রংধনুর_আকাশ #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ পর্ব-৫১: (১ম অংশ)

0
635

#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৫১: (১ম অংশ)

৮২।
মাফিন চট্টগ্রামে ফেরার পর সোজা স্বস্তিকার সাথে দেখা করতে চলে গেলো। স্বস্তিকা মাফিনকে দেখে তার মাকে বলল,
“দেখেছেন আম্মিজান, মাফিনের কাছে আমি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। সে চট্টগ্রামে এসে সোজা আমাকেই দেখতে এলো, মাকে কিন্তু দেখতে যায় নি।”

ফাতেমা জান্নাত মেয়ের কথা শুনে বললেন,
“এগুলো কেমন অদ্ভুত কথাবার্তা! আমি কি তোমাকে এমন শিক্ষা দিয়েছি? আমার এমন কেন মনে হচ্ছে তুমি মাফিনকে ওর পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছো?”

“আম্মিজান, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আমি এমনটা চাই না। আমি শুধু মাফিনের কাছে গুরুত্ব পেতে চাই৷ উনি তো আমাকে অনেক কম গুরুত্ব দেন, আর আজ উনি আমাকেই প্রথমে দেখতে এসেছে, তাই অনেক ভালো লাগছে। আর মাফিনের পরিবারের কেউই আমাকে ভালোবাসে না। মহুয়া-মারিয়া ওদের দৃষ্টিতে বড় ভাবীই সেরা। মা এতোদিন আমাকেই পছন্দ করতেন। কিন্তু বড় ভাবী হয়তো আমার বিরুদ্ধে মাকে উসকে দিয়েছেন। আপনি জানেন আম্মিজান, বড় ভাইয়াও আমাকে অনেক পছন্দ করেন। কিন্তু সব ঝামেলা সৃষ্টি হয়, বড় ভাবীর জন্য। উনার পরিবারের লোকেদের দেখলে গরীব গরীব মনে হয়। আমি বুঝি না, এতো মেয়ে থাকতে বড় ভাইয়া শুধু শুধু উনাকেই কেন বিয়ে করলেন!”

ফাতেমা জান্নাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“ভেদাভেদ জিনিসটা খুব খারাপ। তুমি শুধু শুধু পড়াশুনা করে তোমার আব্বার টাকা নষ্ট করেছো, মানসিক ভাবে তোমার শিক্ষা এখনো হয় নি। শুনো, তোমার বড় ভাবী অমায়িক একটা মেয়ে। তুমি খুব শীঘ্রই তা বুঝতে পারবে।”

স্বস্তিকা রুমে বসে ছিল, তখনই মাফিন স্বস্তিকার কাছে এসে বসলো, আর বলল,
“তোমাকে নিতে এসেছি।”

“আমি যাবো না। কেউই আমাকে পছন্দ করে না। আপনি বরং সবার পছন্দে বিয়ে করে নিন।”

মাফিন হেসে বললো,
“তোমাকে তো ভালোবেসে বিয়ে করি নি, সবার পছন্দেই বিয়ে করেছি।”

“এখন কেউই আমাকে পছন্দ করে না। তাই আরেকটা বিয়ে করে ফেলুন।”

মাফিন স্বস্তিকার কাছে এসে তার মুখের সামনে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল,
“তুমি তাহলে অনুমতি দিয়ে দিচ্ছো। ধন্যবাদ। আমি বরং এবার নিজের পছন্দেই বিয়ে করে দেখি। অদ্রি মেয়েটা অনেক ভালো। দেখতেও সুন্দর।”

স্বস্তিকা চোখ বড় বড় করে মাফিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তার হাতে কামড় বসিয়ে দিলো। মাফিন ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো আর স্বস্তিকাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “রাক্ষসী।”

স্বস্তিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, আমি রাক্ষসী। আপনি যদি আরেকটা বিয়ে করেন, তাহলে আমি আপনাকে আর আপনার বউকে এভাবে কামড়ে খেয়ে ফেলবো।”

“আমাকেও খেয়ে ফেলবে?”

স্বস্তিকা অভিমানী কন্ঠে বললো, “হ্যাঁ।”

“আচ্ছা, তাহলে খেয়েই ফেলো। কারণ আমি তো বিয়ে করবোই।”

স্বস্তিকা এবার কান্নাভেজা চোখে মাফিনের দিকে তাকালো। মাফিনের এই মুখটা দেখে বড্ড মায়া হলো। সে স্বস্তিকার কাছে এসে তার গালে হাত রেখে বলল,
“যদি তুমি এই মুহূর্তে আমার সাথে আমার বাসায় না চলো, তাহলে তো আমাকে আরেকটা বিয়ে করে বাসায় উঠতে হবে। কারণ ইদানীং আমার একা একা ঘুম আসে না। আর এতোদিন তো আমি ঠিকভাবে ঘুমাতেই পারি নি।”

স্বস্তিকা মুচকি হেসে বলল,
“আমি এক্ষুনি তৈরি হয়ে আসছি। আর আজকে আপনাকে আমিই ঘুম পাড়িয়ে দেবো।”

স্বস্তিকা কথাটি বলে উঠে চলে গেলো। আর মাফিন মনে মনে বলল,
“ভাবী ঠিকই বলেছে, কিছু মানুষকে ভালোবাসা দিয়েই ভালো করা যায়। সব পরিস্থিতিতে রাগ দেখানো যায় না।”

মাফিন স্বস্তিকাকে নিয়ে বাসায় ফেরার পর আরিয়া ফেরদৌস স্বস্তিকাকে বললেন,
“তুমি আমাকে না বলে কেন চলে গিয়েছিলে?”

মাফিন স্বস্তিকার হাত ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“স্বস্তিকা ওর বাবার বাসায় গিয়েছিল, তাই হয়তো বলার প্রয়োজন মনে করে নি।”

মাফিনের উত্তর শুনে সবাই অবাক হয়ে গেলো। আরিয়া আবার বললেন,
“তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?”

“কারণ আমার অনুপস্থিতিতে সবাই আমার স্ত্রীর সাথে খারাপ আচরণ করেছে, যা আমি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারবো না।”

সূচনা বলে উঠলো,
“স্বস্তিকার সাথে কেউ খারাপ আচরণ করে নি। ও নিজেই..”

সূচনাকে থামিয়ে দিয়ে মাফিন বলল,
“ভাবী প্লিজ, ঘরোয়া কথাগুলো আমি শুনতে চাই না। আমার দায়িত্ব আমার স্ত্রীকে সাপোর্ট করা। কেন, ভাইয়া আর মা তো আমাকেই তাই শিখিয়েছিলো। আমি তো আর মিরাজ জামান নই, যে স্ত্রীর সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করবো, আর তাকে অপমানিত হতে দেখবো।”

তারপর মাফিন মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“বাবা তোমার পক্ষে ছিলো না, তাই কি কোনো স্বামীই তার স্ত্রীর পক্ষ নেবে না? তোমার দৃষ্টিতে প্রেম করে বিয়ে করলে অসুখী হয়, কারণ তুমি সুখ পাও নি। তাই হয়তো এটাও আশা করছো পৃথিবীর সব স্বামী তার স্ত্রীর বিপক্ষে দাঁড়াবে।”

আরিয়া ফেরদৌস রাগী কন্ঠে বললেন,
“মাফিন, তুমি এখন খুব বাড়াবাড়ি করছো।”

“হ্যাঁ, আর আমি এভাবেই বাড়াবাড়ি করতে থাকবো। এতোদিন আমরা তোমার সব অদ্ভুত নিয়ম মেনে এসেছি। তুমি আশা করছো আমার স্ত্রীও সেই নিয়মগুলো মেনে চলবে? আমি কালই বাসায় একটা কাজের বুয়া নিয়ে আসবো। সে শুধু আমার স্ত্রীর কাজগুলো করে দেবে। বাকী যদি কারো কোনো সমস্যা হয়, তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। তুমি যেভাবে তোমার জীবনকে দেখেছ, ওভাবে আমি দেখছি না। তার মানে এইটা নয় যে তুমি শুদ্ধ, আমি ভুল। হয়তো আমাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। তাই তোমাকে আমার দিকটাও দেখতে হবে।”

কথাগুলো বলে মাফিন স্বস্তিকার হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো। আর আরিয়া ফেরদৌস নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে মেঝেতে বসে পড়লেন। আর কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“আমি তো জীবনে স্বামীর সুখ পাই নি। আর এখন আমার সন্তানরাও আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তাহলে এতোদিন আমি কাদের জন্য বেঁচে ছিলাম?”

এদিকে পরিবারের সবাইকে অবাক করে দিয়ে মারিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়। কিন্তু মারিয়াকে এতো দূরে পড়ানোর ব্যাপারে প্রহরের বাবা-মা কোনো সিদ্ধান্তই দিচ্ছিলেন না, যেখানে আরিয়া ফেরদৌস মেয়ের ভালো ফলাফলে অনেক খুশি হয়েছেন। মাসুমা আকতার আরিয়া ফেরদৌসকে জানালেন, আরিয়াকে চট্টগ্রামে ভর্তি করিয়ে দিলেই ভালো হবে। সব শুনে মাফিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
“বিয়ে দাও, একদম ঘটা করেই বিয়ে দাও। মারিয়ার ভবিষ্যতটা তুমিই নষ্ট করেছো। এখন আর চুপ করে আক্ষেপ করে লাভ নেই। ওরা তোমার মেয়েকে ঢাকায় কেন পাঠাবে? বর থাকবে এখানে বউ থাকবে দেশের আরেক প্রান্তে, এর জন্য তো ওরা ছেলেকে বিয়ে দেয় নি। ছেলেকে বিয়ে করিয়েছে সংসার করানোর জন্য। আর তুমি আমাদের বিয়ে দিয়েছো, প্রেম থেকে বাঁচানোর জন্য। এম আই রাইট?”

মারিয়া মাফিনের কাছে এসে বলল,
“ভাইয়া আমি তো চট্টগ্রামের ভালো ইউনিভার্সিটিতেও চান্স পেয়েছি। আমি এখানেই পড়বো। আর এখানে তো আমার আরো ভালো সাব্জেক্ট এসেছে। আর এটাই আমার পছন্দের সাব্জেক্ট। আর মহুয়াও আমার সাথে একই ভার্সিটিতে পড়বে। ভাবতেই অনেক ভালো লাগছে। ঢাকাতে যাওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। আমার বান্ধবীরাও চট্টগ্রামে থাকবে। আমি ওখানে গিয়ে কি করবো?”

মারিয়ার কথা শুনে বোঝা গেলো সে পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার চেষ্টায় এই কথা বলছে। কারণ তার এখানে থাকার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না। সে বারবার বলেছিল, সে চট্টগ্রামের বাইরে গিয়ে পড়াশুনা করতে চায়। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। যদিও সে মায়ের সাথে যুদ্ধ করে তার ইচ্ছেটার পূর্ণতা দিতে পারতো, কিন্তু প্রহরের বাবা-মারই যেখানে ইচ্ছে নেই, সেখানে কার সাথে যুদ্ধ করবে? আর প্রহর তো এই খবর শুনে খুশিই হয় নি। এমনকি একটাবার তার সাথে দেখা করতেও এলো না।

শেষমেশ মারিয়া ও মহুয়াকে চট্টগ্রামে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো। এই কয়েকদিনে মহুয়ার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সে ইদানীং সাজগোজ করতে পছন্দ করে। একা একাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে থাকে। আর হুটহাট ছাদে গিয়ে বসে থাকে। তবে মহুয়াকে এই নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে নি। কারণ প্রশ্ন করার মতো বাসায় কেউই থাকে না। সূচনা স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে কোচিং ক্লাস নিতে চলে যায়। আর স্বস্তিকা ওইসময় ভার্সিটি থেকে ফিরে ঘুমে ব্যস্ত থাকে। তবে মারিয়া এসব লক্ষ্য করেছে। যদিও সে মহুয়াকে এই ব্যাপারে এখনো কোনো প্রশ্ন করে নি। তবে মহুয়ার এই হাবভাব তার খুব অদ্ভুত লাগছে।

কিছুদিন পর,
সকালে নাস্তার টেবিলে বসে আরিয়া ফেরদৌস সবার উপস্থিতিতে বললেন,
“গতকাল মাসুমা আপা আমাকে কল দিয়েছিলেন। তারা মারিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়ে যাবেন। এখন যেহেতু পড়াশোনার চাপ নেই, তাই বিয়েটা হয়ে গেলেই ভালো হবে। কারো কোনো আপত্তি আছে?”

মাফিন বলল,
“আপত্তি থাকলেও কি তুমি আটকে থাকবে?”

মাহাথি বলল,
“ওরা চাইলে মারিয়াকে আমরা তুলে দেবো। এখন তো আমাদের চেয়ে মারিয়ার উপর ওদের দায়িত্বই বেশি।”

মারিয়া মনে মনে খুশি হলো, কারণ প্রহরকে সে এবার সারাক্ষণের জন্যই নিজের কাছে পাবে। যখন ভাবীর কারণে প্রহরের সাথে সে প্রহরের বন্ধুর বাসায় উঠেছিলো, তখন ঠিকভাবে প্রহরের সাথে কথাও বলতে পারে নি। সে কোচিং থেকে এসে ক্লান্ত থাকতো, অন্যদিকে প্রহরও অফিস থেকে এসে ঘুমিয়ে পড়তো। রাতে প্রহর অন্য রুমে ঘুমাতো, কারণ মারিয়া সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করতো। কিন্তু এখন তো তার কোনো চাপ নেই। সে এখন দিনরাত শুধু প্রহরকেই দেখবে।

পরের সপ্তাহে আরিয়া ফেরদৌস, তার বড় ও মেজ আপা আর দুলাভাইদের নিয়ে প্রহরদের বাসায় গেলো। আর সেদিনই তারা বিয়ে নিয়ে যাবতীয় আলাপ-আলোচনা করলো। সিদ্ধান্ত হলো আগামী মাসের শুরুতেই প্রহর আর মারিয়ার বিয়ে দেওয়া হবে। এরপর বিয়ে নামক অনুষ্ঠানকে ঘিরে আয়োজন করা হলো যাবতীয় সব ছোট খাটো অনুষ্ঠান। মারিয়ার ইচ্ছে ছিলো বিয়ের আগে প্রহরের সাথে ফটোশুট করবে। যেদিন প্রহরের ছুটি থাকবে সেদিনই এই ফটোশুট করা হবে৷ আর স্থান হবে বরিশালের সাতলা গ্রামে। এই গ্রামটি মূলত শাপলার জন্য বিখ্যাত। এখানে তিন ধরনের শাপলা দেখা যায়, লাল, সাদা এবং বেগুনি। তবে লাল শাপলা বেশি চোখে পড়ে। মারিয়া এমনিতেই ভ্রমণ প্রিয় মানুষ। তাই বিয়ে উপলক্ষে তার শাপলা বিলে যাওয়ার বহুদিনের এই ইচ্ছেটাও পূর্ণ হয়ে যাবে। তবে শুধু ছবি তুলার জন্য এতোদূর যাওয়াটা প্রহরের খুব অদ্ভুত লাগছে। সে মোটেও আগ্রহী ছিলো না। কিন্তু যেখানে মাহাথি আর মাফিন বোনের ইচ্ছে পূরণের জন্য সব ব্যবস্থায় করে ফেলেছে, সেখানে প্রহর আগ বাড়িয়ে না বললে বিষয়টা সুন্দর দেখাবে না। তাই সে রাজী হয়ে গেলো। আর পরেরদিন মাফিনের পরিচিত ফটোগ্রাফারকে সাথে নিয়ে মাফিন, স্বস্তিকা, প্রহর আর মারিয়া বরিশালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো।

৮৩।
হোটেল থেকে বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো প্রহর, মাফিন আর স্বস্তিকা। প্রহর মারিয়ার পছন্দ করা সাদা শার্ট ও সাদা গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পরেছে। এই মুহূর্তে সবাই মারিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রায় বিশ মিনিট পর মারিয়া হোটেল থেকে নিচে নামলো। মারিয়াকে দেখেই প্রহর চমকে উঠলো। আজ প্রথম সে মারিয়াকে শাড়িতে দেখেছে। যদিও আক্দের দিন মারিয়া শাড়ি পড়েছিলো। তবে সেই শাড়িতে তাকে কৃত্রিম লেগেছিল। কিন্তু আজ একদম প্রাকৃতিক লাগছে। মারিয়ার হাতে সাদা চুড়ি, কপালে কালো টিপ। ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক। খোলা চুলের ফাঁক দিয়ে কানে পরা ঝুমকো গুলো দেখা যাচ্ছে।
মারিয়া প্রহরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“কি দেখছেন? ভালো লাগছে না?”

প্রহর ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে বললো,
“খুব সুন্দর লাগছে৷ কিন্তু তুমি তো শাড়ি পরতে পছন্দ করো না। হঠাৎ!”

“বিয়ে উপলক্ষে ছবি তুলছি, এই দিন কি বারবার আসবে? এমনিতে শাড়ি পরতে আমার ঝামেলায় লাগে, মনে হয় সাপ পেঁচিয়ে ধরেছে।”

কথাটি বলে মারিয়া হেসে উঠলো। প্রহর চোখ ছোট করে বলল,
“এখন পেঁচিয়ে ধরে নি?”

“ধরেছেই তো। কিন্তু এমন জায়গায় শাড়ি পরলে ছবি সুন্দর আসে। এই মুহূর্তে আমার কাম্ফোর্ট থেকে ছবি সুন্দর আসাটাই গুরুত্বপূর্ণ।”

“তুমি কাম্ফোর্ট থাকলেই তো ছবি সুন্দর আসবে।”

“আমি সুন্দর ছবির জন্য সব ঝামেলায় মেনে নিতে পারবো।”

প্রহর আর কিছুই বলল না। যেখানে তার শাড়ি পরা মেয়ে পছন্দ, সেখানে তার বউ এটিকে ঝামেলা মনে করে।

শাপলা বিলে নেমে মারিয়া মোটামুটি শ’খানেক ছবি উঠিয়েছে, যা তার একার। আবার প্রহরের সাথে আরো শ’খানেক উঠিয়েছে। ছবি উঠানোর পর মারিয়া হোটেলে ফিরেই শাড়িটা খুলে একটা টি-শার্ট পরে নিলো। প্রহর মারিয়াকে তার আগের রূপে দেখে দমে গেলো। কিন্তু সে চিন্তা করলো এবার আর চুপ থাকবে না। প্রহরের মনে মারিয়াকে দ্বিতীয়বার শাড়িতে দেখার লোভ জন্ম নিচ্ছে। তাই সে বলল,
“চলো আমরা এবার সূর্যমুখী বাগানে যাই।”

“কিন্তু এখানে সূর্যমুখী বাগান কোথায় পাবো?”

“খুঁজে নেবো।”

প্রহর অনেক খোঁজ নেওয়ার পর একটি বাগানের সন্ধান পেলো। আর এর আগে মারিয়ার জন্য লাল রঙের শাড়ি আর তার সাথে মিলিয়ে লাল গাজরা আর চুড়ি কিনলো। মারিয়া প্রহরের দেওয়া উপহারগুলো পেয়ে খুব খুশি হলো। কিন্তু সে প্রহরকে একটা আবদার করে বসলো। বললো,
“আমি এক শর্তে এই শাড়িটা পরবো, যদি আপনি নিজ হাতে আমাকে শাড়ি পরিয়ে দেন।”

প্রহর প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে রাজী হয়ে গেলো, কারণ লাল শাড়িতে মারিয়াকে দেখার ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতে পারছিলো না। তবে মারিয়া প্রহরের ইতস্তত ভাব কমানোর জন্য একটা শার্ট পরে নিলো। এরপর প্রহর মারিয়াকে শাড়ি পরিয়ে দিলো। তারপর চুলে খোপা করে লাল গাজরা বেঁধে দিলো, কানে লাল ঝুমকো আর হাত লাল চুড়ি পরিয়ে দিয়ে বলল,
“বাকীটুকু তুমিই করে ফেলো। আমি সাজাতে পারি না। আমি কখনো কাউকে সাজিয়ে দেই নি।”

মারিয়া হেসে বলল,
“অভ্যাস তো করতে হবে। কারণ আপনার বউ মেকাপ করতে খুব পছন্দ করে।”

“যদি বলি তাকে মেকাপ ছাড়া বেশি সুন্দর লাগে!”

মারিয়া কিছুক্ষণ প্রহরের দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রহর মারিয়ার চাহনি দেখে বলল,
“আমি কারো ইচ্ছের উপর নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দেবো না।”

এরপর মারিয়া সম্পূর্ণ তৈরী হয়ে নিলো। প্রহর এবার মারিয়াকে দেখে সত্যিই অবাক হলো। প্রতিটি নারীই শাড়িতে মায়াবিনী। মারিয়াই এর প্রমাণ।

সূর্যমুখী বাগানে গিয়ে প্রায় শ’খানেক ছবি তোলার পর মারিয়া সন্তুষ্ট মনে হোটেলে ফিরলো। রাতে মহুয়াকে কল করে বলল,
“জানিস, আজকে প্রহর আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে।”

মহুয়া হেসে বলল, “তাহলে তো আমার বোনুর প্রেমের গল্প শুরু হয়েছে!”

“জ্বি, না। প্রহর আমাকে ভালোবাসে না। ওর শুধু শাড়ি পরা মেয়েই পছন্দ। তুই শাড়ি পরলে তোকেও পছন্দ করবে।”

“আরেহ, এটাকে পছন্দ বলে না। দুর্বলতা বলে। ভাইয়া শাড়ি পরা মেয়েদের প্রতি দুর্বল।”

“যাহ! তাহলে তো ও একটা ছ্যাচড়া বর। যে মেয়ে শাড়ি পরবে তাকেই ভালোবাসবে, তার দিকেই তাকাবে। ইয়া আল্লাহ, আমার বরকে শুধু আমার দিকে আসক্ত করো। আমিন।”

মহুয়া হাসলো। মারিয়া আবার বলল,
“এই আমিন বল।”

“আমিন। আমিন। আমিন। এখন কবে আসবি?”

“আজ রাতেই রওনা দেবো।”

পরের দিন তারা চট্টগ্রাম ফিরে এলো। আর দুইদিন পর মারিয়া তার কাছের বান্ধবীদের নিয়ে ছোটখাটো একটা হলুদ অনুষ্ঠান করলো। এরপরের দিন খুব ধুমধাম করে মেহেদী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো।

এদিকে প্রহর চুপচাপ বারান্দায় বসে আছে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, কাল তার মারিয়ার সাথে বিয়ে। সে ভাবছে, কিভাবে সে মারিয়াকে মেনে নিবে। মারিয়া তার পছন্দের কাজগুলোকে ঝামেলা মনে করে। আর মারিয়ার পছন্দের বিষয়গুলো প্রহরের কাছে অপছন্দনীয়। তাহলে সে এই পরিস্থিতিতে কিভাবে মারিয়ার কাছে আসবে? প্রহরের বিয়ের রাত নিয়ে স্বপ্ন ছিলো, বউকে নিয়ে ছাদে যাবে, তার বউ সাদা শাড়ি পরবে, আর তারা সারা রাত রাতের আকাশ দেখে গল্প করবে। কিন্তু মারিয়ার সাথে সে এসব ভাবতেই পারছে না। কারণ মারিয়া এক মিনিট যেখানে ধৈর্য নিয়ে বসে না, সেখানে সারা রাত তার সাথে বসে শুধু শুধু আকাশ কেন দেখবে? প্রহরের দ্বিতীয় অভ্যাস হবে বউয়ের হাতে বানানো নাস্তা খাওয়া, যেখানে মারিয়া কিছুই পারে না। আর মারিয়ার অনর্থক বকবকানি, পাগলামো, বেপরোয়া চলাফেরা এসব কিভাবে সে সহ্য করবে?

এদিকে রাত তিনটাই মারিয়া প্রহরকে ফোন দিয়ে বলল,
“এই মুহূর্তে আপনি যেখানেই আছেন আমার বাসার সামনে চলে আসুন।”

প্রহর অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু কেন?”

“যা বলছি তাই করুন।”

মারিয়ার জোরাজুরিতে প্রহর বাধ্য হয়ে মারিয়ার বাসার সামনে আসতেই দেখলো মহুয়া শাড়ি পরে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। প্রহর মহুয়ার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“মারিয়া কোথায়? ও আমাকে বাসার সামনে আসতে বললো।”

মহুয়া কিছু না বলে দৌঁড়ে প্রহরের গাড়িতে উঠে গেলো আর ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া, আপনি একটু সামনে যান প্লিজ।”

“কিছু হয়েছে।”

“ভাইয়া প্লিজ। গাড়িটা সামনে নিয়ে যান।”

প্রহর মহুয়ার হাবভাব কিছুই বুঝতে পারছিলো না। হঠাৎ সে দেখলো তিনটা ছেলে মহুয়াদের বাসার গেইট দিয়ে বের হচ্ছে। তাদের দেখে প্রহর বলল,
“কি সমস্যা আমাকে বলবে?”

“ভাইয়া মা আমাকে মেরেই ফেলবে। এই ছেলে দুইটা অনেকদিন ধরে আমাকে বিরক্ত করছিলো। আমার বাসার সামনে এটা-ওটা দিয়ে যেতো। আমাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করতো। পরে জানতে পারলাম আমাদের উপরের ফ্ল্যাটের আন্টির ভাইয়ের ছেলে। আরেকটা আছে, সেই ছেলেটা ওদের বন্ধু। আমি একটু আগে আগে ক্লাব থেকে এসেছি। কিন্তু লিফট খুলতে ওদের দেখে সাথে সাথে বের হয়ে যাই। এরপর ভাগ্যিস আপনি এসেছেন।”

“কিন্তু ওরা তোমার কিছু করতে পারতো না। নিচে দারোয়ান আছে।”

“কথা তো বলতোই। মা যদি একবার দেখে ফেলে আমি বাইরের কারো সাথে কথা বলছি আমাকে অনেক বকা দেবে। মা এসব পছন্দ করে না।”

“আচ্ছা, বুঝলাম। এখন ওরা চলে গেছে। চিন্তা করো না।”

মারিয়া গাড়ি থেকে নামতেই দেখলো দূরে প্রহরের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সে খুশি হয়ে সূচনাকে বলল,
“ভাবী, আমি একটু উনার সাথে কথা বলে আসছি।”

সূচনা বলল, “প্রহর কোথায়?”

মারিয়া গাড়ি দেখিয়ে বলল,
“ওই যে উনার গাড়ি। আমি আসতে বলেছিলাম তো তাই এসেছে।”

সূচনা বলল, “আমি এখানেই দাঁড়াচ্ছি। এতো রাতে তোমাকে একা ছাড়তে পারবো না। যাও, তুমি কথা বলে এসো।”

মারিয়া মুচকি হেসে প্রহরের গাড়ির সামনে আসতেই দেখলো মহুয়া গাড়ির ভেতরে বসে আছে। মহুয়াকে প্রহরের সাথে দেখে মারিয়ার রাগ উঠে গেলো। তারা গাড়ি থেকে নামতেই মারিয়া রাগী কন্ঠে বলল,
“তুই আমার বরের সাথে কি করছিস?”

মহুয়া কিছু বলতে যাবে তখন প্রহর বলল,
“বাসায় কেউ ছিলো না। অপরিচিত কিছু ছেলেকে লিফটে দেখে ও বাইরে এসে আমার গাড়িতে উঠেছে।”

মারিয়া প্রহরের উত্তর শুনে কিছু বললো না। কিন্তু সে এখনো সন্দেহের দৃষ্টিতে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মহুয়া বুঝতে পেরে মলিন হেসে চলে গেলো। মহুয়াকে চলে যেতে দেখে মারিয়া হুট করে প্রহরকে জড়িয়ে ধরলো। আর প্রহরের গালে আদর করতে লাগলো। প্রহর এক ঝটকায় মারিয়াকে সরিয়ে দিয়ে রাগী দৃষ্টিতে মারিয়ার দিকে তাকালো। মারিয়া সাথে সাথেই পাশ ফিরে দেখলো মহুয়া চলে যাচ্ছে।

প্রহর বলল,
“এসব কি করছিলে?”

“এমন রিয়েক্ট করছেন মনে হচ্ছে বমি করে দিয়েছি।”

“রাস্তায় অন্তত এমন করা উচিত না। কেউ দেখলে অভদ্র বলবে।”

“আপনি আমার বর।”

“তাই তুমি রাস্তায় আমার সাথে যা-তা করবে?”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। কালকে তো আপনার বাসায় যাচ্ছি একদম পার্মানেন্টলি, তখন যা-তা করতে কোনো বাঁধা নেই। এখন তো কাল আমাদের আনুষ্ঠানিকতাও হয়ে যাবে। সবাই জানবে, আমি মিস মারিয়া নাওয়াল থেকে মিসেস আলভী হোসেন প্রহর হয়ে গেছি।”

প্রহর মনে মনে বলল,
“এই মেয়ের তো কোনো লজ্জায় নেই।”

মারিয়া চোখ ছোট করে বলল,
“মনে মনে হয়তো বলছেন, আমার মুখে কিছুই আটকাই না। কিন্তু লিসেন মিস্টার বর, আমি মনে মনে যা ভাবি মুখে তাই বলি। যাদের আপনি লাজুক ভাবেন, তারা মনে মনে অনেক কিছুই চিন্তা করে। কিন্তু ভাষা সৃষ্টির অভাবে মুখে বলতে পারে না। আমি কিন্তু খুব ইন্টেলিজেন্ট। তাই মিনিটেই মনের ভাব প্রকাশ করে ফেলি।”

প্রহর বলল,
“তোমার ভাষা দক্ষতা দেখে আমি স্তম্ভিত। এই মুহূর্তে আর স্তব্ধ হতে চাই না। এখন আমাকে ডাকার কারণটাই বলো।”

মারিয়া হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মেহেদী লাগানো হাতটা আপনার হাতের উপর রেখে একটা ছবি তুলবো, তাই ডেকেছি। রাতেই স্টোরিতে দেবো। কালকে অনেক ব্যস্ত থাকবো তো তাই।”

প্রহর মারিয়ার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এরপর প্রহর হাত বাড়িয়ে দিতেই মারিয়া বিভিন্ন কোণে ছবি তুলতে লাগলো।

রাতের আকাশ, শূণ্য রাস্তা, হলুদ শাড়ি আর ফুলের গহনা পরা এক বধূ, হাতে মেহেদী, সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার বর। দূর থেকেই এই দৃশটি ফোনে ধারণ করে নিলো সূচনা। আর বলল,
“ভালো থাকুক এই নব দম্পতি।”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here