তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ০৭
Writer Taniya Sheikh
আজকের সকালটা বেশ ঝকঝকে। আলস্য গায়ে একটুখানি রোদ উঠেছে। ক্যালেন্ডারের দিন তারিখ হিসেব করলে কদিন বাদে বসন্তের আগমন ঘটবে। গ্রামের ঘরে ঘরে মাসলেনিৎসা উৎসবের আয়োজন চলছে। এই শেষ সময়ে শীতের প্রকোপ বেড়েছে আরো। হুটহাট শুরু হয় তুষার বৃষ্টি। গতরাতেও একটানা তুষারপাত হয়েছে। সামান্য নয়, একপ্রকার তুষার ঝড় বললে ভুল হবে না। বাইরের বাতাসের তান্ডব রাতভর জানালার কাঁচে আছড়ে পড়েছে। তার উপর নতুন উপদ্রব ইসাবেলার দুঃস্বপ্ন। গত তিন রাত ধরে একটানা দুঃস্বপ্নটা দেখছে। দুঃস্বপ্ন! না, ইসাবেলার কেন যেন মনে হয় এ দুঃস্বপ্ন নয়, বরং স্বপ্নই নয়। এ হচ্ছে সত্য। আজ সকালেই সত্যিটা উপলব্ধি করেছে। প্রমাণও পেয়েছে। আয়নায় দাঁড়িয়ে যখন ঘাড়ের কাছে ওই দুটো ক্ষত দেখল, আঁতকে উঠল। দর্পণে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে শিউরে ওঠে। ফ্যাকাশে ত্বক, চোখ দুটো পাণ্ডুর। মাথা ঘুরে যায়। হঠাৎ এসব কী হচ্ছে তাঁর সঙ্গে? প্রথমদিন ভয়ে চিৎকার করলেও পরের দুদিন চিৎকার করতে পারেনি। শরীর জড়বৎ হয়ে থাকে। ভারটা কেটে গেলে ফের ঘুমে তলিয়ে যায়। সকালে ঘুম ভাঙলে কিছুই গুছিয়ে মনে করতে পারে না। মাদাম কয়েকবার প্রশ্ন করেছিলেন এ নিয়ে। ইসাবেলা ঠিকঠাক জবাব দিতে পারেনি। সারাক্ষণ একটা ভয় তাকে গ্রাস করে। আচ্ছা, মাদামকে কি সব খুলে বলা উচিত? কিন্তু মাদাম এই ক’দিন খুব ব্যস্ত ওই যুবক অতিথি সেবা শুশ্রূষা নিয়ে। যুবকের নামটা মনে করতে চেষ্টা করে ইসাবেলা। মনে পড়ে, নিকোলাস। কিন্তু পুরো নাম মনে করতে পারল না। নিকোলাসের সাথে আর ওর দেখা হয়নি। মাদাম বলছিল, সেদিন মূর্ছা যাওয়ার পর সে না কি অনেকক্ষণ বসে ছিল ওর শিওরে। কথাটা শুনে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। লজ্জায়, সংকোচে রুম থেকে বেরোনোই ছেড়ে দিয়েছে। ঘরে বসে মাদাম আর নিকোলাসের গলার স্বর শুনতে পায়। মাদাম হাসছে! ইসাবেলা এই প্রথম শুনল মাদামের হাসি। সাথে নিকোলাসের। তিনদিনেই বেশ ভালো সম্পর্ক জমিয়েছে দুজন। মাদামকে এতটা মনখোলা এসে অব্দি দেখেনি ইসাবেলা। অবসন্ন শরীর নিয়ে বিছানায় উঠে বসে। সারাটাদিন শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলো। দেয়াল ঘড়িতে বাজে পৌনে পাঁচটা। আজ ভ্যালেরিয়ার আসার কথা। অন্যদিন সকাল সকাল এসে পৌঁছায়। কিন্তু আজ দেরি হচ্ছে কেন? নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা ভ্যালেরিয়াকে না বলতে পারলে শান্তি পাচ্ছে না। কখন যে আসবে সে?
“ইসাবেলা?” দরজায় নক করে মাদাম।
“মাদাম”
ভেতরে ঢুকলেন মাদাম। মুখখানা আজ আর গম্ভীর নয়, হাস্যজ্বল। ইসাবেলাকে দেখে এই প্রথম মুচকি হাসলেন। অবাক না হয়ে পারল না ইসাবেলা। মাদাম ভ্রু কুঁচকে তাকাতে বিস্ময় গোপন করে মৃদু হাসল।
“আজ তোমাকে বড্ড ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। শরীর কি খুব খারাপ লাগছে? দুঃস্বপ্নটা গতরাতেও দেখেছ?”
ইসাবেলা মাথা নাড়ায়। ওর বিবর্ণ মুখটা লক্ষ্য করে মাদাম চিন্তিত হলেন। গত তিনদিন নিকোলাসকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ইসাবেলাকে সময় দিতে পারেননি। নিকোলাস বেশ অমায়িক। ওকে দেখলে নিজের ছেলের কথা মনে পড়ে যায় প্রৌঢ়ার। যুদ্ধে গিয়েছিল তাঁর ছেলে ইভানোভিচ। কতই বা বয়স ছিল তখন ওর? এই বিশ কী একুশ! ইভানোভিচের সাথের ছেলেগুলো ফিরে এলেও ইভানোভিচ ফিরল না। অনেকে বলেছে সে বেঁচে নেই। কিন্তু তারই বা কী নিশ্চয়তা ছিল? বছরের পর বছর সন্তানের ফিরে আসার প্রতীক্ষা করছেন। একমাত্র সন্তান হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। আজও কাটিয়ে উঠতে পারেননি পুত্রহারানোর শোক। এই শোকই তাঁকে করেছে নিঃসঙ্গ, গম্ভীর।
“মাদাম।” ইসাবেলার ডাকে তন্ময়তা ভাঙে মাদামের। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,
“নিকোলাস আমার ছেলেটাকে চিনত। আমার ইভান, আমার ছেলের শেষ সময়ে নিকোলাস পাশে ছিল। মৃত্যুর আগে আমার ইভান আমাকে স্মরণ করেছিল। আমাকে নিয়ে ওদের কাছে কত গল্প শুনিয়েছে।”
মাদামের গলা ভিজে আসে। কথাগুলো কেন তিনি ইসাবেলাকে বলছেন জানেন না। নিজের নিয়ন্ত্রিত আবেগটা আজ যেন নিয়ন্ত্রণের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে। কত বছর পরে তিনি সন্তান সম্পর্কে জানতে পারলেন! ইভানোভিচ বেঁচে আছে এই আশায় এতটা বছর অপেক্ষা করলেন। কিন্তু দিনান্তে এলো তার মৃত্যুর খবর। ইসাবেলা আস্তে করে তাঁর হাতদুটো চেপে ধরে। মাদাম চোখ মুছে বলেন,
“নিকোলাস আমাকে কথা দিয়েছে ইভানের কবর দেখাতে নিয়ে যাবে। আমার ইভানের কবর। শেষ দেখাটাও দেখিনি আমি ওকে। জানো ইসাবেলা, ও একটা মেয়েকে ভীষণ পছন্দ করত। যুদ্ধে যাওয়ার আগের দিন সকালে এসে আমাকে বলল,”মা, অ্যানাকে তোমার কেমন লাগে?”
আমি হেসে বললাম,”মিষ্টি একটা মেয়ে ও। খুব ভালো লাগে।” আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”আমি ওকে ভালোবাসি মা। খুব শীঘ্রই প্রপোজ করব।” খুব খুশি ছিল আমার ইভান। কিন্তু খুশিটুকু সকাল হতেই উবে গেল। যুদ্ধে যেতে বাধ্য হলো ছেলেটা আমার। আর ফিরে এলো না। আমার ইভান।” মাদাম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। ইসাবেলা জড়িয়ে ধরে মাদামকে। ও নিজেও কাঁদছে। নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে বসলেন মাদাম। ইসাবেলার হাতদুটো ধরে নত মুখে চুপচাপ বসে রইলেন কিছুক্ষণ। নিকোলাসের মধ্যে নিজের ছেলেকে দেখতে পেয়েছেন। ওভাবেই তো হেসে হেসে কথা বলত ইভানোভিচ। ঠিক ওর মতোই আন্তরিক ছিল। কত মিল খুঁজে পান মাদাম ওদের মধ্যে! নীরবতা ভেঙে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“কোনো কিছু কারণ ছাড়া ঘটে না। নিকোলাসকে অসুস্থ অবস্থায় পাওয়াটাও অকারণ নয়, তাই না বলো?”
ইসাবেলা মাথা নাড়ায়। মাদাম সজল নেত্রে মৃদু হেসে বলেন,
“ছেলেটা খুব সুশীল, ভদ্র আর অপরিসীম মায়া ওর মনে। ঠিক আমার ইভানোভিচের মতো। আমার ভীষণ ভালো লেগেছে ওকে। এই তিনদিনেই কেমন আপন হয়ে গেছে। জানোতো, ওর মনটা খুব ভালো। তোমার কথা কয়েকবার জিজ্ঞেস করল। সেদিন ওমন চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলে যে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। নিকোলাস অসুস্থ, দূর্বল শরীর নিয়ে ছুটে এলো এ ঘরে। তোমার জ্ঞান ফিরল কিন্তু হুঁশ ছিল না সারারাত। গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছিল তোমার। গা মুছিয়া দেওয়ার জন্য পানি প্রয়োজন ছিল। ঘরে পানি ছিল না। ওই অসুস্থ শরীরে মাঝরাতে জঙ্গলে গিয়ে পানি নিয়ে এলো ছেলেটা। তোমার শিওরে বসে মাথায় জলপট্টি দিলো ভোর পর্যন্ত। আমাকে বলল আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। বেলা সুস্থ হয়ে যাবে। চমৎকার একটা ছেলে নিকোলাস। একটু আগেও জিজ্ঞেস করেছে তুমি ঠিক আছো কি না। পরের জন্য কত ভাবে! সারাদিন একা রুমে বসে না থেকে ওর সাথে একটু কথাটথা বললেও তো পারো। দেখো খারাপ লাগবে না। নিকোলাস তোমাকে ভালো লাগিয়েই ছাড়বে।” প্রসন্নমুখে হাসলেন একটুখানি মাদাম। ইসাবেলার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“চলো কিছু খেয়ে নেবে। মুখ-চোখ কেমন সাদাটে হয়ে গেছে। রাতে ঘুম হয় না বুঝি?”
মাদাম ওর চোখ দেখলেন। নাড়ি পরীক্ষা করলেন। তাঁর মুখটা কালো হয়ে গেল সাথে সাথে। আর্ত কণ্ঠে বললেন,
“তোমার শরীর আবার অসুস্থ হলো দেখছি। খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম করছ, না? আমি ঠিক বুঝেছি। তোমাকে নিয়ে আর পারি না। সিস্টার আসুক, আমি তোমার নামে অভিযোগ করবোই করব। একটা কথাও শোনো না তুমি।” হাঁফ ছেড়ে আবার বললেন,”আজ ঘুমের ওষুধ দেবো। ওসব আজেবাজে স্বপ্ন তোমাকে অসুস্থ করল বেশি। খেয়ে দেয়ে ওষুধ খাবে। দেখবে এক ঘুমে রাত পার। ওসব স্বপ্ন দেখবে না।”
মাদামের সহজ, হাস্যমুখটা এখন আর নেই। সেই আগের মতো গম্ভীর, কঠিন হয়ে গেলেন। ইসাবেলা কিছু বলতে চাইলে মাদাম থামিয়ে দিলেন। বললেন,
“হয়েছে। আর সাফাই গাইতে হবে না। এক্ষুনি চলো আমার সাথে। সামনে বসিয়ে প্লেট ভরে খাওয়াব তোমাকে, চলো।”
মাদাম আগে আগে গেলেন। ইসাবেলা পেছনে। শরীরটা সত্যি দূর্বল লাগছে ওর। মাদাম অনুযোগের স্বরে বকবক করে যাচ্ছেন। অনুযোগগুলো একেবারে মিথ্যে নয়। ইসাবেলা সত্যিই খাবার দাবারে অনিয়ম করছে। ওই ঘটনার পর থেকে শান্তি পাচ্ছে না। ভয় হচ্ছে খুব। রাতে ঘুমাতে ভয় পায়। কিন্তু অবসন্ন শরীরে কতক্ষণ আর না ঘুমিয়ে থাকতে পারে। কিচেনের কাছাকাছি যেতে মাথাটা ঘুরে উঠল ওর। পড়েই যাচ্ছি তখনই একটা পেশিবহুল হাত ওকে জড়িয়ে ধরে। ইসাবেলা দু’হাতে খামচে ধরে মানুষটার বুকের শার্ট। জোরে জোরে শ্বাস নেয়। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে, ঝাপসা হয়ে যায় দৃষ্টি।
“বেলা, ঠিক আছো তুমি?”
উৎকণ্ঠিত পুরুষালি গলা শুনে চমকে তাকায় তার মুখের দিকে। বিধাতা যেন বড়ো ফুরসতে বানিয়েছে তাকে। এমন সুদর্শন পুরুষ আগে দেখেনি ইসাবেলা। এ কী পার্থিব কেউ না কি স্বর্গের কোনো দেবতা! চোখে ঘোর লেগে যায়। সম্মোহিত হয় সে। মানুষটার বুক সমান ইসাবেলা। দীর্ঘদেহী, প্রসস্থ বুক। নীলাভ আঁখি ওরই দিকে স্থির।
“বেলা!”
নিকোলাস আরো কাছে টেনে আনে ওকে। দুজনের দেহের মধ্যে ইঞ্চি তফাৎ। ইসাবেলার সর্ব শরীর আকর্ষিত হয় কী এক নিষিদ্ধ টানে। দু-চোখ বন্ধ করে অনুভব করে নিকোলাসের দেহের নৈকট্য, সুবাস। এই সুবাসের সম্মোহনী শক্তি আছে। নয়তো এমন হবে কেন ওর সাথে? রান্নাঘরে ঝনঝন করে কিছু পড়ে। সেই শব্দে একপ্রকার লাফ দিয়ে ওঠে ইসাবেলা। তাড়াতাড়ি নিকোলাসের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ায় দূরে। মনে মনে শত সহস্র তিরস্কার করতে লাগল। এই নিকোলাসের কাছে এলে এমন হয়ে যায় কেন ও? এই যুবক মারাত্মক ক্ষতিকর ইসাবেলার জন্য। ইসাবেলা নিজেকে সাবধান করে। সে প্রতিজ্ঞা করে এই নিকোলাসের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলবে। নিকোলাসের উদ্বিগ্ন দৃষ্টি এখনো তেমনই স্থির ওর দিকে। সেই নীল চোখের মণিতে চেয়ে শ্বাস নিতে ভুলে যায় ইসাবেলা। যেন চোখ নয়, নীল সমুদ্রের জল। একটু একটু করে অতল জলের গভীরে ডোবাতে চায়।
“বেলা!”
“হুঁ!”
সংবিৎ ফিরতে দৃষ্টি নামিয়ে নেয় ইসাবেলা। আবার সে ঘোরে পড়ছিল। এই যুবক প্রহেলিকা। “সাবধান ইসাবেলা, সাবধান। এ তোকে ধ্বংস করে ছাড়বে। দূরে যা, দূরে যা।” মনকে সতর্ক করে ইসাবেলা। নিকোলাস জবাবের আশায় চেয়ে আছে। ইসাবেলা আরো দু কদম পিছিয়ে কোনোরকমে বলল,
“আমি ঠিক আছি।”
মাদাম বেরিয়ে এলেন কিচেন থেকে।
“তোমরা দুজন ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এসো খেয়ে নেবে।”
নিকোলাস মুচকি হেসে মাথা নাড়াতে মাদাম কিচেনে ফিরে গেলেন। ইসাবেলার দিকে ফিরতে ইসাবেলা পাশ কেটে দ্রুত পদে চলে আসে কিচেনে। নিকোলাস এলো ওর পিছু পিছু। পরনে রাশিয়ান ট্রেডিশনাল কোসোভোরোটকা শার্ট আর টাউজার। ওগুলো মাদামের ছেলে ইভানোভিচের। মাদাম যত্ন করে আগলে রেখেছিলেন। ইসাবেলা শুনেছিল ছেলের ব্যবহৃত জিনিস কাওকে স্পর্শ করতে পর্যন্ত দেন না মাদাম। আর এই নিকোলাসকে পরতে দিলো! ইসাবেলা অবাকই হলো বেশ। সে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে। মাদামের ছেলের বয়স আর নিকোলাসের বয়সে অনেক ফারাক, তবে এরা বন্ধু হয় কীভাবে? হিসেবে নিকোলাস তখন বালক। বালকেরা কী যুদ্ধে যেত?
নিকোলাস খেয়াল করে ইসাবেলা ওর কাপড়ের দিকে চেয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসল। ইসাবেলার গাল লাল হয়ে ওঠে। মুখ ফিরিয়ে বসে। নিকোলাস মৃদু কাঁশল তাই দেখে। হাসি গোপন করল আরকি। ইসাবেলা মাথা নুয়ে রইল তো রইলই। সে না দেখেও বুঝতে পারে নিকোলাসের দৃষ্টি ওর উপরই অনড়। উফ! কী বিরক্তিকর! মনে মনে অসন্তোষ প্রকাশ করে।
খাবার টেবিলে মাদাম আর নিকোলাস কথা বলছে। ছেলে ইভানোভিচ সম্পর্কে নানান স্মৃতিকথা বলছেন তিনি। নিকোলাস আগ্রহের সাথে শুনছে। প্রৌঢ়া ছেলে সম্পর্কে বলতে যেমন পছন্দ করেন, শুনতেও তেমন পছন্দ করেন। নিকোলাস তাঁকে শোনায় ইভানোভিচের মৃত্যুর পূর্বের কথাগুলো। যা সে বলে গিয়েছিল নিকোলাসকে। ইভানোভিচ মা’কে খুব ভালোবাসত। মৃত্যুর পূর্বে সে মা আর প্রিয়তমা অ্যানাকেই স্মরণ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। যুদ্ধের ক্যাম্পে বসে মা এবং প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে কিছু চিঠি লিখেছিল। নিকোলাসের কাছে সেগুলো গচ্ছিত রয়েছে। মাদামকে সেগুলো এনে দেবে বলে নিকোলাস প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। ছেলেকে স্মরণ করে আবারো মাদাম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। নিকোলাস তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। ইসাবেলা মাথা নিচু করে খাচ্ছিল এতক্ষণ। মাদামের কান্না শুনে সরে বসল তাঁর পাশে। নীরবে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। আড়চোখে দেখল নিকোলাস ওকেই দেখছে। এই লোকটা এভাবে তাকিয়ে থাকে কেন ওর দিকে? ইসাবেলার এখানে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে। মাদাম নিজেকে সামলে নিতে ও উঠে দাঁড়ায়। মাদাম ভ্রু কুঁচকে তাকান। তারপর বলেন,
“উঠলে কেন?”
“আমার খাওয়া শেষ।” নিজের খাবার প্লেটের দিকে চেয়ে বলল সে। মাদাম বিস্মিত গলায় বললেন,
“খাওয়া শেষ! প্লেটে তো সব খাবার পড়েই আছে। কী খেলে? এই করে তোমার শরীর ফের খারাপ হচ্ছে। সিস্টার এসে তোমার এই অবস্থা দেখে ফাদারকে বললে মান সম্মান থাকবে আমার? কত বিশ্বাস করে আমার কাছে রেখেছে তারা। বসো। সব খাবার শেষ করে তবে উঠবে, বসো।”
শেষ কথাগুলো নীরস গলায় বললেন মাদাম। কিছুটা ধমকের সুরে। নিকোলাসের সামনে মাদাম এভাবে বলল বিধায় লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। নত মুখে বসল চেয়ারে। নিকোলাস ওর দিকে চেয়ে মাদামকে প্রশ্ন করল,
“ও আপনার আত্মীয় নয়?”
মাদাম মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“না, ফাদার জালোনভের পরিচিত।”
“ফাদার জালোনভ?” প্রশ্ন করে নিকোলাস। মাদাম মৃদু হেসে বললেন,
“খুবই মহৎপ্রাণ আর পূণ্যবাণ মানুষ ফাদার। একসময় এই গ্রামের চার্চের দায়িত্বে ছিলেন। আমার ভেষজ ওষুধের প্রশংসা করতেন খুব। বলতেন, “বাছা, দেখো তোমার ওষুধ একদিন দেশ বিদেশে সুনাম কুড়াবে। ঈশ্বর তোমাকে বিশেষ আশীর্বাদ দিয়েছেন। এটাকে হেলাফেলা করো না।” ফাদারের আশ্বাস আর বিশ্বাসের জোরে এই গাঁ ছাড়িয়ে দূর দূরান্তে আমার ভেষজ ওষুধ ছড়িয়ে পড়েছে।”
“এবার সেন্ট পিটার্সবার্গ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে আপনার ওষুধের সুনাম।” নিকোলাস হাস্যমুখে বলতে মাদামের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ইসাবেলা ঠিক বুঝল না কথাটা। নিকোলাসের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতে নিকোলাস মুচকি হাসল। ইসাবেলা তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। নিকোলাস ওর দিকে চেয়ে মাদামকে পুনরায় প্রশ্ন করে,
“ফাদারের সাথে বেলার সম্পর্ক কী?”
নিকোলাসের মুখে বেলা ডাক মোটেও পছন্দ করছে না ইসাবেলা। বেলা কেবল ওর বাবা-মা ডাকে। ওর কাছের মানুষ। আর কেউ ওই নামে ডাকুক সে চায় না। কিন্তু এই নির্লজ্জ লোকটা শুনলে তো হয়!
“নির্লজ্জ বলছিস? অথচ, এই নির্লজ্জ তোকে সেদিন রাতে সেবা শুশ্রূষা করেছে। একটু আগে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। অকৃতজ্ঞ।” বিবেকের তিরস্কারে নমনীয় হয় ইসাবেলা। চোখের কোনা দিয়ে নিকোলাসকে দেখছে। মাদামের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে সে।
মাদাম এক ঢোক পানি পান করে বলেন,
“সিস্টার ভ্যালেরিয়া ফাদারের বিশেষ আস্থাভাজন মানুষ। আর ইসাবেলা হলো সিস্টার ভ্যালেরিয়ার প্রিয় ভাগ্নি। মেয়েটার হৃদয়,, ”
ইসাবেলা মাদামকে কথা শেষ করতে দেয় না। তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে বিব্রত স্বরে বলল,
“মাদাম, প্লিজ!”
মাদামের হয়েছেটা কী? অচেনা ব্যক্তির সামনে কোনো রাখঢাকই রাখছেন না। ইসাবেলার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কেন বলবে এই নিকোলাসকে? দরকারটা কী? এসব ভেবে কান্না পেল ইসাবেলার। এক
মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে দৌড়ে চলে যায় নিজের রুমে। মাদাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে খাবার খেতে লাগলেন। ইসাবেলার এই আচরণ তাঁর ভালো লাগল না। রাশভারি মুখে এঁটো থালাগুলো নিয়ে গেলেন ধৌত করতে। নিকোলাস তখনো বসে আছে চেয়ারে। গভীর ভাবনায় বুঁদ। ভাবনা কাটতে চেয়ে রইল ইসাবেলার বন্ধ দরজায়। অস্ফুটে কিছু আওড়াল মুচকি হেসে।
চলবে,,