এক_শহর_প্রেম💓 লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_১১

0
716

#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১১
মারসাদ শিস বাজাতে বাজাতে পকেটে হাত গুঁজে চলেও গেছে কিন্তু রেখে গেছে হতভম্ব আদিরাকে। আদিরা চোখ বড়ো বড়ো করে সম্মুখপানে চেয়ে আছে। কয়েকমিনিটের মধ্যে ক্লাসে স্টুডেন্ট আসতে শুরু করেছে। মাহি ও রিন্তি এসে আদিরাকে অন্যমনষ্ক দেখে ওর দুই পাশে দুইজন বসে। রিন্তি আদিরাকে বলে,

–দোস্ত পড়া কতোটুকু শেষ করলি? কম্পিলিট তোর? প্রিপারেশন কেমন?

আদিরার থেকে কোনো জবাব পেলো না বিপরীতে। রিন্তি মাহির দিকে তাকিয়ে আদিরাকে দেখিয়ে ইশারা করে। মাহিও কিছু জানে না এই ব্যাপারে। এবার আদিরার হাতে ঠেলা দিলে আদিরার হুঁশ ফিরে। রিন্তি জিজ্ঞেস করে,

–কী-রে? কোথায় হারিয়েছিস? তোর সাথে কথা বলছি আর তোর কোনো ভাবান্তর নেই!

আদিরা অপ্রস্তুত হয়। অপ্রতিভ কন্ঠে বলল,

–কিছু না। এমনিতেই। তুই পড়তে থাক। আমার একটু মাহির থেকে কিছু জানার ছিল।

আদিরা আর কোনো বাক্যব্যয় না করে মাহির হাত ধরে বাহিরে নিয়ে এলো। মাহি আদিরার চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। আদিরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঢোক গিলে বলল,

–দেখ মাহি, কিছু মনে করো না। তোমার দাভাই কেমন উদ্ভট ভাবে কথা বলে। আমাকে কী বলে আমি বুঝে উঠতে পারি না। আর অপ্রাসঙ্গিক অনেক কিছু বলে যা কখনোই সম্ভব না।

মাহি অবাক হয়। মাহি জানে তার দাভাই কারো সাথে অহেতুক অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলে না। তার দাভাই কেমন তা তার জানা। মাহি সন্দিহান কন্ঠে বলে,

–কী বলে দাভাই?

আদিরা আবারও অপ্রস্তুত হয়। মারসাদ যাওয়ার পর মারসাদের বলা কথা গুলো পুনরায় পর্যালোচনা করে তার এটাই বোধগম্য হয়েছে যে, মারসাদ কোনো ভাবে তাকে পছন্দ করা শুরু করেছে। তাছাড়া বিগত একমাসের বেশি সময় ধরে করা প্রতিটা কাজ ও ঘটনাও আদিরাকে ভাবতে বাধ্য করছে।
এইতো চার দিন আগে মারসাদ সপ্তাহে অন্য দুই দিনের মতো সেদিনও রাতের বেলা আদিরাকে টিউশনের জন্য নিয়ে যেতে এসেছিএ। আদিরার নাম্বারে কল করে আসতে বলার পর আদিরা জানিয়েছিল যে সে দুই দিন রাতে আর দুই দিন দিনের বেলা পড়ায়। মারসাদ এটা শুনে প্রচণ্ড রেগে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। কেনো তাকে না জানিয়ে এটা করা হলো? দিনের বেলা টিউশনির সময় নেওয়ার কী দরকার ছিলো? এসবই উচ্চস্বরে বলেছিল যা শুনতে রুড লাগছিল। আদিরাকে নিজের দিকটা ব্যাখ্যা করার সুযোগটাই দেয় নি সেদিন। রে*গে-মেগে মারসাদ চলে গিয়েছিল।

মাহি আদিরাকে আবারও অন্যমনষ্ক দেখে আদিরার দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল,

–তোর কী হয়েছে বলতো? অনেকক্ষণ যাবত বেখায়ালি লক্ষ্য করছি। আর দাভাই কী করেছে সেটাও বল।

আদিরা মলিন হেসে বলে,
–পরীক্ষার পর বলি। স্যার চলে আসতেছে।

মাহিও রাজী হয়। ওরা ক্লাসে গিয়ে পরীক্ষা শুরু হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে। পরীক্ষার পর আদিরা ও মাহি, সাবিহা ও রিন্তিকে বলে একটু আলাদা কথা বলতে যায়। গোলাপি সাদা ফুল বোঝাই কড়ই গাছটার নিচে মাহি ও আদিরা দাঁড়িয়ে আছে। আদিরা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,

–আমি গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে। কতোটা যু*দ্ধ করে গ্রাম থেকে এই অচেনা শহরে এসেছি আমিই জানি। মা ঋণ করে আমার ভর্তির টাকাটা দিয়েছে। শহরে থাকার মতে জরুরী জিনিসপত্র ক্রয় করার পর হাতে টাকা ছিলো না। বাবা তো চায়ই নি আমি আর পড়ালেখা করি। গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছেও বাবার ঋণ আছে। বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছিল কিন্তু মা ও শিক্ষকদের সহায়তায় আজ আমি এখানে। মায়ের স্বপ্ন আমি পূরণ করবোই। কিন্তু এখানে এসে একের পর এক ঝামেলাতে জড়িয়ে যাচ্ছি। কারও কারও চোখের বি*ষে পরিণত হয়েছি। সেই সংখ্যাটা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে যদি তোমার ভাই নিজেকে না থামায়।

মাহি বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে বলল,
–দাভাই কী করেছে?

আদিরা হতাশ স্বরে বলে,
–তোমার দাভাই নাকি আমাতে নিজের মন হারিয়েছে! এটা কতোটা যুক্তিবহ তুমিই বলো? সে তার প্রেমিকাকে ধোঁকা দিচ্ছে! আর তার প্রেমিকা ভাবছে আমি তোমার দাভাইকে বশ করে নিয়েছি। কিন্তু আমি এসবের কিছুই করি নি। আর আমি এসবের ইচ্ছে নিয়েও আসি নি।

মাহি জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,
–দাভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড কে? আমার দাভাই তো কোনো রিলেশনে জড়ায়ই নি!

আদিরা থমকালো তারপর বলল,
–সামিরা আপু! সে তো তোমার দাভাইয়ের প্রেমিকা। তুমি জানো না?

মাহি বিদ্রূপাত্মক এক্সপ্রেশন দিয়ে বলে,
–কই জানতাম না তো! তা তুই জানলি কী করে? দাভাই বলেছে বুঝি!

আদিরা কনফিউজড হয়ে বলল,
–সবাই তো তাই জানে। সামিরা আপু ও তোমার দাভাইয়ের প্রেমের সম্পর্ক আছে।

মাহি হুট করে হাসতে শুরু করে। পেটে হাত দিয়ে হাসি থামানোর চেষ্টা করেও ব্যার্থ সে। কড়ুই গাছটার গোড়ার কাছে বসে হাসি থামানোর চেষ্টায় আছে সে। আদিরা বোকার মতো তাকিয়ে আছে মাহির দিকে। হাসির কারণটাই তার বোধগম্য হচ্ছে না। ভাই-বোন দুইটাকেই কেমন অদ্ভুত লাগে আদিরার কাছে। আদিরা মাহির কাছে গিয়ে কনফিউজড হয়ে বলে,

–হাসছো কেনো?

মাহি হাসতে হাসতেই থেমে থেমে বলে,
–তো হাসবো না! একটা কথা আছে জানো? চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে তা পরীক্ষা না করেই চিলের পেছোনে দৌঁড়ানোটা একটা অভ্যাস হয়ে গেছে মানুষের। মানুষ বিচার বিবেচনা না করেই উঁড়ু কথায় এতোটা গুরুত্ব দেয় যে নিজেদের টাইম ও এনার্জি অযথাই নষ্ট করে। আরে ভাই, নিজের কানে হাত দিয়ে তো দেখবে! তোমার কান আছে নাকি গেছে! কার না কার কান গেছে আর সেটার বার্তা বাতাসের সাথে ছড়িয়ে পরেছে আর তুমিও সেটাই সত্য মানতে শুরু করে দিয়েছো!

আদিরার মুখ লটকে তাকিয়ে আছে। মাহি উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
–আরে সামিরা আপু দাভাইয়ের উপর ক্রাশড। দাভাই ওকে পছন্দ করে না। সামিরা আপু এতো বাড়াবাড়ি করে কারণ সামিরা আপু আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হয়। দাভাইয়ের স্কুল লাইফ থেকেই সামিরা আপু যেনো দাভাইয়ের পেছোনে আঠার মতো লেগে আছে কিন্তু দাভাই সামিরা আপুকে ততোটা পাত্তা দিতো না। সামিরা আপুর বিহেভিয়ারে সম্মান শব্দটা নেই দাভাইয়ের ভাষায়। এখন একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে সামিরা আপু নিজেকে দাভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড বলে পরিচয় দিচ্ছে। দাভাই কিন্তু এক বছর আগে সামিরা আপুর প্রচণ্ড রকম বাড়াবাড়িতে ভরা অডিটোরিয়ামের মধ্যে সামিরা আপুকে চ ড় দিয়েছিল।

চ ড়ের কথা শুনে আদিরার চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। মাহি হাসতে হাসতে বলল,
–আমি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম না তবে আহনাফ বলেছিল, সামিরা আপু নাকি ভার্সিটির সবার কাছে রটাচ্ছিল সে ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আর তারা কয়েকবার ডেটিং করেছে। ভাইয়া প্রচুর রেগে গেছিলো এতো বড়ো মিথ্যা শুনে। টিচাররা পর্যন্ত ভাইয়াকে ডেকে বলেছিল যে পার্সোনাল কথা মানে ডেটিং এসব সবার সামনে ঢোল পি*টিয়ে না বলতে। ভাইয়া টিচারদের কাছে প্রিয় তাই তারা ডেকে বলেছিল। তারপরেই দাভাইয়ের একশন। সেসব পুরোনো কথা। সামিরা আপু সেসব নিয়ে কনসার্ন না তাই সে একই কাজ বারবার করে। সামিরা আপু আব্বুর কাছে দাভাইয়ের নামে নালিশও জানিয়েছিল কিন্তু আব্বু তা পাত্তা দেয় নি। ভাইয়া তো আব্বুর নাগালের বাহিরে!

আদিরা শেষের কথাটা ধরে বলে,
–নাগালের বাহিরে কেনো? তাদের মাঝে কী ঝামেলা হয়েছে?

মাহি হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে,
–আপিলির মৃ*ত্যুর পরোক্ষ কারণ বাবাকে ভাবে দাভাই। কিন্তু বাবা খোঁজ খবর নিয়েই বিয়ে দিয়েছিল তবে আমার মায়ের তাড়াহুড়োতে খুব কম সময়ের মধ্যে বিয়ে দিয়েছিল। কথায় আছে না? হারানো কিছু খুঁজে পাওয়া গেলেও যা স্বেচ্ছায় হারায় তা পাওয়া যায় না! যদি আপিলির শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিজেরা কিছু না লুকাতো তবে বাবা সেখানে আপিলিকে কখনওই বিয়ে দিতো না। এতে বাবার দোষ না তবে বাবার খামখেয়ালিপনা পরোক্ষভাবে দৃশ্যমান হয় ভাইয়ার নজরে।

আদিরা মলিন হেসে বলল,
–তার ভাগ্যে এমনটাই লিখা ছিল। নাহলে তো এরকম হতোই না।

মাহি তাচ্ছিল্য হেসে ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
–আমার মা যদি আপিলির বিয়ে নিয়ে এতো তোড়জোড় না করতো তাহলে হয়তো এমনটা হতো না। আপিলির মাস্টার্সের শখ ছিল অনেক। মেধাবী স্টুডেন্ট ছিল তো। বাবা তো আপিলির জন্য কানাডাতে মাস্টার্সের এপ্লাইও করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু মায়ের অতিরিক্ত তাড়াহুড়োতে সেসব আর হয় নি।

আদিরা মাহির হাত ধরে স্বান্তনা দিয়ে বলে,
–মা তো। মায়েদের চিন্তা থাকে মেয়ের বিয়ে নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাই হয়তো তিনি বিয়ের কথা বলেছেন।

মাহি আদিরার সরল কথা শুনে মুখে হাত দিয়ে হাসতে থাকে। আদিরা মাহির মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মাহি তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,

–হ্যাঁ। খুব চিন্তা হতো তার। আপিলির মাস্টার্সের খরচ, তারপর বিয়ের সময় খরচ এসবের কারণে তো আমার জন্য ভাণ্ডার কম পরে যেতো আর তার লাক্সারিয়াস লাইফের জন্য কম পরে যেতো। আসলে আমাকে তিনি যতোটা ভালোবাসেন, আপিলি বা দাভাইকে তার বিন্দু পরিমানও ভালোবাসেন না। কী করবে বলো? নিজের সন্তান না তো তারা!

আদিরা এতোবড়ো সত্যটা জেনে হতভম্ব হয়ে যায়।

চলবে ইন শা আল্লাহ্,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here