লীলাবালি🌺 #পর্ব_৬৫ আফনান লারা .

0
443

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৬৫
আফনান লারা
.
‘শুনছো অর্ণব বাবা!’

অর্ণব তার রুমে বসে মাথার চুল টানছিল।মিজুয়ানা আন্টির আওয়াজ শুনতে পেয়ে ছুটে এসে দরজা খুলে দিয়েছে।

“তোমার বউ তো একা একা কোথায় যেন চলে গেছে’

‘কই গেছে?’

‘জানিনা।রাস্তায় নেমে চলে গেলো।জলদি আটকাও।পথঘাট কি চেনে সে?’

অর্ণব ছুটলো নিচে।বাগানে দেখা হয়েছে সুলতান শাহের সাথে।জাহানকে দিয়ে কাপড় আনিয়ে লাঠি শুকাচ্ছেন।
শুকানো শেষে লাঠি ধরে দাঁড়িয়ে বললেন,’পশ্চিম দিকে গেছে বাবা।ধরো জবা ফুল একটা নিয়ে যাও’
—-
কিছুদূর গেলেই একটা দিঘি পড়ে।কুসুম সেখানে ঘাটে বসেছিল।সন্ধ্যা নেমে এসেছে।দিঘির পানি থই থই করছে।কি ভেবে পা ডুবিয়ে বসলো সে।বাড়ির নদীটার কথা মনে পড়ে গেলো।কত সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো।হেসে খেলে দিন যেতো।
‘আচ্ছা!মানুষ কেন কাউকে ভালবাসে?কেন বাসে?ভালবাসে কষ্ট পেতে?আমি কেন ভালবাসলাম!যাকে বাসলাম তিনি অন্য কাউকে ভালবাসেন।হাহ!আমার জীবন!
তরীর মতন।একদিন নিশ্চিত ডুববে।
তাহলে কেন আমার জীবন?কেন আমার জীবনে অল্প সময়ের জন্য সুখ আসলো!যে সুখ আমার নামে লেখাই ছিলনা।এই সুখ মিননয়ি আপুর।আমি কেড়ে নিয়েছি।
নিজের অজান্তে দুটো মানুষের জীবন নষ্ট করে দিয়েছি।
আমি ভীষণ স্বার্থপর।আমি কেন মরিনা!!’

চোখের পানি দিঘির পানিতে ফেলে তাতে পা দুলাতে দুলাতে গান ধরলো সে।

চুকিয়ে দেব বেচা কেনা
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে
তারার পানে চেয়ে চেয়ে
নাইবা আমায় ডাকলে
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
আমি বাইব না
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে গো
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।

গলা শুকিয়ে আসায় গান থেমে গেলে মাঝ পথেই।হাত দিয়ে গলা চুলকে পানিতে এক পা এক পা করে নামলো সে।হাতে ক্যানোলো গাঁথার ব্যাথা আছে তাও সিঁড়ি বেয়ে পানির মাঝখানে গেলো সে।দুহাত দিয়ে চুল ধরে পানিতে ডুব দিলো।অর্ণব কিণারায় থেকে দেখে ভাবলো কুসুম আত্নহত্যা করতে পানিতে নেমেছে।
তা ভেবে সঙ্গে সঙ্গে সে একটা ঝাঁপ দিলো পুকুরে।সাঁতরে ওর কাছে এসে ওকে পানি থেকে তুলে ধরলো।আচমকা চোখের সামনে অর্ণবকে দেখে কুসুম ভয় পেয়ে গেছিল।অর্ণব ওর গালে একটা চড় মেরে দিয়েছে ততক্ষণে।গালে হাত দিয়ে কুসুম বললো,’আমি কি করলাম?’

‘পানিতে ডুবে মরতে চাইতেছো!এত সাহস তোমার!আমি কি করেছিলাম তোমায়?বকেছি নাকি মেরেছি?কি কারণে তুমি এই সন্ধ্যাবেলা একা একা এতদূর চলে এলে?কত খুঁজেছি জানো?তোমার না শরীর খারাপ?পানির মাঝখানে আসার সাহস করলে কি করে? আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তোমার সব কিছুতে’

কুুসুম হাত দিয়ে মুখ থেকে চুল সরিয়ে বললো,’আমি গোসল করতে নেমেছি।নিজ থেকে মরতে চাইবো কেন?’

অর্ণব ওর হাত ধরে কিণারায় নিয়ে আসলো কোনো জবাব না দিয়ে।
এরপর সিঁড়িতে বসিয়ে দিয়ে বললো,’আমি তোমার এই কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না।তুমি নির্ঘাত মরার জন্য পানির মাঝখানে গিয়েছিলে।তা নাহলে এই সময়ে কেউ গোসল করে?’

‘আমার মন ভাল না থাকলে আমি গোসল করি।মাথার ভেতরের জঞ্জাল ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়।নিজেকে হালকা লাগে তখন’

অর্ণব খেয়াল করলো রাস্তা দিয়ে যে এক দু জন মানুষ যাচ্ছে তারা কুসুমকে দেখতে দেখতে যাচ্ছে।সিরিয়ালের নায়কদের মতন তার কাছে জ্যাকেট নেই নায়িকাকে পরিয়ে দেয়ার জন্য।তাই গায়ের সুতির ভেজা পাঞ্জাবিটাই খুলে ওর গায়ে লেপটে দিয়ে বললো,”চলো এখন।বাসায় গিয়ে বাকি বকা বকবো’

কুসুম অর্ণবকে উদম দেখে চোখ নামিয়ে হাঁটা ধরেছে।অর্ণব ওর পিছু পিছু আসতে আসতে বললো,’মানুষ কি বলবে একবার ভেবে দেখেছো?কেন করলে এমন?আমি কি করেছিলাম অন্তত কারণটা দেখাও’

‘আপনি কিছু করেননি।সব আমার কপালের দোষ’

‘আবারও কথা ঘুরাচ্ছো!বলো,কেন বেরিয়ে আসলে?’

কুসুম মাঝ পথে থেমে গেলো।অর্ণবের মুখের দিকো দু মিনিট তাকিয়ে থেকে মুখটা আবারও ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটা ধরেছে।
এর মানে মতলবের কিছুই সে বুঝতে পারেনি।কুসুম কেন এমন করছে তার কারণ সে কল্পনাও করতে পারেনা।
বাসায় আসার পর থেকে কুসুম যে রুমে ঢুকেছে ঐ রুম থেকে বের হয়নি।
অর্ণব গা মুছে শুকনো পাঞ্জাবি পরে দরজার বাহিরে ঘুরঘুর করছে।
ওর যে অসুখ তাতে যেকোনো সময় দূর্বল হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে।এভাবে দরজা বন্ধ করে বসে থাকার মানেটা কি দাঁড়ায়।
কি দোষ করেছি অন্তত সেটা বলুক।কানে ধরে সেই বিষয়টাকে উপড়ে ফেলে দেবো নাহয়।কারণ না বলে রাগ করে থাকলে এটার কোনো বিহিতই হবেনা।
কুসুম!দরজা খোলো!অনেক হয়েছে রাগারাগি।আমাকে বলবে কি হয়েছে?’

দরজা ধাক্কাধাক্কির পর কুসুম এসে দরজা খুলেছে এবার।অর্ণব ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে গাল ফুলিয়ে।কুসুম মাথা নিচু করে সোজা হেঁটে অর্ণবের রুমের দিকে চললো।অর্ণব ওর পিছু এসে পথ আটকে দাঁড়িয়ে দেয়ালে হাত রেখে বললো,’কি হয়েছে বলবা নাকি??’

‘কিছু হয়নি।আমি একটু একা থাকতে চাই’

‘অনেকক্ষণ একা থাকা হয়েছে। আর নয়,এইবার বলবে কি কারণে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছিলে। যদি না বলো তো আমি এখন তোমার বাবাকে কল করে বলবো তুমি এরকম উদ্ভট আচরণ করে বেড়াও আমার সাথে।’

কুসুম চোখ বড় করে বললো,’কি শুনতে চাইছেন?’

‘যেটা সত্যি’

“আমার বারবার মনে হয় আপনি আমাকে দয়া দেখাচ্ছেন।আমার অসুখ বলে সেবার খাতিরে আপ্যায়ন করেন। এর বাহিরে কিছুইনা।ফুল দেওয়াটাও ঐ কারণেই। যার কারণে তখন আফসোস করছিলেন।
আমি চাইনা আপনি জোর করে আমাকে পছন্দ করেন।পছন্দ করেন না এটা খারাপ কিছুনা আমার কাছে।কিন্তু কেন মুখোশ দিয়ে থাকবেন?একটা মানুষ যখন জানে তার সাথে ভাল আচরণ করা ব্যাক্তি গোপনে সেই ব্যবহারে আফসোস করে তখন তার কাছে কেমন লাগে সেটা?
আপনি আমায় আর কোনো দয়া দেখাবেননা।যেমন ঘৃনা করতেন তেমন ঘৃনা করেন অন্তত মনকে বলতে পারবো মিথ্যের মাঝে বেঁচে নেই।’

‘এসব কি বলো তুমি!আমি কোনো নাটক করিনা।তোমার সাথে যে আচরণ করেছি আজ পর্যন্ত সেসব আমি মন থেকে করেছি।রীতিমতে তুমি আমার স্ত্রী। এসব আমি তোমার সাথে করবোনা তো কার সাথে করবো?
এসব তোমার কেন অভিনয় মনে হলো বুঝতেছিনা।

‘অভিনয় না হলে আফসোস কেন করলেন?’

অর্ণবের কাছে এর জবাব ছিলনা বলে সে চুপ হয়ে গেলো।কুসুম ওকে পেরিয়ে রুমের ভেতর চলে গেছে।বাবা বারবার ভিডিও কল দিচ্ছিলেন বলে ফোন নিয়ে নিচে বিছানো তোষকে বসলো অর্ণব।
বাবার পাশে মা ও ছিলেন।অর্ণবকে দেখে মা বললেন,’কিরে বাবা?মুখ ওমন শুকিয়ে আছে লেন?খাস না ঠিকমত?’

বাবা উনাকে থামিয়ে বললেন,”কুসুমের এমন অবস্থায় ও কি করে নিজের খেয়াল রাখবে বলোতো?আচ্ছা অর্ণব কুসুমকে একটু দেখা তো।দেখি মেয়েটাকে’

অর্ণব উঠে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে গেছে।কুসুম সেসময়ে গাল ফুলিয়ে চুলের পানি মুছছিল গামছা দিয়ে।অর্ণব হালকা কাশি দিয়ে ফোন ওর দিকে ধরেছে।কুসুম শাড়ীর আঁচল মাথায় দিয়ে সালাম দিলো দুজনকে।কিছুক্ষণ কথা বলার পর তারা ফোন রেখে দিয়েছেন।কুসুম আবার আগের মতন গাল ফুলিয়ে চুল মুছতে মন দিলো।অর্ণবের ও রাগ হচ্ছিল তাই সে চলে গেছে রুম থেকে।
দুজনে দু রুমে বসে গাল ফুলিয়ে যে যার কাজ করছে।
ঘন্টাখানেক পর কুসুম হঠাৎ মেইন দরজার কাছে এসে দরজা খোলা ধরতেই অর্ণব এগিয়ে এসে দাঁড়ালো সামনে।জিজ্ঞেস করলো এই রাতে কোথায় যাচ্ছে।

“যেখানেই যাই।আপনার কি?বললাম না আমাকে যেমন ঘৃনা করতেন তেমন করেন।’

‘তুমি বেশি করতেছো!কথা শুনবে নাকি সকাল বিকাল থাপড়ানো শুরু করতাম?আমার কথা না শুনলে মানুষটা যদি বয়সে ছোট হয় তবে আমি খুব মারি।তুমি কি বলো?’

‘আমি বাসা থেকে যাচ্ছিনা।মম আপুকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে।আমায় যেতে বলেছে।আর আপনি আমায় মারবেন?মারেন!তখন ও তো মেরেছিলেন।আপনার আঘাতে আমার ব্যাথা লাগবেনা।কিন্তু জোর করে দয়া দেখানোটা ক্ষতের সৃষ্টি করে।’
—–
মৃদুল বারবার ভিডিও কল দিচ্ছিলো।জুথি বাসার ছাদে এসে শুকনো গাছের পাতা জমিয়ে সেগুলোকে হাওয়ায় ভাসিয়ে একটা স্লোমো ভিডিও করছিল কিন্তু মৃদুলের কলের কারণে ভিডিওটা বারবার নষ্ট হচ্ছে।শেষে ছাদে বসে ওর কলটা রিসিভ করলো সে।

‘কি সমস্যা তোমার!!কতবার কল করেছি!দেখো আমি কিন্তু তোমায় কিছুতেই আমায় ভুলতে দেবোনা!!আমি খুব খারাও কিন্তু!!’

‘দিয়েন না ভুলতে।দেশে থেকে কি আর করবেন।কলে এসে দাপট দেখানো ছাড়া আপনার আর কিছু করার নাই’

‘বলো বলো!একবার শুধু দেশে আসার সাহস দেখাও।তোমায় আর যেতে দেবোনা।বেঁধে রাখবো”

‘আমাকে আপনি বাঁধতে জানলে আজ আমি এখানে আসতে পারতাম না।’

‘জানো কুসুমের অসুখ’

কুসুমের নাম শুনে জুথির মুখের ভাবগতি বদলে গেলো।মূলত কুসুমের নামটা অর্ণবের নাম মনে করিয়ে দেয়।দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে বললো,’কি হয়েছে ওর?’

‘ব্রেইন টিউমার!”

জুথি চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ তারপর চিন্তিত হয়ে বললো,’কি অবস্থা এখন?ভাইয়ার কি খবর?’

‘ও তো প্রায় বেহুশ।এত দৌড়াদৌড়ি ওকে আমি জীবনে করতে দেখিনি।অনেক টায়ার্ড লাগছিল,তবে রেস্ট নেওয়ার সময় ও পাচ্ছেনা।হঠাৎ করে কুসুমের এমন রোগ দেখা দিলো।কত হাসিখুশি ছিল মেয়েটা,কে জানতো তার এমন কঠিন রোগ হবে’

জুথির মন খারাপ হলো।সে কখনও কুসুমের খারাপ চায়নি।মেয়েটার মুখে এত মায়া।সেবার অর্ণবদের বাড়ি থেকে চলে আসার সময় শেষবার ওর মুখ দেখে ইচ্ছে করছিল একবার জড়িয়ে ধরে কাঁদতে।এত সুন্দর মেয়েটার এমন কঠিন রোগ কেন হলো।দোয়া করি যেন সে সুস্থ হয়ে ওঠে।
অর্ণব ভাইয়াকে আমি পাইনি বলে সে পাবেনা এমনটা আমি চাই না।সে তো অর্ণবকে পেয়েছে তবে যাতে সারাজীবনের জন্য ওর পাশে থাকতে পারে সেটাই চাই আমি।
ও ভাল থাকুক, তাতে করে অর্ণব ভাইয়াও ভাল থাকবেন।
চলবে♥

জয়েন হোন আমাদের নতুন গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/676436250036874/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here