রোদেলা,৪২,৪৩
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব : ৪২
রাত এগারোটা, স্থান বুড়িগঙ্গা ব্রীজের উপরে। এত রাত হওয়ায় লোকসমাগম কমেছে এখানে, এমনিতে অনেক ভীড় থাকে, ঢাকা শহরের মানুষের বিনোদনের জায়গা খুবই কম। তাইতো বুড়িগঙ্গার পঁচা পানির গা গুলানো গন্ধ থাকার পরও কত মানুষ আসে এখানে ঘুরতে।
এত রাত হওয়া সত্ত্বেও জোড়া জোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিছু মেয়েও স্থানে স্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেমন উদ্ভট সাজ সেজে। বিশ্রী অঙ্গভঙ্গিতেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাদের দাঁড়িয়ে থাকার কারন।
রোদেলা দাঁড়িয়ে আছে বুড়িগঙ্গা ব্রীজের উপরে ফুটপাতের রেলিং ধরে। ভাবছে আ*ত্ন*হ*ত্যাটা কিভাবে করলে কম কষ্টে অল্প সময়ের মধ্যে ম*রা* যাবে। পানিতে লা*ফ দেওয়ার কথা ভেবেছে, ও সাঁতার জানে, তাছাড়া এখানে ঝাঁপ দিলে জানাজানি হয়ে যাবে, ম*রার নিশ্চয়তা এক্ষেত্রে ৫০/৫০।
বড় একটা গাড়ি দেখে সামনে দাঁ*ড়ি*য়ে যাবে কি…?
গাড়ি গুলো দেখেই ভয় করছে ওর। ব্যাগের ফোনটা অনবরত বেজেই চলেছে। বাড়ির লোক ফোন করছে নিশ্চয়ই। সেদিকে খেয়াল নেই রোদেলার। ও দ্রুত ভাবতে থাকে কম কষ্টে আর কম সময়ে কিভাবে কাজটা করা যায়…
ফোনটাকে এরোপ্লেন মুড করে রাখে রোদেলা। ভাবতে থাকে জীবণের কথা। ওদের কৃষ্ণচূড়া বাড়িটা এখান থেকে দিনের বেলা দেখা যায়। এখন অন্ধকার হওয়ায় দেখা যাচ্ছে না। ও দাঁড়িয়ে থাকে চোখ বন্ধ করে। একটু ভাবার চেষ্টা করে, হাতড়ে বেড়ায় এমন কোন কারন যাকে অবলম্বন করে এ যাত্রায় বাঁচা যায়। কি চেয়েছে জীবনে, অর্থ, বিত্ত, জশ, প্রতিপত্তি কিছুই চায় নি, চেয়েছে নিজের মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা। জীবণটা এমন ওদের যে বাবা-মা দুজন থাকা সত্ত্বেও ওরা এতিম। কারো ভালোবাসা পায় নি জীবণে, অবজ্ঞা, অবহেলা, লাঞ্ছনা, এই ছিলো ওদের প্রাপ্তির ঝুলিতে ভরতি। আজ যে জীবন ওকে এখানে দাঁড় করিয়েছে তার জন্য একমাত্র এবং একমাত্র দায়ী ওর বাবা মা।
আজ যে এত কঠোর ও হয়েছে জীবণের প্রতি এটার কারন কি….?
সবাই কঠোরতা দেখে কিন্তু ওদের পরিস্থিতি কেও বুঝে না। একটা সময় ভাবতো রোদেলা বড় হয়ে চাকরী করবে, অফিসার হবে, কিন্তু ও এখন বুঝে গেছে সবার আগে একটা মেয়ের ভালো মা হওয়া কতটা জরুরি। ওর মা সব সময় ভাবতো মেয়েরা তো আমার আছেই, কই আবার যাবে আমায় ছেড়ে, ওদের তাই তোষামদ করবার কিছু নেই। তাই সব সময় নিজের মেয়েদের চেয়ে অন্যকে প্রায়োরিটি দিতো। যা একসময় ওদেরকে কোনঠাসা করতে করতে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে…..
আর ভাববে না এসব রোদেলা, ম*র*বা*র আগে জীবণের সুন্দর সুন্দর স্মৃতি গুলো মনে করার চেষ্টা করে ও। এলোমেলো বাতাসে ওর মুখের উপর চুল আছড়ে পরছে। সামনে সুন্দর নদীর রাতের দৃশ্য…
ক্ষণে ক্ষণে আসা জাহাজ কিংবা লঞ্চের আলো পরে পানি চিকচিক করছে।
দ্রুত জোড়া লাগাচ্ছে ও সব আনন্দের টুকরো টুকরো স্মৃতি গুলোকে। দু-একজন মধ্য বয়সী লোক ঘুরঘুর করছে রোদেলার আসেপাশে। চোখে তাদের বিশ্রী ইঙ্গিত হয়তো। সোখানে তাকায় না রোদেলা। তারা এখনো দেখছে ওকে, অন্য দিকে মুখ করা রোদেলা তবুও বুঝতে পারে তারা চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলছে ওকে ।
একটা ছেলের বাজে কথায় হঠাৎ সংবিৎ ফিরে রোদেলার, কেমন যেন অস্বস্তি লাগে ওর। ছেলেটার কথায় ওর কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে যেন। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় ও এক পলকের জন্য। মনে মনে ভাবে এত সুন্দর চেহারা অথচ ভিতরটা ততই কুৎসিত …..।
কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওর, কিন্তু কিছু না বলোই দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে ও। ছেলে দুটো ওর পিছু পিছু হেঁটে চলছে…..
এমন পরিস্থিতিতে একটু যেন ভয় পায় রোদেলা। ব্রিজটা মোটামুটি ফাঁকাই, ছেলে দুটো একটা বাইকে করে স্লো করে রোদেলার পাশ দিয়ে যাচ্ছে। কথাবার্তায় অশ্লীল ইঙ্গিত। পেছনের ছেলেটা বললো নিয়া নেই লগে কইরা মামা, রাইখা খামুনি….!
রোদেলার বুক কেঁপে উঠে, এমন কথায়, দ্রুত পা চালায় ও। দৌড় দিলেও পারবে না, কারন ওরা বাইকে করে পিঁছু নিয়েছে। কোন দিকে না চেয়ে সোজা হাঁটে ও, বাইকের পেছনের ছেলেটা রোদেলার ওড়না ধরে টান দেয়। রোদেলা কেন মতে ওড়নাটা ছাড়ায়, ভয় ঢুকে যায় ওর মনে। দ্রুত সাই-সাই করে বড় বড় গাড়ি চলে যাচ্ছে, তারা হয়তো এসব লক্ষ্যই করছে না।
এদিকে ছেলেদুটির কুৎসিত হাসি আর কথা বার্তায় রোদেলা এত ভয় পাচ্ছে যে ওর পা কাঁপা শুরু করলো। একটু আগে যে ও আ*ত্ন*হ*ত্যা করবার সহজ পথ খুঁজছিলো তা ভুলেই গেলো বেমালুম। মাথা থেকে জাস্ট উড়ে গেলো সব। এই মুহূর্তে এখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে ও ।
পেছন থেকে একটা সিএনজি এসে বাইকের সামনে থামলো। চেয়ে দেখলো সেটা খালি। ড্রাইভার যাত্রী সিটের গেটটা খুলে দিলো। কোন কিছু না ভেবে সিএনজি তে উঠে পরে ও। নিজেই আটকায় সেই গেইটটা। বাইকে করে ছেলে দুটো তখনো পিছু পিছু আসছে। রোদেলা বলে, মামা একটু জোরে চালান।
বাইকটা সিএনজির পাশাপাশি চলছে। দুজনেই খুব গালাগালি দিতে থাকে ড্রাইভারকে। ভয় দেখায় শাসায় গাড়ি থামাতে। না থামালে কি পরিস্থিতি করবে ওর তাও বলতে থাকে ওরা। এ পর্যন্ত ড্রাইভার কোন কথাই বলে নি।
এমন সময় হাসনাবাদের মোচড়ে একটা বড় গাড়ি ইউটার্নে ঘুরবে, সিএনজির ড্রাইভার হয়তো বুঝতে পেরেছে ঐ ছেলে দুটোর খারাপ মতলবের কথা তাই তিনি অনেক বড় একটা রিস্ক নিয়ে সিএনজিটা ঐ বড় কাভার্ড ভ্যানের মোড় ঘুরানোর আগেই পার হওয়ার জন্য স্পিড বাড়ালেন। ড্রাইভার হয়তে নিজেও জানতো না কি করতে যাচ্ছেন তিনি। পুরো দৃশ্যটা পুরোই সিনেমাটিক। এ দৃশ্যের বর্ননা ভাষায় দেয়া সম্ভব না।
সিএনজির এমন আ*ত্ম*ঘা*তী স্পিড দেখে এত বড় গাড়িটা হার্ড ব্রেক করলো। ভাগ্যিস সময় মতো হার্ড ব্রেক করেছিলেন। তা না হলে এত বড় কাভার্ড ভ্যানের তলায় সিএনজি পিষ্টে যেতো। সিচুয়েশনটা এমন যেন কেও হাতে করে ঐটুকু পার করে দিলো ওদের । কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে লাগলো সিএনজির ড্রাইভারকে। তিনি ওভারটেক করে এমন পরিস্থিতিতে গাড়ি মুভ করায়। রোদেলা সিএনজি থেকে মুখ বের করে দেখলো পেছনে। মোটরসাইকল আটকে পরেছে কাভার্ড ভ্যানের পেছনে। সেটা টার্ন না নেয়া পর্যন্ত ওরা সেখান থেকে আসতে পারবে না।
সিএনজির ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো আপা কোথায় যাবেন। রোদেলা দ্রুত ভাবলো কোথায় যাবে ও…?
আতংকের ঘোর তখনো কাটেনি ওর। ড্রাইভারের প্রশ্নে ওর যেন হুঁশ ফিরে এলো। এই বিশাল দুনিয়াটাকে ভীষণ ছোট্ট মনে হলো ওর।
যাবার যে একমাত্র জায়গা তা থেকে ওকে বের করে দেয়া হয়েছে এই তো ঘন্টাখানেক আগে। কোন আত্নীয়ের বাড়ি যাবে না ও। আর বাইরের দুনিয়াটা কত জটিল তার রূপ তো কিছুক্ষণ আগেই দেখা হয়ে গেলো। ঘড়িতে তাকায় রোদেলা রাত পৌনে বারোটা। ড্রাইভার আবার তাগাদা দেয় কোথায় যাবে তা জানতে। কি ভেবে যেন রোদেলা বলে- ইকুরিয়া চলেন। ইকুরিয়ার রোড ছেড়ে এসেছে ওরা অনেক আগেই। ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে ভিতরের রাস্তা দিয়ে সিএনজি টা চললো। মিনিট সাতাশ পর রোদেলার বলে দেয়া রাস্তা ধরে সিএনজিটা পৌঁছে গেলো এক বিশাল পাঁচিল ঘেরা বাড়ির সামনে। ঘড়িতে তখন বারোটা পনেরো।
ড্রাইভারকে ভাড়া দিয়ে বললো-
অনেক ধন্যবাদ ভাই, আপনি না থাকলে…..
ড্রাইভার হেসে বলল-
আপা এত রাইতে একলা বাইর হওয়া ঠিক না, দিন কাল ভালো না, রাইতের দুনিয়াডা রাইতের মতোই অন্ধকার। রাইতের গাড়ি চালাই তো। এহন এসব ডাইল-ভাত আমাগে কাছে। একটু সাবধানে চলবেন…
বলে কোন প্রতিত্তোর না শুনেই গাড়িটা টান দিলেন তিনি। রোদেলা মনে মনে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তার প্রতি। নিজ হাতে খোদা ওকে সাহায্য করেছেন। তা না হলে…..
বাড়ির মেইন গেইটে নক করে রোদেলা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পরেছেন তারা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার নক করে। দারোয়ান তার ঘর থেকে আসছে তা বোঝা যাচ্ছে তার ঘরের গেইট খোলার শব্দে। ওপাশ থেকে গেইট না খুলেই জিজ্ঞেস করে কে….?
আমি রোদেলা….
কন্ঠটা পরিচিত দারওয়ানের কাছে, তাই দ্রুত গেইট খুলে বললেন..
আফা এত রাইতে….!
হ্যা সামাদ ভাই, সবাই কি ঘুমিয়ে পরেছেন…
না…
বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিলো আজ, মেহমান আসছিলো। চলেন আপনি, তারা মনে হয় ঘুমায় নাই এখনো…
রোদেলা বলে আপনার আসা লাগবে না কষ্ট করে, আমিই যাচ্ছি… তবুও পিছুপিছু গেলেন তিন। ভৃত্য বলে কথা…
কলিং বেলে চাপ দিল রোদেলা। একটু অপেক্ষা করে আবার চাপ দিতেই গেইট খুললেন এক মহিলা….
শাড়ি আর গহনায় মোড়া সম্ভান্ত্র এক গৃহিণী। যার পোশাক আর অলংকারে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট।
তিনি বিগলিত হাসি মুখে বললেন-
আরে…
রোদেলা যে, এত রাতে…
চলবে…
রোদেলা
লেখা: মাহাবুবা মিতু
পর্ব- ৪৩
রোদেলা চলে গেছে আজ চতুর্থ দিন। এমন কোন জায়গা নেই যেখানে ওর খোঁজ করা হয় নি। নোভেল আর সুফিয়ান সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছে। থানায় জিডিও করা হয়েছে।
বাড়িতে সবাই মোটামুটি শঙ্কিত। তরুণী মেয়ে ঘরের বাইরে আর বর্তমান সময়টা কত খারাপ। চারদিকে নানান খবর আসছে প্রতিদিন। সেদিন খবরে দেখালো – ষাটোর্ধ এক মহিলাকে গন ধ*র্ষ*ণ করেছে কয়েকজন যুবক মিলে।
সমাজের পরিস্থিতি কোন জায়গায় দাড়িয়েছে তা এমন খবরই জানান দেয়। যে সমাজে মা-নানীর বয়সী কেও শঙ্কা মুক্ত না সেখানে রোদেলা তো…..
তাছাড়া যে পরিস্থিতিতে ওকে বের করে দেয়া হয়েছে তাতে আ*ত্ন*হ*ত্যার ব্যাপারটা ও ইঙ্গিতে মাথায় রাখতে বলেছেন বড় মামী। তাই ওরা হসপিটাল গুলোতেও যাচ্ছে কোন খবর পেলেই।
নাসিমা ঐ রাতের পর পুরোই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। কারো সাথে কথা বলে না। খাওয়াদাওয়া ও করে না ঠিকঠাক। ঘরের দরজা আটকে কাঁদে শুধু। নোভেলকে নতুন নতুন জায়গায় খোঁজ নিতে ঠিকানা দেন।
তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন রাগের মাথায় কত বড় ভুল করেছেন তিনি, কিংবা আদৌ বুঝেন নি। তবে তার আচরণ পুকুরের জলের মতো শান্ত হয়ে গেছে। আচার আচরনে কোন উত্তাপ নেই, কথায় কোন ঝংকার নেই, নেই ভুল ধরার বালাই, কাজ কর্ম যদিও সবই করছেন স্বাভাবিক ভাবে কিন্তু তিনি কেমন যেন বদলে গেছেন। তবে সেটা কেমন বদল তা বোঝা মুসকিল। কারন তিনি তো সবসময়ই নিজেকে রহস্যে মুড়ে রাখেন। তাকে ভেদ করা ভীষণ কঠিন।
নানী সেই রাত থেকে কাঁদছেন তো কাঁদছেনই। নাসিমাকে বকছেন, কেন সে এমন করলো মেয়েটার সাথে। বড় মামীরও মন খারাপ। রোদেলাকে মেয়ের মতো দেখতেন তিনি। সেদিন রাতে তার কান্নার আত্ন চিৎকারে আশেপাশের সবাই ভেবেছে যে তার স্বামীর হয়তো কিছু একটা হয়ে গেছে। এখনো তিনি কাঁদেন, রান্নার সময়, খাওয়ার সময়, ওর কাপড়, জুতা ধরে কান্না করেন তিনি সময়ে অসময়ে। ঠিক যেমনটা করার কথা ছিলো ওর জন্মদাত্রী মায়ের।
নোভেল দিনরাত শুধু দৌড়াচ্ছে এদিক থেকে সেদিক। একদিন পর সব খুলে বলে সাহায্য নিয়েছে সুফিয়ানের। যেখান থেকেই খবর আসুক না কেন দৌড়ে গেছে সেখানে। রাত নেই দিন নেই খুঁজেছে রোদেলাকে। হসপিটালের মর্গ থেকে শুরু করে স্টুডেন্টের বাসা, কলেজের বন্ধুবান্ধব
সবখানেই খোঁজ করেছে ওরা।
এই বাড়ির একমাত্র নিশ্চিন্ত মুখ প্রিসিলা। ওর যেন কোন চিন্তাই নেই বোনের জন্য। ও খাচ্ছে, সময় করে কোচিং এ যাচ্ছে, রাতের বেলা নিয়ম করে নাটক দেখছে, কোন কারনে সেটা মিস করলে দুপুরে সেটা দেখে নিচ্ছে, বিকেলে কল্লোলের উপহার দেয়া ক্যামেরায় নানান ছবি তুলে তা পর্যবেক্ষণ করছে। নতুন নতুন ট্রিকস শিখছে ছবি তোলার।
রোদেলার ব্যাপারে ওর যেন কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ওর আচরণে মনে হচ্ছে রোদেলা বলে কেও এখানে কোন দিন ছিলোই না। কত রহস্যময়ী চরিত্র প্রিসিলা….
নাতাশাদের বাড়ির মানুষ জেনেছে তিনদিন পর। এসব তো আর ডেকে জানানোর কথা না। তারা আর কি করতে পারে দুঃখ প্রকাশ ছাড়া। তবে শোভন যখন জানলো এসবের পিছনে ও নিজেই কারন তখন থেকেই অনুতাপের আগুনে জ্বলেছে। কি করছে, কোথায় আছে এ-ই ভেবেছে দিনরাত। খোঁজ নিচ্ছে নোভেলের কাছ থেকে।
নোভেল আর সুফিয়ান প্রতিদিন একবার করে যায় থানায়। তারা যথেষ্ট চেষ্টা করছে ওকে খুঁজতে, কিন্তু ফোনের সর্বশেষ লোকেশন ওদের বাড়ির আচেপাশে হওয়ায় তারা বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না।
বড়মামার অবস্থা ও ভালো না এদিকে। বেশ কয়েকদিন হলো ঔষধ বন্ধ। চিকিৎসা তো আরো আগে বন্ধ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তারা সিদ্ধান্ত নেয় নিচের ঘরগুলো ভাড়া দেওয়ার। যা পাওয়া যায় তাতে ইউটিলিটির বিল গুলো তো অন্ততঃ দেয়া যাবে।
রোদেলার চলে যাওয়ায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে নোভেলের জীবণে। ও যেন বড় একটা ধাক্কা খায় রোদেলা চলে যাবার পর। নিয়মিত কাজ করতে থাকে সুফিয়ানের এক প্রোজেক্টে। সেখানে বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন সাইটে সাপ্লাইকৃত সকল ধরনের মালামালের হিসেব রাখে ও । প্রতিদিন বিকেলে ওকে ৫০০ করে টাকা দেয়া হয়। সুফিয়ান ইচ্ছে করেই ওকে প্রাপ্যর চেয়ে কম দেয় সুফিয়ান। কারন টাকার মর্মটা ওর শেখা জরুরী। নোভেল সে টাকার পুরোটাই তুলে দেয় বড় মামীকে। আপাততঃ সংসার খরচ চলছে সেখান থেকেই। তাছাড়া নাসিমার দুই বোন ও রীতিমতো সহায্য করছে ওদের সংসারে।
এ পরিবারের এমন বিপদের দিনে সুফিয়ান যেন আরো কাছে এসেছে তাদের, ঠিক পরিবারের বড় ছেলের মতো। প্রথম প্রথম কয়দিন বাজার সদাই করে দিয়ে গেছে, বড় মামী তখন বলেছিলেন – বাবা তুমি কতদিন এমন দিবে, তারচে বরং ঐ টাকাটা যদি তোলার ব্যাবস্থা করে দিতে…….
ও বলেছে-
চিন্তা করবেন না, এ সপ্তাহের মধ্যে একটা খবর জানাবে আমাকে। এদিকে সুফিয়ানের ও চেষ্টা তদবির চলছে পূর্বাচলের জমির টাকাটা তুলে দিতে। এ সময় তাদের এ টাকাটা ভীষণ জরুরি।
নাতাশাও এসেছে অসুস্থ শরীর নিয়েই, বেচারীর এমন হাল পানিটা পর্যন্ত খেয়ে রাখতে পারছে না, বমি করে ফেলে দিচ্ছে। না খেতে পেরে অনেক শুকিয়ে গেছে। বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে শোভন। ও নিজেও ছিলো বেশ কিছুক্ষণ। কারো সাথে কথা বলে নি। বসবার ঘরে সোফায় চুপ করে বসে ছিলো এক কোনে স্থির দৃষ্টিতে। তারপর কোন রকম নাশতা না খেয়েই চলে গেছে কাওকে কিছু না বলেই। বোঝাই যাচ্ছে ব্যাপারটা ওর জন্য ও কতটা কষ্টের । এদিকে নাতাশা বাড়ি এসেই কেঁদে বুক ভাসিয়েছে বোনের এমন চলে যাওয়ার কথা শুনে।
নাতাশাকে শান্ত করতে বলে বড় মামী জানায় বিকেলে এক হুজুরের বাড়ি যাবে, তিনি নাকি নিখোঁজ ব্যাক্তির সন্ধান দিতে পারে। নাতাশা কিছুদিন থাকবে ঠিক করে এসেছে তাই ওর মা ওর ব্যাগপত্র ওর ঘরে রেখেছে। নাতাশা তা নিয়ে গিয়ে উঠেছে রোদেলার ঘরে। ওর খুব কষ্ট হয় কেন ওর কষ্টটার ভাগিদার হতে পারলো না তা ভেবে। দুজনই যে কতো ভালোবাসে দুজনকে, তাহলে আজ কেন এমন হলো, কেন ও বাড়ি থেকে বের হয়ে ওকে ফোন দিলো না। সেই আক্ষেপেই ও শেষ হয়ে যাচ্ছে।
পরদিন কল্লোলও কিছু টাকা পাঠায় নাতাশার একাউন্টে, বাবার চিকিৎসা শুরু করতে বলে….
কিন্তু চাইলেও ওর পরিবারের এমন দৈন্য দশার কথা খুলে বলতে পারে না ও ওর শ্বশুর বাড়ির লোকদেরকে। এমনকি কল্লোলকেও। কারন সবকিছু এত হঠাৎ হয়ে গেলো যে নাতাশাই সবকিছু ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। আসলে মানুষের জীবণ যে কত আনপ্রেডিক্টেবল তার বাস্তব উদাহরণ ওর বাবা। একটা অসুখ সব শেষ করে দিলো, সব………..
রোদেলার খোঁজ নিতে কল্লোল ওর এক পুলিশ বন্ধু যে কি না পুলিশের এস.আই তার নম্বর দিয়ে বলে নোভেলকে দিতে। সে নাকি ওকে খুঁজতে সাহায্য করতে পারবে তা জানায়। নাতাশা নোভেলকে ফোন নম্বর দেয়, নোভেল বলে আপা- এখনকার থানার ওসি খুবই ভালো লোক, তিনি খুবই আন্তরিক ভাবে দেখছেন ব্যাপারটা। আপাততঃ কোন সাহায্যের দরকার নেই। দোয়া করতে বল…
গতকাল নাতাশার মা সেই হুজুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন ও ভালো আছে, এবং ভালো লোকের কাছেই আছে। যার কাছে আছে তাতে কোন চিন্তা নাই ওকে নিয়ে, এবং ও ফিরে আসবে……
কিন্তু আজ বিকেলে হঠাৎ নাসিমার ফোনে ফোন এসেছে। ওপাশ থেকে একটা লোক বলছে- মগবাজারে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, একেবারে স্পট ডে*থ, ডে*ড ব*ডির ব্যাগ থেকে পাওয়া কলেজের আইডি কার্ড থেকে নম্বর নিয়ে ফোন করলাম। নাসিমা যেন কিছুই বুঝতে পারছে না, কি বলছে ওপাশ থেকে….
রান্নাঘরের মেঝেতে কেমন যেন মাথা ঝিম ধরে পরে গেলো সে। রান্নাঘর থেকে হুড়মুড় করে কিছু পরার শব্দে বড় মামী দৌড়ে এসে দেখেন নাসিমা মেঝেতে পরে আছে, চিৎকার করে ডাকেন তিনি নোভেলকে। তখনও ফোনটা বাজতেই থাকে। ফোনটা রিসিভ করে প্রিসিলা…..
ওপাশ থেকে একই কথা পুনরাবৃত্তি হয় আবারো, প্রিসিলা কেঁদে নোভেলকে ফোনটা দিয়ে বলে দেখ তো কি বলছে… নোভেল লোকটার কথা শুনে মাটিতে বসে পরে…..
ওকে বসে পরতে দেখে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে প্রিসিলা…
বড় মামী জিজ্ঞেস করে কিরে- কি বললো….
নোভেল কাঁদতে কাঁদতে বলে বড় আম্মা আপার এক্সিডেন্ট হইছে, স্পট ডে*থ…….
সেই মুহূর্তে রওনা দেয় নোভেল মগবাজারে, সুফিয়ানকে জানায় ফোন করে সব সুফিয়ান যেন বিশ্বাস ই করে না এসব… দৌড়ে গিয়ে গাড়ি বের করে। নিজে ড্রাইভ করার সাহস হচ্ছে না ও তাই ওর এক এসিস্ট্যান্ট কে বলে গাড়ি চালা। যদিও ও সবসময় ই নিজে ড্রাইভ করতে পছন্দ করে।
বিপদের পথ যেন ফুরায়ই না….
প্রতিটা সিগনালে জ্যাম। এত বিশ্রী লাগছে ওর যেন জ্যাম জিনিসটার সাথে ওর এ যাবৎ কালে পরিচয়ই ছিলো না। নোভেল পথিমধ্যে বাস থেকে নেমে যোগ দেয় সুফিয়ানের সাথে। দু’জনেই চুপ…
কোন কথা বলবার জন্য খুঁজেই পাচ্ছে না হয়তো….
অবশেষে সেখানে পৌঁছে দেখে একটা মেয়ের লাশ, বুক থেকে উপরের অংশ এমন বাজে ভাবে থে*ত*লে গেছে যে….. প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় একটা বাস মেয়েটাকে ধাক্কা দেয়, সেখানকার লোকজন হৈ হৈ করে তেড়ে আসায় ভয়ে ড্রাইভার আর গাড়ি থামায় নি, সেই বডির উপর দিয়েই গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যায়। যার কারনে ডে*থ ব*ডিটার এমন করুন অবস্থা। জ্যাম থাকার কারনে গাড়িটা নিয়ে কেটে পরতে পারে নি। তাই গাড়িটাকে একটু সামনে এগিয়ে থামিয়ে ড্রাইভার পালিয়েছে।
লা*শ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়েছে। নাসিমা, বড় মামী, নাতাশা বসে আছে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে। লা*শ সনাক্তের জন্য পুলিশ গায়ের জামাকাপড়, জুতা, ব্যাগ আর ফোন দিয়েছেন পরিবারের সামনে। ব্যাগ দেখে বড় মামী কান্নায় মাটিতে গড়াগড়ি খায়, ফোনটাও রোদেলার, তবে ভিতরে সিমটা নতুন। পার্স, আইডি কার্ডে সবই রোদেলার….
সেখানে যেন হঠাৎই এক শোকের ছায়া নেমে আসে, ওদের আর্তনাদে ভারী হয়ে যায় ওখানকার বাতাস…
নাসিমা ব্যাগটা বুকে জড়িয়ে ধরে কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে, কথা বলে না অনেকক্ষণ, লা*শ বের করার সময় নাসিমার ধ্যান যেন ভঙ্গ হয়, চিৎকার করে বলে-
মারে…………..
স্থব্ধতার থমথমে আকাশ ভেঙে প্রথম বারের মতো পরে শোকের বৃষ্টি। যে বৃষ্টি ক্রমেই রূপ নেয় ঝড়ের, ভেতরকার ঝড় যেন উপরে বের করে দিতে চাইছেন তিনি। তার মেয়ে, তার প্রথম সন্তান, যে দুর্দিনে সংসারোর হাল ধরেছিলো, যার সবচেয়ে বেশী অবদান তার সংসারে এবং যার প্রতি সবচেয়ে বেশী অবহেলা অন্যায় তিনি করে এসেছেন দিনের পর দিন। আজ যে মেয়েটাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে তার…
কিন্তু রোদেলার শরীরটার যে নাম বদলে গিয়ে লা*শ হয়েছে, তাকে ধরে আদর করার মতো কোন উপায় নেই, একটা শরীর পরে আছে স্ট্রেচারের উপরে, বুক নেই, মাথা নেই শুধু কাটা অংশে র*ক্ত আর দুটি অক্ষত পা। সেই পা দুটি ধরেই আজ অঝোরে কাঁদছেন তিনি। তার ভাগ্যে মেয়েটাকে আদর করাও জুটলো না….
কি নিয়তি…
কি নির্মম নিয়তি………….
চলবে….