং টেবিলে বসা।আমি খাবার বাড়ছি।দুজনে মিলে পেট ভরে খাবি।কত কষ্ট করে আমি এত পদ রান্না করলাম।কেউ ঠিক করে খেলোনা’
অর্ণব আবার গিয়ে শুয়ে পড়েছে।মা কোমড়ে হাত দিয়ে বললেন,’ঠিক আছে! তোর বাবাকে ডাকছি’
অর্ণব চট করে আবার উঠে বসে গেলো।মায়ের দিকে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে থেকে বললো,’এবার জোর করবা সব কিছুতে?’
-“বিয়েটা তুই তোর ইচ্ছেতে করেছিস।আমরা জোর করে একটা সময়ে থেমে গিয়েছিলাম তোর ঘাউড়ামির সাথে না পেরে।কিন্তু কাল তুই নিজের ইচ্ছায় রাতের এগারোটায় বিয়ে করেছিস।এরপর যদি মেয়েটার সাথে অন্যায় করিস সেটা ঠিক করতে অবশ্যই আমরা জোর করবো।’
অর্ণব পাঞ্জাবির হাতা উঠাতে উঠাতে বললো,’যাচ্ছি!’
মা মুচকি হাসি দিয়ে আওয়াজ বাড়িয়ে বললেন কুসুম মনে হয় ছাদে।
অর্ণব সোজা ছাদের দিকে গেছে।সেখানে কুসুম এমন ভাবে বসে ছিল যেন স্ট্যাচু হয়ে গেছে। অর্ণবের মাথা রেগে চড়ক গাছ হয়ে ছিল। হনহনিয়ে ওর সামনে গিয়ে হাত ধরে এক টানে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে ফেলে বললো,’কি সমস্যা কি তোমার?’
-‘কিসের সমস্যা আমার?’
-“তুমি জানো না?তাহলে আমি বলছি!আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও!’
-“দিলাম তো।আপনার থেকে দূরে থাকলেও কি সমস্যা? ‘
অর্ণব ওর হাতে চাপ দিয়ে বললো,’বাড়িতে একা তুমি আর আমি থাকিনা।যে রাগ তুমি দেখালে সেটা বাবা মা ও দেখেছে।এসব করে তাদের দিয়ে আমাকে টাইট করতে চাও?’
-‘আপনাকে কিছু বলতেই চাইনা।আপনি রাগ দেখিয়ে যাবেন আর আমি সেগুলো দেখে যাবো?শুরুটা কে করেছিল?’
অর্ণব এবার বললো,’যদি চাও আমি তোমার সঙ্গে থাকি তবে আমার বাবা মায়ের সামনে আমায় ছোট করবেনা।তারা আমার পক্ষ নেয় না।বরং তোমার পক্ষ নেয় সবসময়।সেটা জেনেই কি এমন করছো?’
কুসুম হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলো ছাদ থেকে।অর্ণব অবাক হলো কুসুমের পাল্টা এমন রাগ দেখে।
কুসুম সোজা মেহমানের রুমে ঢুকে বসে আছে।অর্ণব ছাদ থেকে নেমে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে চেয়ার টেনে বসতে যেতেই মা এসে বললেন,’কিরে কুসুম কই?’
-‘আসেনি?’
-‘তোকেই তো পাঠালাম ওকে আনতে।আশ্চর্য! কত দেরি হয়ে গেলো।মেয়েটা খাবে কখন’
অর্ণব কুসুমের নাম ধরে জোরে ডাকলো।কুসুম ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।এমন ভাবে ডাকলো যেন এখন কুসুম সামনে উপস্থিত না হলে মারামারি হানাহানি শুরু হয়ে যাবে।তাই ভয় পেয়ে ছুটে গেলো ওখানে।অর্ণব ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করায় ও চুপচাপ পাশে চেয়ার টেনে বসে গেলো।মা মিটমিট করে হাসছেন।এরপর তিনি সব খাবার বেড়ে দিয়ে চলে গেলেন ওখান থেকে।অর্ণব চুপচাপ খাচ্ছে।কুুসুম খেতে পারছেনা।বমি আসছে।ঔষুধ সেটা মিশু ভাবীর থেকে নিতে হবে খাওয়ার জন্য।এখন ভাত কিছুতেই খাওয়া যাবেনা।
তাই ভেবে উঠতে যেতেই অর্ণবের ধমক খেয়ে আবার থামলো।অর্ণব বললো বসে চুপচাপ খেতে।কুসুম মাথা নিচু করে বললো,”আমি পরে খেয়ে নেবো’
-“তুমি চাইতেছো বাবা এসে আমাকে ঝাড়ি দিক? আর আমি তোমায় নিজের হাতে খাইয়ে দিই?আর সেটারই বাকি আছে এখন’
-“আমি সেটা বলিনি। আমার শরীর খারাপ লাগছে।ঔষুধ খেয়ে তারপর ভাত খাবো।আপনার এত ভাবতে হবেনা।’
-“কিসের ঔষুধ?কি হয়েছে তোমার?’
-‘ভাত খেতে বসলে বমি পায়।’
-“বমি পাবেই তো।সকাল থেকে কতবার দেখেছি আমাদের বাগানের সব ফলপাকড় ছুটিয়ে ছুটিয়ে খেয়েছো।এগুলো খেলে ভাত খাওয়া আসবে কই থেকে?বুঝছি গ্যাস্ট্রিকের ঔষুধ।’
অর্ণব বাম হাত দিয়ে মাথার চুল টানতে টানতে রুমে ফিরে গিয়ে ঔষুধ খুঁজে বের করে বললো,’ঔষুধ তো আমার কাছেই থাকে’
-‘কাল থেকে আপনার চোখে যে আগুন জ্বলছে, আমি ঔষুধের কথা জিজ্ঞেস করতাম কি করে?আমার কথা তো কেরোসিন ‘
অর্ণব পাতা থেকে ঔষুধ টিপ দিয়ে বের করে মুখ তুলে তাকালো কুসুমের দিকে।তারপর গ্লাস এগিয়ে ধরে নিজে খেতে বসলো চুপচাপ।মনে মনে বললো,”মাঝে মাঝে কাঁচা ডিম মনে হয়,আর মাঝে মাঝে অমলেট।কুসুম নামটা সার্থক।’
চলবে♥