#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_43
দৃশ্য চুপচাপ নাস্তার টেবিলে বসতেই খেয়াল করলো দু জোড়া চোখ তাকে তীক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।দৃশ্যর কিছুটা অসস্তি হচ্ছে। সে সুপের বাতি নাড়াচাড়া করতে লাগলো।সকল নীরবতা ভেঙে দৃশ্যই বললো
-“এই ভাবে দেখার কি আছে?এমন ভাবে তাকিয়ে আছো যেনো কোনো বড়ো অপরাধ করে ফেলেছি।”
ঝিনিয়া চোখ গরম করে বললো
-“শালী তুই একটা খারাপ।এতো বড়ো সত্যিটা লুকিয়ে রেখেছিলি।অন্যদিকে আমি কিনা বেস্ট ফ্রেন্ড জামাইয়ের উপরে ক্রাশ খেয়ে বসে আছি? আস্তাগফিরুল্লাহ!!”
দৃশ্য দাত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নিচু করে রাখলো। মাহাদ হটাৎ সকালে এসে এমন কাণ্ড করে বসবে সে তো ভাবতেই পারেনি।সে অপরাধী চোখে লতার দিকে তাকালো।লতা ভাবলেশহীন ভাবে বললো
-“মাহাদ সাহেবের বিষয়টা আমাদের কাছে বলিসনি কেনো?”
-“কি বলতাম আপু?বাংলাদের জনপ্রিয় মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলর রকস্টার আমার স্বামী?আদো এটা বিশ্বাসযোগ্য হতো?”
-“আমাদের বলতে পারতি?আমরা নিশ্চয়ই তোকে অবিশ্বাস করতাম না?”
-“বলনি কারণ এই মানুষটিকে তোমার যতোবার দেখতে ততবার আমার জন্য কষ্ট পেতে।বাসা থেকে বেরিয়েই রাস্তায় যার হাজারো পোস্টার ঝুলানো থাকে। প্রায়শই যার নাম ব্রেকিং নিউজে থাকে,সেই মানুষটাকে চাইলেই আমরা এড়িয়ে চলতে পারতাম না। আমি চাইনি তোমাদের সামনে অস্বস্তিতে পড়তে।তাছাড়া সব জানলে তোমরা মানুষটিকে তার যোগ্যতা দিয়ে বিচার করতে না।আমার কথা মনে করে হয়তো অপছন্দ করতে।শুধু শুধু তার ফ্যান ফলোয়িং কমিয়ে কি লাভ হতো?”
জিনিয়া মুখ গোমড়া করে বললো
-“ইসস!! তোর সামনেই তোর জামাইকে নিয়ে কতো কিছু বলেছি। এখন আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে।”
-“তোর লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।ওই মানুষটিকে নিয়ে হাজারো মেয়ে এমন স্বপ্নই দেখে।এটাই স্বাভাবিক।তাছাড়া ওই মানুষটির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।তাই লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই।”
লতা খেয়াল করলো দৃশ্যর চোখ চিক চিক করছে।তাই ইশারায় জিনিয়াকে থামিয়ে দিলো।এই মেয়েটা কতটা কষ্ট সহ্য করেছে সেতো নিজের চোখেই দেখেছে।এই কঠিন দৃশ্য হতে মেয়েটাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।যখন প্রথম মেয়েটাকে দেখেছিল তখন তার মনে হয়েছিল একদম নরম মাটি।যাকে সামান্য কষ্ট ছুয়ে দিলেই নেতিয়ে পড়তো।কিন্তু আজকের দৃশ্য অনেক মজবুত।সময় আর পরিস্থিতি মেয়েটাকে পরিবর্তন হতে বাধ্য করেছে।
দৃশ্য তার রুমের ছোট্ট বারান্দায় বসে আছে।এই বারান্দাটা ছোট হলেও তার খুব প্রিয়। এখানে সে নিজের পছন্দের সব গাছ লাগিয়েছে।বেশির ভাগ ফুল গাছ।বাকি কয়েকটা ঔষধি গাছ।এই বাগানের যেই ফুলের গ্রান সবচাইতে বেশি পাওয়া যায় তা হলো বেলি ফুলের।অসম্ভব ভালো লাগে তার।বাড়িতেও ভাইয়া তার জন্য বেশ কয়েকটা বেলি ফুলের গাছ লাগিয়েছিল।ঠিক তার আর নাবিলার জানালা বরাবর।নিচ তলায় নাবি আর উপরের তলায় সে।সময়টা কতো ভালো ছিলো।তাদের বাড়ির বাগানে বেশ কয়েকটা ঔষধি গাছ ও ছিলো।সেগুলো লাগিয়েছিল নাবিল ভাইয়া।তার মতে ঔষধের চাইতে এই গাছ বেশি উপকারী।তাদের বংশের সবচাইতে পড়ুয়া মানুষটিও ছিলো নাবিল ভাইয়া।
এই মানুষটা একজন ভালো ডক্টর হবে এটা নিয়ে দৃশ্য নিশ্চিত ছিলো।বছর খানেক আগে তাকে দেখেছিল দৃশ্য।সেদিন জিনিয়াকে নিয়ে নিয়ে গেছিলো ঢাকা মেডিকেলে।জিনিয়াকে ডক্টরের চেম্বারে ঢুকিয়ে সে বসেছিলো করিডোরে।হঠাৎ চোখ পড়ে দূরে দাড়িয়ে থাকা সুদর্শন যুবকটির দিকে। চোখে চশমা আর গায়ে সাদা এপ্রণ।গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপ।দূর থেকেও মানুষটাকে চিনতে তার এক মিনিটও লাগলো না।নাবিল ভাইয়া।এই মানুষটাও তাকে কম ভালোবাসেনি।নাবিলা আর দৃশ্য যেনো তার প্রাণ ছিলো।লেখাপড়ার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ থেকে এসএসসির পর চলে আসে ঢাকায়।হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করেছে।নাবিল ভাইয়া মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর বাবা আর বড়ো চাচা পুরো এলাকায় মিষ্টি বিলিয়েছেন।ভীষণ এক্সাইটেড ছিলেন তারা।
সেদিন অবশ্য ফাহিম ভাইয়ার মুখের অবস্থা দেখার মতো ছিলো।কারণ বাবা সেদিন কতো কথাই না শুনিয়েছে।নাবিল ভাইয়া থেকে কিছু শিখতে বলেছে।ফাহিম ভাইয়া কয়েকদিন বেশ চটেছিলো।কথায় কথায় বাবা নাবিল ভাইয়ার প্রশংসা করতো।ঠিক এই কারণেই ভাইয়া কখনোই নাবিল ভাইয়াকে পছন্দ করত না।
দৃশ্য সেদিন ভাইয়ার সাথে দেখা না করেই মেডিকেল থেকে বেরিয়ে এসেছিলো।এতো দিন পর ভাইয়ের সাথে দেখা করতে কেমন অস্বস্তিবোধ হচ্ছিলো।তাছাড়া সে চাইতো না কেউ তার ঠিকানা জানুক।ভালোই তো আছে।সেই বন্ধী জীবনে আর দৃশ্য ফিরে যেতে চায়না।
আজ সারাটা দিন দৃশ্যর অলস কাটলো।আজ অনেকদিন পর এমন অলস দিন কাটালো।নাহলে এই কয়েক দিন এতো বেশি বেস্ততায় কাটছিলো যে নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় ছিলো না।জ্বরের কারণে আজ ছুটি নিয়েছে দৃশ্য।তাছাড়া তার ঘাড়ের কামড়ের দাগ গুলো স্পষ্ট।এই অবস্থায় অফিসে যাওয়া অসম্ভব।
বিকেলের দিকে দৃশ্য বই নিয়ে বসলো।কাজের চাপ এতো বেশি ছিল যে দিন শেষে শরীরের বিন্দুমাত্র এনার্জি থাকতো না।আজ অনেকদিন পর বইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হলো। কাল একবার কলেজে যাবে বলে ভেবেছে।অনেক নোটস জমা হয়ে আছে। সেগুলো কালেক্ট করতে হবে। সোমা ছিলো বলে রক্ষা।এই পড়ুয়া মেয়েটার সাথে তার কেমন করে যেনো ভাব হয়ে গেছে।মেয়েটা তাকে সব নোটস জোগাড় করে দেয়।নাহলে এই ভাবে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পাস করা দৃশ্যর পক্ষে সম্ভব ছিলো না।সে চাইলেই ক্লাস এটেন্ট করতে পারে না।কারণ জব না করলে ভার্সিটির ফিস দিবে কি করে?সে তো আর এখন বাবার হোটেলে খায় না।কাজ না করলে যে না খেয়ে থাকতে হবে।জিনিয়া আর লতা আপু না থাকলে তার কি হতো ভাবতেই গা শিউরে উঠে।
পড়ায় কিছুতেই মনোযোগ বসাতে পারছেনা দৃশ্য।সকালের কথা মনে পড়লেই গা শিউরে উঠে।হঠাৎ মাহাদের এমন পাগলামির মানে বুঝতে পারলনা দৃশ্য। এখনো বাজছে সেই কথাটা
-“ভালোবাসি বউ”
দৃশ্য তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মাহাদের দিকে।এক মুহূর্তের জন্য দৃশ্যর মনে হলো তার সামনে সেই আগের মাহাদ দাড়িয়ে আছে।তার সেই উন্মাদ প্রেমিক।যে ভীষণ যত্নে ভালোবাসতে জানে। পরো মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে মাহাদের কাছ থেকে দূরে সরে বলেছিলো
-“স্যার আপনি এখানে কেনো এসেছেন?প্লিজ এক্ষনি চলে যান।কেউ দেখলে সমস্যা হবে।মিডিয়াতে জানা জানি হলে কেলেঙ্কারি বেধে যাবে।তাছাড়া আমার সাথে আরো দুটো মেয়ে থাকে এখানে।আমার জন্য তাদের কোনো সমস্যা হোক চাই না।”
-“আই ডোন্ট কেয়ার।শুধু এইটুকু জানি আমার করা অন্যায়ের পাল্লা আরো ভারী করে ফেলেছি।যার কোনো ক্ষমা নেই।”
দৃশ্য কি বলবে বুঝতে পারছে না।গত রাতে অমন একটা কান্ড ঘটিয়ে আজ আবার এসবের মানে কি?দৃশ্য খেয়াল করলো মাহাদের ডান হাতে ব্যান্ডেজ।গত রাতেও তো ছিলনা। দৃশ্য গম্ভীর হয়ে বলো
-“কেনো এসেছেন, প্লিজ চলে যান।”
মাহাদ অশ্রু সিক্ত নয়নে তাকিয়ে বললো
-“আমাকে অনেক ঘৃণা করো তাইনা?”
দৃশ্য বার কয়ের ঢোক গিলো।নিজেকে কেমন এলোমেলো লাগছে।সে তো এই পরিস্থিতির জন্য নিজেকে তৈরি রেখেছিলো।তাহলে কি সব ভেস্তে গেল।না এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না।সে শক্ত কন্ঠে বললো
-“আপনার সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক নেই যে ঘৃণা করবো।আমি আপনার বিশাল বড়ো অফিসের অতি ক্ষুদ্র তম সদস্য।তাছাড়া আমি মিস লুবনার আন্ডারে কাজ করি।আপনি তার বস।সেই সুবাদে আমারও।”
-“আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই?”
-“আছে তো।আপনি বস আর আমি এমপ্লয়ই।আর আপনি নিশ্চই সকল এমপ্লয়ই দের অসুস্থতায় বাসায় যেয়ে খবর নিতে জাননা।তাই আমার ক্ষেত্রে এতো দয়া দেখিয়ে লজ্জা দিবেননা।মিডিয়া জানতে পারলে বিভ্রান্তি ছড়াবে।অফিসিয়াল কোনো কথা থাকলে কাল অফিসে যাবার পর বলবেন।তাছাড়া আমাদের মধ্যে পার্সোনাল কথা থাকতে পারে না।তাই এখন আপনি আসতে পারেন।”
দৃশ্যর সেই কঠিন রূপ দেখে হয়তো মাহাদ অনেক চমকে গেছে।তাইতো আর কোনো কথা না বলে চলে গেছে।
দৃশ্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তার জীবনটা এমন এলোমেলো কেনো হয়ে গেলো? আট দশটা মেয়ের মতো সে কেনো তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে ঘর বাঁধতে পারলো না?
আজ মাহাদকে দেখে তারও জড়িয়ে ধরে কাদতে ইচ্ছে করছিল।হাজারো অভিযোগ করতে মন চাইছিলো।কিন্তু চাইলেই কি সব পারা যায়। অতীতের দিন গুলি আজও মনে পড়ে।জীবনের সবচাইতে বড় ধাক্কাটা তো সে সেদিন খেয়েছিলো যেদিন তার ভালোবাসার মানুষটি তাকে জীবন থেকে ছুড়ে ফেলেছিলো।আর সে ধাক্কাটা জলোচ্ছাসের রূপ নিয়েছিলো মাহাদের ঢাকায় চলে আসাতে।
মাহাদ ঢাকায় চলে আসার পর দৃশ্য ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছিলো।তার বেহায়া মন কিছুতেই এই সব কিছু মানতে পারছিলো না। মাহাদের সাথে একটা বার যোগাযোগের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলো।লাবিবা আপুকে রিকোয়েস্ট করে মাহাদের ঢাকার ফ্ল্যাটে খবর নিতে বলেছিলো।লাবিবা জানিয়েছিলো মাহাদের সেই ফ্ল্যাটে কেউ থাকে না।হয়তো তারা অন্য কোথাও উঠেছে।দৃশ্য শেষ ভরসা টুকুও হারালো।মানুষটাকে ছাড়া তার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।
নিজের রুমে সারাক্ষণ পড়ে থাকতো।করো সাথে কথা বলতো না।এমনকি কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিলো।নাবিলা এসে অনেক বুঝাতো।কিন্তু দৃশ্য ছিলো নিরব।এই পৃথিবীর সব কিছুই তখন তার জন্য অর্থহীন।
মানুষিক ভাবে ভেঙে পরলো সে।সেই সময় মানুষিক যন্ত্রণা থেকে বাজে একটা কাজ করে বসলো।হাত কেটে সুইসাইড করার চেষ্টা করলো।কিন্তু ফাহিম সঠিক সময়ে হসপিটালে নিয়ে গেলো।প্রায় দুই দিন দৃশ্য হসপিটালে অজ্ঞাত অবস্থায় ছিলো।যখন তার জ্ঞান ফিরলো তখন ফাহিম তার হাত ধরে অনেক কেঁদেছিলো।হয়তো অপরাধ বোধ তাকে কষ্ট দিচ্ছিলো। নাকি দৃশ্যর নীরবতা?
দৃশ্য ফাহিমের সাথে কোনো কথা বলতো না। ভায়ের প্রতি তার পাহাড় সমান অভিমান জমা ছিলো।যেই মানুষটি কাছে সে সবচাইতে বেশি সাপোর্ট আশা করেছিলো,সেই মানুষটাই তাকে ভীষণ ভাবে নিরাশ করেছে।
ভালোবাসার মানুষ গুলোর কাছথেকে পাওয়া কষ্ট গুলো তাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছিলো।দৃশ্যর এমন কাজে আশরাফ হুসাইন প্রচন্ড ক্ষেপে গেছিলেন।তিনি তখন একটা কঠিন সিদ্বান্ত নিলেন।দৃশ্যর বিয়ে দিবেন।এই মেয়েকে আর কিছতেই বাড়িতে রাখবেনা।তাদের এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করলেন।নির্বাচনের সময় এই বন্ধুই তাকে আর্থিক ভাবে অনেক হেল্প করেছিলো।তার বিনিময়ে চেয়েছিলো দৃশ্যকে তাদের বাড়ির বউ করতে।আসলে তার ছেলেই দৃশ্যকে ভীষণ পছন্দ করতো।এই কথা বাবাকে জানিয়েছিলো।তাই এই সুযোগে তিনি প্রস্তাব দিয়ে বসলেন।দৃশ্য তখন সবে মাত্র এসএসসি দিবে।তাই তারা ঠিক করে দৃশ্যর এইচ এসসির পর বিয়ে হবে।এই কথা আশরাফ হুসাইন আর তার বড়ো ভাই আনোয়ার হুসাইন ছাড়া কেউ জানতো না।দৃশ্যর পরীক্ষার পর সবাইকে জানাতো।
দৃশ্যর এই ঝামেলার পর আশরাফ হুসাইন অনেকটা ভয়ে ছিলেন।বিয়েটা যদি ভেঙে যায়।কিন্তু তারা দৃশ্যর পালানোর খবর জানার পরও বিয়েতে রাজি থাকে।তার একটাই কারণ ছেলে যে কোনো মূল্যে দৃশ্যকে বিয়ে করতে চায়।আশরাফ হুসাইন দৃশ্যর বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথাটা গোপন রাখলেন।
স্বামীর এমন কথা শুনে আনিকা কবীর অস্থির হয়ে বলেছিলেন
-“এমন পাপ কাজ কি করে করতে পারেন?মেয়ে বিবাহিত জেনে অন্য জায়গায় কেমনে বিয়ে দিবেন?এই ঘোর পাপ আল্লাহ সইবে না।”
-“ওই বিয়ে আমি মানিনা।ওইটা কোনো বিয়েই না।তাই ফাও প্যাচাল পাইরো না।মেয়ে যেই কলঙ্ক লাগিয়েছে আমি সেটাই মোচন করার চেষ্টা করছি।আমার মান সম্মান কিছুই রাখে নাই তোমার মেয়ে।ওই পরিবার এতো কিছুর পর তোমার মেয়েকে নিতে রাজি হয়েছে এটাও বেশি।”
আনিকা কবিরের কোনো কথাই শোনেনি তিনি।বাবার এমন ডিসিশনে দৃশ্য অবাক হয়ে গেছিলো।সে বিবাহিত জেনেও বাবা এমন কাজ কি করে করতে পারলো?এমন জঘন্য ডিসিশন কি করে নিলো?নিজেকে তখন দৃশ্যর নর্দমার কীট মনে হচ্ছিলো।এই জঘন্য মানুষটার রক্ত তার শরীরে বইছে?
দৃশ্যর বিয়ের বিষয়টা জেনে ফাহিম বেশ চটে গেছিলো।দিন দিন বাবার কাজে সে হতাশ হয়ে পড়েছিলো।ফাহিম প্রতিবাদ জানালে আশরাফ হুসাইন হুংকার দিয়ে উঠেন।যে কোনো মূল্যে দৃশ্যর বিয়ে দিলেন বলে জানালেন।অনেক প্রতিবাদ করেও বাবাকে দমানো গেলো না।বোনের অবস্থা দেখে তার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিলো।সে বাবাকে অনেক রিকোয়েস্ট করে বিয়ের ডেট দৃশ্যর পরীক্ষার পর রাখতে বললো।কারণ আর তিন মাস পরই দৃশ্যর এইচ এসসি পরীক্ষা।
আশরাফ হুসাইন সব ভেবে ফাহিমের কথা মেনে নিলো। মাহাদ রাজশাহী না থাকায় তিনি কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিলেন।তাছাড়া সেদিন মাহাদের ব্যাবহারে বুঝতে পেরেছিলেন সে আর দৃশ্যর জীবনে আসবে না।
নাবিলা,মৌ আর সায়মা জোরাজুরিতে দৃশ্য কলেজে যাওয়া শুরু করে।কারণ পরীক্ষার মাত্র তিন মাস বাকি।দৃশ্য আর লেখাপড়া করবেনা বলে জানিয়েছিলো কিন্তু নার্গিস তাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করালো পরীক্ষার জন্য।
-“পরীক্ষা কেনো দিবিনা?”
-“পরীক্ষা দিয়ে কি হবে আপু।আমিতো এখন মৃত লাশ।বিবাহিত হয়েও নাকি আমার আবার বিয়ে করতে হবে। এর চাইতে বাবা আমাকে মেরে ফেলুক না।এই ভাবে তিলে তিলে কেনো মরছে?জানো আপু আমি বিয়ে করবনা বলে বাবা আমাকে প্রচুর মেরেছে।এটা অব্দি ঠিক ছিলো।কিন্তু মাকে কেনো মারলো?আমাকে হুমকি দিয়েছে বিয়ে না করলে মাকে জানে মেরে ফেলবে।আমি জানি বাবা এমন জঘন্য কাজটা ঠিক করে ফেলতে পারবে।”
-“কাদিস না বোন।”
দৃশ্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বললো
-“আমাকে একটু বিষ এনে দাও না আপু।একেবারে মরে যাই।আমিযে আর সইতে পারছি না। মাহাদ আমাকে কেনো ছেড়ে চলে গেলো আপু?আমার কি দোষ ছিলো?আমিতো তাকে সবটা দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।সব সহ্য করেও তার হাত ছাড়িনি।সে কেনো ছাড়লো?”
নার্গিসের চোখেও অশ্রু হানা দিলো।সে বুঝতে পারছে দৃশ্যর কষ্ট।সে নিজেই এই কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে।ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে অন্য অন্যকারো সাথে সংসার করা যে কতো টা যন্ত্রণার সেটা সে বুঝতে পারছে।অথচ দিন শেষে ভালোবাসার মানুষটির কাছে সে ছলনাময়ী।
-“দৃশ্য লেখাপড়া ছাড়িস না।আজ যদি আমি লেখাপড়া শেষ করতে পড়তাম তাহলে এই বিষাক্ত সংসার থেকে বেরিয়ে আসতাম।একটা জব করে নিজের পায়ে দাড়াতে পারতাম।তুই সেই সুযোগ হারাস না।লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাড়া।করো প্রয়োজন যাতে না পড়ে।”
দৃশ্য অনেক ভাবলো নার্গিসের কথা।
তাছাড়া কিছুটা সময় এই বাড়ি থেকে দূরে থাকতে পারবে বলে দৃশ্য কলেজে যেতে রাজি হয়ে যায়।কিন্তু সেই সময় সে মানুষিক ভাবে ছিলো বিপর্যস্ত।নিজেকে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো। মাহাদকে বলতে ইচ্ছে করছিল
-“এ কোন জাহান্নামে আমাকে ফেলে গেলে।আমিযে আজ বেচেঁ থেকেও মৃত।”
আশরাফ হুসাইন তখন দৃশ্যর পেছনে লোক লাগিয়ে দিলেন।দৃশ্য যাতে আবার উল্টা পাল্টা কিছু করতে না পারে।প্রচন্ড মানুষিক চাপ আর অস্থিরতায় দৃশ্য পরীক্ষা দিলো।
দৃশ্যর পরীক্ষা শেষ হতেই আশরাফ হুসাইন বিয়ের তোর জোর শুরু করে দিলেন।ফাহিম কি করে এই বিয়ে আটকাবে ভেবে পাচ্ছিলো না।বাবার এই অন্যায় কাজকে সে কি করে বাধা দিবে ভেবে পাচ্ছেনা।বাবা যে কারো কথাই শুনতে রাজি না।দৃশ্য তার সাথে কোনো কথাও বলেনা।তার দিকে কেমন ঘৃণার দৃষ্টি ছুড়ে দেয়।সেই দৃষ্টি ফাহিমের হৃদয়ে যন্ত্রণা দেয়।
বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসতে থাকে দৃশ্য ততো অস্থির হয়ে পড়ে। কাল হলুদ।দৃশ্য ঠিক করে নিজেকে শেষ করে দিবে।এই বিয়ে কিছুতেই করবে না।স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় বা ডিভোর্স ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করার কোনো বিধান ইসলামে নেই। মাহাদ তো তাকে ডিভোর্স দেয়নি।তাহলে বাবা কি বুঝে এমন কাজ করছে। আল্লাহর ভয়ও কি নেই তার?কিন্তু সে কিছুতেই এই পাপ কাজে সায় দিবে না।নিজেকে শেষ করে দিবে।
তার এই পরিকল্পনা নাবিলা বুঝতে পারে।তাই দৃশ্যকে বাসা থেকে পালানোর পরিকল্পনা দেয়।অনেক চিন্তা করে দৃশ্য ঠিক করে সে ঢাকা পালিয়ে যাবে।কিন্তু কথা হলো ঢাকায় ছোট মামা ছাড়া আর কেউ পরিচিত নেই।আর ছোট মামার কাছে গেলে এক দিনেই বাবা ধরে ফেলবে।
অনেক চিন্তা করে তার মনে পড়লো ফেসবুকের এক ফ্রেন্ডের কথা।তার সাথে দৃশ্যর ভীষণ ভালো সম্পর্ক।আর তার কথা বাসার কেই জানেনা।তার সেই ফ্রেন্ড একটা হোস্টেলে থাকতো।একবার তাকে এড্রেসটা বলেছিলো।দৃশ্য প্ল্যান করলো সেখানে যাবে।তার মাধ্যেমে কোথাও থাকার একটা বেবস্থা করে ফেলবে।কিন্তু দৃশ্য তার সাথে কোনো যোগাযোগ করলো না।একটা কাগজে তার ফোন নম্বর লিখে নিলো।কারণ দৃশ্য জানে তার বাবার হাত কতো দূর।কোনো ভাবে তার আইডি হ্যাক করে যদি কনভারসেশন থেকে বুঝে যায় দৃশ্য কোথায় আছে?তাই দৃশ্য তাকে কোনো মেসেজ দিলো না।
দৃশ্য দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিলো।সে কয়েক সেট জমা,নিজের জমানো কিছু টাকা, মাহাদের দেওয়া হিরের দুল আর সেই গোলাপী বিয়ের শাড়ীটা নিলো। হাতে চোখ বুলিয়ে দেখলো অনামিকা আঙ্গুলের হীরের আংটি টা।কেমন জ্বল জ্বল করছে।এই আংটিটা মাহাদ বিয়ের দিন মালা বদলের পর পরিয়ে দিয়েছিলো।তারপর তার হাতে বেশ কয়েবার চুমু খেয়েছিলো।দৃশ্যর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।জীবনটা আজ ঠিক কোথায় এসে দাড়িয়েছে?আজ সব আপন মানুষ গুলোকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে অনিশ্চিত জীবনের দিকে।
সবাই ঘুমিয়ে পড়তেই দৃশ্য ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে।সিড়ির কাছে আসতেই কেউ তার হাত টেনে ধরলো।ভয়ে দৃশ্যর বুকটা ধুক ধুক করতে শুরু করলো।হাত পা রিতিমত কাপছে তার।ভয়ে ভয়ে পেছনে ফিরে চমকে গেলো।