হলিডে #পর্ব_১৩_ও_১৪

0
350

#হলিডে
#পর্ব_১৩_ও_১৪

#পর্ব_১৩

জুস কর্নারের আইডিয়াটা নীরার বেশ পছন্দ হয়েছে।আজকাল এটা চলছেও খুব। কিছু উৎপটাং কাপল দুটো জুসের গ্লাস নিয়ে মুখোমুখি বসে মোবাইলে ফেসবুকিং করে। এই মোবাইল কাপলরা আবার খুব হেলথ কনশাস হয়। কিছুক্ষণ গল্প করে তারপর আবার তারা জুস অর্ডার করে। এটা যে ভালোই চলবে সেটা নীরা শিওর। শুধু বাজেটটা নিয়ে একটু খটকা আছে।

—দেখো নীরা, এটা যদি একবার ক্লিক করে যায় পেছন ফিরে আর তাকাতে হবে না। আমরা মোটামোটি সব ধরনের ফলের জুস রাখবো। আপেল, কমলা, আনারস, ডালিম…
লাবণী ধমক দিয়ে রনিকে থামালো।
—ডাক্তারি পড়ে পড়ে এখন জুস বিশেষজ্ঞ হয়েছো? এতগুলো ফ্রুট জুস প্রিপারেশান এনেছো কোন আক্কেলে? ফল তো আর বললেই আকাশ থেকে পড়বে না। তাজা ফল কিনতে হবে, স্টোর করে রাখতে ফ্রিজ লাগবে, এছারা ডেকোরেশন ছাড়া আজকাল কিচ্ছু চলে না।
—তো আমরা ডেকোরেশন করে নিবো। একটু রং চং, লাইটিং, আর দামী গ্লাসের সেট। দেখো লাবণী ভাবী, জায়গাটা আমরা বিনা সিকিউরিটিতে পাচ্ছি। ঢাকা শহরে বিগ এমাউন্টের সিকউরিটি ছাড়া কেউ একচুল জায়গাও দেয় না লাবনী ভাবী।
—রনি, তোমাকে কতবার বলেছি হয় আমাকে ভাবী বলবে নয় লাবণী বলবে। একইসাথে দুটো ডাকবে না।
রনি জিভ কাটলো। নীরা পুরো টাকাটা একবার মনে

মনে আবার হিসেব করলো। যা আছে তাতে কি সম্ভব?
—কি হলো নীরা? তোমার ভাবাভাবি কি শেষ হয়নি? কিছু তো বলবে!
—তোমরা দুজনে বরং একটা কাজ করো ভাবী, কোন ফলের জুসে আমরা কত করে রেট নিতে পারি একটা মেন্যূ করে ফেলো। আমার মিনিমাম রেটে নিবো।
—আমরা করবো মানে তুমি?
—আমি বেরোবো একটু। কয়েকজন ডিরেক্টর ডেকে পাঠিয়েছেন। দেখা করে আসি কিছু হয় টয় কিনা!
নীরা উঠে দাঁড়ালো। জুস কর্নারটা হয়ে গেলে সে বাবাকে তাতে বসিয়ে দেবে। কর্মচারীও রাখবে। শুধু ভালোয় ভালোয় কাজটা হয়ে গেলে হয়।
সিড়ির কাছে গিয়ে নীরা দাঁড়ালো,
—রনি ভাইয়া, আপনি কি একটু এখানে আসবেন? একটা বিশেষ কথা আছে।
রনি এগিয়ে গেল। নীরা গলার স্বর নামিয়ে নিলো,
—এটা আপনার জন্য একটা বিশেষ সুযোগ রনি ভাই, আপনাকে এর মধ্যেই ভাবীকে মুগ্ধ করে ফেলতে হবে। আপনার কাজের মধ্য দিয়ে জুনিয়র ভাবটা কাটিয়ে উঠার সুযোগ।
লাবণী সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নীরা গলার আওয়াজ বাড়ালো এবার,
—আমি আপাতত আপনাকে পঞ্চাশ হাজার দিচ্ছি রনি ভাই, এর মধ্যে আপনি যা কিনতে পারেন ভাবীকে সাথে নিয়ে কিনে ফেলুন। বাবা আসলেই বাকি টাকাটা পাবেন।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে ইতু গম্ভীর মুখে বললো,
—ভাইয়া, আমরা কয়েক বন্ধু মিলে একটা ক্যাম্পেইন ট্রিপের আয়োজন করেছি। স্কুলের পরে সবাই যাচ্ছি। আমি যদি আজ একটু রাত করে ফিরি মানে ধর আটটা-নটার মধ্যেই! তুই একটু মাকে বল না।
—কোথায় যাচ্ছিস?
—ঢাকার ভেতরেই। প্লিজ ভাইয়া! প্লিজ…
—আচ্ছা ঠিক আছে। ডান।
ইতু মহানন্দে নাশতা অর্ধেক ফেলেই উঠে গেল।
রিতু বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
—তোকে বললো আর তুই অমনি পারমিশন দিয়ে দিলি ভাইয়া? এটা কিছু হলো? ও কত বোকা জানিস!
—ক্যাম্পেইন ট্রিপে যাচ্ছে, একা তো আর না।
—তারপরও, ও’র কোনো ব্যালেন্স নেই। ইদানীং ও কি হারে টাকা খরচ করছে। তুইও দিচ্ছিস, বাবাও।
—এই বয়সে একটু খরচ করেই। সেটা সমস্যা না।
আচ্ছা এখন দেখতো রিতু আমায় কেমন দেখাচ্ছে?
রিতু কৌতূহলী চোখে বললো,
—মিট করতে যাচ্ছিস নাকি?
—হুঁ।
—তোর ডিউটি নেই?
—আছে, প্রাইম মিনিস্টারের সাথে বিকেলে শরীয়তপুর যাবো। এরপর আরও ট্যূর আছে। দুদিন পর ঢাকায় ফিরবো। ভাবলাম প্রেয়সীর মুখদর্শন করে যাই….
রিতু হাসলো।
—খুবই সাধারণ মেয়ে জানিস কিন্তু সবার মাঝ থেকে না ফট করে আলাদা করে ফেলা যায়! কি রকম আলাদা একটা কাঠিন্য মুখে তাও কোমল দেখায়। আমি তো যখনই দেখি তখনই হার্টবিট মিস করি।
—সে তো তুইও হ্যান্ডসাম দেখতে। এই যেমন তুই যখন গগল পরে ছবি টবি আপ্লোড করিস, আমার কিছু বান্ধবী তো মরে যাই মরে যাই করে! এই যেমন ধর এখন তোকে গ্রীক পুরানের রাজপুত্রের মতো লাগছে।
—তারপরও ও আমার থেকেও বিশেষ। ন্যাচরাল।তাকালেই আমি না কিরকম একটা ঘোরে চলে যাই। একদম পৃথিবীর বাইরে।
—বিয়ে করে নিয়ে আয় না, আমরাও দেখি! আচ্ছা, কি করে বলতো?
—মডেলিং। টুকটাক.. স্ট্রাগলিং করে যাচ্ছে। তুইও দেখেছিস তাকে।
—সত্যি?
—হুঁ! কিছুদিন আগেই ছবি এসেছিলো পেপারে।
—আর পড়াশোনা?
—পড়ে না। ইন্টারমিডিয়েটেই থেমে আছে।
—বলিস কিরে? তোর মতো বিদ্যাসাগরের হবুপত্নী বিদ্যা অর্জনে বিমুখ!
তামিম হাসলো।
—অনেক ঝড় ঝাপটার মাঝে বেঁচে থাকা সুন্দর একটা পাখি। নিজের সব ধরনের ভঙ্গুর অবস্থানেও মাথা উঁচু করে কথা বলে। নিজের ঝামেলা ভর্তি জীবন নিয়েও সন্তুষ্ট! ব্রেভ গার্ল!
—আমাদের কথা বলে দিস নিতো ভাইয়া? আমরা কিন্তু দু-বোনে প্রথম দেখায় মজা করবো অনেক। কে রিতু আর কে ইতু চিনবেই না।
—ও’কে নিয়ে মজা হবে না। দেখা যাবে আগে থেকেই জেনে বসে আছে যে, তোরা টুইন। ওকে তো হাসতে আমি দেখিইনি। ফান টান বুঝে কিনা সন্দেহ আছে।
রিতু গোমরামুখো হয়ে তাকালো।
তামিম শার্টের হাতা ফোল্ড করে নিচ্ছে।
—তোকে দারুণ লাগছে, ভাইয়া। হঠাৎ এমন রেড পড়লি, তাই গার্নিশড লাগছে। বেস্ট অফ লাক।

তামিম গ্লাসে পানি ঢেলে মুখের কাছে নিয়ে একমুহূর্ত থামলো,
—ও’র কি আমাকে কখনো পছন্দ হবে? একদমই বিরক্ত আমার উপর..
রিতু তামিমের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইলো। তার ইন্টিলিজেন্ট হ্যান্ডসাম ভাইটি অসহায় ফিল করছে খুব। তাঁর চোখ মুখ বোকার মতো ঝুলে আছে।
—তোর কাছে পিস্তল আছে না, ও’র হার্ট বরাবর ধরবি। বলবি পছন্দ না করলে মেরে দিবো একদম… ঠাস… ঠাস…. ঠাস!
—এরকম করা যায়?
রিতু উঠে এসে তামিমের মাথার চুল টেনে ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো,
—একশো বার করা যায়। এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার!
তামিম বিড়বিড় করে বললো,
—তাহলে অবশ্যই গুলি করবো….. অবশ্যই….
রিতু ডান হাতের বুড়ো আঙুল তুলে ধরলো।
—সে আসলেই খুব লাকি ভাইয়া। তুই ভালোবাসছিস…
—নীরা, নীরা নাম ও’র।
রিতু চলে যেতে গিয়ে ফিরে তাকালো। তামিম কাঁদছে। কান্না লুকাতে একটু পরপর শার্টের হাতায় চোখ মুছছে।
—ভাইয়া, তারও হয়তো তোকে পছন্দ কিন্তু পরিস্থিতির জন্য বুঝাতে পারছে না। তুই এমন ভেঙ্গে যাচ্ছিস কেন? কিপ ওয়েটিং এন্ড কিপ পেশেন্স।
তামিম ঝট করে বেসিনের দিকে চলে গেল। মুখ ধোওয়া দরকার!

নীরা বের হতে গিয়ে যেটা দেখলো, সেটার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ভাবী এবং রনি ভাই’র সাথে জুস কর্নার প্রজেক্ট আলোচনায় এখন আরো একজন যোগ হয়েছে, মি. তামিম। নীরা দেখেই থমকে দাঁড়ালো। এই লোক চায় কি? এর মতলব কি? সেদিনের টাকার ভাগ নয়তো? এই বাড়ির সাথে যোগ হতে চাইছে কেন?
নীরা খুবই নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামলো। কেউ টের পাবার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে। এই লোক দুষ্টের অবশেষ! নীরা নিচের সিঁড়ি পর্যন্ত আসতেই তামিম উৎফুল্ল গলায় ডাকলো,
—আরে মিস নীরা না? আপনাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। আসলে মি. শফিকের নাকি ক্লাস এটেন্ড করার পারমিশন হয়ে গেছে, সেটা শুনেই দেখা করতে এলাম। এত সুন্দর একটা নিউজ; তিনি আবার নরমালি ট্র্যাকে ফিরছেন। সব তো…
তামিমের কথা শেষ হলো না লাবণী অবাক হয়ে বললো,
—অমন মুখটুখ ঢেকে বেঁধে আছো কেন নীরা? শ্বাস বন্ধ হয়ে তো মারা যাবে। এভাবেই মুখ বেঁধে বেরোচ্ছো নাকি?
নীরা মনে মনে বললো, এই লোকটার একদম বিশ্বাস নেই ভাবী। কথা বলতে বলতে আবার কোন ফাঁকে হয়তো কাজটা করে বসবে।
—আসলেই তো মিস নীরা, আপনি এমন করে মুখ বেঁধেছেন কেন?
নীরা জবাব দিলো না। রাগে তার গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে।
—কি হয়েছে বলবে তো, পুরো মুখটাই ঢেকে নিলে। মেক-আপ করেছো নাকি?
—ঠান্ডায় কান ব্যথা করছে হালকা। মাফলারের মতো করে নিলাম আর কি। ভাবী আমার ফিরতে দেরি হবে, আই মিন রাতও হতে পারে। গেলাম…

নীরা সোজা বেরিয়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে সে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললো। তামিম নামক চুমু গুন্ডা থেকে বাঁচা গেছে। যাক্…
ওড়নাটা খুলতেই তামিম পাশ থেকে বললো,
—আপনি কোথায় যাচ্ছেন বলুন তো? আমি নামিয়ে দিচ্ছি চলুন।
নীরা বেশ বড় একটা শক খেলো। লোকটা পেছন পেছন চলে এসেছে। পেছনে কিছু করেনি তো? নীরা একটু সেইফ দুরত্বে গিয়ে দাঁড়ালো। পিঠের উপর থেকে লম্বা ঘোমটা টেনে ওড়নাটা মুখে চেপে ধরে বললো,
—আপনি যেটা চাচ্ছেন, সেটা আপনি পেয়ে যাবেন। শুধু আমাকে দু-দিন সময় দিন। বাবা ফিরলেই সব হবে।
—দুদিন সময় না হয় দিলাম কিন্তু শিওর দিবেন কিনা কনফার্ম করুন!
তামিম এগিয়ে গেল একটু। নীরা আবার সরে দাঁড়ালো। তামিম আরেকটু এগিয়ে গেল.. নীরা আরেকটু সরলো।
—কাছে আসবেন না। একদম না। আমি বলে দিচ্ছি কিন্তু, আমি অত সোজা মেয়ে না… সরুন… আপনার ধান্ধা আমার জানা আছে।
—আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা বরং দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলি। তাহলে আপনিও ভয় পাবেন না, আমিও যা চাই তা বলতে পারবো।
নীরা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। তামিম সামনে দাঁড়িয়েই নীরাকে ফোন করলো।
—হ্যালো, মিস নীরা আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো, হ্যালো…
—ঢং না করে কাজের কথা বলুন। আপনার মতলব কি? কি চান? কত পার্সেন্ট চান?
—আমার মতলব আপনার পড়াশোনা। আর সেটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট চাই। পরিস্থিতির দোহাই দেয়া ঠিক নয় নীরা। ইচ্ছে থাকলে সব সম্ভব। আপনি পড়াশোনাটা করছেন না কেন?
—আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না।
—পড়াশোনা কারোরই ভালো লাগে না। এটা ভালো লাগলে তো সবাই পড়াশোনা করতো। কিন্তু এই ভালো না লাগার কাজটি যারা করতে পারে তাদের জীবনে আর কোনোরকম দুর্ভোগ থাকে না। তারা হয় প্রকৃত মানুষ।
—আপনিও তো যথেষ্ট পড়াশোনা করেছেন! প্রকৃত মানুষ কি হতে পেরেছেন? রাস্তাঘাটে মেয়ে ধরে ধরে চুমু খাচ্ছেন। ছিঃ
তামিম মাথা চুলকালো, প্রকৃত মানুষ হওয়ার সাথে চুমুর সম্পর্কটা কি?
—আপনার মতলব আমি জানি। আপনি যেটা চান, সেটা আমি দিয়ে দিবো। তবে পড়াশোনা করবো না। এখন রাখছি।
—কথা শেষ হয়নি আমার, আমি দুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। বৃহস্পতিবার ফিরবো, তাও সন্ধ্যা হবে।
—সেটা আমাকে বলছেন কেন? আশ্চর্য..
নীরা ফোন রেখে দিলো।
এবং খুব সাবলীলভাবেই একটা রিকশা ডেকে নিয়ে চলে গেল।

তামিম কিছুক্ষণ গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েই রইলো। মানুষের হৃদয়ের অনুভূতির উপর কিছু বই কিনে পড়তে হবে। আচ্ছা মানুষের মন বদলে দেবার কি কোনো ম্যাজিক আছে? থাকলে সেটা জানা দরকার।
হারুন ফোন করেছে,
—হ্যালো স্যার, হ্যালো…
—বলুন হারুন সাহেব।
—স্যার, বর্ষা ম্যামের সব ডিটেইল খবর নেওয়া হয়ে গেছে। একটা ব্যাড নিউজ আছে।
—এখন কোনো ব্যাড নিউজ শুনবো না হারুন সাহেব।
তামিম ফোন রেখে দিলো। তার শরীয়তপুর যেতে ইচ্ছে করছে না। বিরক্ত লাগছে।

#পর্ব_১৪

নীরা আরেকবার পুরো পেপারটা পড়ে নিলো। এটা স্বপ্ন নয়তো? এক্ষুণি হয়তো দেখবে ঘুম ভেঙে গেছে। একবার কি হাঁটাহাঁটি করে দেখবে? পাশের কোথাও টিভিতে নিউজ চলছে, প্রধানমন্ত্রী আজ শরীয়তপুরের সমাবেশে জনগণের উদ্দেশ্য ভাষণ দিবেন বিকেল ৫টায়। শরীয়তপুর কথাটা তাকে কে যেন বলেছিল? মি. তামিম। আজ বেরোবার সময় তাঁর সাথে দেখা হয়েছে। কি রকম শার্ট যেন পরেছিলো? কিরকম যেন দেখতে লাগছিলো?
নীরা মনে করতে পারলো না ।

শরীফ সাহেব বলে যিনি পেপারটা দিয়েছেন, তিনি আবার এসেছেন।
—আপনি কি কিছু খাবেন? চা, স্ন্যাকস?
—জি না।
লোকটা চলে গেল। কিন্তু ঠিকই চা নাশতা পাঠিয়ে দিলেন। নীরা আবার শুরু থেকে এগ্রিমেন্ট পেপারটা পড়তে শুরু করলো।
মোট তিনটা টিভিসির জন্য অফার করা হচ্ছে।সবগুলোতেই সিংগেল পারফরমেন্স। তাও একদম মনমতো। বিউটি প্রোডাক্ট… দেশের প্রথম সারির একটি কোম্পানি। শূটিংস্পটের পর্যন্ত স্পষ্ট ঠিকানা ও বিবরণ, কাজের সময় সব বিস্তারিত বলা আছে। এই কোম্পানির আগের সব টিভিসিতে ছোটপর্দা ও বড়পর্দার নামীদামী হিরোইনরা কাজ করেছেন।এখানে তার মতো নিউ কামার!
নীরা পেপারটা উল্টে পাল্টে আবার দেখলো। কোনো দুইনম্বরি হয়তো লুকিয়ে আছে ভেতরে! ছোট করে কোথাও কি শর্ত টর্ত দেওয়া আছে? নীরা পেপারটা একদম চোখের কাছে এনে ধরলো।
আরিফুর রহমানের মতো এত নাম করা একজন টিভি কমার্শিয়ালের ডিরেক্টর নীরাকে সরাসরি না দেখেই অফিসে ডাকলো। এখন আবার পি এস দিয়ে এগ্রিমেন্ট সাইন করিয়ে নিচ্ছে। লোকটা পাগল নয়তো? কোনো স্ক্রিনটেস্ট নেই, অডিশন নেই! এরকম কি হয়? মিডিয়া কি একদম কাস্টিং কাউচ ফ্রি হয়ে গেল? মি. তামিম সাহেবের মতো গোয়েন্দা পুলিশের দরকার ছিল এখন।

শরীফ নামের লোকটি আবার এসেছে। নীরা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
—-আপনি তো দেখি চা নেননি। নীরা নিচ্ছি নিচ্ছি বলে হাত বাড়িয়ে চা নিতে গিয়ে পুরো চা-টা জামায় ফেলে দিলো। সাদা জামা চায়ে মাখামাখি।
শরীফ সাহেব টিস্যু বক্সটা বাড়িয়ে দিলেন।
—আপনার কি কোনো প্রশ্ন আছে ম্যাডাম কন্ট্রাক্ট এর ব্যাপারে বা এমাউন্ট নিয়ে?
—না মানে উনি আমাকে না দেখেই একদম কিভাবে সিলেক্ট করে ফেললেন? আমি কিন্তু অনেক কিছুই জানি না। অনেক কিছুই। এই কাজ করতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না।
—স্যার আপনাকে নিয়ে অনেক ভেবেই ডিসিশান নিয়েছেন। তিনি এখানে আসছেন। ব্যস্ত মানুষ… আপনি রাজি হলে এগ্রিমেন্ট সাইন করে ফেলুন তাড়াতাড়ি। এডভান্স কত চাই বলুন। তবে অর্ধেকের বেশি আমরা পে করি না। নতুনদের জন্য টুয়েন্টি ফাইভ পার্সেন্ট।
নীরার সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। এত সহজ কেন? এটা কি আসলেই? ঠিকঠাক জায়গা তো এটা?
নীরার ভাবনায় ছেদ পড়লো। ডিরেক্টর আরিফুর সাহেব এসেছেন। ভদ্রলোক বেশ বয়স্ক। কিন্তু তাঁর পোশাক আশাক বাচ্চা ছেলেদের মতো, কটকটে লাল হাফপ্যান্টের সাথে টম এন্ড জেরীর ছবিসহ ডার্ক ইয়েলো টিশার্ট। তার উপর মাথায় একটি কাউবয় হ্যাট। নীরা হেসে ফেলতে গিয়ে নিজেকে সামলালো।
নীরার এতক্ষণে মনে পড়লো মি. তামিম সকালে একটি লাল শার্ট পরে এসেছিলো।
ডিরেক্টর সাহেব বসতে বসতে পকেট থেকে মোট চারটে ফোন বের করে টেবিলে রাখলেন। এতগুলো মোবাইল ফোন তিনি কিভাবে ম্যানেজ করেন কে জানে?
—শরীফ, দুটো কফি বলো। আমি পাঁচমিনিট একা কথা বলবো নীরার সাথে।
ভদ্রলোক ঘড়ি দেখে বললেন,
—কফি নিয়ে ঠিক পাঁচমিনিট পর আসবে, ওকে? আর হ্যাঁ, আধঘন্টা সময় নিয়ে ও’র হোমওয়ার্কগুলো বুঝিয়ে দেবে।

শরীফ সাহেব মাথা নেড়ে বেড়িয়ে গেলেন।
—তা কি খবর তোমার নীরা? গ্রামের বাড়ি কোথায়?
নীরা হকচকিয়ে গেল। ইনি গ্রামের বাড়ি নিয়ে প্রশ্ন করছেন! মডেলিং এ এসব দরকার হয় বুঝি? গ্রামের বাড়ি যেটা ছিল সেটাও বিক্রি হয়ে গেছে আপাতত।নীরা কি বলবে, আমরা ভাসমান জনগোষ্ঠী স্যার। গ্রামের বাড়ি, শহরের বাড়ি এসব কিছু নেই।
—জি, কুমিল্লায় ছিল বাড়ি, সেটা বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।
—আমার ওয়াইফেরও ওখানে। ঢাকায় কোথায় থাকা হয়?
—জি, মোহাম্মদপুরে আমার এক ফুফুর বাসায়।
—ওহ, বেশ! তা বলোতো, এগ্রিমেন্ট তোমার কি পছন্দ হয়েছে? ফোর মান্থসের মিনি ডিল। শুধু এই সময়টা তুমি অন্য কোথাও কাজ করবে না। এই টিভিসিগুলো অন এয়ারে যাবার পর তুমি অন্য কাজ হাতে নিতে পারবে। অর্থাৎ টিভিতে তোমাকে আমরাই ফার্স্ট লঞ্চ করবো। হাইট কত তোমার?
—-ফাইভ ফাইভ।
—-ঠিক আছে, এখানে কস্টিউম ডিজাইনারের সাথে কথা বলে যাবে। মাপ দিয়ে যাবে। লিসেন, আমরা কাজ শুরু করবো আগামী চারদিন পর। এর মাঝে তুমি কতগুলো ছোট্ট প্রিপারেশন করে নিবে। শরীফ নোট দিয়ে দিবে তোমাকে। চারদিনের চাররকম ডেইলি ওয়ার্কের একটা শিডিউল করা আছে। তোমার কাজ হলো, ডেইলিরটা ডেইলি হচ্ছে কিনা প্রতিদিন বিকেলে জানাবে। এখন থেকে কাজ শুরুর আগের চারদিন কিপ মি আপডেটেড। টাকা নিয়ে ভেবো না, আমি শিওর আমি তোমাকে নিয়ে আগামীতে অনেক কাজ করবো। বাড়িয়ে নিও তখন! ইট ইজ যাস্ট দ্য বিগিনিং। চলবে তো?
নীরা কোনোরকম অস্ফুট গলায় বললো,
—জি আচ্ছা।
—শূটিং স্পটে ডট ইন দ্য টাইম আসবে। কাজের সময় নো ফোনকলস, নো পাবলিক মিটিং, নো প্রেশার। খাওয়া দাওয়া করবে মন খুলে। ভালো খাওয়া মানে ভালো মুডে থাকা। এন্ড ইয়েস মোস্ট ইম্পর্টেন্ট থিং, আই টু আই কন্টাক্ট রেখে কথা বলতে শেখা। এরকম মাথা নিচু করে বসে থাকলে চলবে না। লুক এট মি, ওকে। নাউ দিস ইজ গুড।
নীরা খুবই আড়স্ট ভাবে বললো,
—আমার পরিবার থেকে একটা জুস কর্নার করতে যাচ্ছি ঢাকা ভার্সিটির ওখানে। আসলে আমাদের আয় রোজগারের উৎস আপাতত বন্ধ। এই চারদিনে সেই কাজটা করে নিতে পারি?
—অফকোর্স… সব কাজ করো। কোনো প্রবলেম নেই। নাউ স্ট্যান্ড আপ এন্ড ওয়াক।
নীরা উঠে দাঁড়ালো।
—ওয়াক… ইয়েস.. ইয়েস… কিপ ওয়াকিং। ওকে লিসেন, হাঁটার সময় মাথায় রাখবে স্টমাক ইন, চেষ্ট আউট, এন্ড ওয়াক ইন এ স্ট্রেইট লাইন। ভিশন থাকবে প্যারালাল। ইয়েস গুড… ইয়েস….
ভদ্রলোক আবার ঘড়ি দেখলেন।
—নাউ সিট ডাউন। নীরা, এখানে তোমার এডভান্সটা আছে। বেরিয়ে গিয়ে প্রথমে তোমার স্যান্ডেলটা চেইঞ্জ করবে। মডেলিং এ জুতো এবং হেয়ার স্টাইল; এই দুটো কিই নোট। এ ব্যাপারে সবথেকে বেশি কেয়ারফুল থাকবে।
নীরা নিজের জুতোটার দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেলো।
—গার্ল, বি কনফিডেন্ট। ইউ হ্যাভ দ্য ফায়ার এন্ড বি রেডী টু শো ইওর ফায়ার। আমি তোমাকে দু-সপ্তাহ অবজার্ভেশনে রেখেছি, তারপর ডিসাইড করেছি যে তোমাকে নিয়ে কাজ করবো। মিডিয়ায় শুধু গ্ল্যামার দিয়ে টিকে থাকা ইম্পসিবল। এখানে টিকে থাকতে হয় কাজ দিয়ে। ইওর ওয়ার্ক উইল মেইক দ্য ডিসিশান ওয়েদার ইউ স্টে অর গো। মডেলিং মানে টু বি আ পাবলিক পার্সন। তোমাকে হ্যাপেনিং হতে হবে। যখন তোমার ছবির দিকে মানুষ বারবার তাকালেও বিরক্ত হবে না, তখন তুমি হবে মডেল। ক্লিয়ার? দ্যাট ইজ অল ফর টুডে।
ভদ্রলোক হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন।
—-ওয়েলকাম টু দ্য জার্নি উইথ মি নীরা!
নীরা হাত বাড়ালো না। সে দু-হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো। এত আনন্দ সে কোথায় রাখবে? কোথায়?

আরিফুর রহমান সাহেব বেরিয়ে গেলেন। শরীফ কফি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। নীরা কেঁদেই যাচ্ছে। তাঁর কাছে বিষয়টা খুবই অবাক লাগছে।
একটা নতুন মেয়ে এত সুন্দর কাজের অফার পেয়ে কাঁদছে। কারণ কি?

রাস্তায় বেরিয়ে নীরার এই ভালো খবরটা কাউকে দিতে ইচ্ছে করলো। কাকে দেয়া যায়? আচ্ছা ভালো খবর বা গুড নিউজ এদের কি প্রাণ আছে? এরা কি জীবন্ত? এরা একজন মানুষের কাছে আসামাত্র অতি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষটাকে তাড়া দিতে থাকে, আমি গুড নিউজ বলছি, আমাকে শেয়ার করো। আর খারাপ খবরগুলো হয় মৃত। এগুলো কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না। কেউ জানতে চাইলে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাতে হয়।
অন্য আরও তিনটে এড এজেন্সিতে নীরাকে যেতে হবে। কথা বলে আসা দরকার। আগামী চার মাসে সে কোনো কাজ করবে না। যত ভালো অফারই হোক, কাজ নেবে না। সে এগ্রিমেন্ট সাইন করে এসেছে। নীরা ঘড়ি দেখলো, তিনটে বাজে। একটা শপিং মল যাওয়া দরকার, জুতো কিনতে হবে।
শপিং মলে গিয়ে নীরার জুতো কেনা হলো না। শফিক ভাইয়ার জন্য কিছু ভালো কাপড় কেনা দরকার। বেচারা অনেকদিন পর ক্যাম্পাস জয়েন করবে। এতদিনের ঝুট ঝামেলায় কাপড়চোপড় কিছু কেনাই হয়নি। এমনিতেও বেচারার জীবন থেকে ভালো নামক জিনিসটাই হারিয়ে গেছে। একগাদা কাপড় কিনে নীরা দোকানে রেখেই বেরিয়ে এলো। আগে ডিরেক্টরদের সাথে কথা বলার কাজগুলো সেড়ে আসা যাক্। আজ বাড়ি ফিরতে ঠিক রাত হবে।

তামিমের কেন জানি নাফিসাকে খবরটি ফোনে বলতে ইচ্ছে করছিলো না। ফোন করে এরকম খবর কাউকে বলতে ভালো লাগার কথাও নয়।
তামিম মেসেজ পাঠালো,
“শ্রদ্ধেয় নাফিসা ম্যাডাম, প্রথমে আমি আপনাকে একটি সুখবর দিচ্ছি তা হলো, আপনার অনুমানই সঠিক। শফিক সাহেবের একটি কন্যাসন্তান আছে।
তিনি হয়তো নিজের মেয়েকে নিয়েই আপনাকে ধন্যবাদ দিতে আসবেন। এটা সত্যিই আনন্দের!
এখন আমি আপনাকে দুটি দুঃসংবাদ দিচ্ছি। প্রথম দুঃসংবাদ, শফিক সাহেবের প্রাক্তন স্ত্রী মানে বর্ষা চৌধুরী আবার বিয়ে করেছেন চারমাস হলো। দ্বিতীয় দুঃসংবাদ হলো, শফিক সাহেবের কন্যাসন্তানটি অসুস্থ। গর্ভে থাকা অবস্থায় তার মা হাই ডোজ এবরশান পিল গ্রহণ করেন, যার ফলাফলে শিশুটি বিভিন্ন জটিল শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। শিশুটির নাম, মুকুল। মুকুলের বয়স দেড়মাস।”

তামিম আর কিছু লিখলো না। নাফিসার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। আচ্ছা, নীরা কি মুকুলের কথা জানে? তাদের বাড়ির কেউ কি জানে? শফিক সাহেব কি ব্যাপারটা প্রথম থেকেই জানতো? না জানলে পরে কিভাবে জানলো? মুকুল যে অসুস্থ, এটা কি শফিক সাহেব জানেন? বর্ষা মেয়েটি কি স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে? একটা সাত-আটমাসের প্রেগন্যান্ট মহিলা কি স্বেচ্ছায় বিয়ে করার মানসিকতা রাখেন নাকি তাকে জোর করা হয়েছে? তাঁর স্বামী কি করে? সেই স্বামীই বা কিরকম? এবরশান পিল সে কি করে নিতে পারলো? একটা মা কি কখনোই এরকম ভয়ানক কুৎসিত কাজ করতে পারেন নাকি সে কারো ষড়যন্ত্রেরর শিকার?
—স্যার, অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার স্যার এখন একটু বেরোবেন। আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তামিম ঘড়ি দেখলো, রাত ন’টা বাজে। এরকম সময় তো উনার বেরোবার কোনো শিডিউল ছিল না। তাহলে? তামিম উঠে দাঁড়ালো।
—স্যার কিছু বলেছেন?
—ফুল্লি আর্মড হয়ে বেরোতে বললেন। অপজিশানের সাথে একটা সিক্রেট মিটিং আছে। গাড়িতেই কথা বলবেন।
তামিম দুটো বন্দুকই সাথে নিলো। আজ গুলির ব্যবহার লাগবেই মনে হচ্ছে।

সেলিনা মেয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন। তিনি আরেকটি এন্টি এনজাইটি পিল নিলেন। গা গুলাচ্ছে, আবার বমি হবে। প্রেশার কি নেমে গেছে বেশি? ইতু তো কখনোই এত দেরি করে না। রাত ন’টা দশ! মোবাইল ফোনও বন্ধ বলছে। তামিমকেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না, নিশ্চয় ডিউটিতে আছে। ছেলেকে এই পেশায় দিয়ে তো মহাভুল হয়েছে। তামিমের কোনো অফিস কলিগকে কি ফোন করবেন? তা বোধহয় ঠিক হবে না। মেয়ে এতরাত পর্যন্ত ফেরেনি, এটা নিশ্চয় ভালো খবর নয়! আরেকটু অপেক্ষা করা যাক। রিতু ইতুর সব বান্ধবীদের বাসায় ফোন করছে, কারও কাছেই কোনো খবর মিলছে না। রিতু একটু পর পর মায়ের কাছে ছুটে ছুটে আসছে,
—-ভাইয়া থাকলে এমন হতো না মা। কখনোই এমন হতো না। বাড়িতে তিন তিনটে গাড়ি, ও একটা গাড়িও নিলো না।এমনকি ড্রাইভারকেও মানা করেছে সাথে যেতে। ইতু নিশ্চয় বিপদে পড়েছে মা। ওকে কেউ প্ল্যান করে বিপদে ফেলেছে।
সেলিনা রিতুর কথা বিশ্বাস করতে চাইছেন না। ইতুর বাবাও হুট করে আজ বিকেলেই ইন্ডিয়া গেছেন; ফিরবেন আগামী পরশু। এরকমটা কেন হলো? বাবা-ছেলে দুজনের কেউই এই মুহূর্তে ঢাকায় নেই! তাহলে সত্যিই কি কোনো বড় বিপদ আসছে? গতরাতে তিনি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। সেটাই কি সত্যি হতে চলেছে? সেলিনা আবার মাথায় আইস ব্যাগ চেপে ধরলেন।
রিতু আবার ছুটে আসলো,
—মা ভাইয়ার অফিসের হারুন সাহেবকে ফোন করি? তিনি হয়তো কোনো কিছু করতে পারবেন?
হারুন ফোন রিসিভ করে এক সেনটেন্সেই বললো,
—তামিম স্যার প্রাইম মিনিস্টার স্যারের গাড়িতে আছেন। অন ডিউটি। এখন তাকে পাওয়া যাবে না।
—শুনুন, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। আমার বোন ইতু ক্যাম্পেইন ট্রিপে গেছে আজ বিকেলে। ও’র বাকি সব বন্ধুরা বাসায় ফিরেছে, শুধু ও’ই এখনো এসে পৌঁছায়নি। মা কাঁদছেন খুব! কিছু একটা করুন।
খবরটাতে হারুন থতমত খেয়ে গেল।
—ট্রিপটা কোন জায়গায় ছিল?
—সে জায়গার নাম বলে নি, তবে ঢাকার ভেতরে। ও’র মোবাইল ফোনও বন্ধ বলছে।
—লাস্ট কটায় ও’র সাথে কথা হয়েছে।
—বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ।
—ক’টায় ফিরবে এমন কিছু কি বলেছে? বাকি বন্ধুরা কি বলছে?
—ও’র সব বন্ধু বলছে, ওদের ক্যাম্পেইনটা সাতটার মাঝেই শেষ হয়ে গেছে। তবে ইতু ও’র এক ছেলেবন্ধুকে সাথে করে ফিরছিলো। আমি জানি, ও নিশ্চিত বিপদে পড়েছে।
—রিতু, আমি গুলশান থানার ওসি সাহেবকে খবরটা দিচ্ছি, তিনি বাসায় আসলে যা যা ইনফরমেশন দরকার বলো। আমি আশেপাশের থানাও জানিয়ে দিচ্ছি। ইতুর একটা ছবি আমায় হোয়াটস এপে পাঠাও এক্ষুণি।
—ওকে
বলেই রিতু কেঁদে ফেললো।
—ইতু খুবই সহজ সরল। ওকে কেউ বিপদে ফেললে, ও ফেইস করতে পারবে না।
হারুন নিজের কণ্ঠ দৃঢ় করে বললো,
—ইতু ফিরবে, অবশ্যই ফিরবে। ডোন্ট ওরি রিতু।
হারুন ফোন রেখে, ওসি সাহেবকে ফোন করলো।
তামিম স্যার মোটামোটি তিনটে গাড়ি সামনে। খবরটা কিভাবে দেওয়া? প্রাইম মিনিস্টার স্যার তো সাথেই তাই তামিম স্যারের ফোন বন্ধ। মেসেজ করে দেওয়া যাক। ফোন অন করলেই দেখতে পাবে!
হারুন বিড়বিড় করে বললো, হে পরম দয়ালু মেয়েটার যেন কোনো বিপদ না হয়!

নীরা বিল্ডিংটার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল। ঢাকার মতো শহরে এরকম প্যাঁচ লাগানো গলিতে এত ভগ্নদশা বিল্ডিং এখনো আছে? নীরা ব্যাগ থেকে এড্রেস বের করে মিলিয়ে নিলো। হ্যাঁ ঠিক আছে, এর তিনতলাতেই অফিস। আশপাশটা এরকম নীরব কেন? লোকজন আছে তবে একেবারেই কম! এরকম জায়গায় এরা এড এজেন্সি খুলেছে কেন? নীরা ঘড়ি দেখলো, ন’টা পয়ঁত্রিশ। এত রাতে এখানে যাওয়া কি ঠিক হবে? নীরা একমুহূর্ত ভাবলো।এত দূর এসে যখন কষ্ট করে অফিস খুঁজে বের করেছে, ফিরে যাওয়া কি ঠিক হবে? না যাওয়া যাক, মিডিয়ায় কাজ করতে হলে এসব দিন রাতের সময় ধরে চলা যাবে না। এই প্রফেশনটাই তো চ্যালেঞ্জিং। ভয়, জড়তা সব বাদ দিয়ে শুধু কাজে ফোকাস করতে হবে। এটা তার শুরুর সময়, এভাবেই তাকে কাজ খুঁজে নিতে হবে। এভাবেই বিভিন্ন জায়গায় নক করে করে। আচ্ছা, এটা যদি আবার কোনো দুষ্টু লোকের আস্তানা হয়? নীরা ব্যাগের ভেতরটা ভালো করে দেখে নিলো। এসিডের বোতল, ছুড়ি, ব্লেড, মরিচের গুঁড়ো, ব্লিচিং পাউডার সব আছে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে নীরার মনে হলো, একটা বন্দুক সাথে থাকলে ভালো হত। সে যখন অনেক বড় মডেল হয়ে যাবে, অনেক টাকা যখন তার হবে, সে নিশ্চয় একটা দামী বন্দুক কিনে লাইসেন্স করে নিবে। বন্দুক চালানো সে শিখবে তামিম নামক চুমুগুন্ডার কাছ থেকে। আচ্ছা, এই মুহূর্তে কেন লোকটার কথা মনে হলো? সকালেও তার এগ্রিমেন্ট পেপারটা হাতে পেয়ে লোকটার কথা মনে হয়েছিলো। মানে কি? যখনি তার হার্টবিট বেশি হচ্ছে লোকটার কথা মনে পড়ছে। সকালে আনন্দে হার্টবিট বেড়েছিলো, তখন মনে পড়েছে আর এখন ভয়ে মনে পড়েছে।

নীরা দোতলার সিঁড়ি পেরোতেই দেখলো তিন তলার সিঁড়িতে বাতি জ্বলছে না, গা ছমছম করছে তার। লোকজন নেই নাকি? কোনো সাড়াশব্দ নেই কেন?
তার কি ফিরে যাওয়া উচিত? এত ভয় করছে কেন হঠাৎ? ধুত! আসাই উচিত হয়নি এখানে….

(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here