লীলাবালি🌺 #পর্ব_২৮

0
475

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_২৮
আফনান লারা
.
বাবা তার রুমে ঢোকার সময় অর্ণবকে বললেন বাজার থেকে পেপসি দুই লিটার নিয়ে আসতে।তাই অর্ণব নিজের মানিব্যাগটা নিয়ে চলে গেছে।মৃদুলও ওর সঙ্গে গেলো।
মম কলির সাথে ছাদে ছবি তুলছিল তখন।কুসুম মাটির পথটাতে দাঁড়িয়ে অর্ণবের চলে যাওয়া দেখছে।পথটার পাশে বনের ঝাড়।আর এই পাশটায় ধানক্ষেত।
কুসুম অর্ণব যাবার পর কিছুটা পথ হেঁটে গেলো এদিক সেদিক দেখতে দেখতে।অর্ণবদের পাশের বাসার এক আন্টি তখন গোসল করতে যাচ্ছিলেন।কুসুমকে দেখে বিড়বিড় করে বললেন,’নতুন বউ নাকি এমন ঘুরঘুর করে।ছেঃ’

কুসুম কথাটা শুনতে পেয়ে খয়েরী আঁচলটা মাথায় টেনে চলে যাওয়া ধরতেই পেছন থেকে একজনের ডাকে থামলো আবার।পেছনে ফিরে দেখলো তার সামনে একটা মেয়ে।সাদা পুতির কাজ করা একটা শাড়ী পরে আছে মেয়েটা।চুল খোলা।হাতে দুটো চুড়ি।সেগুলো অবশ্য কালো।দেখে এনাকেও শহরের মনে হলো কুসুমের কাছে।কুসুমের সামনের মেয়েটি আসলে জুথি।
কুসুমকে সে চিনতে পারলোনা।ওকে এভাবে ঘুরঘুর করে দেখতে দেখে বললো,’এখানে অর্ণবদের বাড়ি কোনটা জানো?’

কুসুম হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো,’এটা’

জুথি কুসুমকে থ্যাংক ইউ বলে চললো সেদিকে।কুসুম জুথির গায়ের পারফিউমের গন্ধে মাথা ধরে দাঁড়ালো।কি ঝাঁঝালো ঘ্রান!!
এরপর জুথির পিছু পিছু সেও চললো।জুথি হনহনিয়ে অর্ণবদের বাড়ির ভেতর ঢুকতে যেতেই সামনে পড়লো অর্ণবের মা।
তাকে সালাম দিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো অর্ণব কোথায়।
মা উত্তর দেওয়ার আগে কুুসমের দিকে একবার তাকালেন।কুসুম শাড়ীর কুচি মুঠো করে ধরে ছুটে আসছিল এদিকে।সেও দেখতে চায় কি হবে এখানে।মা বললেন অর্ণব তো বাজারে।জুথি এবার বললো,’তার রুমটা দেখিয়ে দিন আমায় ‘

-“তুমি কে তা তো বুঝলাম না’

-‘আমি উনার বান্ধুবী’

কুসএম সামনে এসে জুথিকে আবারও দেখছে।জুথির কথাবার্তা শুনে তেমনটাই মনে হলো যেমনটার বর্ণণা একদিন অর্ণব তাকে দিয়েছিল।তার চাহিদা।সাদা শাড়ীতে কি সুন্দর লাগে মেয়েটাকে।ধরে দেখতে ইচ্ছে করলো কুসুমের।দেরি না করে শাড়ীর আঁচলটা ধরে দেখলো সে।শাড়িটা সুতির।এরপর মাথা বাঁকিয়ে কুচি দেখতে লাগলো তারপর নিজের শাড়ীর কুচি।মেয়েটার কুচি গুলো কি সুন্দর সাজানো,আর তার গুলো সব এলোমেলো। মেয়েটার চুল ও তো কেমন চিকচিক করা আর সোজা।যেন একটা পরী!!
জুথি কুসুমের এমন ব্যবহারে আশ্চর্য হলোনা।এর আগেও চাচার বাসার আশেপাশের মেয়েগুলো ওকে এমন ভাবেই দেখছিল।
মা জুথির এমন ব্যবহার দেখে আন্দাজ করলেন এ যেন তেন বান্ধুবী হতে পারেনা অর্ণবের।তাই চুপিচুপি ওর বাবার ঘরের দিকে চললেন।কুসুম জুথির সামনে এসে বললো,’আপনার নাম কি?’

-‘জুথিকা মৃন্ময়ী ‘
——
অর্ণব পেপসির বোতল এনে সোফার সামনের টেবিলে রেখে সেখানে বসতে যেতেই কুসুম ওর সামনে এসে কিছু একটা বলতে চাইতেই অর্ণব ওকে থামিয়ে বললো,’আমার ফোন জ্বলছে তাই তো?’

-“না।’

-“তো?

-‘মৃন্ময়ী আপু এসেছে’

অর্ণব চোখ বড় করে এদিকসেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো কোথায় এখন।কুসুম বললো ওর রুমে।
অর্ণব সোজা মৃদুলের দিকে তাকিয়েছে।মৃদুল কাছে এসে বললো সে জুথিকে বাড়ির এড্রেস দেয়নি।কি করে পেলো তাই বুঝতেছেনা।কুসুম অর্ণবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
অর্ণব মাথায় হাত দিয়ে তার রুমের দিকে গেলো।জুথি সাজানো বাসরের প্রত্যেকটা ফুল ধরে ধরে দেখছিল।এই বাসর মিশু আর কলি মিলে সাজিয়েছিল অর্ণব আর কুসুমের জন্য।জুথি একটা গোলাপ হাতে পেছনে তাকাতেই অর্ণবকে দেখে কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’কি দোষ করেছিলাম?এভাবে শাস্তি দেবেন?আমি কতবার ফোন করেছিলাম।আমার সাথে কথা না বলার মৌনব্রত করেছিলেন?লাভ হলো?আমি তো তপন ভাইয়ার থেকে এড্রেস পেয়েই গেলাম।’

অর্ণব মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে।জুথি হাসিমুখে এগিয়ে এসে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই ও দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।জুথি মুখটাকে ফ্যাকাসে করে বললো,’কি হলো?আচ্ছা, আপনাদের বাসায় কারো বিয়ে নাকি?’

অর্ণব মাথা নিচু করে বললো,’হুম।আমার বিয়ে’

জুথি খিলখিল করে হেসে বিছানায় গিয়ে বসে পা তুলে গোল হয়ে বসে বললো,’বউ তো আমি।তা কাকে বিয়ে করলেন?’

-‘যে আমার ভাগ্যে ছিল’

জুথি আবারও হাসছে।একটা হলুদ গোলাপ টেপ থেকে ছুটিয়ে লাল গোলাপের সাথে লাগিয়ে ধরে বললো,’বাসরটা সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।আচ্ছা আমি একটা মেয়েকে দেখলাম,বেশ দেখতে।একেবারে দারুণ!কে ও??’

-“আমার স্ত্রী ‘

জুথি রেগে এবার বিছানা থেকে নেমে বললো,’এটা কেমন মজা করা?একদম এমন মজা করবেননা।আমার সত্যি সত্যি মনে হয়।
ভাল্লাগেনা এমন মজা।চলুন আমার সাথে বাকিদের পরিচয় করিয়ে দেবেন’
—-
-‘ও এতক্ষণ ঐ মেয়ের সাথে কিসের কথা বলে?মেয়েটা কে জানো?’

-‘না তো জানিনা।কুসুমকে পাঠাবো ওর রুমে?’

-“না থাক।হতে পারে মেয়েটা ওর ভার্সিটির কেউ।কুসুম আবার অন্য কিছু ভাবতে পারে।তুমি এক কাজ করো মিশুকে বলো কুুসুমকে যেন কাজে ব্যস্ত রাখে।আমি দেখছি বিষয়টা কি’

অর্ণবের বাবার কথা শুনে মা চলে গেলেন কুসুমকে আনতে।।

অর্ণব কি বলবে না বলবে তার মাথা কাজ করছেনা কিছুতেই।জুথির চোখ তাকে কিছু বলতে দিচ্ছেনা।জুথি এরই মাঝে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেললো।মুখটা অর্ণবের পাঞ্জাবিতে ডুবিয়ে বললো,’অনেক বেশি ভালোবাসি।আর কষ্ট দেবেন না প্লিজ।আমার সহ্য করার এত ক্ষমতা নেই।অনেক কষ্ট দিয়েছেন কাল থেকে।আর মনে হয় একটু কষ্ট পেলে মরেই যাব’

অর্ণব জুথিকে বুক থেকে সরিয়ে দূরে ঠেলে দিলো।জুথি এবার ঘোর থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে গেছে।ছলছল চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,’আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন এটা আপনার বাসর না!!তাকান!’

অর্ণবের চোখ দিয়ে পানি টপটপ করে নিচে ফ্লোরে গিয়ে পড়ছে।জুথি চিৎকার করে বাসরের সব ফুলগুলোকে ছিঁড়ে ফেললো এক টানে।পুরো বাসর ছিন্নভিন্ন করে নিচে বসে গেছে সে।চিৎকার শুনে বাবা ভেতরের রুম থেকে ছুটে এসে এমনটা দেখে চোখ কপালে তুলে ফেলেছেন।
অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললেন,’কে ও?’

অর্ণব কিছু বলতে পারছেনা।জুথি কাঁদছে নিরবে।মাথাটা বিছানায় ঠেকিয়ে রেখে।কুসুম ছাদে কলির সাথে দৌড়াদৌড়ি খেলছিল।তার মনে নেই জুথির কথা।

-‘কি হলো বলছিস না কেন?মেয়েটা কে?’

-“আমার……আমার..!আমার অনেকদিনের একটা অল্প সময়ের অনুভূতি।যার নাম নেই আমার কাছে।শেষ হয়ে গেছে কাল রাত আটটা পনেরো মিনিটে।এর নাম আমার কাছে নেই।জিজ্ঞেস করোনা’

জুথিকে কাঁদতে দেখে বাবা এক পা একা পা করে এগিয়ে এসে বললেন,’মা তুমি কাঁদছো কেন?’

জুথি কান্নার কারণে কিছু বলতে পারছেনা।বাবা চুপ করে চলে আসলেন রুম থেকে।মা এসে বললেন কুসুম মনে হয় ছাদে।বাবা মাকে কড়া করে বলে দিলেন কুসুম যেন নিচে না আসে।
অর্ণব জুথির কাছে এসে বললো,’আমায় ক্ষমা করবেনা জানি।কিন্তু ঘৃনা করোনা।আমি হেল্পলেস ছিলাম। আমার হাতে চয়েস ছিলো না জুথি।ভাগ্যের সাথে হেরে গেছি।কুসুম আমার স্ত্রী হবার ছিল।তিন বছর ধরে আমি অনেক করেও শেষে হেরেই গেলাম।তুমি এভাবে কেঁদোনা।আমি অপরাধ করেছি যদি তবে শাস্তি দাও।মাথা পেতে নেবো।কিন্তু এভাবে কেঁদোনা।আমি তোমার চোখের পানি দেখবার ভয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না এতসময় ধরে।জুথি শুনতে পারছো?’

জুথু নিচের থেকে উঠে দাঁড়ালো।অর্ণবের চোখে চোখ রেখে বললো,’যেদিন ভালোবাসলাম, সেদিন বিচ্ছেদ দিলেন??হয়ত আমি অভিশাপ দেবো না কাউকেই।কিন্তু আমার মনের উপর তো আমার নিয়ন্ত্রন নেই।সে যদি ছুটে আসে বারবার,,সে যদি আপনার সংসারে ভাঙ্গন করতে চায়,সে যদি সহ্য করতে না পারে!!
সে যদি অভিশাপ দেয় তবে আপনি আমায় মাফ করে দেবেন।প্লিজ মাফ করে দেবেন!আমাকে এড়িয়ে যাবেন।কারণ জুথি জীবনে একবারই ভালোবেসেছিল।আর সেটা আপনাকে!
প্রথম ভালোবাসা জুথি ভুলবেনা।সরি!আপনার মৃন্ময়ী ভুলবেনা!কোনোদিন ভুলবেনা।মরে গেলেও না।’

এবার জুথি চলে যাওয়া ধরতেই অর্ণব ওর সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললো,’এভাবে কেন বলছো?তোমার কি মনে হয় আমি জেনে শুনে বিয়েটা করেছি?পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে করেছি।বিশ্বাস করো!যদি বিয়েটা না হতো তবে এই বাসরের বধূ তুমি হতে’

জুথি মাথা তুলে বললো,’কিন্তু আমি তো হইনি!হয়েছে তো অন্য কেউ।তাহলে কেন কি হতো না হতো তা বলে আরও কষ্ট দিচ্ছেন?’

কথাটা পুরো বলতে না পেরে জুথি অর্ণবের পাঞ্জাবিটা খাঁমছে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,’একবার বলুন আপনি মজা করতেছেন।একবার বলুন এই বাসর আপনার না!’

অর্ণব জুথির মাথায় হাত দিয়ে ওকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বললো,’আমার কিছু বলার নেই।ভালো থেকো।মৃদুলকে বলছি তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেবে’

জুথি পিছিয়ে গেলো।হাতের সাথে লেগে অর্ণবের টেবিলের ফুলদানিটা পড়ে ভেঙ্গে গেছে।
জুথি চোখ মুছতে মুছতে বললো,’কথা ছিল সাজিয়ে ফেরাবেন ঢাকায়।আজ আমার কাজল লেপটে, সাদা শাড়ীতে নোনতা অশ্রু মিশে যে বর্ণ হয়েছে এমন সাজের কথা ছিল তাহলে?
মৃন্ময়ী নিজের খেয়াল নিজে রাখতে জানে।তার কারোর প্রয়োজন নেই।অল্প সময়ের জন্য যে মনে সাড়া জাগাতে এসেছিল তার বড্ড প্রয়োজন ছিল,কিন্তু আজ সে অন্য কারোর।
সে মৃন্ময়ীর না।তবে তাই হোক। মৃন্ময়ী একাই সব পারবে।শুধু একটা কথাই বলবো,কখনও আমার কল আর রিসিভ করবেননা।এটা ঠিক না।কখনও আমার সাথে দেখা হলে চোখে চোখ রাখবেননা।আমি চাইনা আপনি ঐ মেয়েটার সাথে অন্যায় করুন।ঠিক বললেন।আজ আমিও ভাগ্যের সাথে হেরে বসে আছি।আমি ফেল করেছি।’

জুথি দুহাত দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে অর্ণবের পাশ দিয়ে চলে গেলো।
ওর মা বাবা বাহিরের রুমেই ছিলেন।জুথিকে চলে যেতে দেখে তারা এবার অর্ণবের দিকে তাকালেন।অর্ণব মূর্তির মতন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কুসুম কলির সাথে খেলার ছলে নিচে নেমে এসে যখন দাঁড়ালো তখনই জুথি চলে যাচ্ছিলো।
যখন সে এসেছিল তখন তার চোখের কাজলের টানটা কি সুন্দরই না লাগছিল আর এখন কাজল লেপটে কেমন হয়ে আছে।চোখ লাল।পাপড়িগুলো ভেজা।
জুথি কুসুমকে দেখে থেমে গিয়েছিল।কুসুম জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে।

জুথির চোখে আবার পানি এসে গেছে।কুসুমকে দেখাতে চাইলোনা।চলে গেলো ওখান থেকে।কুসুম ওর চলে যাওয়া দেখে বুঝতে পারলো ভেতরে কিছু একটা হয়েছে।তাই দৌড় দিলো ভেতরের দিকে।
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here