লীলাবালি🌺 #পর্ব_৬০

0
469

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৬০
আফনান লারা
.
অর্ণব নিজের হাতে সব নিচ্ছে।কুসুমকে কিছু ধরতে দিচ্ছেনা। কুসুম এক পাশে দাঁড়িয়ে ওর এমন ব্যবহারে আশ্চর্য হয়ে আছে।
তার কি হলো ভেবে কূল কিণারা খুঁজেই পাচ্ছেনা সে।অর্ণব ওকে জোর করে চেয়ারেও বসিয়ে দিলো এরই মধ্যে।তারপর লোকমা তুললো মুখের সামনে।কিন্তু সে খেলোনা।গাল ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো এমনটা কেন করে।কি কারণ।
অর্ণব উত্তর দেয়নি।অন্য সময় হলে ধমক দিতো এতক্ষণে।কিন্তু এখন দেবেনা,আর কোনোদিন দেবেনা।

আবারও লোকমা তুলেছে সে।অর্ণবের থেকে কোনো জবাব না পেয়ে সে লোকমাটা খেলো।অর্ণব আবারও কাঁদছে।কাঁদতে কাঁদতে লোকমা সাজাচ্ছে। কুসুমের এবার বড্ড রাগ হলো।রাগের চোটে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’কি সমস্যা? কথা বলছেননা কেন?এভাবে কান্না করার মানেটা কি?আমাকে খুলে বলবেন নাকি আমি চলে যাব এখান থেকে?’

অর্ণব চুপ করে আছে।কোনো কথাই বলছেনা। কুসুম রাগ করে চলে যেতে নিতেই সে হাত ধরে আটকালো ওকে।এবার মুখে খুলেছে।

‘আমার হাতে খেতে ইচ্ছে করেনা তোমার?’

কুসুম নির্বাক।অর্ণবের ব্যবহারে সে বারবার অবাক হয়ে যাচ্ছে।কেন সে এমন করে তার কারণ না জানা পর্যন্ত শান্তির দেখা মিলবেনা।মনের ভেতর এই প্রশ্নটা জট পেকে আসে।
চুপচাপ আগের জায়গায় বসে সে ওর হাতে কয়েক লোকমা ভাত খেয়ে নিলো।অর্ণব নিজে খায়নি।প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এসেছে।
এরপর সোজা রুমের এক কোণায় গিয়ে বসে আছে এখন।
কুসুম দরজার সাথে লেগে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ
শেষে শক্ত গলায় বললো’আমাকে তো জোর করে খাওয়ালেন।নিজে খাবেননা?’

‘পরে’

‘তাহলে আমাকে এত ব্যস্ত হয়ে খাওয়ানোর কারণ কি?আপনি যদি না বলেন তবে আমি এখন এ সময়ে বাসা থেকে বের হয়ে চলে যাব’

অর্ণব ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকালো ওর দিকে।মনে মনে চিন্তা করলো কুসুমকে অসুখের কথা জানানো হয়ত ঠিক হবেনা।তাই কথা কাটিয়ে বললো,’আমার রেসাল্ট খারাপ হয়েছে’

‘তো এত মন খারাপের কি আছে?আসুন খাবেন।আমার হাতে খাবেন?’

‘না।খিধে নেই।যখন খিধে হবে তখন খেয়ে নেবো’
—-
একটা ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে চোখে কাজল লাগিয়ে নিয়েছে জুথি।আজ সন্ধ্যায় তার ফ্লাইট।চলে যাবে অনেকগুলো বছরের জন্য।
ফিরবে কিনা সন্দেহ,তবে বাবার মন রাখতে বলে দিয়েছে এক দু বছর পরেই ফিরবে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে ভেবেছে মৃদুল বুঝি আসবে।মৃদুল ভুলে গিয়েছিল আজ জুথির চলে যাবার দিন।যখন মনে পড়েছে তখন থেকে ঘরমুখো হয়ে আছে।তাই হয়ত রাগ করে আসছেনা।নাহলে ঐ পাগলটার এতক্ষণে দশ বার এসে যাওয়ার কথা।
মুচকি হেসে ব্যাগটা খুলে সব আছে কিনা দেখে নিলো সে।ফরহাদ কান্নাকাটি করছে।সে বায়না ধরেছে বুবুর সাথে সেও যাবে।
জুথি অনেক বুঝিয়ে তাকে শান্ত করলো।আজ কেন যেন যেতে ইচ্ছে করেনা।মৃদুলের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত চোখের সামনে জলসার মতন ভেসে যাচ্ছে।মন বলছে থেকে যেতে।কিন্তু মন কি ভুলে গেছে সে কটাদিন আগে ভেঙ্গে গিয়েছিল?সে ব্যাথা তো এখনও আছে।যতদিন না সে ব্যাথা শুকিয়ে চামড়া উঠবে ততদিন মৃন্ময়ী দেশে ফিরবেনা,ভুলেওনা,কোনদিনও না।’
—-
অর্ণব দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে ছিল।কুসুম এই নিয়ে পাঁচবার খাবারের জন্য ডেকে গেছে।
বাবা কল ব্যাক করেছেন,মৃদুল করেছে।ফোন ছুঁড়ে মারায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে কল আসেনি। কুসুম ফোন খুলতে জানেনা।তাই ফোন এনে বললো’আপনার ফোন তো জ্বলে না’

অর্ণব দেয়াল থেকে মাথা তুলে ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে খুললো।সঙ্গে সঙ্গে মৃদুলের কল এসেছে।রিসিভ করে কুসুমের কথা বলার আগেই সে বলে দিলো আর দু ঘন্টা পর জুথি চলে যাবে।সে যেন একবারের জন্য হলেও এয়ারপোর্টে এসে ওর সাথে দেখা করে যায়।

অর্ণব ফোন রেখে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে কুসুমের দিকে চেয়ে বললো,’ঘুরতে যাবে?’

কুসুম মাথা নাড়ালো।ওকে তৈরি হতে বলে রান্নাঘর থেকে পাউরুটির প্যাকেট নিয়ে বিছানায় এসে বসে দুটো পাউরুটি খেলো সে।বাবার সাথে কথা বলতে হবে এই নিয়ে।বাবা যা বলেন তাই হবে।আমার পক্ষে একা এত কিছু করা সম্ভব নাহ’
—–
এয়ারপোর্টে এসে বাহিরেই দাঁড়িয়ে আছে জুথি।পা চলেনা,মন চায়না,কেউ চায়না আজ সে চলে যাক।অথচ তার দেহ চায় চলে যেতে।আর থাকতে চায়না এই দেহ!

‘মৃদুল ভাইয়া কি আসবেননা?আমার উপর তার এত রাগ?
আমি কি দোষ করেছি?কেন সবাই আমায় দোষী ভাবে?আমাকে কষ্ট দিয়ে তাদের কিসের এত লাভ?একবার দেখা করলে তার ইগো নষ্ট হয়ে যেতো?নাকি ভেলপুরি খেতে গিয়ে যে দেখা হলো সেই দেখাই তার কাছে যথেষ্ট হয়ে গেলো?যাচ্ছি তবে!
আর কোনোদিন মৃন্ময়ী ফিরবেনা।মৃন্ময়ীর ও রাগ আছে,ইগো আছে।সে আর কষ্ট পাবেনা।সবাইকে কষ্ট দেবে। যতক্ষণ না তারা নিজের ভুল বুঝবে ততদিন রাগ দেখাবে সে।ইগোতে অটল থাকবে সবসময়।’

চোখ মুছে পা বাড়াতে যেতেই সামনে এসে দাঁড়ালো এক চেনা মানুষ।ছাই রঙের পাঞ্জাবি তাতে নীল রঙের লেস।বোতাম তিনটে।মানুষটার মুখ দেখা যাচ্ছিলনা।হাতে দুটো হাওয়াই মিঠাই ধরে রেখেছে মুখের সামনে।
জুথি অবাক হয়ে দেখছিল।মৃদুল মুখের সামনে থেকে হাওয়াই মিঠাই সরিয়ে বললো,’একটা তোমার আর আরেকটা আমার না হওয়া শাশুড়ি আম্মুর।নাও ধরো’

জুথি ভ্রু কুঁচকে বললো,’আর কেন আসলেন?কি দরকার ছিল?’

‘চলে যাব?’

‘নাহ।থেকে যান’

মৃদুল হাওয়াই মিঠাই ধরিয়ে দিয়ে বললো,’এখনও সময় বাকি, দাঁড়াও তোমায় কয়েকটা হলুদ গোলাপ কিনে দেই।নব থিয়েটারের সামনে দেখেছিলাম নানা রঙের গোলাপ।হাঁটতে হবে তাও পারবো।জাস্ট কিছু সময় ওয়েট করো।আমি যাব আর আসবো।
হলুদ গোলাপ দিয়ে প্রতিশোধ তুলবো আজ।আমিও কম না’

মৃদুল জুথিকে কিছু বলার সুযোগই দিল না।চলে গেলো ফুল আনতে।জুথি হাওয়াই মিঠাই একটা খুলে খেতে গিয়েও পারলোনা।মৃদুলের চোখে সে পানি দেখেছে আজ।
‘মানুষটা এত কষ্ট কেন পাচ্ছে?আমাকে কেন এত দোষের ভাগিদার করে তুলছে।তাকে কষ্ট দিতে চাইনা বলেই তো ভালবাসিনি।
আমার মন যাকে একবার ভাল বেসেছিল সেই মন তো এখনও সেরে ওঠেনি।তাহলে কি করে ঐ দূর্বল মনটা দিয়ে তাকে ভালবাসতাম?কেন বুঝেননা!’

হাওয়াহ মিঠাইয়ের প্যাকেটটা ফেলতে যেতেই জুথি সামনে দেখলো মৃদুল দাঁড়িয়ে হাওয়াই মিঠাই কিনছে।বিষয়টা ওর কাছে অদ্ভুত মনে হলো।সে তো মাত্রই গেছে হলুদ গোলাপ আনতে তবে আবার হাওয়াই মিঠাই কিনছে কেন?এই তো দুটো কিনে দিলো?মাথা খারাপ হলো নাকি?’

কোমড়ে হাত রেখে জুথি সেদিকে যাচ্ছে এখন।হঠাৎ মৃদুলের অশ্রুভরা চোখ মনে আসায় এগিয়ে গিয়ে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো সে।যেটা কখনও করেনি সেটা আজ করলো।হয়ত মানুষটা এতে করে নিজের মনকে বোঝাতে পারবে।
পিঠে মুখ ডুবিয়ে জুথি বললো,’আই এম সরি।প্লিজ কষ্ট পাবেন না।আমাকে যেতেই হবে।তা কই আপনার হলুদ ফুল?’

যাকে সে জড়িয়ে ধরেছিল সে মানুষটা হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে বললো,’জুথি!’

মৃদুলের জায়গায় অর্ণবকে দেখে জুথি পিছিয়ে গেছে।মৃদুল যে পাঞ্জাবি পরেছিল হুবুহু একই পাঞ্জাবি আজ অর্ণব ও পরেছে।জুথি চিনতেই পারেনি।
অর্ণব কিছুই বুঝতে পারছেনা।জুথি চোখ মুছে বললো,’সরি আমি ভাবলাম…. ‘

‘ইটস ওকে।আপনার বাবা আসেননি?ফরহাদ কোথায়?’

‘দাদা দাদি একা বলে তাদের আসতে দেইনি এতদূর।যেতে যেতে অনেক দেরি হতো তাই আমি একা এসেছি।আপনি কেন এলেন?’

‘মৃদুল থেকে শুনলাম আজ চলে যাচ্ছেন।তাই দেখতে এসেছি’

‘কেন এসেছেন?কি অধিকার আপনার?’

‘জানি অধিকার নেই।তবে কোনো একদিন আপনি আমার ভাল বান্ধুবী ছিলেন।তার জোরে দেখতে আসা।এরপর আবার কবে দেখা হবে কে জানে।দেখতে আসতে তো ক্ষতি নেই।আপনি খুশি হোননি?’

‘বান্ধুবী??
বান্ধুবীকে মানুষ রেস্টুরেন্টে নিয়ে বারবার খাওয়ায়??বান্ধবীকে মানুষ জঙ্গলে হারিয়ে পাগলের মতন খুঁজে?
তার মোহে পরে বলে সাজিয়ে নেবো??বান্ধুবীর কাছে ক্ষমা চায় অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করার পর!!
বান্ধবীর প্রেমে পড়ে নিজের সদ্য বিয়ে করা বউকে দু চোখের বিষ মনে করা হয়??
মিঃ অর্ণব!আপনি আসলে নিজেই জানেননা আপনার কি চাই!!
আপনি পছন্দ আর ভালবাসার ভেদাভেদ জানেননা।আপনি ভালবাসা চেনেননা।
আপনি যেদিন ভালোবাসার ব্যাখ্যা জানবেন সেদিন আপনার জীবনে কোনো ভালবাসা থাকবেনা।একটুও না,ছিঁটেফোটাও না।আমাকে দেখতে আসার এই নাটক না করলেও হতো!হাওয়াই মিঠাই আপনার বউয়ের জন্য নিচ্ছিলেন তাই না?
লজ্জা করেনা??বউকে সাথে নিয়ে প্রাক্তনকে বিদায় দিতে এসেছেন?
আমার জন্য মন পোড়ে আপনার?
কি পোড়ে??এখানে আসার কারণ জানেন?ওহ হ্যাঁ!অর্ণব তো কিছু জানেনা।সে শুধু পরিস্থিতির স্বীকার হতে জানে।আজ কেন চলে যাচ্ছি জানেন?আপনার কারণে!
আপনার স্মৃতি আমার জীবন তছনছ করে দিয়েছে!আমি আর লড়তে পারছিনা এসবের সাথে।বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছি।’

—-
হাতে হলুদ গোলাপ একটা নিয়ে মৃদুল হেঁটে আসছিল এদিকে।জুথির কাছাকাছি এসে হঠাৎ থেমে গেলো।তার সামনে কুসুম দাঁড়িয়ে আছে।তার চোখে পানি।ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই সে সামনে দেখতে পেলো অর্ণব আর জুথিকেও।কুসুম একটু দূরে ছিল।গাছগাছালির আড়ালে।মৃদুল ওদের দুজনকে দেখে বুঝতে পারলো তারা কোনো কথা বলেছে যেটা কুসুম শুনেছে যার কারণে কাঁদছে এখন।
সবটা শুনেছে কিনা কে জানে।ওর কান্না করার কারণ কি?কি বলতেছে ওরা!
ওদের সাবধান করতে সে জোরে হেসে বললো,’কিরে অর্ণব! কখন এলি?’

তখনই জুথি হনহনিয়ে চলে গেলো ওখান থেকে।
অর্ণব মৃদুলের দিকে চেয়ে বললো,’ও চলে যাচ্ছে।ফুলটা দিয়ে আয়।আমি যাই।কুসুম মনে হয় অপেক্ষা করছে’
চলবে♥

জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here