লীলাবালি🌺 #পর্ব_৬৪ আফনান লারা

0
436

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৬৪
আফনান লারা
.
সবচেয়ে দুঃখজনক কিছু ভাবনা ভাববার সময় হঠাৎ করে মুখে নরম কাপড়ের ছোঁয়া লাগায় দুঃখজনকটা মিষ্টিজনক হয়ে দাঁড়ালো।চোখ বুজে আবেশে অর্ণব বললো’ঘাম গালে নয়,গলায়’

কুসুম হাতটা সরিয়ে এবার গলা মুছে দিচ্ছে।
এত ভাললাগা কাজ করছিল অর্ণব ভাষায় প্রকাশ করতে পারছেনা।কুসুম ভালভাবে ওর গলা মুছিয়ে দিয়ে বাহিরের দিকে নজর দিতেই দেখলো কতগুলো স্বরবর্ণ বড় বড় করে লেখা দেয়ালে।
তখন জ্যাম ছিল।সে ভাল করে দেখে বললো,’অ তে অর্ণব,আ তে আমি,ই তে ইলিশ…

‘এ্যাই! তোমাকে এসব শিখিয়েছি আমি?অ তে অজগর শিখিয়েছিলাম, অর্ণব না’

‘অ তে দুটোই হয়।একটা বললে কি সমস্যা? ‘

‘সমস্যা আছে।তুমি অ তে অজগর বলবে’

কুসুম ভেংচি মেরে পড়াই বন্ধ করে দিয়েছে।
—-
সিঙ্গাপুরের Bedok-এ জুথির নানুর বাসা।বাসাতে আসার পর মাকে এখনও দেখেনি সে।মা নানুর সাথে সুপারমার্কেটে গেছেন।চাবি রেখে গেছে প্রতিবেশীর কাছে।জুথিদের প্রতিবেশীও মুসলিম পরিবার।তবে তারা এই দেশের।যা বলে সিঙ্গাপুরের ভাষায় বলে।
জুথিকে দেখে ছুটে এসে চাবি দেওয়ার আগে জড়িয়ে ধরলেন বাসার মালিক মিসেস জুনমি।
উনি আশ্চর্য হয়ে গেছিলেন জুথিকে দেখে।অনেক বছর আগে দেখেছিলেন।এখন জুথিকে প্রায় চেনাই যাচ্ছিলো না।জুথি চাবি নিয়ে সবার কথা জিজ্ঞেস করলো এক এক করে।উনি বললেন তার সাথে তার বাড়ি যেতে ব্রেকফাস্ট করতে।
আপাতত না করে দিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুললো জুথি।মৃদুলের সাথে কথা বলেছিল ট্রেনে বসে।
বাসায় ঢুকে মায়ের গায়ের গন্ধ নাকে আস্তেই চোখ বুজে ফেললো সে।
কতটাদিন পর মাকে জড়িয়ে ধরবে আজ।ব্যাগ রেখে সোফায় বসে টিভিটা অন করে ওখানেই শুয়ে পড়লো লম্বা হয়ে।তখনই সামনে এসে হাজির হলো মোরকো।
মোরকো হলো জুনমির বড় ছেলে।জুথির ছোটবেলার বন্ধু। জুথি ওকে দেখে সোফা থেকে উঠিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।এরপর দুজনে হাত মিলিয়ে কিছুক্ষণ লাফালাফি করলো খুশিতে।মোরকো তো অবাক।জুথি যখন বাংলাদেশে গেছিল তখন সে চিকন, টিনেজ ছিল।আর এখন একেবারে মোটাসোটা ম্যাচিউর হয়ে ফিরে এসেছে।
—–
অর্ণব পকেটের সব টাকা গুনছিল রুমের এক কোণায় বসে। কুসুম সবসময়কার মতন দরজার ফটক ধরে দেখছিল ওকে অনেকক্ষণ যাবত।

অর্ণব টাকা গুনতে গুনতে বললো,’কিছু বলবে?’

‘আমি কি আর বাঁচবোনা?’

‘কে বলেছে এসব তোমায়?অবশ্যই বাঁচবে’

“তাহলে ডাক্তার যে বললেন দেরি হয়ে গেছে’

“ও কিছুনা।ডাক্তার তো কত কিছুই বলে।খাবে কিছু?আমি বাহিরে থেকে খাবার নিয়ে আসবো।আজ আর কারোর রান্নার ঝামেলা মাথায় নিতে হবেনা’

“খেতে ইচ্ছে করেনা।পানির তৃষ্ণা পেয়েছিল সেটা চলে গেছে।আর…

‘আর কি?’

‘নাক দিয়ে আবারও রক্ত গেলো’

অর্ণবের হাত থেকে টাকাগুলো পড়ে গেলো সেসময়ে।ওগুলো গুছিয়ে না তুলে সে পকেটে হাত দিয়ে টিস্যু একটা নিয়ে এগিয়ে আসতেই কুসুম বললো,’মুছে ফেলেছি’

‘কখন হয়েছে এমন?’

‘কিছু সময় আগে’

অর্ণব হাত দিয়ে ওর চুলগুলোকে পিঠের উপর নিয়ে ওর মুখটা ধরে মুছে দিলো।তারপর একটা দোয়া পড়ে ফু দিয়ে একটু বেড রেস্ট নিতে বলেছে।
সকাল থেকে শুয়ে থাকায় কুসুমের এখন বিছানা দেখলেই অস্বস্তি বোধ হয়।তাই বিছানায় বসে রইলো শুধু।অর্ণব তার আগের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।টাকা সব গুনে পকেটে পুরে কুসুমকে বলে চলে গেছে রাতের জন্য খাবার কিনে আনতে।আজ তাদের দুপুরের খাওয়া হয়নি।অথচ তার খিধে নেই একটুও।কুসুম খায়না বলে তারও খাওয়ার ইচ্ছা জাগেনা।
একা একা ওকে নিয়ে বেঁচে থাকতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে ওকে।নিজেকে অনেক অসহায় মনে হয়।
কুসুমের মতন একটা মেয়ের এমন একটা রোগ হয়েছে মেনে নিতে পারছেনা সে।এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
খাবারের অর্ডার দিয়ে হাতের ঘড়িটা উল্টেপাল্টে দেখছিল সে।হঠাৎ মনে হলো কুসুম বুঝি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে?
আন্দাজে একবার দেখার জন্য পেছনে ফিরলো সে।
আন্দাজ যে এতটা সত্যি হবে সে জানতোনা।কুসুম সত্যিই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল।
ও তাকাতেই সরে গেছে।কিন্তু অর্ণব ততক্ষণে ওকে দেখে ফেলে।
খাবার হাতে দোতলায় এসে টেবিলে সেগুলোকে রেখে অর্ণব আজ জবা ফুল গাছটা একবার দেখতে বারান্দায় পা রেখেছে।এমনিতে সে কখনওই বারান্দায় কেবল জবা দেখতে আসেনা।কিন্তু আজ আসলো।
শুধু তাই নয়।একটা জবা ফুল ও ছিঁড়েছে ।ওটাকে হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলো বেডরুমের দিকে।
অনেকদিন আগে দেখা স্বপ্নটা সিনেমার পর্দার মতন চোখের সামনে ভাসতেছে।
এক পা দু পা করে রুমে এসে দাঁড়িয়ে কুসুমকে সেই জায়গাতেই দেখলো।ওয়ারড্রবের কাছে।সে জানালার গ্রিল ধরে বাহিরে দেখছিল।অর্ণব আরও কাছে এসে ওর হাত ধরে নিজের দিকে ফিরালো এক টানে।কুসুম অবাক হয়ে আছে।ওর অবাক হওয়াটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে অর্ণব।লাল টুকটুকে ফুলটা ওর কানে গুজে দিয়ে বললো,’লীলাবালি’

‘কে লীলাবালি?’

‘সেই মেয়েটা।যার কোঁকড়ানো চুল,রুপ তার মোহে ভরা,ঠোঁটজোড়া জানান দেয় জবা ফুলের কলির কথা,যার কানেই কেবল রক্তজবা সাজে!যার চোখের সরলতা বলে দেয় তার শুদ্ধতার পরিমাণ।সে হলো লীলাবালি।আমার লীলাবালি’

‘আপনার?’

‘হ্যাঁ।’

দীর্ঘ উক্তি ছাড়ার পর অর্ণবের যখন হুশ আসলো তখন সে কুসুমের হাতটা ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেলো।তারপর মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়ে বললো,’ভুলে যাও!জানিনা কি বললাম।’

কুসুম কানে হাত দিয়ে ফুলটাকে ছুঁয়ে ওর সামনে থেকে চলে গেলো।অর্ণব কপাল টিপতে টিপতে ভাবছে সেই স্বপ্নের কথা।
কেন সে ফুলটা ধরলো আর কোনো সে ওটা আবার ওর কানে গুজতে গেলো।সেই নামটা লীলাবালি ছিল?
এর মানে তো আমি নিজেও জানতাম না!অথচ গড়গড় করে সবেমাত্র বিশাল সংজ্ঞা দিয়ে ফেললাম।মেয়েটার চোখে কোনো নেশা দ্রব্য আছে, তাকালে ঘোরে পড়ে যেতে হয়।অদ্ভুত এক মায়া কাজ করে!বাবা বুঝি এই কারণে বলেছিল আমি একদিন না একদিন ওর এই মায়ায় পড়তে বাধ্য হবো!
এমন বাধ্য হয়েছি যে, যেই স্বপ্ন দেখে হাঁপিয়ে পড়েছিলাম সেই স্বপ্নটা নিজের হাতে পূর্ণ করে দিয়েছি।যেন কেউ আমাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিলো।কিন্তু!আমার লীলাবালি এটা কেন বললাম?
ধুর!কি হলো আমার!এমন ব্যবহার কেন করছি!এই মেয়েটাকে তো আমি সহ্য করতে পারিনা।তাহলে এতক্ষণ ওগুলা কি করলাম!কেন করলাম!’

কুসুম কানে হাত দিয়ে মুচকি হাসছিল বারান্দায় এসে।অর্ণবের আজকের করা এই ব্যবহার তার সবসময় মনে থাকবে।একটা ফুল দিয়ে যেন এত বিরাট একটা অনুভূতি উপহার দেওয়া যায় তা কেউ উনার থেকে শিখুক।
উনি এত সুন্দর করে কি করে আমার মনটা ভাল করে দিলেন!আমার মন খারাপ তা জানলেন কি করে?’

এক রাশ ভাললাগা নিয়ে কুসুম ফেরত আসতেই দেখলো অর্ণব বসে বসে আফসোস করছে ফুল দেওয়া নিয়ে।মূহুর্তেই তার মন খারাপ হয়ে গেলো।কান থেকে ফুলটা ছুটিয়ে সরে গেলো সে।বারান্দা দিয়ে ফুলটাকে ফেলে দিলো নিচে।এত খারাপ লাগছে যার কারণে ফুলটা তার কাছে থাকাটাই অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।ফুলটা ফেলে দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে সে।
যা ভেবেছিল তাই হচ্ছে।
‘উনি আমার অসুখ দেখে আমাকে দয়া দেখাচ্ছেন।আর আমি ভাবছি উনি আমায় বুঝি সত্যিকারের ভালোবাসেন!মিননয়ী আপুর আর আমার মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ।
ঠিক তো!আমাকে কেন ভালোবাসবেন!কি আছে আমার মধ্যে!এখন আবার রোগ পাতিয়েছি।
এখন তো আমার থেকে উনার আরও দূরে দূরে থাকার কথা।
শুধু শুধু কেন স্বপ্ন দেখিস তুই কুসুম?উনি তোকে আগেও পছন্দ করতেন না।এখনও করেননা।এখন যা করেন তার সব তোর রোগ বলে করেন।নাহলে তোর দিকে ফিরেও তাকাতোনা জীবনে।বুঝেছিস?’

‘এ্যাই মিজুয়ানা!দেখো ওটা কুসুম মা না?’

মিজুয়ানা আর সুলতান শাহ বাগানে বসে চা খাচ্ছিলেন।কুসুমকে হনহনিয়ে বাসা থেকে চলে যেতে দেখলেন দুজনে।মিজুয়ানা চশমা ঠিক করে বললেন,’হ্যাঁ তাই তো।মেয়েটা কই চলে যায়?’

“মনে হয় ওদের রাগারাগি হয়েছে”

‘ঠিক।আচ্ছা ও কি রাস্তাঘাট চেনে?আরে আটকান ওকে।পরে তো হারিয়ে যাবে’

“আমার লাঠিটা পাচ্ছিনা।ও হ্যাঁ মনে পড়েছে,মাত্রই তো জাহানকে দিয়েছিলাম সাবান দিয়ে ধুয়ে আনতে।সে মনে হয় ধুতে গিয়ে কাজল লাগাচ্ছে চোখে।তুমি গিয়ে আটকাও’

‘আমার গায়ে মেক্সি।এটা পরা অবস্থায় রাস্তায় নামবো কি করে?’
——
‘আম্মু দেখো তো!এই ছেলেটা কেমন?’

জুথির মা ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে ভাল করে দেখে বললেন,’পাশেরটা কে?পাশের জন বেশ দেখতে।অবশ্য এটাও সুন্দর।দুজনেই সুন্দর’

‘পাশের জন অর্ণব ভাইয়া।উনি বিবাহিত ‘

‘ওহ!তাহলে এটাও সুন্দর।কেন তোর কি পছন্দ নাকি?’

‘না!মোটেও না।এমনি দেখিয়েছি।বাংলাদেশের ছেলে দেখোনা কত দিন হলো মনে আছে?’

‘আমি দেখে কি হবে?বিয়ের বয়স তো তোর।তা ছেলে কিসে পড়ে?’

‘আমি এত জলদি বিয়ে করছিনা।ছেলে কিসে পড়ে জেনে কি করবে?’

“জেনে রাখি।আমার মেয়ে সচরাচর কোনো ছেলের ছবি আমায় দেখায়না।
এ প্রথম দেখালো।ঘাপলা আছে’

‘উনি আমার ভাইয়া হোন।এমনি দেখাতে পারিনা বুঝি?যাও তোমাকে আর কারোর ছবি দেখাবোনা’

চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here