তোমার_আমার_প্রণয় #israt_jahan_arina #part_54

0
1003

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_54

রাতের আঁধার কাটিয়ে ধরণী জুড়ে নেমেছে এক ফালি রোদ।সকালের স্নিগ্ধ বাতাস চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।দূরে পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে।দৃশ্য ভাবছে প্রতিটা সকাল এতো স্নিগ্ধ কেনো হয়না?দৃশ্য এক দৃষ্টিতে মাহাদের ঘুমন্ত মুখটা দেখছে।এই ভাবে কখনো আগে মাহাদকে দেখা হয়নি।কতটা পবিত্রতা ছেয়ে আছে তার ঘুমন্ত মুখটায়।আজকের সকালটা ভীষণ অন্যরকম।ভালোলাগা খারাপ লাগার সংমিশ্রণ রয়েছে।এইযে চোখ খুলে নিজেকে ভালোবাসার মানুষটির বুকে পাওয়াটা কতটা সুখের সেটা বলে বুঝানো সম্ভব না।কিন্তু অন্য দিকে অনিশ্চিত জীবনের দিকে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে সে।যেই সম্পর্কের কোনো ভিত্তি নেই,সেই সম্পর্কের কতটা গভীরে চলে গেছে সে।

দৃশ্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।নিজেকে এই স্রোতে ভাসিয়ে দুর্বল হলে চলবে না।সে মাহাদকে আটকে রাখতে চায়না।দৃশ্য মাহাদের কপালে হাত রেখে দেখলো তেমন জ্বর নেই।দৃশ্য ফ্লোর থেকে মাহাদের টিশার্ট গায়ে জড়িয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলো।

আখি রহমান অনেকক্ষণ যাবত বসে আছে স্বামীর কবরের পাশে।প্রায়ই তিনি আসেন।স্বামীর কাছে হাজারো অভিমান,অভিযোগ করেন।আজও তাই করছেন।আজ সকাল থেকেই তার স্বামীকে ভীষণ মনে পড়ছে।

মাহিম ও মায়ের পাশেই আছে।বাবাকে সেও ভীষণ মিস করে।কারণ বাবা যে তার বেস্টফ্রেন্ড ছিলো।বাবা বেচেঁ থাকতে বর্ষা তার জীবনে ছিলো না।তাহলে অবশ্যই বাবার সাথে দেখা করাতো।বাবার সাথে বর্ষার ভীষণ জমতো।একদিন সে বর্ষাকে নিয়ে এসেছিলো বাবার সাথে দেখা করাতে।তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষটির সাথে বাবার পরিচয় করাতে।বর্ষার সেদিন প্রথম দেখেছে এক অন্যরকম মাহিম কে।বাবার কবরের বসে সেদিন অনেক কেঁদেছিলো মাহিম।

দৃশ্য রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো লতা নাস্তা রেডি করছে।দৃশ্য দ্রুত এগিয়ে লতাকে সাহায্য করতে লাগলো।লতা আড় চোখে দৃশ্যর দিকে তাকালো।দৃশ্যর যেনো লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।ভীষণ অসস্তি ফিল হচ্ছে।আপু কি ভাবছে কে জানে?লতা খাবার টেবিলে রেখে বললো

-“আয় নাস্তা করে নে।”

দৃশ্য মাথা নেড়ে হে জানালো।দৃশ্য চেয়ারে বসতেই লতা বললো
-“তোর গায়ক সাহেবের জ্বর কমেছে?”

-“হে কমেছে।”

-“আজ তোর শপে ডিউটি আছে?”

-“হুম।”

কিছু ক্ষন নীরবতার পর লতা গম্ভীর স্বরে বললো
-“যা করছিস ভেবে চিন্তে করছিস তো?কারণ এসবের কোনো ভবিষ্যৎ দেখছি না।”

দৃশ্য অশ্রু শিক্ত নয়নে তাকালো লতার দিকে।লতা আবার বললো

-“আমি বলছি না তোরা অন্যায় কিছু করছিস।তোদের সম্পর্কের বৈধতা আছে।তোদের মধ্যে ফিজিক্যাল রিলেশন হওয়া ভীষণ স্বাভাবিক।কিন্তু যেখানে তোরা নিজেরাই অনিশ্চিত এই সম্পর্ক নিয়ে সেখানে এতটা গভীরে প্রবেশ করলে কষ্ট কিন্তু আরো বেড়ে যাবে।সামলাতে পারবি তো?অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছিস।তোকে আবার ভেঙে পড়তে দেখতে চাই না।”

দৃশ্য আরো কয়েক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বললো
-“আমি কি করতাম আপু।নিজেকে তো যথেষ্ট শক্ত রাখার চেষ্টা করেছি।কিন্তু নিজের স্বামীর আহব্বানে সারা না দিয়ে পারিনি।আমি যে ভীষণ দুর্বল আপু।মানুষটা আমার কাছে আসলে আমি আরো দুর্বল হয়ে পরি।”

লতা দৃশ্যর অশ্রু কনা মুছে দিয়ে বললো
-“তুই মোটেও দুর্বল না দৃশ্য।তোর মতো সাহসী মেয়ে আমি একটাও দেখিনি।তুই যে বয়সে ভালোবাসার মর্যাদা রাখতে বিলাসী জীবন ছেড়ে এই সংগ্রামী জীবন কে বেছে নিয়েছিস,আমি হলে হয়তো পারতাম না।যাই হোক,আচ্ছা চল।আমারও বের হতে হবে।তোর গায়ক সাহেবের খাবার আমি রেডি করে রেখেছি।জিনিয়া আজ দেরিতে বেরুবে।তাই ওকে বলে যাবো তাকে নাস্তা দিতে।”

দৃশ্য নিজেকে সামলে লতার সাথে বেরিয়ে গেলো।গলির মোড়ে এসেই লতা বললো
-“তুই একটু দাড়া আমি এক্ষনি আসছি।”

বলেই লতা সামনের ফার্মেসিতে চলে গেলো।পাঁচ মিনিট পর সে ফিরে এসে দুইটা মেডিসিন দিয়ে বললো
-“ধর।মেডিসিন গুলো খেয়ে নে।”

দৃশ্য অবাক চোখে তাকিয়ে বললো
-“কিসের মেডিসিন?”

-“একটা পেইন কিলার।আর একটা কন্ট্রাসেপটিভ পিল।”

দৃশ্যকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে লতা বললো
-“জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছিস।কিন্তু আমি চাই না আর কোনো ভুলের জন্য তুই কষ্ট পা।তোর এই অনিশ্চিত জীবনে আরো একটা প্রাণ আসুক আমি চাই না।”

দৃশ্য লতাকে ঝাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কেদে দিলো।এই মানুষটা তাকে এতো বুজে কি করে?মায়ের পেটের বোন ও এতটা ভালোবাসতে পারতো না যতটা এই মানুষটা ভালোবাসে তাকে।তার না বলা কথা বা যন্ত্রণা সবটাই সে উপলব্ধি করতে পারে।দৃশ্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে লতা বললো

-“আরে পাগলী কাদিস কেনো?আমি সব সময় তোর পাশে আছি।চিন্তা করিস না।একদিন ভীষণ সুখী হবি দেখিস?”

দৃশ্য নিজের চোখ মুছে নিলো।লতা দৃশ্যর গায়ের ওরনা গলায় ভালো করে জড়িয়ে দিলো।এতে দৃশ্য ভীষণ লজ্জা পেলো।সকালে গোসল শেষে মিররে দেখেছে গলায় বেশ কয়েকটা কামড়ের দাগ।সে সকাল থেকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে রেখেছে।কিন্তু আপু ঠিক দেখে ফেলেছে।লতা আর দৃশ্যকে অসস্তিতে না ফেলে বললো

-“আজ শপে যেতেই হবে?তোকে দুর্বল দেখাচ্ছে।একটু রেস্টে থাকতে পারতি?”

দৃশ্য আসলেই ভীষণ দুর্বল।ঘুম থেকে উঠার পর থেকে তলপেটে চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে।কিন্তু আজ তার ডিউটি আছে।তাছাড়া মাহাদের মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না।তাই কাজে যাচ্ছে।দৃশ্য মুচকি হেসে বললো

-“আমি ঠিক আছি আপু।চিন্তা করো না।”

দৃশ্য চলে গেলো।আর লতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো
মেয়েটার জন্য তার ভীষণ মায়া হয়।আর কোনো কষ্ট যেনো মেয়েটাকে ছুঁতে না পারে।একটা স্বাভাবিক জীবন যেনো পায় মেয়েটা।

রোদের তীক্ষ্ণ আলো চোখে পড়ায় ঘুম ভেংগে গেলো মাহাদের।পিট পিট করে তাকিয়ে বেশ চমকে গেলো সে।অপরিচিত একটা জায়গায় নিজেকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলো।পরও মুহূর্তেই গত রাতের কথা তার মনে পড়তে লাগলো।বুকের মাঝে অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করলো। কাল জ্বরের ঘোরে কতো পাগলামি করেছে।দৃশ্যকে কি সে কোনো ভাবে কাছে আসতে বাধ্য করেছে নাকি সব কিছুতে দৃশ্যর সম্মতি ছিল?নিশ্চয়ই দৃশ্য তার উপর ভীষণ রেগে আছে কাল রাতের জন্য?সে আশেপাশে তাকিয়ে দৃশ্যকে খোঁজতে লাগলো।কিন্তু কোথাও পেলো না।ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।

পাশের রুম থেকে তখন জিনিয়া বেরিয়ে আসছিলো। মাহাদ কে দেখে সে অসস্তিতে পড়ে গেলো।একটা সময় সে যেই মানুষটার উপর মিনিটে মিনিটে ক্রাশ খেতো সে কিনা তার বেস্টফ্রেন্ড হাজবেন্ড?ভাবলেই লজ্জা পায় সে।দৃশ্যর সামনেই কতো কিছু বলেছে ভাবলেই হাসি পায়।
মাহাদ জিনিয়াকে দেখে মুচকি হেসে বললো

-“ভালো আছো আপু?”

জিনিয়া মনে মনে বললো শেষ মেস আপু?ক্রাসের মুখে আপু ভীষণ বেদনাদায়ক।শালীকা বলতে পারতো।জিনিয়া ভাবনা থেকে ফিরে নিজেকে সামলে বললো

-“জি ভালো।আপনি?”

-“ভালো।দৃশ্য কোথায়?”

-“দৃশ্য তো কাজে বেরিয়েছে আরো অনেক আগে।আপনি বসুন।নাস্তা করে নিন।”

-“না আপু আজ না।অন্য একদিন। এখন আমাকে বেরুতে হবে।আসি।”

-“জি।”

মাহাদ দ্রুত বেরিয়ে গেলো।মনটা আজ ভীষণ অস্থির হয়ে আছে।মায়ের সাথে আজ সে কথা বলবে।নিশ্চয়ই মা তার কথা বুজবে।দৃশ্যর তো কোনো দোষ ছিল না।আজকের পর এই মেয়েটাকে ছাড়া সে আর এক মুহুর্তও থাকতে পারবে না।অনেক হয়েছে দূরত্ব।আর কোনো দূরত্বই সে রাখতে চায়না। এবার সে দৃশ্য হাতটা ধরতে চায়।ভীষণ শক্ত ভাবে ধরতে চায়।আর এক ফোঁটা চোখের জল সে দৃশ্যর চোখ থেকে ঝরতে দিতে চায়না।আবার সে মাকেও কষ্ট দিতে চায় না।মায়ের মনে দৃশ্যকে নিয়ে যে রাগ,অভিযোগ রয়েছে সেটা দূর করা ভীষণ দরকার।

আজ কাজের ভীষণ চাপ।দৌড়ঝাঁপ করে দৃশ্য ভীষণ ক্লান্ত।দৃশ্য আজ আর দাড়িয়ে থাকতে পারছে না। পেটে চিনচিন বেথা হচ্ছে। আজ চাইলেও ছুটি পাওয়া যাবে না।আজ কাল সুপারভাইজার তার উপর আর তেমন চেঁচায় না।কিন্তু কাজ ভুল করলে সেলারি কেটে রাখে।আর কয়টা দিন।তার পর সে এই জবটা ছেড়ে দিবে।

প্রায় বিকেলের দিকে মাহাদের রেকর্ডিং শেষ হয়।সে রবিন কে বলে সোজা বাড়িতে যেতে।রবিন ও ড্রাইভারকে তাই করতে বলে।সে আজ তার স্যারের অবস্থা ঠিক বুঝতে পারছে না।তবে আজ তিনি ভীষণ অস্থির সেটা বুঝতে পড়ছে।

মাহাদ বাসায় পৌছে সোজা মায়ের রুমে চলে গেলো।আখি রহমান তখন কাপড় ভাঁজ করছিলেন। মাহাদকে দেখে তিনি মুচকি হাসলেন।ছেলে বলেছে অস্থিরতা কমলে বাসায় আসবে।কিন্তু এখন তো দেখা যায় ছেলের অস্থিরতা কমার বদলে আরো বেড়ে গেছে। মাহাদ মাকে জড়িয়ে ধরে কপালে আলতো চুমু খেলো।আখি রহমানের প্রাণ জুড়িয়ে গেলো।ছেলেটা তাকে ভীষণ ভালোবাসে। মাহাদ বললো

-“মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে প্লিজ।ভীষণ ব্যাথা করছে।”

আখি রহমান বিছানায় বসে মাহাদকে কাছে ডাকলেন। মাহাদ খুশি মনে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।আখি রহমান পরম আদরে মাথায় হাত বুলাতে থাকলো। মাহাদ বললো

-“তোমার হাতে মেজিক আছে।মিনিটেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।”

কিছুক্ষণ নিরবতা পর মাহাদ কাপা গলায় বললো
-“আমার সাথে কি কোনোদিন কথা বলবেনা মা?তুমি কথা না বললে ভীষণ কষ্ট হয়।মারো,কাটো যা খুশি করো।কিন্তু চুপ করে থেকো না।কারণ নিজেকে তখন আরো অপরাধী লাগে।
বাবা কি আমাকে ক্ষমা করেছে মা?নাকি ভীষণ অভিমান করে আছে?আমি যে তার আদর্শ ছেলে হতে পারিনি।আমি কাউকে ভালো রাখতে পারিনি।না তোমাকে আর না..”

মাহাদ আর বলতে পারলো না।
আখি রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন
-“কে বলেছে তুই আদর্শ ছেলে হতে পারিস নি?অবশ্যই তুই আমার আদর্শ ছেলে।বরং ভালো ছেলে হতে যেয়ে ভালো স্বামী হতে পারিস নি।”

মাহাদ চমকে তাকালো মায়ের দিকে।আজ কত দিন পর মা তার সাথে কথা বলছে।সে তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।আখি রহমান বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বললেন

-“তোর বাবা মোটেও তোর প্রতি অভিমান করে নেই। বরং তোর উপর ভীষণ সন্তুষ্ট।কিন্তু তিনি আমার উপর অসন্তুষ্ট। আমি তার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে পারিনি।”

মাহাদ কপাল কুঁচকে তাকালো।মা কিসের কথা বলছে?আখি রহমান আবার বললেন
-“তোর বাবা মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছিলো

‘ দৃশ্য এই বাড়ির বউ।ওর কোনো অসম্মান যেনো না হয়।আমার ছেলের সুখ এই মেয়েটার মধ্যে নিহিত।তাই আমার কিছু হয়ে গেলেও দৃশ্যর দিকে যেনো কোনো আঙ্গুল না উঠে।আশরাফের মেয়ে বলে তাকে কোনো অসম্মান যেনো না করা হয়।আমার ছেলের বউয়ের দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে গেলাম।’

কথাটা বলে আখি রহমান দুফোঁটা অশ্রু ঝরালেন। মাহাদ তখন অবাক চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।আখি রহমান নিজেকে সামলে বললেন

-“কিন্তু দেখ আমি তোর বাবার কথা রাখতে পারিনি।এই বাড়ির বউয়ের যোগ্য সম্মান দৃশ্যকে দিতে পারিনি।বরণ আমার সব রাগ জমা হয়েছে বাচ্চা মেয়েটার উপর।আমার জন্যই আজ তোদের মধ্যে এতো দূরত্ব।আমি কখনো মুখে না বললেও তোকে আমার ব্যবহারে বুঝিয়েছি।তুই আমার কষ্টের কথা ভেবে মেয়েটার হাত ছেরেছিস।”

মাহাদ মাথা নিচু করে বসে রইল।তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।তার মানে বাবা তার বিয়ে মেনে নিয়েছিলো?আখি রহমান কাপা কাপ গলায় বললেন

-“আমি তার কথা রাখতে পারিনি।আমজাদ রহমানের ছেলের বউ এসব মোটেই ডিজার্ভ করে না।অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি মেয়েটাকে।কিন্তু তোর বাবার মৃত্যুর পর আমি ভেঙে পড়েছিলাম।আমার সব রাগ জমা হয় সেই বাচ্চা মেয়েটার উপর।আমি ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেছিলাম।নিজের ছেলের যন্ত্রনাও আমি বুঝতে পারিনি।আমার এই ক্রোধের জন্য যে আমার নিজের ছেলেই এতো সাফার করছিলো আমি কেনো বুঝতে পারিনি?ভীষণ স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম।”

মাহাদ মাকে ঝাপটে ধরে কেদে দিলো।ভীষণ অন্যায় করেছে সে দৃশ্যর সাথে।মেয়েটার কোনো অপরাধ ছিলো না।অথচ দিন শেষে মেয়েটাই বেশি কষ্ট পেলো।সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেলো।কিন্তু মাহাদের উপর কোনো অভিযোগ তুলে নি। আখি রহমান ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

-“তুই থাকতে আমার ছেলের বউকে যেনো আর কোনো কষ্ট করতে না হয়।আমার ছেলের বউ রাজরানীর মতো শুধু ফরমায়েশ করবে,আর তুই সব পূরণ করবি।আজ এক্ষনি আমার ছেলের বউকে নিয়ে আসবি।আমার ঘরের লক্ষিকে আর দূরে রাখতে চাইনা।তার প্রাপ্য সম্মানই তাকে দিতে চাই।তোর বাবার ভীষণ পছন্দ ছিলো দৃশ্যকে।হসপিটালে মুচকি হেসে বলেছিলো

-“দেখলে তো শেষ মেশ এই বাচ্চাটাই আমার ছেলের বউ হয়ে আসলো।ওই আশরাফ আমার ছেলেকে আটকাতে পারেনি।তার মেয়েকে নাকের ডগা থেকে ঠিক নিয়ে এসেছে আমার ছেলে।”

মাহাদ মাথা নিচু করে বললো
-“তোমার বৌমা আমার উপর ভীষণ রেগে আছে।এতো সহজে আমাকে মাফ করবে না।”

-“রেগে থাকলে রাগ ভাঙ্গাবি।আমি নিজেও তার কাছে ক্ষমা চাইবো।অনেক অন্যায় হয়েছে তার সাথে।”

মাহাদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।মাকে বলে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো দৃশ্যর বাসার উদ্দেশ্যে।আজ আর তাকে কেউ আটকাতে পারবে না।পিচ্ছিটাকে যে তার খুব করে চাই।
শামসুন্নাহার বেগম এতক্ষণ সবটাই শুনলেন।তার ধারণা ছিল আখি এই মেয়েকে কক্ষনো মানবে না।কিন্তু তিনি ভুল।তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। মাহাদ বেরিয়ে যেতেই তিনি আখির রুমে ঢুকেই রেগে বললেন

-“তোমার মাথা ঠিক আছে বউ?ওই মাইয়ারে তুমি কেমনে মাফ কইরা দিল?ভুইলা গেলা ওই মাইয়ার বাপের লাইগা তুমি বিধবা হইছো।”

-“কিছুই ভুলিনি আমি আম্মা।কিন্তু এই সব ওই মেয়েটার কোনো দোষ ছিল না।”

-“ওই আশরাফের মাইয়ারে আমি এই বাসায় ঢুকতে দিমু না।আমার দুই পোলায় ওই জানোয়ারের লাইগা কষ্ট পাইছে।অহন আমার নাতির জীবন শেষ করতে উইঠা পইড়া লাগছে।ওই মাইয়া তমগো মায় পোলারে তাবিজ করছে।হের লাইগা তোমরা অহন ওর অংগুরের ইশারায় নাচতেছো।”

-“আম্মা বাবার অপরাধের শাস্তি মেয়ে কেনো পাবে?সে ক্ষেত্রে কিন্তু আপনার নাতি বেশি দোষী।সে কিন্তু দৃশ্যকে বিয়ের জন্য প্রেসার দিয়েছে।ওই মেয়ে না আপনার নাতি ওই মেয়ের পেছনে পরে আছে।আপনার নাতি তাকে ছেড়ে চলে এসেছিলো।আশরাফ তখন মেয়েটার অন্য জায়গাতে বিয়ে ঠিক করেছিল।কিন্তু দৃশ্য আমার ছেলেকে এতটাই ভালোবাসে যে তার জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারেনি।এত বড় ঘরের মেয়ে হয়েও আমার ছেলেকে ভালোবেসে মেয়েটা সব ছেড়ে চলে এসেছে। এখন এই শহরে মেয়েটা সংগ্রাম করে টিকে আছে।মেয়েটা আমার ছেলেটাকে ভালোবেসে সব হারিয়েছে।আমার মাহাদকে যেই মেয়ে এতটা ভালোবাসতে পারে তার উপর আমি কি করে রেগে থাকতে পারি?আম্মা আপনি নিজেও জানেন আমার মাহাদ মেয়েটার জন্য কতটা পাগল।মেয়েটাকে ছাড়া আমার ছেলে কোনো দিন সুখী হতে পারবে না।আর মাহাদ অন্য কাউকে বিয়েও করবে না।এই কয়েক বছরে আপনি তো কম চেষ্টা করেননি মাহাদকে বিয়ের জন্য রাজি করতে।কিন্তু পারেননি।আমার ছেলে দৃশ্যকে কখনোই ছাড়তে পারবে না আম্মা।অন্তত নিজের নাতির সুখের কথা ভেবে আগের সব ভুলে যান আম্মা।”

শামসুন্নাহার বেগম কিছু না বলে রেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।কেউ তার কথা শুনছে না।ওই অলক্ষী মেয়েকে বাড়িয়ে তুলতে উঠে পড়ে লেগেছে।

বিকেলে দৃশ্য ডিউটি শেষ করে শপ থেকে বেরিয়ে পড়লো।কিছুটা সামনে এগিয়ে রিকশা খুঁজতে লাগলো।শরীর ভীষণ দুর্বল লাগছে।হঠাৎ দৃশ্যর চোখ পড়ে রাস্তার অপর পাশে।সেখানে ভীষণ পরিচিত একটা মুখ দেখে দৃশ্য থমকে যায়।মুহূর্তেই দৃশ্যর দুচোখে অশ্রু ভিড় করতে শুরু করে।আজ কতো দিন পর এই মানুষটাকে দেখছে।কতটা পরিবর্তন হয়ে গেছে মানুষটা।দৃশ্যর ইচ্ছে করছে মানুষটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাদতে।দৃশ্য আর কিছু না ভেবেই দ্রুত রাস্তা পার হয়ে মানুষটার কাছে ছুটে যেতে লাগলো।কিন্তু ব্যাস্ত রাস্তার দিকে দৃশ্যর নজর ছিল না।হটাৎ একটা প্রাইভেট কার দৃশ্যকে ধাক্কা দিতেই দৃশ্য ছিটকে পড়ল অনেকটা দূরে।মুহূর্তেই মাথা ফেটে গড়গড় করে রক্ত ঝরতে লাগলো।ততক্ষণে রাস্তায় ভিড় জমে গেলো।দৃশ্য এই ভিড়ে সেই পরিচিত মুখটা খুঁজতে লাগলো।কিন্তু তার দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছে।সামনের সবকিছুই ঝাপসা হয়ে আসছে।সারা শরীর জুড়ে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে।দৃশ্য কাঁপা গলায় শুধু বললো
-“ভাভাইইইয়া!!!”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here