#রংধনুর_আকাশ
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-৪৯:
৭৯।
মারিয়া রুম বন্ধ করে বসে আছে। আর রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে মাফিন অনেকক্ষণ ধরেই বোনকে ডাকছে। মাহাথিও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। এদিকে স্বস্তিকা বুঝতে পারছে না কি হয়েছে। সে মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু কি হয়েছে?”
মহুয়া শীতল দৃষ্টিতে স্বস্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“আজ অনেক কিছুই তো হয়ে গেছে। মা থাকলে এতোকিছু বোধহয় হতো না।”
স্বস্তিকা মহুয়ার হাত ধরে বলল,
“আমি কি ভুল কিছু করেছি? তোমার ভাইয়া আমার উপর খুব রেগে আছে! আমার ভীষণ ভয় করছে। প্লিজ মহুয়া, বলো কি হয়েছে!”
মহুয়া স্বস্তিকার হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
“ভাবী আপনি আপতত রুমে থাকলেই ভালো হবে। আর ভাইয়া আপনাকে কিছুই বলবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
কথাটি শুনে স্বস্তিকা যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। সে মহুয়ার কথামতো রুমে চলে গেলো। কিন্তু তবুও সে মনকে শান্ত করতে পারছে না। মাফিনের মেজাজ খুব মারাত্মক! এর আগের বার মাফিন যা করেছে এবার না জানি কি করে।
এদিকে মারিয়া গালে হাত দিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। অন্যদিকে দরজার ওপাশ থেকে মাফিন ডাকছে। মারিয়া মনে মনে বলল,
“কিছুক্ষণ আগে আমাকে চড় মেরে এখন ডাকছে! আমিও দরজা খুলবো না।”
মারিয়া ফোন হাতে নিয়ে দেখলো প্রহরের মেসেজ। মেসেজটা পড়েই তার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। কিছুক্ষণ আগের সব কিছুই ভুলে সে চোখের পানি মুছে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখটা ভালোভাবে ধুয়ে নিলো। তারপর দরজার কাছে এসে মনে মনে বললো,
“প্রহর এসে কাল আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। তখন ভাইয়া বুঝবে আমি একা নই। আমারও কেউ আছে, যে সবসময় আমার যত্ন নেয়, আমার খেয়াল রাখে, আর আমার কষ্ট সহ্য করতে পারে না। আর তখন ওই ভিলেন ভাবীর মুখটাও বন্ধ হয়ে যাবে।”
মারিয়া দরজা খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই মাফিন রুমে ঢুকলো। মারিয়ার ফোলা ফোলা চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কান ধরে মারিয়ার সামনে বসে পড়লো আর মাথা নিচু করে বলল,
“মারু, আমাকে মাফ করে দে বোন। আমি খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমি তোকে কষ্ট দেওয়ার জন্য চড় মারি নি। তুই তো জানিস আমার মেজাজ সম্পর্কে। আমি তোদের চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম। আর ভাই তো বাবার মতো হয়, তাই না? ছোটবেলায় মা আমাদের শাসন করার সময় কতোবার মেরেছিল। আমিও শাসন করতে গিয়েছিলাম তোকে। কিন্তু ভুলেই গিয়েছি, তুই আর সেই সাত-আট বছরের পুচকি নেই, এখন তো পুচকিটা বড় হয়ে গেছে। পুচকিটার বিয়ে হয়ে গেছে। এভাবে চড় মারা উচিত হয় নি আমার। আমাকে মাফ করে দে মারিয়া। মনে আছে যখন আমি রাগ করতাম, তখন তুই আমার রাগ ভাঙানোর জন্য এভাবেই কানে ধরে ওঠবস করতি। আমিও কান ধরে বসে আছি। তুই বললে দাঁড়াবো, ঠিক আছে? পাঁচ বারের বেশি করতে পারবো না কিন্তু। পায়ে ভীষণ ব্যথা। তোদের খুঁজতে খুঁজতেই পা ব্যথা হয়ে গেছে।”
মারিয়া মাফিনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে পাঁচবার করো।”
মারিয়ার কথা শুনে মাহাথি আর মহুয়া হেসে উঠলো। মাফিন মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তুই তোর বড় ভাইকে কান ধরে ওঠবস করতে বলছিস?”
মারিয়া কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,
“মাকে বলবো আর কখনো যাতে আমাদের ফেলে না যায়।”
মাফিন এই কথা শুনে কান ধরে ওঠবস করতে লাগলো। মাফিনকে ওঠবস করতে দেখে মারিয়া কাঁদছে, আবার মুখ চেপে হাসছেও। মাফিন পাঁচবার ওঠবস করে বলল,
“চল শেষ করলাম। এবার মাফ করে দে।”
মারিয়া চোখের পানি মুছে বলল,
“না, এভাবে মাফ করবো না আমি।”
“এই মাত্র কান ধরে ওঠবস করলাম। আর কি করবো বল!”
মারিয়া কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“এক শর্তে, তুমি ক্ষমা পেতে পারো বৎস। যদি আজ আমাদের দুই বোনকে তোমরা দু’জন মিলে ট্রিট দাও। আমরা চারজন আজকে বাইরে ডিনার করবো। কিন্তু ভাইয়া, তুমি ছোট ভাবীকে নিতে পারবে না। উনি গেলে আমি যাবো না।”
মহুয়া বলল,
“না, উনিও যাবেন। ভাবী যা করেছেন ভুল করেছেন। হয়তো উনি বুঝতে পারেন নি। আমরা কেন ওমন করবো?”
মাফিন বলল,
“মারিয়া যা বলবে তা-ই হবে। স্বস্তিকা আমাদের সাথে যাবে না।”
মাহাথি মুচকি হেসে মারিয়ার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“একদম লাল হয়ে গেছে মুখটা। এখন যা, মুখ ধুয়ে ভালোমতো ক্রিম মেখে আয়। নয়তো সবাই দেখলে বুঝবে চড় খেয়ে ট্রিট খেতে যাচ্ছে।”
মারিয়া চেঁচিয়ে বললো, “ভাইয়া।”
মাহাথি আর মাফিন দু’জনেই হেসে উঠলো। এরপর মাফিন রুমে এসে দেখলো স্বস্তিকা একপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। মাফিনকে দেখেই স্বস্তিকা উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু মাফিন চুপচাপ ওয়াশরুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে এসে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলো। তখন স্বস্তিকা বলল,
“আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন?”
মাফিন কোনো উত্তর দিলো না। স্বস্তিকা আবার বলল,
“আমি ভুল করে ফেলেছি। আমি বুঝতে পারি নি। আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?”
মাফিন এবারও কোনো উত্তর না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে মহুয়াকে বলল,
“মহু, আমি গাড়ি বের করছি। তোরা চলে আসিস।”
মাফিন চলে যাওয়ার পর স্বস্তিকা মহুয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় যাচ্ছো তোমরা?”
মারিয়া পেছন থেকে এসে বলল,
“ভাইয়ারা আমাদের ট্রিট দিচ্ছে। আমরা চারজন আজকে বাইরে ডিনার করবো।”
“আমাকে তো কেউ কিছু বলেই নি।”
“কারণ আপনি তো আমাদের সাথে যাচ্ছেন না। ভাবী, আপনি বরং বাইরে থেকে অর্ডার করে নিন, দুপুরে যেভাবে করেছিলেন!”
স্বস্তিকা আর কিছুই বললো না। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আর বিড়বিড় করে বলল,
“আজ বড় ভাবী বাসায় থাকলে ভাইয়া উনাকে সহ নিয়ে যেতেন। শুধু আমার বরটাই আমাকে গুরুত্ব দেয় না।”
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর চার ভাই-বোন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই অদ্রিকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। অদ্রি হাতে দুইটা ব্যাগ নিয়ে ক্লান্ত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। মারিয়া অদ্রির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“অদ্রি আপু, তুমি?”
অদ্রি নিজের নাম শুনে পাশে তাকিয়ে মারিয়াকে দেখে বলল,
“আরেহ পুচকি যে, কেমন আছিস?”
মারিয়া ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ভালো আছি। কিন্তু আপু, আমি এখন আর পুচকি নেই। ”
“আচ্ছা! তা তুই এতো রাতে এখানে কি করছিস? আন্টি জানলে কিন্তু খুব বকবে।”
“একা আসি নি তো। তোমার আন্টির দু’জন ট্রেইন কমান্ডারকে সাথে নিয়ে এসেছি।”
অদ্রি পেছন ফিরে দেখলো মহুয়া, মাফিন আর মাহাথিও মারিয়ার সাথে এসেছে। মাফিনকে দেখেই অদ্রি হালকা হাসলো। মাফিনও হাসি ফেরত দিলো। অদ্রি মাহাথিকে দেখে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া৷ কেমন আছেন?”
“ভালো। তুমি কেমন আছো?”
“জ্বি, ভালো। আর মহুয়া, তুমি তো অনেক শুকিয়ে গেছো!”
মহুয়া বলল,
“পরীক্ষার চাপে এই অবস্থা। কিন্তু আপু, আপনি তো আগের চেয়ে বেশি সুন্দর হয়ে গেছেন।”
অদ্রি মাফিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন তো আর চিন্তায় ফেলার মতো মানুষ নেই, তাই।”
মাফিন বুকে হাত গুঁজে বলল,
“তা তুই তাহলে এখন অন্যদের চিন্তায় রাখিস!”
“না। চিন্তা শব্দটাই এখন আমার জীবনে নেই।”
মহুয়া মারিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“এরা চিন্তা নিয়ে এতো আলাপ-আলোচনা করছে কেন? কাহিনি কি?”
“আরেহ, এটাই তো কথা বলার মাধ্যম। নয়তো অদ্রি আপু আর কি বলবে? তোকে না পেয়ে আমি কতো সুন্দর হয়ে গেছি, মাফিন, দ্যাখ দ্যাখ। আর ভাইয়া কি উত্তর দেবে? তাহলে হয়তো আমার মতো কেউ আর তোকে ইগনোর করে না, তাই না!”
“মারিয়া, তুই এতো কথা কিভাবে বলিস?”
“মুখ আছে। মুখ দিয়ে বলি।”
মাহাথির কথায় মারিয়া-মহুয়া তাদের ফিসফিস থামিয়ে দিলো। মাহাথি বলল,
“অদ্রি তুমি এতো বড় দুইটা ব্যাগ নিয়ে এখানে কি করছিলে?”
“ভাইয়া, আসলে একটা বিপদে পড়েছি। আমি এই মাসে এখানেই একটা অফিসে নতুন জয়েন করেছি। এতোদিন আমি একটা বাসায় পেইয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতাম। আজ ওই বাসায় কিছু লোক এসেছিল। ওদের সুবিধের মনে হয় নি। খুব অদ্ভুত কথাবার্তা বলছিল। আমি তাই তাড়াতাড়ি ব্যাগ-পত্র নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ওখানে রাতে থাকার মতো সাহস হয় নি। আর এখন বুঝতে পারছি না এতো রাতে কোথায় যাবো!”
“এতো রাতে একা থাকাটাও অনেক বিপদজনক হবে। তোমার কোনো কলিগ বা ফ্রেন্ডের বাসায় যেতে পারো।”
“না ভাইয়া, এমন কেউ নেই যে অন্তত একটা রাত আমাকে রাখবে। মেয়ে ফ্রেন্ডে দু’জন ছিল, ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। ওদের শ্বশুড় বাড়িতে যাওয়াটা সুন্দর দেখাবে না। ওরাও ওতো আগ্রহী না। আর কলিগদের সাথে ওতো ভালো সম্পর্ক এখনো হয় নি যে আমাকে বাসায় থাকতে দেবে। আমি হোটেলে উঠবো ভাবছিলাম। কিন্তু আগে কখনো হোটেলে উঠি নি। বুঝতে পারছি না এখানকার হোটেলগুলোর পরিবেশ কেমন হবে! আর ভালো হোটেলে উঠার মতো টাকা আমার হাতে এই মুহূর্তে নেই।”
“তাহলে তুমি কি এখানে থাকবে?”
“বাড়ি চলে যাবো ভাবছি।”
“বাড়ি কোথায় তোমার?”
“চকরিয়া।”
“অনেক দূর।”
মারিয়া হঠাৎ বলে উঠলো,
“আপু এটাই হয়তো ভাগ্য। তুমিও বিপদে পড়েছ, আর আমাদের সাথেও দেখা হয়ে গেল। ভাগ্য হয়তো বোঝাতে চাইছে, আজ তোমার আমাদের সাথে আমাদের বাসায় যাওয়া উচিত।”
মাফিন চোখ বড় বড় করে মারিয়ার দিকে তাকালো। অদ্রি বলল,
“আন্টি যদি কিছু মনে করেন?”
“মা তো দেশের বাইরে গেছে। আর কেউ কিছু মনে করবে না। তোমার বিপদের কথা শুনলে মা অবশ্যই হ্যাঁ বলবে।”
মাহাথি আর মাফিন দু’জনেই এই ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিল। তবুও একজন পরিচিত মেয়েকে একা রাস্তায় ফেলে যাওয়াটা তাদের উচিত হবে না, তাই তারা অদ্রিকে নিয়ে বাসায় চলে এলো।
বেল দিতেই স্বস্তিকা দরজা খুলে মাফিনের পাশে একটা মেয়েকে দেখে চমকে উঠলো। মনে মনে বলল,
“মাফিন আমার সাথে রাগ করে কি আরেকটা বিয়ে করে এনেছে?”
এদিকে অদ্রি স্বস্তিকাকে দেখে বলল,
“উনাকে তো চিনলাম না।”
মহুয়া বলল, “আমাদের ভাবী।”
অদ্রি মুচকি হেসে বলল,
“ভাইয়া তাহলে বিয়ে করে ফেলেছেন!”
মাফিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“ও আমার বউ। ভাইয়ার না।”
কথাটি শুনে অদ্রি অবাক হয়ে গেলো। আর স্বস্তিকা মনে মনে খুশি হলো। অদ্রি মলিন হেসে বলল,
“এতো তাড়াতাড়ি! তোর তো বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। আর এখন দেখছি মাস্টার্স শেষ হতে না হতেই বিয়ে।”
স্বস্তিকা এবার রাগী কন্ঠে বলল,
“কেন? মাস্টার্সের আগে কি বিয়ে করা যায় না?”
মাফিন এমনিতেই স্বস্তিকার উপর রেগে ছিলো, তার উপর ওর এমন প্রশ্ন শুনে মাফিনের মেজাজটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। মাফিন জোর গলায় বলল,
“আমি তো বিয়ে করতে চাই নি। মা জোর করে আমার গলায় আপদ ঝুলিয়ে দিয়েছে!”
মাফিনের কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। মারিয়া মহুয়াকে চাপা কন্ঠে বলল,
“এদের দেখে কি মনে পড়ছে তোর!”
“রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি উপন্যাসটার কথা মনে পড়ছে।”
“আর আমার মনে পড়ছে অমিতাভ বাচ্চনের সিলসিলা মুভিটার কথা!”
এরপর মারিয়া আর মহুয়া অদ্রিকে নিজেদের রুমে নিয়ে গেলো। এদিকে মাফিন রুমে এসে ওয়াশরুমে যাচ্ছিল তখন স্বস্তিকা মাফিনের হাত ধরে বলল,
“আমি আপদ? একটা বাইরের মেয়ের সামনে আপনি আমাকে আপদ বললেন?”
মাফিন বুকে হাত গুঁজে বলল,
“তাহলে তুমি কি খুব নিরাপদ মেয়ে?”
“মানে!”
মাফিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুমি আপদ, তাই তোমাকে আপদ বলেছি। তোমার জন্য আজ আমার বোনরা কষ্ট পেয়েছে। আমি চাইলে এক্ষুনি তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিতে পারতাম, তোমাকে সেই চড়টা দিতে পারতাম, যেটা আমি ভুল বুঝে মারিয়াকে দিয়েছিলাম। কিন্তু না, তখন তো আবার তুমি আমাকেই ফাঁসিয়ে দেবে। তার চেয়ে ভালো তুমি তোমার মতো থাকো, আর আমি আমার মতো থাকবো।”
স্বস্তিকা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমাকে মারুন। কিন্তু এভাবে অবহেলা করবেন না।”
মাফিন এক ঝটকায় স্বস্তিকার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“এসব নাটক আমার সামনে চলবে না।”
মাফিন কাপড় পালটে বালিশ নিয়ে রুম থেকে বের হতে যাবে তখনই স্বস্তিকা বলল,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“আমার বাসা, আমি যেখানে ইচ্ছে সেখানেই যাবো।”
“আপনি কিন্তু জানেন বাসায় একটা বাইরের মেয়ে এসেছে।”
“তো!”
“আমি আপনাকে যেতে দেবো না। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না।”
“ফাইন। তোমার বিশ্বাস করতেও হবে না।”
“না, আপনি যাবেন না।”
“স্বস্তিকা, আমার হাত ছাড়ো। মেজাজ খারাপ করবে না বলে দিলাম।”
“মেয়েটা আপনাকে বাইরে দেখলে কি মনে করবে! প্লিজ, এভাবে বাইরের মানুষের সামনে আমাদের সম্পর্কটা ছোট করবেন না।”
“সেটা তোমার আগে ভাবা উচিত ছিল, যখন তুমি আমার বোনদের ছোট করছিলে।”
“আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি বুঝতে পারি নি। আমার ভুল হয়ে গেছে। আর এমন হবে না।”
মাফিন এবার চেঁচিয়ে বলল,
“চুপ অসভ্য মেয়ে। বললাম তো আমাকে আমার মতো থাকতে দিতে। সমস্যা কি তোমার! আরেকবার এমন ন্যাকামো করলে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেবো। সম্মানের কথাও চিন্তা করবো না।”
স্বস্তিকা মাফিনের ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেলো। মাফিন রুম থেকে বের হতেই অদ্রিকে দেখলো। অদ্রি মাথা নিচু করে চলে যাবে তখনই মাফিন বলল,
“এখানে কোনো ড্রামা চলছে না যে দাঁড়িয়ে আছিস।”
অদ্রি মাফিনের পিছু পিছু বসার ঘরে এসে বলল,
“তোর এতো মেজাজ কেন রে! বউয়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
“তুই আমাকে জ্ঞান দিতে আসিস না। যা ঘুমা এখন।”
অদ্রি মাফিনের মুখোমুখি বসে বলল,
“মেয়েটাকে ভালোবাসিস না?”
মাফিন ভ্রূ কুঁচকে কিছু বলতে যাবে, হঠাৎ খেয়াল করলো বসার ঘরের পর্দাটা নড়ছে। সে বুঝলো স্বস্তিকা আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছে। মাফিন তাই তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তোকে ভুলতে পারলেই তো অন্য কাউকে ভালোবাসবো। তুই তো আমার মন থেকে বেরই হতে পারিস নি।”
অদ্রি অবাক হয়ে মাফিনের দিকে তাকালে, মাফিন ইশারায় বুঝালো স্বস্তিকা দাঁড়িয়ে আছে। অদ্রি হালকা হেসে বলল,
“তুই এখনো সেই আগের মতোই আছিস। কলেজে তুই আমার পেছনে কতো ঘুরেছিস। ইশ! যদি আজ আমি তোকে পাত্তা দিতাম, তাহলে এই মেয়ের জায়গায় আমিই থাকতাম, তাই না!”
মাফিন মনে মনে বললো,
“আচ্ছা, উল্টোটাই বলবি এখন! থাক, সেই সুযোগে নিজেকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে নে।”
মাফিন জোরে জোরে বলল,
“হ্যাঁ, রে। চাইলে এখন আমাকে পাত্তা দিতে পারিস৷ আরেকটা বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই।”
“না না, আমি বিবাহিত পুরুষদের পাত্তা দিতে চাই না। তোর বউ যে আমাকে দেখে সাপের ফোঁসফোঁস করে উঠলো, সতীন হলে তো প্রথম দিনেই মেরে ফেলবে। না রে, আমি নিজেকে অনেক ভালোবাসি।”
মাফিন বুকে হাত গুঁজে বলল,
“যা এখান থেকে। আমি ঘুমাবো।”
অদ্রি বের হওয়ার আগেই স্বস্তিকা নিজের ঘরে চলে এলো। এসেই সে দরজার পাশে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আর মনে মনে বলল,
“আজই এই মেয়েকে আমি ঘর থেকে বের করবো। নয়তো আমার রাতে ঘুমই হবে না।”
স্বস্তিকা সাথে সাথে ফোন হাতে নিয়ে সূচনাকে কল করলো। ওপাশ থেকে সূচনা কল ধরতেই স্বস্তিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“ভাবী, কোথায় আপনি! এভাবে বরকে ফেলে কেউ ঘরের বাইরে থাকে? আপনার অনুপস্থিতিতে এরা বাসায় একটা মেয়ে নিয়ে এসেছে! আর মাফিন তো ড্রয়িংরুমে ঘুমাচ্ছে। ভাইয়ার রুমের পাশে গেস্ট রুমে মেয়েটা উঠেছে। আমি সারারাত কি এদেরই পাহারা দেবো, নাকি ঘুমাবো, বলুন আপনি!”
সূচনা কল কেটে সাথে সাথেই মাহাথিকে কল করলো। কিন্তু মাহাথি শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেছে। তাই আর ফোন ধরতে পারে নি। পরের দিন সকাল সকাল সূচনা বাসায় এসে সব জানার পর স্বস্তিকাকে বলল,
“তুমি আমাকে কথাটা এভাবে পেঁচিয়ে কেন বললে?”
স্বস্তিকা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। মাহাথি রাগী দৃষ্টিতে স্বস্তিকার দিকে তাকিয়ে রইলো। কারণ আজ তাদের সম্পর্কে প্রথম কোনো তৃতীয় মানুষকে নিয়ে ঝগড়া হয়েছে। স্বস্তিকার কথা শুনে সূচনা ভুল বুঝে মাহাথিকে উল্টোপাল্টা মেসেজ পাঠায়। এরপর সকালে বাসায় এসে যখন দেখলো মাহাথি রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ না করেই ঘুমিয়েছে, তখন সূচনার মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো। বিছানা এলোমেলো দেখে সে অন্যকিছু ভেবে ওয়াশরুম থেকে এক বালতি পানি এনে মাহাথির গায়ের উপর ঢেলে দিলো৷ আর আচমকা ঘুম ভাঙতেই মাহাথির মেজাজটাও বিগড়ে গেলো। দু’জনের মধ্যে কয়েক মিনিট ঝগড়া হওয়ার পর যখন তারা বুঝতে পারলো, তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে তখন তারা শান্ত হলো। আর এদিকে অদ্রি ঘরের পরিস্থিতি দেখে প্রচুর লজ্জায় পড়ে গেলো। আর সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মারিয়া আর মহুয়াকে বলল,
“তোদের ভাবীগুলো এক একটা মারাত্মক দেখছি। আমি এখানে আর একটা মিনিট থাকলে এই দুই বউ মিলে আমাকে কবে মেরে ফেলে বলা যায় না।”
মাফিন অদ্রিকে বলল,
“কোথায় যাবি এখন!”
স্বস্তিকা মাফিনের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ওর যেখানে ইচ্ছে যাবে।”
অদ্রি বলল, “বাড়িতে যাবো।”
মাফিন বলল,
“চল, আমি তোকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আসি।”
অদ্রি বলল,
“না, না, না। আমি যেতে পারবো।”
অদ্রি বেরিয়ে পড়লে স্বস্তিকা মাফিনের হাত ধরে বলল,
“আমি আপনার জন্য নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি!”
মাফিন বলল,
“তুমি বরং বাইরে থেকে অর্ডার করে একা একাই খাও।”
এদিকে মাহাথি সূচনাকে বলল,
“তুমি সকাল সকাল কি আমাকে গোসল করিয়ে দিতে এসেছো!”
“মাহা, সরি। রাগ করছো কেন! তুমি বউদের টেনশন বুঝবে না। এসব মেয়েরাই বুঝে। আচ্ছা, যা হওয়ার হয়েছে। তোমার টুকটুকি তো ফিরে এসেছে তোমার কাছে, তুমি খুশি হও নি?”
“কল্যান হয়েছে আমার। এখন যাও, ছাদে গিয়ে তুমি একা একাই বেড-বালিশ শুকোতে দেবে। আজ রাতে যেন এই বেডেই আমি ঘুমোতে পারি। তুমি জানো অন্য বিছানায় আমার ঘুম হয় না।”
সূচনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“বউ আসছে খবর নেই। তোমার আছে শুধু ঘুম। এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে, আবার ঘুম ঘুম করছো! তুমি ঘুমকেই বিয়ে করে ফেলতে!”
“করতে তো চেয়েছিলাম, তুমিই তো জোর করছিলে তোমাকে করার জন্য।”
“মাহা!”
মাহাথি সূচনাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আচ্ছা, আচ্ছা আসল কথাটাই বলি।”
“কি কথা!”
“অনেক মিস করেছি তোমাকে।”
সূচনা মুচকি হেসে বলল, “সত্যি?”
“হুম।”
“আমিও।”
চলবে-