#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_57
নিস্তব্দতা ছেয়ে আছে সারা রুম জুড়ে।দৃশ্য এক দৃষ্টিতে তার ভাইকে পর্যবেক্ষণ করছে।ফাহিম মাথা নিচু করে দৃশ্যর সামনে বসে আছে।অনেক অন্যায় করেছে সে বোনটার সাথে।নিজেকে তার জন্য কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না।
একটু আগে মা এসে দেখা করে গেছে।দৃশ্যকে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদেছে।কোনো মা সন্তানের এই করুন পরিস্থিতি সহ্য করতে পারেন না।মেয়ের মুখে কতো শত চুমু খেয়েছেন তিনি।কেদে বলেছেন
-“তুই ঢাকায় এসে আমার সাথে যোগাযোগ কেনো রাখিস নি?আমি তোর চিন্তায় শান্তি পেতাম না।”
-“মা আমাকে মাফ করে দিও।আমি বাবার ভয়ে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।”
-“তুই কেমন আছিস মা?”
-“চিন্তা করোনা আমি ভালো আছি।বাবা কেমন আছে?বাবা আসেনি?”
আনিকা কবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে দৃশ্যকে তার বাবার অবস্থার কথা জানালেন।দৃশ্য ডুকরে কেঁদে উঠে।বাবা নামক মানুষটি কাছ থেকে কখনো কোনো ভালোবাসা পায়নি।কিন্তু তবুও সে বাবা।তার সাথে রক্তের সম্পর্ক।বাবার অবস্থা দৃশ্যকে প্রচন্ড যন্ত্রণা দিয়েছে।সে অস্থির হয়ে বাবাকে দেখতে চাইলো।
আশরাফ হুসাইন লজ্জায় প্রথমে মেয়ের সামনে যাননি।একমাত্র মেয়েকে তিনি ভীষণ কষ্ট দিয়েছেন।অহংকারের বেড়াজালে থেকে তিনি সন্তানদের নিজের কাছ থেকে দূর করে ফেলেছেন।দৃশ্যর সামনে যাওয়ার সাহস তিনি পাচ্ছেন না।আনিকা কবির বুজিয়ে তাকে দৃশ্যর সামনে নিয়ে যায়।
হুইলচেয়ারে বসা প্যারালাইজড বাবাকে দেখে দৃশ্যর ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিলো।শক্ত সবল মানুষটা কেমন নেতিয়ে পড়েছে।চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে।সেই কঠিন ভাব আর বাবার মধ্যে নেই।ডান পাশ সম্পূর্ণ অবশ।
আশরাফ হুসাইন এক হাতে দৃশ্যর হাত ধরে অনেক সময় কাদলেন।দৃশ্যর কাছে মাফ চাইলেন নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য।পরম আদরে দৃশ্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।দৃশ্যর চোখ ভিজে উঠেছিলো।বাবার এই স্নেহময় হাতটাই সে সারা জীবন খুঁজেছে।কিন্তু পায়নি।আজ বাবার স্নেহ পেয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে।
ফাহিমের দিকে তাকিয়ে দৃশ্য বললো
-“আমার সাথে কথা বলবে না ভাইয়া? এখনো রেগে আছো?”
ফাহিম ভেজা চোখে তাকালো দৃশ্যর দিকে।দাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে কাপা কাপা গলায় বললো
-“এই ভাইটার উপর একটু ভরসা রাখতে পাড়লি না?কেনো এই ভাবে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসলি?আমি তো ওই বিয়েটা কখনোই হতে দিতাম না।”
-“আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম ভাইয়া।কি করা উচিৎ কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।”
-“আমি তোর ভাই হওয়ার যোগ্যই না।নিজের বোনকে কি করে এত কষ্ট দিলাম?সারা জীবন যাকে আগলে রেখেছি তার গায়েই হাত তুলেছে।যায় মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই সব বুঝে যেতাম,সে হাজার বার মুখে বলার পরও কেনো তার ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারলাম না।তোর যন্ত্রণা কমানোর বদলে আরো বাড়িয়ে দিয়েছি।”
কথা গুলো বলেই ফাহিম কেদে দেয়।দৃশ্যই ভাইয়ের হাতে হাত রেখে বলে
-“তুমি আমার বেস্ট ভাইয়া।যেই মানুষ গুলিকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি তার মধ্যে তুমি অন্যতম।তুমি আমাকে আগলে রেখেছো।কোনো কষ্ট আমাকে ছুঁতে দাওনি।আর আগে যা হয়েছে ভুলে যাও।আমিও অনেক ভুল করেছি।পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করেছি।আমাকে মাফ করে দিও ভাইয়া।”
ফাহিম দৃশ্যর কপালে চুমু একে বললো
-“আমার বুড়িটা অনেক বড়ো হয়ে গেছে।সব কিছু বুঝতে শিখে গেছে।”
দুই ভাই বোনের মধ্যে অনেক কথা হলো।নিজেদের মদ্যকার সকল মান অভিমান দূর করে নিলো।তখনই আনিকা কবির ভিতরে প্রবেশ করে বলেন
-“দেখ দৃশ্য তোর সাথে দেখা করতে কে এসেছে?”
দৃশ্য সামনের মানুষটিকে দেখে চমকে গেলো।পরক্ষণে বিশাল হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো
-“তমা আপু!”
তমা দৃশ্যর কাছে এসে দাড়ালো।ফাহিম বসা থেকে উঠে জানালার পাশে দাঁড়ালো।তমা সে দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো
-“কেমন আছিস পিচ্ছি?”
-“ভালো।তুমি কেমন আছো আপু?”
আনিকা কবির হেসে বললেন
-“তমাকে আর আপু ডাকা যাবে না।সে তোর ভাবী হয়।সে এখন আমাদের বাড়ির বউ।”
দৃশ্য চমকে তমার দিকে তাকায়।তমা তখন মাথা নিচু করে বসে আছে।আনিকা কবির চলে যেতেই দৃশ্য উচ্ছসিত কন্ঠে বললো
-“বলেছিলাম না তুমিই আমার ভাবী হবে।মিললো তো?”
তমা এক পলক জানালায় দাড়ানো ফাহিমের দিকে তাকালো।ফাহিম তখন বাইরের ব্যাস্ত রাস্তা দেখায় ব্যাস্ত।তমা ভেজা চোখে দৃশ্যর দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললো
-“ঠিক বলেছিস।আমি তোর ভাইয়ের বউ ঠিকই হয়েছি।কিন্তু ফাহিমের না নাবিলের বউ হয়েছি।”
দৃশ্য আঁতকে উঠল।এমন কিছু শুনবে আশা করেনি।তমা আপু তো ভাইয়াকে পাগলের মতো ভালোবাসতো।তাহলে নাবিল ভাইকে বিয়ে কেনো করলো?তমা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।আজও তার সেই দিন গুলির কথা স্পষ্ট মনে আছে।
“দৃশ্যর ব্যাপারটা নিয়ে সে ফাহিমের উপর ভীষণ রেগে ছিলো।মানুষটা এমন কেনো?আদরের বোনটাকে একটুও বুজলো না।সেখানে তাকে কি করে বুজবে?সে ফাহিমের সাথে তেমন কথা বলতনা।ফাহিমকে আগের মত জ্বালাতো না।দৃশ্য বাড়ি থেকে চলে আসার পর ফাহিম অনেকটা ভেঙে পড়ে।দিন রাত এক করে দৃশ্যকে খুঁজতে থাকে।
তার বেশ কিছুদিন পর তমার বাবা একদিন জানায় তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।তমা তখন অস্থির হয়ে পড়ে।কি করবে কিছুই বুঝতে পারেনা।বাবার উপর সে কোনোদিন কথা বলে নি।কিন্তু সেই দিন বলে।সে বিয়ে করবে না বলে জানায়।কিন্তু বাবা নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। আরো বেশি চমকে যায় তখন যখন শুনে তার বিয়ে নাবিলের সাথে ঠিক হয়েছে।এক ভাইকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে অন্য ভাইয়ের সাথে সে কি করে সংসার করবে?
তমা দিক বেদিক ভুলে ফাহিমের সাথে কথা বলতে চায়।কিন্তু ফাহিম তখন রাজনীতি নিয়ে ভীষণ ব্যাস্ত।তমা ফাহিমকে একবারের জন্য সামনে পেতো না।যেনো মানুষটা ইচ্ছা করে তাকে এড়িয়ে চলছিলো।
সেদিন তমার হলুদ ছিলো।তমা হলুদ শাড়ী পরে বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলো। দু চোখ বেয়ে তার অশ্রু ঝরছিল।তার বিয়ে নিয়ে সবার মাঝে আনন্দের শেষ নেই।একমাত্র সেই পারছেনা আনন্দ করতে।চোখ বন্ধ করলে সে শুধু ফাহিমকে দেখে।কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে।ছোট বেলা থেকে সে মানুষটিকে ভালোবাসে।কিন্তু কোনোদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি।আর মানুষটিও কখনো কি কিছুই বুঝে নি?
হঠাৎ তার চোখ পড়ে সামনের বাড়ির ছাদের উপর।সেখানে দাঁড়িয়ে ফাহিম সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। তমা আর কিছুই ভাবতে পারলো না।সে এক দৌড়ে সেই বাড়ির ছাদে চলে গেলো। ফাহিম এর সামনে এসে হাপাতে লাগলো।ফাহিম সিগারেট টান দিয়ে কপাল কুচকে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। তমা বললো
-“আপনি এমন কেনো ফাহিম ভাই।আমি কবে থেকে আপনাকে খুঁজছি।আর আপনি গা ঢাকা দিয়ে আছেন?”
-“তুই এখানে কি করিস?আজ না তোর হলুদ?”
তমা ভীষণ রেগে গেলো।সে ফাহিমের সামনে এসে বললো
-“আপনি কি সত্যি জানেনা আমি কেনো ছুটে এসেছি?এতটাই অবুঝ আপনি?”
-“কি বলছিস এসব?”
-“আপনি কি সত্যিই বুঝেন না আমি কেনো আপনার পেছনে পড়ে থাকি?কেনো আপনার এতো অপমানের পর ও বার বার আপনার পেছনে ছুটে আসি?কেনো আপনার সাথে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে থাকি? কেনো একটা দিন আপনাকে না দেখলে অস্থির হয়ে পড়ি?”
-“আমি কি করে বলবো?”
-“আমার মুখ থেকেই শুনতে চান তাই তো? ওকে তবে বলছি,আমি আপনাকে ভালোবাসি।সেই ছোট বেলা থেকেই আমার স্বপ্ন পুরুষ আপনি।আমার চিন্তা ধারা সবটা জুড়ে শুধু আপনি।আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না ফাহিম ভাই।”
বলেই সে ফাহিমকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলো।কয়েক মুহূর্তের জন্য ফাহিম স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকে।পড়ে ফাহিম দ্রুত তমাকে ছাড়িয়ে ধমকে বললো
-“পাগল হয়ে গেছিস?আজ বাদে কাল তোর বিয়ে।আর তুই পর পুরুষকে জড়িয়ে ধরে আছিস?তোর লজ্জা করে না?”
-“না করে না।আমি এই বিয়ে কিছুতেই করবো না।আমার বর শুধু আপনি হবেন।এই বিয়ে বন্ধ করে দিন।”
-“পাগলামি করিস না।আমি তোকে ভালবাসি না।এমনি দৃশ্যর বিষয়ে নিয়ে আমি ভীষণ চিন্তায় আছি।তার মধ্যে তোর এই সব পাগলামি মোটেও সহ্য করবো না।”
তমা ফাহিমের পা জড়িয়ে ধরলো।আর কেদে কেঁদে বললো
-“আমাকে আজ ফিরিয়ে দিবেনা ফাহিম ভাই।তাহলে আমি শেষ হয়ে যাবো।অন্য কাউকে আমি কোনো দিন মেনে নিয়ে পারবো না।আপনি একবার বাবার সাথে কথা বললে বাবা এই বিয়ে বন্ধ করে দিবে।”
ফাহিম দ্রুত নিজের পা ছাড়িয়ে তমাকে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলো।আর রেগে বললো
-“সব কিছুর একটা সীমা থাকে।আমি তোকে বিয়ে করতে পারবো না।নাবিলের মতো ডক্টর ছেলে তোকে বিয়ে করছে এটাই তোর ভাগ্য।নাহলে তুই ওর যোগ্য ও না।”
তমা যেনো শেষ ভরসা টুকু হারিয়ে ফেললো।আজ তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।সে কাপা কাপা গলায় বললো
-“আপনি কোনো দিন আমাকে বুঝতে পারেন নি।আমার অনুভূতির কোনো মূল্য দেননি।আরে যে নিজের বোনের ভালোবাসা বুঝতে পারেনা সে আমার ভালোবাসা কি করে বুজবে?আপনাকে ভালোবাসা আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো ভুল।একদিন আপনিও আমার মতো এই আগুনে জ্বলবেন।দেখে নিয়েন?”
তমা কাদতে কাদতে চলে এসেছিল।পরদিন রোবটের মতো বউ সেজে বসে ছিলো।ফাহিম বিয়ের নানা কাজে ব্যাস্ত ছিলো।কাজী যখন তমাকে কবুল বলতে বলছিলো।তখন সে এক দৃষ্টিতে দূরে দাড়ানো ফাহিমের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার মন বলছিলো ফাহিম ভাই শুধু একবার ইশারা করুন।আমি সব ফেলে আপনার বুকে চলে আসবো।কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।চোখ ভিজে উঠেছে তার।
ফাহিম ও তমার দিকে তাকিয়ে আছে।বউ সাজে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তমাকে।ফাহিমের দৃষ্টি যেনো নড়ছেই না।এই প্রথম ফাহিম ফিল করলো সে তমার প্রতি দুর্বল।ভীষণ দুর্বল।এই দুর্বলতা আজ থেকে না,ছোট বেলা থেকে।সে তো কোনো মেয়ের সাথে কথাও বলে না।এমনকি চোখ তুলে কোনো মেয়ের দিকে তাকায় না।কিন্তু তমা!সে তোমার সাথে সারা দিন ঝগড়া করে।ওকে শাসন করে।ওর সব বক বক শুনে।ওর দিকে অন্য কোনো ছেলে তাকালে সহ্য করতে পারে না।এমন কেনো হতো?এটাই কি ভালোবাসা?তার মানে সে কি অনেক আগে থেকেই তমাকে ভালোবাসতো?তবে বুঝতে কেনো পারতো না?
ফাহিম এতো দিনে বুঝতে পারলো তমার প্রতি তার কি ফিলিংস।কিন্তু ততো খনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।তমা কবুল বলে অন্য কারো হয়ে গেছে।
ফাহিম সেদিন সারা রাত দুচোখ এক করতে পারলো না।তমা অন্য কারো বউ এই বিষয়টা সে ঠিক হজম করতে পারছে না। মেয়েটাকে সেদিনও হলুদ শাড়িতে ভীষণ সুন্দর লাগছিলো।সে কেনো সেদিন তমাকে ফিরিয়ে দিলো?ভালোবাসার অনুভূতি সে তখন বুজলো যখন মেয়েটা তার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে।চোখ বার বার ভিজে উঠছে।সে যে বুঝতে ভীষণ দেরি করে ফেলেছে। এখন তমা তার জন্য নিষিদ্ধ।তমার বলা কথা একদম মিলে যাচ্ছে।সে সত্যি আগুনে জ্বলছে।অনুভূতির আগুনে।
সব শুনে দৃশ্য থ হয়ে বসে রইলো।তার চোখ ভিজে উঠেছে।এই অসীম ভালোবাসাকে তার ভাই পায়ে ঠেলে দিয়েছে?কেমন করে করলো।তমা তখনও ফুঁপিয়ে কেঁদে চলছে।দৃশ্য তমার হাতে হাত রেখে শান্ত করলো।তমা চোখের জল মুছে মলিন হেসে বললো
-“আমি ঠিক আছি।নাবিল আমাকে অনেক ভালো রেখেছে।সে আমাকে যথেষ্ট সময় দিয়েছে।তোর ভাইয়ের কাছে যে সম্মান আর ভালোবাসা আমি পাইনি সেটা নাবিল আমাকে দিয়েছে।”
দৃশ্য জানালার পাশে দাড়ানো ভাইয়ের দিকে তাকালো।দেখলো তার ভাই টিশার্টের হাতার সাহায্যে চোখ মুছছে।দৃশ্য বুঝতে পারলো তার ভাইয়ের মনের অবস্থা।ফাহিম তাদের দিকে না তাকিয়ে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
তখনই নাবিল তার কেবিনে ঢুকলো।দৃশ্য অনেকদিন পর নাবিলাকে দেখে খুশি হয়।তবে তার কোলে ছোট একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখে চমকে যায়।তমা মুচকি হেসে বললো
-“আমাদের মেয়ে।”
নাবিল হেসে বললো
-“কীরে এতদিন পর দেখা। তাও হসপিটালে?আমার খোঁজে এসেছিস নাকি?তার জন্য অ্যাকসিডেন্ট করতে হবে?”
তমা ধমকে বললো
-“তুমি এই সময় মজা করছো?জীবনেও ঠিক হবে না?”
-“তুমি পাশে থাকলে আমি এমনই ঠিক থাকি জান।দূরে গেলেই এমন অস্থির হয়ে পরি।”
তমা বেশ লজ্জা পেলো।ছোট বোনের সামনে নির্লজ্জের মতো আচরণ শুরু করেছে।দৃশ্যর মনটা ভরে গেলো তাদের দেখে।এই মানুষ দুটি ভালো আছে এতেই সে ভীষণ খুশি।
আসলে নাবিল অনেক আগে থেকেই তমাকে পছন্দ করতো। তমার চঞ্চলতা তার মনে ভালোবাসার সৃষ্টি করেছে।ছোট্ট তমাকে দেখেই তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতো।কিন্তু কখনো সে তমাকে মনের কথা জানায় নি।তার পর সে ঢাকায় হোস্টেলে চলে আসে।নিজের ক্যারিয়ারের ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।কিন্তু তমা তার মনে সব সময় বিচরণ করতো।ডক্টর হয়ে সে বাবাকে জানায় তমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিতে।বাবাও ছেলের কথায় রাজি হয়ে যায়।এই ভাবেই সে তার ভালোবাসা কে নিজের জীবনে পেয়ে যায়।সে বুঝতে পেরেছে তমার জীবনে হয়তো অন্য কেউ ছিলো।তাই সে তমাকে সময় দিয়েছে।নিজের ভালোবাসা দিয়ে তমার মন জয় করেছে। এখন তারা ভীষণ সুখে আছে।
সবাই চলে যেতেই দৃশ্য কিছুক্ষণ রেস্ট নিলো।প্রায় বিকেলের দিকে তার ঘুম ভাঙলো।মাথায় এখনো চিনচিন ব্যথা করছে। চোখ মেলে আশে পাশে তাকাতেই হঠাৎ কিছুটা চমকে উঠলো। তার সামনে আখি রহমান বসে আছে। দৃশ্যকে তাকাতে দেখেই তিনি মুচকি হাসলেন। আখি রহমানকে এখানে দেখে দৃশ্য কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। এই মানুষটাকে সে ভীষণ সম্মান করে। তাইতো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাহাদকে তার নিজের জীবনে চাইনি। তিনি কি তাকে কিছু কটু কথা শোনাতে এসেছেন? নাকি মাহাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে বলতে এসেছেন?কিন্তু সে তো মাহাদের কাছ থেকে দূরেই আছে।সেদিন রাতে যাই হোক।তার অজুহাতে সে মাহাদকে কিছুতেই আটকে রাখবে না। মাহাদ নিজের জীবন গুছিয়ে নিক সেটাই চায়।
আখি রহমান বুঝতে পারলেন তাকে এখানে দেখে দৃশ্য কিছুটা চিন্তিত হয়ে আছে। তাই তিনি নরম গলায় দৃশ্যকে বললেন
-“কেমন আছো মা?”
দৃশ্য চমকে গেল। সে এতটা শান্ত ব্যবহার কিছুতেই আশা করেনি।আখি রহমান আবার বললেন
-“কি আমার সাথে কথা বলবে না?”
-“জি…..ভালো আছি।”
-“অনেক বড় হয়ে গেছো।আমার ছেলে যখন প্রথম তোমাকে নিয়ে এসেছিল তখন অনেক ছোট ছিলে। আমিতো প্রথম দেখে অবাক হয়েছিলাম আমার ছেলে এই বাচ্চা মেয়েটির প্রেমে পড়েছে?”
দৃশ্য কেমন রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারছে না।সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আখি রহমান আবার বললেন
-“আমার ওপর রেগে আছিস মা?”
-“ছি ছি! না আন্টি।এমন কিছুই না।আমার জন্য বরং আপনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন।আমার জন্যই আংকেল…
দৃশ্য আর বলতে পারলো না।আখি রহমান বললেন
-“এতে তোমার কোনো দোষ নেই মা।বরণ আমার জন্য তোমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।তোমার শশুর আমাকে তোমার দায়িত্ব দিয়ে গেছিলো। কিন্তু আমি সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। তোমাকে যোগ্য সম্মান দিয়ে বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিতে বলেছিল। কিন্তু তখন আমি এর কিছুই করতে পারিনি। তোমার শ্বশুরকে হারিয়ে আমি আসলে তখন নিজের মধ্যে ছিলাম না। তাই ভুল সঠিক কিছুই বিবেচনা করতে পারিনি। আমাকে মাফ করে দিও মা। আমার জন্য তোমরা দুইজন অনেক কষ্ট সহ্য করেছো। আমিতো এতটাই স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম যে নিজের ছেলের কষ্টটা অনুভব করতে পারিনি। আমার ছেলেটা ভালো নেই মা তোমাকে ছাড়া। ছেলের চোখে আমি তোমার জন্য অসীম ভালোবাসা দেখেছি। এ কয়েক বছরে আমার ছেলেটার মুখে আমি কোন হাসি দেখতে পাইনি। একদম বখে গেছে আমার ছেলেটা। এবার অন্তত আমার ছেলের হাতটা শক্ত করে ধরে তাকে সঠিক পথে নিয়ে আসো। তোমাদের দুজনকে সুখে দেখলেই তোমার শশুরের আত্মা শান্তি পাবে। আর আমিও অপরাধমুক্ত হব। তুমি ছেলেটাকে কষ্ট দিও না মা আর নিজেও কষ্ট পেয়ো না।”
আখি রহমান চোখের জল মুছে দিলেন। দৃশ্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।দৃশ্যর কপালে চুমু খেয়ে তারপর মুচকি হেসে বললেন
-“আমার ঘরের লক্ষ্মীকে আর দূরে রাখতে চাইনা। এত মিষ্টি ছেলের বউটাকে কি কিছুতেই দূরে রাখা যায়? আমি আর তুমি মিলে আমার ছেলেটাকে একদম সোজা করে ফেলব। কি আমাকে সাপোর্ট করবে না?তোমার মায়ের সাথে আমি অলরেডি কথা বলে নিয়েছি। আমার ছেলে বউকে আমি ধুমধাম করে ঘরে তুলতে চাই। এখন শুধু তোমার মতামত বাকি। আমার উপর অভিমান করে আমার ছেলেটাকে আর কষ্ট দিওনা। তোমাকে ছেড়ে আমার ছেলেটা ভালো থাকবে না।”
দৃশ্য ফুঁপিয়ে কেদে উঠল।তার চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে।মানুষ গুলো তাকে এতো ভালোবাসে কেনো?সে কি আদো এতো ভালোবাসার যোগ্য?