তোমার_আমার_প্রণয় #israt_jahan_arina #part_56

0
967

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_56

নিকষ কৃষ্ণ আকাশে নির্বিঘ্নে উড়ে বেড়াচ্ছে তুলো রাশির দল। তাদের মাঝে মোহনীয় আলো ছড়াচ্ছে বৃত্তকার চাঁদটি।কিন্তু চারপাশের কোনো সন্দৌর্যই মাহাদকে মোহিত করতে পড়ছে না।সে মুখে মাস্ক পড়ে icu সামনে দাড়িয়ে আছে।দৃশ্যকে এক নজর দেখার জন্য সে এতক্ষণ ঠিক যতোটা অস্থির হয়ে ছিলো,এই মুহূর্তে ঠিক ততটাই ভয় হচ্ছে।দৃশ্যকে দেখে সে স্থির থাকতে পারবে তো?

ফাহিম বাড়িতে কল করে মাকে সব জানালো।আনিকা কবির সব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।আজ এতদিন পর মেয়েটার খোঁজ পেলো কিন্তু এই অবস্থায়?তিনি হাউমাউ করে কাদতে লাগলেন।দৃশ্যর কথা শুনে আশরাফ হুসাইন এই প্রথম ভীষণ কষ্ট পেলেন।মেয়েটাকে তিনি প্রাপ্য ভালোবাসা দিতে পারে নি।তাই বলে কি মেয়েটা অভিমান করে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে চাইছে? আনিকা কবির ঢাকায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন।তাই ফাহিম নাবিল কে কল করে সব জানায়।আর তার মাকে দৃশ্যর কাছে নিয়ে আসতে বলে।নাবিল এই সব শুনে বেশ কষ্ট পায়।দৃশ্যকে সে ঠিক নাবিলার মতোই ভালোবাসে।আর আজ সেই বোনটার এই করুন অবস্থা কিছুতেই মানতে পড়ছে না।

বাইরে অলরেডি মিডিয়া এসে ভির জমিয়েছে।একজন সেলিব্রেটি পাগলের মতো কার জন্য হসপিটালে ছুটে এসেছে তা জানার আগ্রহে।সবাই নানান প্রশ্ন করে যাচ্ছে রবিন কে।এসব খবর যেনো বাতাসের আগে ছড়িয়ে পরে।রবিন আর সিকিউরিটি গার্ড মিলে এইসব বিষয় টেকেল দিচ্ছে।

মাহাদ অনেক সাহস যোগিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।দেখলো রুমটির কর্নারের বেডে কেউ শুয়ে আছে। মাহাদ কাপা কাপা পা নিয়ে সে দিকে এগিয়ে গেলো। বেডের কাছে আসতেই তার চোখ ভিজে উঠলো।

দৃশ্যর মাথায় ব্যান্ডেজ,মুখে অক্সিজেন মাস্ক।যা দিয়ে দৃশ্য জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে।পায়ের দিকে নজর যেতে দেখলো ডান পায়ে প্লাস্টার করা।এছাড়া হাতের বেশ কয়েক জায়গাতে ব্যান্ডেজ করা। মাহাদের চোখ আটকে গেলো গলার দিকে।সেখানে বেশ বড় আঘাতের চিন্হ।যাতে অয়েনমেন্ট দেওয়া।সেই আঘাতের ঠিক উপরে কয়েকটা লাভ বাইট নীলচে হয়ে আছে।

মাহাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো।গতকাল রাতেই তারা ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে ছিলো। যায় বেশ কয়েকটা চিন্হ এখনো তার বউয়ের গায়ে ফুটে আছে।কতটাই না মোহনীয় ছিলো সেই রাতটা।আর আজ তার ভালোবাসা ক্ষতবিক্ষত হয়ে বেডে পড়ে আছে।এমন কিছু ঘটবে বুঝতে পড়লে মাহাদ ভুল করেও দৃশ্যকে চোখের আড়াল করতো না।নিজের বুকে লুকিয়ে রাখতো।

মাহাদ দৃশ্যর কাছে এসে কপালে গভীর ভাবে চুমু খেলো।তার গাল বেয়ে অশ্রু ধারা দৃশ্যর কপালে পড়ছে।সে দৃশ্যর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিলো।বেডের পাশের টুলে বসে দৃশ্যর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলো।দৃশ্যর হাতেও বেশ আঁচড় লেগে অনেক জায়গায় ছিলে গেছে।সে আলতো করে দৃশ্যর হাতের উলটো পিঠে বেশ কয়েকবার চুমু খেলো।
দৃশ্যর নিস্তেজ দেহ দেখে মাহাদের বুকে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।কতটা যন্ত্রণা সহ্য করছে তার পিচ্ছিটা। মাহাদ দৃশ্যর হাত নিজের গালে ছোয়ালো।আর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো

-“তোমার কিছু হবে না পিচ্ছি।তোমার মাহাদ তোমার পাশে আছে।কিছু হতে দিবনা তোমাকে।অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে।তাই আমার উপর অভিমান করে চলে যেতে চাইছো তাই না?আমি সেটা মোটেও হতে দেবো না।”

মাহাদ আবারো দৃশ্যর হাতে চুমু খেলো।আর কাদতে কাদতে বললো

-“সুস্থ হয়ে জলদি আমার কাছে ফিরে এসো বউ। আই প্রমিজ আর কোনোদিন তোমাকে কষ্ট দিবো না।এইযে তোমার হাত শক্ত করে ধরেছি,শেষ নিঃশ্বাস অব্দি এই হাত ছাড়বো না।একটা মিষ্টি সংসার হবে আমাদের।সেই সংসারের রানী হবে তুমি আর আমি হবো তোমার গোলাম।আমারা দুজনে মিলে যে যে স্বপ্ন বুনেছি সবটা পূরণ করবো।অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে।জলদি ফিরে এসো বউ। আই অ্যাম ওয়াটিং ফর ইউ।”

মাহাদ খেয়াল করলো দৃশ্য বেশ জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।একটা সময় দৃশ্য অস্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। মাহাদ চমকে যায়।সে অস্থির হয়ে দৃশ্য কে ডাকতে শুরু করে

-“দৃশ্য?কষ্ট হচ্ছে তোমার?এই দৃশ্য চোখ খোলো।দৃশপাখী কথা বলো প্লিজ।দৃশ্য…?”

একটা সময় মাহাদ চিৎকার করে দৃশ্যকে ডাকতে লাগলো।বাইরে থেকে নার্স শব্দ শুনে দ্রুত ভেতরে গেলো।ভিতরে প্রবেশ করে দৃশ্যর অবস্থা দেখে দ্রুত ডক্টর কে ডাকতে লাগলো।দুই মিনিটের মধ্যে ডক্টর ভেতরে প্রবেশ করে দৃশ্যকে চেক করতে লাগলো।আর মাহাদকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বললো।কিন্তু মাহাদ নাছোড় বান্দা।সে দৃশ্যর হাত আরো শক্ত করে ধরলো।আর বলতে লাগলো

-“আমি কোথাও যাবো না।আমার দৃশ্যকে ছেড়ে আমি যাবনা।আমি কাছে না থাকলে ও আমার উপর অভিমান করে চলে যাবে।আমাকে এখানে থাকতে দিন ডক্টর।”

ততক্ষণে মাহিম হসপিটালে এসে পড়েছে।ফাহিম আর মাহিম ভেতরে প্রবেশ করে মাহাদকে এক প্রকার টেনে বের করতে থাকে। মাহাদ কাদতে কাদতে বলে

-“মাহিম আমাকে তোর ভাবির কাছে যেতে দে।ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।ওর কিছু হলে আমি বাঁচতে পারবো না।ও যদি আমাকে বাবার মতো ছেড়ে চলে যায়,কি নিয়ে বাঁচবো আমি?আমাকে ওর কাছে যেতে দে।”

ফাহিম আর মাহিম মাহাদকে জোর করে বাইরে এনে দার করায়।মাহিমের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ভাইকে এই অবস্থায় দেখে।আর কেউ জানুক বা না জানুক সে তো জানে তার ভাই ভাবিকে ঠিক কতটা ভালোবাসে?আজ ভাবির কিছু হলে তার ভাই যে নিঃশেষ হয়ে যাবে।মাহিম মাহাদকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো।আর কাঁপা গলায় বললো

-“ভাইয়া এমন পাগলামী করো না।ভাবীর কিছু হবে না। ডক্টর কে দেখতে দাও।তুমি এমন করলে ডক্টর তার কাজ কি করে করবে?তোমার নিজেকে শান্ত করতে হবে।”

মাহাদ মাহিম কে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলো।মাহিম ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো।বেশ কিছুক্ষন পর ডক্টর বেরিয়ে আসলো।আর জানালো আজ রাতে দৃশ্যকে অবজারবেশনে রাখা হবে।দৃশ্যর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এখনো হচ্ছে।একে ‘ট্রোম্যাটিক ব্রেইন ইনজুরি’ বা টিবিআই বলে।আজ রাতটা তারা দৃশ্যর অবস্থা অবজার্ভ করবে।রাতের মধ্যে যদি প্রগ্রেস না হয় তবে হয়তো দৃশ্যর ব্রেন সার্জারির প্রয়োজন পড়তে পারে।
ডক্টরের কথায় সবাই অনেকটা ভেঙে পড়েছে।ফাহিম দুহাতে মুখ গুজে কাদঁছে।বোনটাকে এতদিন পর পেয়েও বুকে জড়িয়ে ধরতে পারলনা।এই ছোট বয়সে বোনটা এতো বড়ো সার্জারির ধকল কি করে নিবে?

মাহাদ চুপ করে মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে আছে।দু চোখ তার ভেজা।নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে।সে তার বউকে সকল বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি।নিজের কোনো দায়িত্বই সে পালন করতে পারেনি।এই মেয়েটাকে সে নিজের বুকে পরম যত্নে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলো।কিন্তু পারেনি কিছুই করতে।বুকে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।সে বির বির করে মহান আল্লাহ তায়ালাকে ডাকতে লাগলো।তার পিচ্ছিটা সুস্থ হলে সে আর কোনোদিন নিজের কাছ থেকে তাকে দূরে রাখবে না।সবার সাথে যুদ্ধ করতে হলে তাই করবে।তবুও সে নিজের বউকে আর এক মুহূর্তের জন্য একা ছাড়বে না।

মাহিম মাহাদকে শান্ত করে ফাহিমের কাছে গেলো।মানুষটা ভীষণ ভেঙে পড়েছে।কিন্তু তাকে সান্তনা দেবার কেউ নেই পাশে।ফাহিমের পাশে বসে তার কাধে হাত রাখলো।ফাহিম মাথা তুলে তাকালো।মাহিম দেখলো ফাহিমের চোখ ভেজা আর লাল হয়ে আছে।মাহিম বললো

-“নিজেকে শক্ত করুন।আমার বিশ্বাস ভাবির কিছু হবে না।তার আপন মানুষ গুলো তাকে ভীষণ ভালোবাসে।এই ভালোবাসা উপেক্ষা করে ভাবী থাকতে পারবে না।”

ফাহিম মাহিম কে জড়িয়ে ধরলো।একটা কাধ খুঁজছিলো সে মন খুলে কাদার জন্য।সেটা পেয়ে সে কাদতে লাগলো।অসম্ভব অস্থিরতায় সেই রাতটা পার করলো তারা।
সকালের সূর্য উঠার সাথে সাথে সবাই হসপিটালে এসে উপস্থিত হয়।আনিকা কবির এসেই ফাহিমকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদছে।ফাহিম মাকে শান্ত করতে করতে এক নজর হুইল চেয়ারে বসা বাবার দিকে তাকালো।আশরাফ হুসাইন ছেলের দৃষ্টিতে অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই পেলেন না।তিনি মাথা নিচু করে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলেন।একপলক তার চোখ পড়ল মাহাদের দিকে।অসম্ভব সুদর্শন ছেলেটা কেমন নিস্তেজ,নিষ্প্রাণ হয়ে চেয়ারে বসে আছে।তার চোখ অসম্ভব লাল হয়ে ফুলে আছে।আজ প্রথম তিনি অনুভব করলেন এই ছেলেটা তার মেয়েকে পাগলের মতো ভালোবাসে।নিজের অপরাধ বোধ বাড়লো আখি রহমানকে হসপিটালে দেখে।

আখি রহমান দৃশ্যর কথা শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি।বিনা অপরাধে মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে।তবে আল্লাহ এই বাচ্চা মেয়েটাকে কেনো এই যন্ত্রণা দিচ্ছে?তিনি জানে মেয়েটা যে তার ছেলের প্রাণ।এই মেয়েটার কিছু হলে তার ছেলেকেও তিনি হারাবেন।ছেলেকে নিষ্প্রাণ ভাবে চেয়ারে পড়ে থাকতে দেখে তার বুকটা ধক করে উঠল।কোনো মা পারেনা ছেলের এই যন্ত্রণা সহ্য করতে।

তিনি মাহাদের পাশে বসে গালে হাত বুলিয়ে দিলেন। মাহাদ অশ্রু শিক্ত নয়নে মায়ের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো

-“দেখোনা না মা।তোমার বৌমা আমার উপর ভীষণ রেগে আছে।এই ভাবে থেকে আমাকে কেমন নরক যন্ত্রণা দিচ্ছে।আমি যে ঠিক ভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।দম বন্ধ হয়ে আসছে।ওকে বলো না এই ভাবে আমাকে যন্ত্রণা না দিতে।আমি যে আর নিতে পারছিনা।”

-“কিছু হবেনা বাবা।সব ঠিক হয়ে যাবে।আল্লাহকে ডাক বাবা।”

মাহাদ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।আর আখি রহমান ছেলের এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
অনেকক্ষণ পর আনিকা কবিরের পাশে বসলেন আখি রহমান।আনিকা কবিরের কষ্ট তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন।তাই সব দ্বন্দ্ব ভুলে তাকে সান্তনা দিতে লাগলেন।আর বললেন

-“আমার বৌমা মোটেও দুর্বল না।সে সংগ্রাম করতে জানে।দেখবেন ঠিক সে আমাদের মাঝে সুস্থ ভেবে ফিরে আসবে।আপনি ধৈর্য ধরুন বেয়াইন সাহেব।”

আনিকা চমকে তাকালো।আখি রহমানের কাছ থেকে এমন কথা তিনি মোটেও আশা করেননি।তিনি ভেবেছেন তার স্বামীর মৃত্যুর কথা মনে করে হয়তো তাদের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি ছুড়ে দিবে।কিন্তু এমন কিছু না করে বরং তাকেই সান্তনা দিচ্ছেন।

আশরাফ হুসাইন লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলেন।আজ তিনি ভীষণ অনুতপ্ত।এই মানুষগুলোকে সে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে।কিন্তু তাদের দুঃসময় এই মানুষ গুলি তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে।

সকালে ডক্টর দৃশ্যকে পর্যবেক্ষণ করে জানায় দৃশ্য এখন বিপদ মুক্ত।তার মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে।আরো আটচল্লিশ ঘন্টা পর দৃশ্যর জ্ঞান ফিরবে। ডক্টরের কথায় সকলেই চিন্তা মুক্ত হয়। মাহাদ যেনো নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলো।সে খুশিতে ফাহিমকে জড়িয়ে ধরলো।ফাহিম ও মাহাদকে জড়িয়ে ধরে খুশির অশ্রু ঝরালো।কয়েক মুহূর্ত পর নিজেদের ছাড়িয়ে দুই দিকে ফিরে দাড়িয়ে রইলো। এদের কাণ্ড দেখে মাহিমের হাসি পেলো।খুশিতে সব ভুলে নিজেদের জড়িয়ে নিলেও এদের ইগোর কোনো কমতি নেই।ভাইয়া কপাল গুনে এমন শালা পেয়েছে।একদম তার মতোই।
মাহিম আর রবিন মিলে সবাইকে জোর করে নাস্তা খাওয়ালেও ফাহিম আর মাহাদকে কিছুতেই খাওয়াতে পারলো না।ভাবিকে যে এই দুইজন মানুষ অসম্ভব ভালোবাসে।

সবাই একে একে দৃশ্যকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে এসেছে।আনিকা কবির মেয়েকে দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি।সারা মুখে অসংখ্য চুমু খেয়েছেন।মেয়েটার মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখেছেন তিনি।

আখি রহমান সবাইকে রিকোয়েস্ট করলেন তাদের বাড়িতে যেয়ে সবাইকে রেস্ট নিতে।কিন্তু সবাই মানা করলো।মাহিম বুঝতে পারছে সবার মধ্যে দ্বিধা কাজ করছে।তার চাইতে বড় কথা দাদী কেমন রিয়েক্ট করে কে জানে?তাই সে ফাহিমকে তাদের ধানমন্ডির বাসায় থাকতে রিকোয়েস্ট করলো।এতে ফাহিম না করলেও মাহিম আর আখি রহমানের জোরাজুরিতে রাজি হলো।ফাহিমের পরিবারে সকলকে নিয়ে মাহিম চলে গেলো।আখি রহমান ছেলের পাশে রয়ে গেলেন।
ফাহিম ফ্রেশ হয়েই মাহিমের সাথে হসপিটালে চলে আসলো।বোনকে রেখে তার ঘুম হবে না।

মাহাদ দৃশ্যর কেবিনে বসে আছে। এখন দৃশ্যর মুখের অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেয়া হয়েছে।দৃশ্যর এখনো জ্ঞান ফেরেনি। সে গভীর ঘুমে মগ্ন। মাহাদ দেখলো দৃশ্যর নিচের ঠোঁট কিছুটা কেটে গেছে। মাস্কের জন্য যা আগে বুঝা যায়নি।সে দৃশ্যর কাটা ঠোটে আলতো হাত বুলালো।এই মেয়েটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে।সেই ক্লাস এইটে পরা বাচ্চা মেয়েটা তার জীবনে এসে তার মন মস্তিষ্ক সবটাই দখল করে নিয়েছে। এখন তাকে ছাড়া আর কিছুই চিন্তা করতে পারেনা সে।তার জীবনের সুন্দর মুহূর্ত গুলো এই মেয়েটার সাথেই কাটিয়েছে।নিজের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি সে এই মেয়েটাকেই পাশে চায়।

মাহাদ খুব সাবধানে দৃশ্যর পাশে অল্প জায়গায় শুয়ে পড়লো।দৃশ্যকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো।কিযে প্রশান্তি!দুদিনের ধকলে মাহাদ ভীষণ ক্লান্ত ছিলো।সে দৃশ্যকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

ফাহিম আর মাহিম অনেক রাতে হসপিটালে চলে আসলো।মাহিম নিজের মাকে রবিনের সাথে বাসায় পাঠিয়ে দিল।ফাহিম আর মাহিম কেবিনে ঢুকে দেখলো মাহাদ দৃশ্যকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।এই দুইজনকে এক সাথে দেখে ফাহিমের বুকটা জুড়িয়ে গেলো।তার বোনকে মাহাদের মতো কেউ ভালোবাসতে পারবে না।তার বোন নিজের জন্য সঠিক মানুষটাই বেচেঁ নিয়েছে।তার বোনের জন্য যে সীমাহীন সুখ অপেক্ষা করছে সেটা সে বুঝতে পারলো।ফাহিম দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।মাহিম দ্রুত ভাই আর ভাবির এই সুন্দর মুহূর্তের কয়েকটা পিক তুলে নিলো।তারপর মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলো।

সকালে সূর্যের আবছা আলো এসে কেবিন এর অন্ধকারকে কাটিয়ে তুলেছে।দৃশ্যর নাকে একটা ভীষণ পরিচিত ঘ্রাণ আসছে।সে ধীরে ধীরে চোখ খোলার চেষ্টা করতে লাগলো।কিন্তু সামনের সব ঝাপসা মনে হচ্ছে।সে আরো কয়েকবার চোখের পাতা পিটপিট করে তাকালো।মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলো।এমনকি ডান পা টা নাড়াতে পারলো না।মাথা তুলে ধীরে ধীরে উপরে তাকিয়ে মাহাদ কে দেখতে পেলো। মাহাদ ঘুমিয়ে আছে।আর সে মাহাদের বুকে আছে।সে কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পড়ছে না।ধীরে ধীরে তার অ্যাক্সিডেন্টের কথা মনে হতে লাগলো।কিন্তু এই মুহূর্তে মাহাদের বুকে তার ভীষণ আরাম লাগছে।ভীষণ শান্তি অনুভব হচ্ছে।সে বির বির করে বললো

-“এটা কি জান্নাত?”

-“না আমার বুক।”

দৃশ্য চমকে তাকিয়ে দেখলো মাহাদ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সে মাহাদের বুকে মুখ গুজে বললো
-“এখানে এতো শান্তি লাগে কেনো?”

-“আমার বুকে অশান্তি দিয়ে তোমার তো শান্তি লাগবেই।”

দৃশ্য মুচকি হাসলো। মাহাদ দৃশ্যর কপালে আলতো চুমু খেয়ে বললো
-“আমাকে কষ্ট দিয়ে ভীষণ মজা পাও তাই না?একটা বার ভাবলে না তোমার কিছু হলে আমার কি হতো?”

-“আমি বুঝতে পারিনি এমন কিছু হবে।”

মাহাদ দৃশ্যর হাতটা শক্ত করে ধরে হতে চুমু খেল। মাহাদ নরম সুরে বললো

-“একদিন জিজ্ঞেস করেছিলে না এই হাতটা শক্ত করে ধরে মায়ের সামনে দাড়াতে পারবো কিনা?আজ এই হাতটা শক্ত করে ধরে শুধু মায়ের না সারা দুনিয়ার সামনে দাঁড়াতে পারবো। তোমার হাতটা শেষ নিশ্বাস অব্দি ছাড়বো না বউ। শেষবারের মত আমার উপর বিশ্বাস রেখে দেখো।”

দৃশ্যর চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরলো। মাহাদ দৃশ্যর চোখের জল মুছে রাগী সুরে বললো

-“তোমার জন্য এতগুলো শাস্তি বরাদ্দ। এত অসচেতনভাবে কেন রাস্তায় হাটছিলে?”

-“আসলে আমি বুঝতে পারিনি।”

হঠাৎ দৃশ্যর মনে পড়লো সে কেনো রাস্তায় ওই ভাবে দৌড়ে গেছিলো।সে অস্থির হয়ে বললো

-“আ…আমি সেখানে ভাইয়াকে দেখেছিলাম।”

-“তোমার ভাইয়াই তোমাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে।”

দৃশ্যর চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো।সে করুন দৃষ্টিতে মাহাদের দিকে তাকিয়ে বললো

-“আমি ভাইয়াকে দেখবো। কোথায় ভাইয়া?”

-“বাইরে আছে।তুমি শুয়ে থাকো।আমি ফাহিমকে পাঠাচ্ছি।আর তোমার জন্য আরো অনেকেই অপেক্ষা করছে।”

মাহাদ বেরিয়ে যাওয়ার আগে দৃশ্যকে বললো
-“তোমার দুয়ারে অনাবিল সুখ এসে করা নাড়ছে।সেই সুখটুকু পায়ে ঠেলে দিও না।কারণ তোমার ডিসিশন এর উপর অন্য করো বেচেঁ থাকা নির্ভর করছে।”

দৃশ্য এক দৃষ্টিতে মাহাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।আসলেই কি সুখ তার দুয়ারে বসে আছে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here