তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্বঃ ১৪ Writer Taniya Sheikh

0
419

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১৪
Writer Taniya Sheikh

ইসাবেলার ধারণা ঠিক ছিল। ভৃত্যটি ওই পরিত্যক্ত ভূতূড়ে প্রাসাদে থাকে না। বাইরে দাঁড়ানো টমটমটিও ছিল তার। নিকোলাসের কফিনে আগুন ধরিয়ে সে প্রাসাদের বাইরে এসে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে যায়। অপেক্ষা করছিল কোচওয়ানের। ভৃত্যটি একটু পরেই বেরিয়ে এলো। কোচওয়ানের সিটে বসতে ইসাবেলা সাবধানে উঠে পড়ে পেছনে। হামাগুড়ি দিয়ে সিটের নিচে লুকায়। কোচওয়ান ঘোড়ার গায়ের চাবুক মারতে হ্রেষাধ্বনিতে ঘোড়া টমটম নিয়ে ছুটতে শুরু করে।

মাথার ওপর রৌদ্রজ্বল আকাশ। সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। আকাশটা আগে কখনও এত সুন্দর লাগেনি ওর কাছে। মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলো। মুক্তির আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় ওর চোখ দিয়ে।
টমটমগাড়ি সমান্তরাল রাস্তা ছেড়ে ঢালু পথে নামল। গাড়ির ঝাঁকুনির চোটে ইসাবেলার পিঠ টমটমের সিটের নিচের কাঠে খুব জোরে ধাক্কা খায়। ব্যথায় অস্ফুটে গোঙানির দিয়ে ওঠে। পাছে কোচওয়ান ওর উপস্থিতি টের পায় এই ভয়ে হাতের তালুতে সজোরে মুখ চেপে রাখল। ইসাবেলা আশেপাশে দেখার চেষ্টা করছে। সিটের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে মাথা তোলে। ঢালু পথের দু’প্রান্তে গহীন অরণ্য। জানা- অজানা বৃক্ষ, গুল্মলতা চারিধারে । সূর্যের আলো লম্বা লম্বা গাছগুলোর পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে। ইসাবেলা পেছন ফিরে তাকায়। প্রাসাদটা দেখা যাচ্ছে না। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে ও। পেছনের পথটা ভালো করে দেখল। বনের মধ্যে এই একটি পথই দেখা যাচ্ছে। কোচওয়ানের চাবুকের হিস হিস ধ্বনিতে কম্পিত হয়। ঘোড়া অশ্ব ধ্বনি তুলে প্রাণপণে ছুটছে সামনে। যতদূর চোখ যায় বন। লোকালয় তো দূরের ওরা দুজন ছাড়া পথে আর কোনো জনমানব চোখে পড়ল না। বেশ উপভোগ করছে মুক্ত বাতাস ইসাবেলা। ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি। পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য তর সইছে না ওর। গাড়ি যত এগোচ্ছে ততই আনন্দ হচ্ছে। সে মুক্ত আজ। নিকোলাসের বন্দিদশা থেকে সে মুক্ত। আবার আগের মতো স্বাভাবিক হবে জীবন। বাবা-মা, তাতিয়ানা, ভ্লাদিমি আর দাদা-দিদিমাকে কতদিন পরে দেখবে সে! খুশিতে আরেকদফা নীরবে কাঁদল। জঙ্গল থেকে টমটম এবার খোলা মাঠের কাঁচা রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছে। এদিকেও কোনো লোকালয়ের দেখা পেল না। আরো ঘণ্টা খানেকের যাত্রার পর অদূরে দু একটা ভগ্ন গির্জা চোখে পড়ে। কাঁচা রাস্তা শেষ হয়ে কংক্রিটের রাস্তায় উঠল টমটম। মাঝেমাঝে জব, গম আর ভুট্টার খেত চোখে পড়ে রাস্তার দু’ধারে। হঠাৎ টমটম থেমে যেতে হামাগুড়ি দিয়ে সিটের তলায় ঢুকল ফের ইসাবেলা। সিটের তলায় খুব বেশি জায়গায় নেই। ইসাবেলা এই ক’মাসে শুকিয়ে যাওয়ায় আজ সুবিধায় হলো। শরীরটা জড়সড় করে কোনোমতে সিটের তলে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সে জানে কোচওয়ান এখানে এলে সহজে ইসাবেলাকে দেখে ফেলবে। আত্মরক্ষার্থে একটা লম্বা ধারালো কাঁচের টুকরো কাপড়ে পেঁচিয়ে বুকের কাছে লুকিয়ে রেখেছে।

কোচওয়ান সিট থেকে নামেনি। সামনে এক পাল শুয়োর রাস্তা পার হচ্ছে। জংলী শুয়োরকে রাগানো যে বুদ্ধিমানের কাজ নয় ভৃত্যটির তা জানে। তাই তো ধৈর্য ধরে সিটে বসে আছে টমটম থামিয়ে। শুয়োরের পাল রাস্তা পার হতে ঘোড়ার পিঠে আবার চাবুক কষাল কোচওয়ান। ইসাবেলা ফের বেরিয়ে এসে বাইরে বসে। ওই তো দূরে আবছা কতগুলো প্রাসাদের মতো দেখা যাচ্ছে। শস্যের খেত ছেড়ে গাড়ি ঢুকল একটা ট্যানেলের ভেতরে। মুহূর্তে চোখের সামনে সবটা অন্ধকার হয়ে যায়। ইসাবেলার বুক ঢিপঢিপ করছে। কিছুদূর পরে ক্ষীণ আলোর রেখা দেখে স্বস্তি ফিরে পায়। যত এগোচ্ছে লোকের সোরগোল শুনতে পাচ্ছে। আনন্দে আত্মহারা হওয়ার অবস্থা ইসাবেলার। অবশেষে সে লোকালয়ে এসে পৌঁছেছে। কত মানুষ এখানে। এরা মানুষ! ওরই মতো মানুষ! এতক্ষণে নিজেকে নিরাপদ ভাবল সে। টমটম থেমে দাঁড়ায়। আশপাশে আরো কতগুলো টমটম, গরুর গাড়ি আর ঠেলা গাড়ি। কোচওয়ান নামতে ইসাবেলার গলা শুকিয়ে এলো। এই বুঝি এসে দাঁড়ায় সে সামনে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার সে এদিকে এলো না। গাড়ি থামিয়ে সামনের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। ইসাবেলা ধীর পায়ে নিচে নেমে দাঁড়ায়। লোকাল বাজারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে। খুব বেশি মানুষের সমাগম ইসাবেলার কোনোদিন পছন্দ ছিল না। সে ঘরকুনো, লাজুক মেয়ে। কিন্তু আজ এই এত মানুষের ভিড় তাকে আনন্দ দিলো। বোকার মতো হাসছে আনন্দ। আশেপাশে পথচারীদের কয়েকজন কৌতূহলে চেয়ে আছে ওরই দিকে। ইসাবেলা হাসছে হাসতে মাথা নুয়ে তাদের বলছে,

“হ্যালো, হ্যালো।”

কাপড়, তৈজসপত্র, নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী, বিভিন্ন রকমের সবজি-ফল, মাছ, মাংস আর পশু পাখি ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। ক্রেতা-বিক্রেতা দর-কষাকষি করছে। ওদের ভাষা ইসাবেলা বুঝতে পারল না। হাবভাবে আন্দাজ করে নিচ্ছে। সামনে এগোতে নাকে এসে লাগে ভাজা মাংস আর ভোদকার ঘ্রাণ। পেট গুরগুর করে ওঠে খিদেতে। হাতে টাকা নেই। মুখটা মলিন করে এগিয়ে যায় সামনে। কতগুলো মেয়ে ভারি মেকাপ আর রঙচঙে ছোটো পোশাক পরে ঢলে ঢলে গল্প করছে পুরুষদের সাথে। পাশেই বড়সড় দ্বিতল কাঠের বাড়ি। দুটো মেয়ে গলা জড়িয়ে দুজন পুরুষকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। ইসাবেলা জানে ওরা কোথায় গেছে। ওই বাড়িটার সামনে দিয়ে যেতে ভেতরে নাচ- গানের জোরালো শব্দ শুনতে পায়। কয়েকটি মেয়ে হেসে ওর দিকে তাকাতে দ্রুত পা চালিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। পাশে শুয়োর, গরু, ভেড়া আর হাঁসের মৃতদেহ ঝুলানো একটি দোকানে। কসাই ইসাবেলার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে হাতের বড়ো মাংস কাটার ছুরি দিয়ে ভেড়ার মাথাটাকে দুভাগ করে ফেলে। ইসাবেলা ভয় পেতে পৈশাচিক হাসি ফুটে ওঠে কসাইয়ের পুরু মোছের নিচের ঠোঁট দুটোতে। ভয়ে তাড়াতাড়ি সে স্থান ত্যাগ করে ইসাবেলা। এদিক সেদিক উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে লাগল। কয়েকজন মহিলার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু ওরা ইসাবেলার ভাষা বুঝল না আর না ইসাবেলা ওদের ভাষা বুঝল। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের এক স্থানে মানুষের জটলা দেখে। কৌতূহলে সেদিকে যায়। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। দাস কেনা-বেচা হচ্ছে এখানে! ঠিক আদিম বর্বর যুগের মতো। নিজের বয়সের কতগুলো মেয়েকে দেখল সে। মেয়েগুলো ভয়ে কাঁপছে। পরনের সাদা জামা স্থানে স্থানে ছেঁড়া। পেছনে হাত বাঁধা। দাম হাঁকাচ্ছে টেঁকো, মোটা অসুরের মতো দেখতে একজন ত্রিশোর্ধ পুরুষ। একটা মেয়েকে কিনে নিলো বৃদ্ধ, কদাকার এক লোক। টাকা দেওয়ার সাথে সাথে যুবতি মেয়ের বুকের সামনের কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলল। তা দেখে সমস্বরে উল্লাস করে ওঠে উপস্থিত অনেক যুবক আর মধ্য বয়সী পুরুষ। মেয়েটা কাঁদছে ভয়। বৃদ্ধের দয়া তো হলোই না উলটো জনসমক্ষে যুবতি মেয়েটার ওপর যৌন নিপীড়ন চালাতে লাগল। বুভুক্ষু কুকুরের মতো মেয়েটাকে কামড়ে, খামচে ধরেছে সে। মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে ওই জঘন্য দৃশ্য। কেউ প্রতিবাদ করছে না, সাহায্যও করছে না। ইসাবেলা এ দৃশ্য সহ্য করতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এলো। মেয়েটার মুখটা বার বার চোখের সামনে ভাসছে ওর। দাস প্রথার গল্প ও কেবল দিদিমার কাছে শুনেছে। কিন্তু এই প্রথার এমন নিষ্ঠুর ভয়াবহতা দেখে ভীতসন্ত্রস্ত সে। নিকোলাসকেই শয়তান ভেবেছিল অথচ, ওর চেয়েও বড়ো শয়তান মানুষের রূপ ধরে আশেপাশেই রয়েছে। ওর মন চাচ্ছে বুড়ো শয়তানটাকে পায়ে পিষে মারতে। ইসাবেলা জানে নিজের অসহায়ত্ব। মুখ খুললেই বিপদে পড়বে সে। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে নারীর গুরুত্ব কেবল বিছানায় আর ওই দাসীবৃত্তিতে। আওয়াজ তুলতে গেলেই নারীকে সহ্য করতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগের। যদিও ইসাবেলার পরিবার এক্ষেত্রে অনেকটাই ভিন্ন। ওর বাবা ওলেগ মেয়েদের ওপর কখনও জোর করে কিছু চাপিয়ে দেননি। জোর যদি একটু আকটু খাটিয়েছেন তবে তিনি ওর মা আন্না মেরিও। কিন্তু সেই জোরে ভালোবাসা ছিল।

“হেই”

ইসাবেলার ভাবনায় ছেদ পড়ে একজন ভদ্রমহিলার মহিলার গলার স্বরে। পরনে জার্মানির ট্রেডিশনাল dirndl। সাদা কুঁচি গলার ব্লাউজ, লং খয়েরি স্কার্ট আর সবুজ এপ্রোন। চুলগুলো ডানপাশে খোঁপা। তাতে আবার তিনটে বড়ো বড়ো তাজা গোলাপ লাগানো। মুখে গাঢ় মেকাপের প্রলেপ, ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। হাতের জরিদার লাল কাপড়ে কারুকাজ করা পাখাটা নাড়াতে নাড়াতে হাসি মুখে সামনে এসে দাঁড়ালেন। দেখে মনে হলো কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের রমণী।অজানা ভাষায় ইসাবেলাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ইসাবেলা এদের ভাষা বোঝে না। সে বোকার মতো তাকিয়ে রইল ভদ্রমহিলার মুখের দিকে। ভদ্রমহিলা জবাব না পেয়ে ওর আপাদমস্তক ভালো করে দেখে সংশয় মুখে ইশারায় বুঝাতে চেষ্টা করলেন,

“তুমি স্থানীয় নও?”

ইসাবেলা বুঝতে পেরে মাথা ঝাঁকায়। ভদ্রমহিলা হাসলেন আবার। ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন,

“কোথাকার?”

“রিগা।”

“রিগা?”

“রাশিয়া।”

ভদ্রমহিলা অবাক হলেন।

“রাশিয়া!”

ইসাবেলা সামনে পেছনে মাথা নাড়ায়। ভদ্রমহিলা একটু ভাবুক হয়ে আন্তরিক গলায় ভাঙা ভাঙা রাশান শব্দে বললেন,

“সে তো অনেক দূরে।”

ভদ্রমহিলার কণ্ঠে নিজের মাতৃভাষা শুনতে পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ইসাবেলা প্রশ্ন করল,

“আপনি রাশান জানেন?”

ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়

“একটু একটু। তা এতদূরে এলে কী করে? সঙ্গে তো কাওকে দেখছি না। ও ঈশ্বর, বলো না একা এসেছ?”

ইসাবেলা কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। অপরিচিত কাওকে সব ঘটনা খুলে বলতেও দ্বিধান্বিত সে। কিন্তু রিগা পৌঁছাতে হলে কারো না কারো সাহায্য তো তাকে নিতে হবে। এখানকার লোকগুলো কেমন অদ্ভুত করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওর মুখের ভাষাও তো এরা বুঝবে না। ভাগ্যিস ঈশ্বরের করুণায় ভদ্রমহিলার দেখা পেল। কিন্তু তাঁকেও তো হুট করে বিশ্বাস করা যায় না। কী করবে এখন ইসাবেলা? সব খুলে বলবে? না কি মিথ্যা বলবে?

“এই মেয়ে, কোথায় হারিয়ে গেলে?” ভদ্রমহিলা ওর মুখের সামনে হাত নাড়ালেন।

“জি, মানে।”

ভদ্রমহিলা ওর হাত ধরে বললেন,

“তোমার চেহারা বলে দিচ্ছে খারাপ কিছু ঘটেছে তোমার সাথে। আমার ঘরে চলো। সেখানে গিয়েই সব শুনব। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা নিরাপদ নয়।”

“আপনার ঘর? এখানে?”

ভদ্রমহিলা হাসলেন। আঙুল তুলে সামনের সেই পতিতালয়ের দিকে লক্ষ্য করে বললেন,

“ওই তো আমার ঘর। চলো।”

ইসাবেলা নড়ে না। ও জানে ওখানে কী হয়। তাতিয়ানা বলেছে ওকে। ভদ্রমহিলা ওর মুখ দেখে বুঝলেন ব্যাপারটা। ইসাবেলার গালের এক পাশে হাত রেখে বললেন,

“ভয় নেই। ওখানে তুমি আমার মেহমান হয়ে যাবে। কেউ কিচ্ছুটি করবে না। এসো।”

ইসাবেলা তবুও নড়ে না। ভদ্রমহিলা হাঁপ ছেড়ে বলেন,

“আমাকে বিশ্বাস করা ছাড়া তোমার উপায় নেই মেয়ে। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে ওরা তোমাকে তুলে দাসী হিসেবে নিলামে তুলবে।” চোখের ইশারায় পেছনের দুজন লম্বা, পেটমোটা পুরুষ দুটোকে দেখালেন। ইসাবেলার দিকে লালসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরা। ইসাবেলার আর্ত মুখ দেখে ভদ্রমহিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন,

“আমার ঘরে জোর নেই। কিন্তু ওরা তোমাকে জোরপূর্বক যা করাবে তা আর নাই বললাম। দেখেছ তো ওই মেয়েটির সাথে কী করেছে, হুম?”

মহিলার আসল রূপ এতক্ষণে প্রকাশ পেল ইসাবেলার সামনে। ও জানে না গাড়ি থেকে নামার পর পরই এই মহিলার নজরদারিতে পড়েছিল। বেশ চতুর তিনি। কী করে মানুষকে বশে আনতে হয় খুব জানা তাঁর। ইসাবেলার দু’দিকেই বিপদ। কীভাবে বাঁচবে এই বিপদ থেকে। সে জানে চিৎকার করে কোনো লাভ হবে না। কেউ আসবে না সাহায্য করতে। ভদ্রমহিলা শক্ত করে চেপে ধরলেন ওর পেলব ডান হাতটা। টানতে টানতে গণিকালয়ের দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। ইসাবেলা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পেরে উঠছে না।

“ছাড়ুন আমাকে, প্লিজ ছাড়ুন।”

“চুপ করো মেয়ে। একদম চুপ। চিৎকার করলে তোমারই বিপদ।”

ইসাবেলাকে নিয়ে দাঁড়ালেন জলসা ঘরের পাশে। গণিকালয়ের জলসায় তখন চলছে উদ্দাম বেলেল্লাপনা। অর্ধ নগ্ন নর-নারীর অশ্লীল হাসি ঠাট্টা আর শীৎকারে ইসাবেলার কান লাল হয়ে ওঠে। চোখ নামিয়ে ফেলে লজ্জায়। মহিলা অট্টহাসি দিয়ে বলে,

“তুমি তো দেখছি ভারী লাজুক। এত লজ্জা পেলে হবে? ওদিকে দেখো চোখ তুলে, দেখো।”

ইসাবেলার চিবুক শক্ত হাতে তুলে ধরে জোর করে সামনে তাকাতে বাধ্য করেন। ইসাবেলা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে,

“আপনি বলেছেন জোর করবেন না? কেন এমন করছেন আমার সাথে? আমাকে যেতে দিন। প্লিজ!”

“জোর তো করছি না। জোর করা কাকে বলে তুমি ওই দাস বেচার নিলামে দেখেছ তো। আমি তো কেবল তোমাকে বাস্তবতা দেখাচ্ছি।”

ইসাবেলা হাত ছাড়িয়ে কাতর গলায় বলে,

“আমি এসব নোংরা স্থানে থাকতে পারব না। এখনই এখান থেকে চলে যাব।”

“চলে যাবে? কোথায় যাবে? রাশিয়ায়? জানো বর্তমানে কোথায় আছো তুমি? জার্মানির একটা ছোট্ট শহরের বাজারে। যেখানে দিনের আলোতে চলে দাস কেনা-বেচা। তোমাকে ওরা দেখে ফেলেছে মেয়ে। এই দরজা পার হতেই থাবা মেরে ধরবে। কেউ আসবে না বাঁচাতে। তারপর কী করবে জানো? ওই ষাঁড়ের মতো তাগড়া পুরুষ দুটো ছিঁড়ে খাবে তোমাকে। ওদের চাহিদা মিটে গেলে পশুর মতো টানতে টানতে নিলামে তুলবে। তারপর তো কী হয় দেখেছ।”

“আমাকে যে ভয় দেখাচ্ছেন সেই একই কাজ তো আপনি নিজেও আমার সাথে করবেন। ওদের আর আপনার মধ্যে পার্থক্য কোথায়?”

“পার্থক্য? পার্থক্য তো আছে মেয়ে। ওদিকে তাকাও।” সামনে মিলনরত এক যুগলকে দেখিয়ে বলেন,

“মেয়েটার মধ্যে কি ভয়, ডর দেখতে পাচ্ছ? হাসছে ও। আনন্দে হাসছে। আমার ঘরে সকলে আমোদে মেতে থাকে। আমি কাওকে কিছুতেই জোর করি না। দেখো কাওকে কি জোর করছি? সবাই নিজের মতো আমোদে-প্রমোদে মেতে আছে। পৃথিবীর খেয়াল নেই কারো। এই ঘরে দুঃখ নেই, কষ্ট নেই। কেবল আনন্দ আর আনন্দ। তোমার সকল দুঃখ ভুলে যাবে এখানে থাকলে। থাকবে না মেয়ে?”

“না, আপনার এই আনন্দ নোংরা, কদর্য। ঘৃণা হচ্ছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। যেতে দিন আমাকে।”

“বড্ড জেদি তুমি মেয়ে। আচ্ছা যাও। ও হ্যাঁ, এখান থেকে বেরোনোর পথ জানা আছে তো?”

“জেনে নেবো।”

ইসাবেলা মুখ কঠিন করে ঘুরে দাঁড়ায়। দরজার বাইরে পা দিতে সেই দুজন পুরুষ দেখে থেমে গেল। ওকে বেরোতে দেখে এদিকেই আসছে। বুকে লুকানো কাঁচের টুকরোর কথা স্মরণ হয় ওর। কিন্তু এই সামান্য কাঁচের টুকরোতে কী আত্মরক্ষা হবে? মহিলা ফিসফিস করে বলল,

“যাও।”

ইসাবেলা ভেতরে ফিরে আসে আবার।

“প্লিজ আমাকে এখান থেকে যেতে সাহায্য করুন। আমি কথা দিচ্ছি রাশিয়া পৌঁছে বাবাকে বলে আপনাকে অনেক টাকা পাঠাব। সাহায্য করুন আমাকে। আপনার পায়ে পড়ছি।”

মহিলার পায়ের পড়ে ইসাবেলা।

“আরে আরে করছ কী? মেয়েদের অসহায়ত্ব আমি মোটে সহ্য করতে পারি না। ওঠো, ওঠো।”

“আমি আপনার মেয়ের বয়সী। আপনার মেয়ে হলে কি এমন করতে পারতেন বলুন?”

“না।” গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন মহিলা। ইসাবেলা আশার আলো দেখল যেন। মহিলার হাত চেপে ধরে বলল,

“আমাকে সাহায্য করুন মা। আমি আপনাকে মা ডেকেছি। মেয়ে ভেবে আমাকে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করুন মা।”

মহিলা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গম্ভীরমুখে বললেন,

“প্রথমত, আমি মা ক্যাটাগরির না। দ্বিতীয়ত, তোমাকে সাহায্য আমি এক ভাবেই করতে পারব। যা আগেই বলেছি।”

ইসাবেলা ক্ষোভে ফেটে পড়ে,

“আপনি নারী নামের কলঙ্ক। ছল করে, অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে গণিকাবৃত্তি করানোকে সাহায্য বলে না। স্বার্থসিদ্ধ হাসিল বলে। কী পাবেন এসব করে? টাকা? টাকার জন্য সব করতে পারেন? সব? কারো চোখের জলে কিছুই এসে যায় না আপনার?”

“তোমার এসব বাজে প্যাঁচাল শোনার সময় আমার নেই। থাকলে থাকো নয়তো দরজা খোলা আছে চলে যাও। জোর করে টেনে এনেছি বলে জোর করে বের করে দেবো না। থাকা না থাকা তোমার ইচ্ছে।”

মহিলা পাখায় বাতাস করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। ইসাবেলা দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। দরজার বাইরে লোলুপ চোখে পুরুষ দুটো এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ইসাবেলা অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে উপায়ন্তর না পেয়ে মহিলার কাছে গিয়ে আরেকবার অনুনয় করার সিদ্ধান্ত নিলো। তিনি বলেছেন জোর করবেন না। কিন্তু এখানে থাকা মানেই গণিকা হয়ে যাওয়া। এই অসম্মানজনক জীবনের চাইতে নিকোলাসের মৃত্যু পুরীই ভালো ছিল। পৃথিবীটা এত জটিল কেন? কেন বার বার বিপদ ওর সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। মায়ের সেই নিরাপদ আঁচল আজ বড়ো মনে পড়ছে ইসাবেলার। কবে ফিরতে পারবে মায়ের আঁচলের ছায়াতলে? আর যে পারছে না।
হঠাৎ সামনে থেকে পালোয়ান গোছের একজন যুবক এসে ইসাবেলার হাত ধরে করপুটে চুম্বন দেয়। ভয়ে ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিলো ইসাবেলা। তারপর একছুটে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলো। মহিলা দোতলার মাঝের ঘরের বড়ো সোফাতে বসে সিগারেট ফুঁকছেন। ইসাবেলাকে দেখে চমৎকার হাসি দিলেন। আশেপাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে নর-নারীর শীৎকার। কানে হাত দিয়ে মহিলার সামনে এসে দাঁড়ায় ইসাবেলা। হাঁটু ভেঙে বসে বলে,

“আমি এসব পারব না বিশ্বাস করুন। একটু করুনা করুন আমার ওপর।”

“আবার সেই ন্যাকামি? উফ! বড্ড জ্বালাচ্ছ মেয়ে তুমি। আরে একদিনে কেউ কিছু পারে? এখানে থাকতে থাকতে সব শিখে যাবে। ওঠো, কতবার বলব মেয়েদের অসহায়ত্ব আমি চোখে__” মহিলা হঠাৎ থেমে গেলেন। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,

“নিকো, বাবু আমার, অনেকদিন পরে এলে আমার ঘরে।”

“কর্নেলা।”
পরিচিত গলার স্বর শুনতে পেয়ে ইসাবেলা চকিতে তাকাল পেছনে। জানটা লাফ দিয়ে যেন গলায় উঠে এসেছে সামনের পুরুষটাকে দেখে। হুডিওয়ালা লম্বা কালো কোট পরে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস। হুডি ঠেলে ফেললো কাঁধে। চোয়াল কঠিন, দৃষ্টি পাথরের মতো স্থির। শুকনো ঢোক গিললো ইসাবেলা। ভাবছে, কী করে বেঁচে গেল নিকোলাস? এবার বুঝি রক্ষা নেই ওর। আতঙ্কিত গলায় অস্ফুটে বলল,

“নিকোলাস!”

কর্নেলা শুনতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন ইসাবেলার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন,

“নিকোকে চেনো তুমি?”

ইসাবেলা জবাব দেওয়ার আগেই নিকোলাস প্রশ্ন করে,

“কে এই মেয়ে? নতুন আমদানি? দেখতে কিন্তু বেশ , কর্নেলা।”

কর্নেলা নাম্নী মহিলা হাসলেন। ইসাবেলা চোখ মুছে কপাল কুঁচকে তাকায়। কেন যেন নিকোলাসের এই না চেনার ভানে মন খারাপ হয়ে গেল। মনের অজান্তে হয়তো ভিন্ন কিছু আশা করেছিল। দাঁত কটমট করে ঠোঁট নাড়িয়ে অনুক্ত স্বরে বলে,

“হারামজাদা, আমার রক্ত খেয়ে এখন আমাকেই চেনে না।”

ওর ঠোঁটের ভাষা বোধহয় নিকোলাস পড়তে পেরেছে। বা’ ভ্রু তুলতে ইসাবেলা মাথা নুয়ে ফেলে।
মহিলা ঢলতে ঢলতে নিকোলাসের গালে চুমু দিয়ে বললেন,

“তা বলো তোমার খাতির যত্ন আজ কীভাবে করব?”

“এখানকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে পাঠাও আমার ঘরে।”

কর্নেলা ইসাবেলার দিকে তাকাতেই নিকোলাস বলে ওঠে,

“ও নয়। ওকে আমার পছন্দ না। অন্য কাওকে পাঠাও কর্নেলা।”

“এখনই পাঠাচ্ছি। ওই রুমে গিয়ে অপেক্ষা করো বাবু।”

নিকোলাসের গালে চুমু খেয়ে কর্নেলা বা’দিকের রুমটা দেখিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। ইসাবেলা মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ও টের পাচ্ছে নিকোলাস ওরই দিকে এগিয়ে আসছে। বুক দুরুদুরু করছে ইসাবেলার। চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছে। নিকোলাস ঝুঁকে ওর কানের কাছে বলল,

“স্বাধীনতা মোবারক, বেলা।”

ইসাবেলা চোখ তুলে তাকাতেই মুচকি হেসে কর্নেলার দেখানো ঘরের দিকে চলে যায় নিকোলাস।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here