লীলাবালি🌺 #পর্ব_৬১

0
465

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৬১
আফনান লারা
.
কুসুমের কাছে আসার পর অর্ণব ওর হাতে হাওয়াই মিঠাই ধরিয়ে দিয়ে বললো,’আমাকে খুঁজছিলে?’

‘নাহ।দেখছিলাম একটি সুন্দর দৃশ্য।এখানে অনেক সুন্দর সব কিছু’

‘হুম।চলো ফিরে যাই’

অর্ণব হাঁটা ধরেছে।কুসুম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে জুথির চলে যাওয়া দেখলো তারপর ওর ডাকে ছুটে চলে গেলো উল্টো দিকে।
—-
‘জুথি একবার দাঁড়াও।অন্যের উপর করা রাগ আমার উপর কেন দেখাচ্ছো?আজীবন কি আরেকজনের দোষের ভাগিদার আমাকেই হতে হবে?ফুলটা তো নিয়ে যাও অন্তত’

জুথি এবার থেমেছে।কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে একটিবারের জন্য ও তাকায়নি।মৃদুল ওর সামনে এসে ফুলটা ধরে বললো,’আমি ভালবাসি কথাটা বলবোনা।কারণ এটা বললেই যে দুনিয়ায় সব পাওয়া যায় সেটা আসলে মিথ্যে।
পাঁচ বছর আগে একজনকেও একই কথা বলেছিলাম কিন্তু দেখো!আজ নব থিয়েটারের সামনে তাকে দেখলাম স্বামীর হাত ধরে ঘুরছে।কোলে একটি ছেলে বাবু।আমি ওর ভাল থাকা মেনে নিয়েছি কারণ তাকে আমি ভালবাসতাম,সে ভাল থাকুক সেটা অবশ্যই চাই।কিন্তু রাগে ক্ষোভে আমি কখনও ওর স্বামীর কাছে গিয়ে বলার চেষ্টা করিনি সে মেয়েটা কত খারাপ!একটা ছেলের জীবন নষ্ট করে তাকে পথে পাগল বানিয়ে নামিয়ে দিয়েছিল এই মেয়েটি।
তার উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র বড়লোক কাউকে নিজের করে পাওয়া।আমার বাবার মহাখালীতে নিজস্ব দোতলা বাড়ি আছে।সে বাড়ি আমার নামে,মমকে গ্রামের বাড়ি করে দেওয়া।
সেটা অনামিকা জানতোনা।সে জানতো আমি মেসে থাকি তার মানে ঢাকায় আমার বাড়ি নেই, আমি ফকির।গ্রামে থাকা ছেলে।
অথচ বাবার সাথে মন কষাকষি হওয়াতে আমি ঢাকায় বাসা থাকার পরও মেসে থাকতাম।ওকে ইচ্ছে করেই সম্পত্তির কথা জানাইনি।
যাই হোক যার ভাগ্যে যার নাম থাকে আর কি।তোমায় একটা কথা বলি শোনো!অর্ণব এখন বিবাহিত,
তুমি সব জোড়া লাগাতে পারলেও, ও যে বিবাহিত সেই কথা চোখের নজরের বাহির করতে পারবেনা।এটা চিরন্তন সত্য।এটা তোমায় মেনে নিতে হবে তার স্ত্রী আছে।মুখে যা আসে তাই ওকে শুনিয়ে তুমি হয়ত রাগ ঝেড়েছো কিন্তু তাতে কি লাভ হয়েছে? এবার হিসাব করে দেখো।তুমি নিশ্চয় চাইবেনা কুসুম এই সত্য জেনে মন খারাপ করুক?
তোমার আজকের সিন ক্রিয়েটে কোনো লাভ হয়ত হয়নি তবে লস হয়েছে।আর সেটা হলো কুসুম সব শুনেছে।জানিনা তোমরা কি আলাপ করছিলে তবে মেয়েটা আড়ালে কাঁদছিল।তার কান্নার কারণ তোমাদের সম্পর্কের কথা সে আজ জেনেছে।
মেয়েটাকে হয়ত অর্ণব বুঝিয়ে নিতে পারবেনা সেটা আমি জানি।অর্ণব পাথর মনের মানুষ।যা করতে বলে তাই করে কেবল।সে কাউকে বোঝানোর ক্ষমতা নিয়ে আসেনি দুনিয়ায়।
কাউকে বোঝাতে সে পারেনা।তোমাকেও বোঝাতে পারেনি তার সিচুয়েশনটা।তেমনই আজ কুসুমকেও বোঝাতে পারবেনা।যাই হোক, আমি যথাযথ চেষ্টা করবো কুসুম যেন ওকে কখনও ভুল না বোঝে, কারণ অর্ণব খারাপ না একদমই।সে অনেক ভাল মনের মানুষ।তার মধ্যে এমন একটা গুন আছে যেটা দেখে যে মেয়ে কোনোদিন প্রেম করেনি সে মেয়ে প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছে।’

সব কথা শুনে জুথি ফুলটা নিয়ে চলে গেলো।
আর ফিরে তাকালোনা।যেতে যেতে ফুলের পাপড়ির মধ্যে একটা চিরকুট দেখে থেমে গেলো সে আরও একটিবার।হলুদ রঙের চিরকুটটাতে লেখা””””যদি পুরাতন স্মৃতি মুছে নতুন স্মৃতি জায়গা পায় তবে ফিরে এসো।মৃদুল হাওয়া যদি মনে লাগে তবে এসো।সেই হাওয়া অপেক্ষা করে থাকবে””””

সিনএনজিতে যখন অর্ণব আর কুসুম উঠেছিল তখন রাত হয়ে গেছে।কুসুমের বারবার চোখ লেগে আসছিল বলে এক পাশে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুজে ছিল।
অন্যসময়ে কুসুম নিজেই অর্ণবের কাঁধে মাথা রাখতো কিন্তু আজ রাখেনি বলে তার কাছে বিষয়টা অদ্ভুত মনে হলো,পরে ভাবলো হয়ত লজ্জা পায়।তাই সে নিজেই ওর মাথা ধরে কাঁধে রখলো নিরবে।
কুসুম ততক্ষণে জেগে গিয়েছিল।তাই মাথা সোজা করে সরে বসেছে।

‘শরীর খারাপ করছে তোমার?’

‘নাহ’

‘তাহলে মুখ ফুলিয়ে রেখেছো কেন?আজকের ঘোরাঘুরি ভাল লাগেনি?’

‘লেগেছে।বাসায় যাব,বাহিরে আর ভাল লাগেনা’

‘বাসায় যেতে দেরি আছে।পারলে ঘুমাও এখন’

‘ঘুম যে আসবেনা ‘

বাসায় ফিরতে এক ঘন্টার মতন সময় লেগেছে।এই সময়টাতে ভুলেও কুসুম ওর সঙ্গে এক শব্দ কথা বলেনি।অর্ণব ভেবেছে শরীর খারাপ বলে কথা বলছেনা হয়ত।বাসায় আসার পর থেকে বারান্দায় গিয়ে বসেছিল কুসুম।অর্ণব টুকটাক অনেক কাজ করেছে বাসার।কুসুমকে করতে বলেনি।
এরপর বাবার সাথে কথা বললো টিউমার নিয়ে।বাবা বললেন যত দ্রুত সম্ভব ওকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে।তারা সাগর আর মিশু ফিরলে দেখতে আসবে।
অর্ণব ফোন রেখে ওকে ডাকতে বারান্দায় এসে দেখে সে জবা ফুল গাছটার পাতা হাত দিয়ে ধরে দেখছিল।এগিয়ে এসে সে নিজেও কুসুমের পাশে বসে গেলো।এরপর ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,’চড়ুই পাখি খেলবে?’

‘নাহ’

‘কি হয়েছে বলো তো?ঘুমাবে?খাইয়ে দেবো?’

‘আমি নিজের হাতে খেয়ে নেবো।’

‘আমি খাওয়ালে কি সমস্যা? ‘

‘সমস্যা আমি নিজেই।আপনি শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ কেন করছেন?’

‘হুম আমার দোষ নেই।আচ্ছা তাহলে আমিই ঘুমিয়ে পড়ি।তোমার ইচ্ছে হলে খেয়ে নিও’

আর দেরি না করে সে তার কথা টা পূরণ ও করে ফেললো।লাইট অফ করে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।কুসুম অবাক হয়ে গেলো।সে ভেবেছে হয়ত নাটক করবে, কিন্তু না উনি তো সত্যি সত্যি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।সারাটা রাত না খেয়ে থাকবেন নাকি?
‘আমি তো তাও হাওয়াই মিঠাই খেয়ে পেট দমিয়েছি, উনি তো কিছুই খেলেন না।’

ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়াতেই ওর মনে হলো মাথা ঘুরে উঠেছে।দেয়ালে হাত রেখে আস্তে আস্তে অর্ণবের কাছে গেলো সে।ওকে ডেকে বললো খেতে আসতে।অর্ণব ওর কথা শুনেও না শুনার ভান ধরে ঘুমায়।
কুসুম ভাবলো হয়ত সে ঘুমিয়ে পড়েছে।তাই পুরো বাসার সব লাইট বন্ধ করে সেও অর্ণবের এক পাশে এসে শুয়ে পড়েছে।
শুয়ে শুয়ে ভাবছে কাল রাতের কথা।কি সুন্দর করে কাল মাথার উপর হাত দিয়ে রেখেছিলেন তিনি।সেই হাতের ছোঁয়ায় কাল রাতের ঘুম অনেক ভাল হয়েছিল তার।
‘যদি আজও এমন করতেন!হয়ত করবেননা!কেনোই বা করবেন?তিনি তো আমায় ভালবাসেননা।তিনি তো মিননয়ি আপুকে ভালবাসতেন।আর আমি বুদ্ধু এতদিন তার ভালবাসা পাবার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলাম।আমার মতন একটা মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছেন এটাই বা কম কিসের?
কিন্তু একজনের মনে কষ্ট দিয়ে তিনি বিয়ের পিড়িতে বসেছেন জানলে আমি কখনওই কবুল বলতাম না।ইশ কেন জানলাম না আগে।যদি জানতাম তবে এটা হতে দিতাম না।এখন তারা দুজন কষ্ট পাচ্ছে সাথে আমিও।
মিননয়ি আপু তো মনে হয় আমার উপর রাগ হয়ে আছেন।তার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি আমি।বুঝি এ কারণে তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেলেন?আমার কারণে তারা দুজন কত কষ্ট পেলো।আমি তাদের সুখ ছিনিয়ে নিয়ে এখন নিজেও কষ্টে আছি।আসলে আমি তো একটিবারও বুঝতে পারিনি তিনি অন্য কাউকে পছন্দ করেন।বুঝতেও দেননি।অথচ এখন সব দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে যাচ্ছে।
বোঝা গেলো কেন উনি আমায় অপছন্দ করেন,কেন তিনি সবসময় দূরে দূরে থাকেন।আমাকে ভালোবাসার নজরে কেন দেখেননা তার সব উত্তর আজ আমি পেয়ে গেছি।কিন্তু বড্ড দেরি করে ফেলেছি। এগুলো যদি বিয়ের আগে জানতাম!! আজ কাউকেই কষ্ট পেতে হতোনা’

এতগুলো ভাবনা ভাববার সময় কুসুম খেয়াল করলো তার মাথার উপরে অর্ণবের হাতটা ধীরে ধীরে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে নিচ্ছে।তাই চমকে উঠে বসলো সে।চেয়ে দেখলো অর্ণব ঠিক কালকে রাতের মতন এখনও হাত দিয়ে রেখেছে।
গম্ভীর সুরে সে বললো,’ঘুমাননি তাহলে?খাবেন চলুন’

‘নাহ’

‘কেন??’

‘রাগ করেছি’

‘আমি কি করেছি?’

‘তুমি শুধু শুধু রাগ করেছো তাই আমি সত্যি সত্যি রাগ করেছি।হিসাব বরাবর ‘

‘চলুন খাবেন।রাগারাগি পরে হবে’

‘নাহ।আমার এখন ঘুমাতে ইচ্ছে হচ্ছে।খাব না কিছু।শুয়ে পড়ো তুমিও।আর তোমার যদি খেতে ইচ্ছে করে তো বলো আমি খাইয়ে দেবো ‘

কুসুম চট করে শুয়ে পড়লো।দুজনে আবারও চুপ।অর্ণব যে তার হাত নিয়েছিল কুসুমের মাথার পাশে, সে হাত দিয়ে ওর চুলে হাত বুলাচ্ছে এখন।কুসুম চোখ বুজে রেখেছিল।
অর্ণবের গায়ের গন্ধটা খুব কাছ থেকে আসছে আজ।কুসুমের ঘুম কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে ঐ গন্ধ।বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে না পেরে উঠে বসলো সে।তারপর পেছনে তাকিয়ে বললো,”হাত বুলালে আমার ঘুম আসবেনা ‘

‘আমার ছোঁয়া পেতে মরিয়া হয়ে যেতে আর আজ আমাকেই ভাল লাগছেনা?’

অর্ণবের এই কথা কুসুমের বুকে গিয়ে লাগলো।এতটাই কষ্ট পেলো যে ঐ মূহুর্তে কান্না করে ফেলেছে ।
নিজেকে সেতুর মাঝখানে মনে হয়।এদিকে আজকে চোখে দেখা সত্যি আর অন্যদিকে যেটা এতদিন হয়ে আসছিল সেটা।
কোনো কিছুকে আপন করে নিতে পারছেনা সে।এসবের সাথে লড়তে না পেরে কেঁদে ফেললো শেষে।অর্ণব ওকে কাঁদতে দেখে চমকে উঠে বসে আছে।কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।শেষে ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,’কি হয়েছে তোমার বলবে?’

কুসুম চোখ মুছে চুপ করে রইলো। অর্ণব ওকে নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সে ফিরলোনা।
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here