এক_শহর_প্রেম💓 লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_২৪

0
970

#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৪
হৃদয়কারা হাসিতে বিমোহিত হয়ে মারসাদ একটা ঘোরে পরে গেছে। পড়ন্ত বিকেলে ঈষৎ রক্তিম আভা মুগ্ধকরা হাসি আরও দৃশ্যায়িত করেছে। পাখিরা নিজ নিজ নীড়ে কলরব করে ফিরছে। সময়টা উপভোগ্য। আর হৃদয়ের রানীর হাসির ঝংকার এক আলাদা সুর তোলে। আদিরা মারসাদের দিকে এক পলক দৃষ্টি বিনিময় করে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। কিছুটা এগিয়ে পেছোন মুড়ে জোড়ালো কন্ঠে বলে,

–ফুলগুলো সুন্দর। এক অন্যরকম শুভ্রতার সৌন্দর্য। চিরকুটের কথাগুলো হৃদয় ছোঁয়ানো। ধন্যবাদ আপনাকে। এত সুন্দর উপহার গুলোর জন্য!

কথাগুলো বলে আদিরা সামনের দিকে অগ্রসর হয় আর পেছোনে চায় না। পেছোনে তাকালে সে মারসাদের মুখশ্রীতে অবাক মিশ্রিত সূক্ষ্ম হাসির রেখা দেখতে পেতো। মারসাদ নিজে নিজেই বলে,

–বুঝে গেছে সে। শুরু তবে এক শহর প্রেমের অন্যরকম উপাখ্যান!

মা*থা চুলকে হেসে স্থান প্রস্থান করে হোস্টেলের উদ্দেশ্যে চলে যায়।
………………

মাহি ও আহনাফ একটা ওপেন ক্যাফেতে বসে আছে। ওপেন বলার কারণ ক্যাফেটা কোনো বদ্ধ ঘরের ভিতরে না। খোলামেলা জায়গায় খোলা আকাশের নিচে শুধু প্রতিটা টেবিলে বেতের তৈরি ছাউনি দেয়া। আশেপাশে বিভিন্ন রকম ফুল ও ক্যাকটাস গাছের সমাহার। মাহি কোল্ডকফি স্ট্র দিয়ে খাচ্ছে আর আহনাফ ব্ল্যাক কফি। মাহি মা*থা তুলে কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেসা করে,

–দাভাই ভিপি হবার জন্য রাজী হলো কী করে? সে তো এক প্রকার পণ করে বসেছিল যে ভিপি হবেই না।

আহনাফ বাঁকা হেসে কফির মগে এক চুমুক দিয়ে বলে,
–একটু ভয়, একটু সংকা। তোমার কথা ভেবে ভিপি পদ থেকে সরে গিয়েছিল তারপর তার জীবনে এক রমণীর আবির্ভাব ঘটে আর সে তখন আরও চিন্তিত হয়ে পরে। তোমাদের দুইজনের জন্য সে আবার নিজের পদে দাঁড়িয়েছে। নিজের অতীতকে পেছোনে ফেলে। এতে সাগরেরও ভূমিকা আছে। সাগরের কাজের কারণে মারসাদ নিজের সিদ্ধান্ত বদলে নিয়েছে। আর কয়েকদিন পর আশিক ভাই পদ ছেড়ে দিবে আর মারসাদ অফিশিয়ালি ভিপির দায়িত্ব নিবে।

মাহি দাঁত বের করে হেসে আবার স্ট্র মুখে নেয়। আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
–এই তুমি ব্রাশ করো না? এতো হলুদ কেনো দাঁত?

মাহি আচমকা এমন কথায় চমকে উঠার কারণে কফি নাকে মুখে উঠে হিচকি উঠে যায়। আহনাফ দ্রুত ওয়েটারকে ডেকে পানির বোতল আনিয়ে নেয়। মাহি পানি পান করে স্বাভাবিক হয়ে আহনাফের দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর রেগে বলে,

–অ*সভ্য পুরুষ! আমাকে না খোঁচালে আপনার হয় না? আমার দাঁত হলুদ আপনাকে কে বলল? প্রতিদিন দুইবার ব্রাশ করি আমি। চকলেটের কারণে এমন দেখাচ্ছে আর আপনি…!

আহনাফ বাঁকা হেসে বলে,
–আমি যা দেখেছি তাই তো বলেছি।

মাহি রাগে মুখ ঘুরিয়ে কফি খাচ্ছে। আহনাফ মাহির রাগ দেখে নিঃশব্দে হাসলো। নিজের ফোনটা মাহির দিকে টেবিলে এগিয়ে দিলো। মাহি আঁড়চোখে একবার আহনাফকে দেখে ফোনের দিকে দেখল। ফোনের স্ক্রিনে নিজের আঁকা ছবি বড়ো করে ফ্রেমে বাঁধাই করা দেখে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো ওটা আহনাফের বাড়িতে ওর বেডরুমে বেডের পেছোনের দেয়ালে লাগানো। মাহি অবাক হয়ে সুধালো,

–আপনি এইজন্য আমাকে দিয়ে আঁকিয়েছেন? ওয়াও।

আহনাফ হাসিমুখে বলল,
–ইয়েস মেম।

মাহি মুখ ভাড় করে বলল,
–আমি আপনাকে কতো সুন্দর একটা ছবি এঁকে দিলাম কিন্তু আপনি তো আমায় বিনিময়ে কিছু দিলেন না!

আহনাফ মাহির অভিযোগ শুনে ওর দিকে সামান্য ঝুঁকে গেল। তারপর সম্মোহিত কন্ঠে বলল,

–কী চাই বলো? আমি পুরোটাই তোমার সামনে উপস্থিত!

মাহি আহনাফের কপালে আঙুল ঠেকিয়ে আহনাফের মাথা নিজের কাছে থেকে সরিয়ে বলে,
–সময় মতো চেয়ে নিবো। আপনার সাহয্য দরকার পরবে। তখন ফেরালে আর কোনোদিন কিচ্ছু চাইবো না।

আহনাফ মাহির কথার মানে না বুঝে তীক্ষ্ম নজরে চেয়ে আছে। মাহি তা দেখে হেসে বলে,
–বাদ দিন। এবার বলেন, সেলিব্রেশন কবে আপনাদের? দাভাইয়ের সে কী জানে? নাকি আমি জানাবো?

আহনাফ বলে,
–জানাতে পারো। কবে যে ওদের মাঝে সব সেটেল হবে! তোমার ভাইকে বলি সরাসরি বলতে কিন্তু সে সরাসরি বলবে না। খাবার সামনাসামনি না খেয়ে মাথার পেছোন দিয়ে ঘুরিয়ে এনে খাবে! পোলার ধৈর্য মাশাআল্লাহ্!

আহনাফ কথাগুলো বলছিল আর অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে দেখাচ্ছিল। মাহি হাসতে হাসতে মুখের কফি ছিটকে ফেলে দিয়েছে যা কিছুটা আহনাফের শার্টে লেগেছে। আহনাফ শার্টের দিকে চেয়ে মুখ কুঁচকে ফেলল। মাহি টিসু নিয়ে জলদি করে আহনাফের কাছে গিয়ে শার্ট মুছে দিচ্ছে আর মিটমিট হাসছে। আহনাফ ভাবেনি মাহি এরকম করবে। আহনাফ হা করে তাকিয়ে আছে। মাহি আহনাফের কাছ থেকে সরে আসার সময় আলতো স্বরে বলল,

–আপনারা দুই বন্ধু একই প্রজাতির!

মাহি নিজের জায়গার বসে কোল্ডকফিতে শেষবারের মতো চুমুক দিয়ে বলে,

–আজকে আর না। আমার বুঝা হয়ে গেছে যে আজকে আমি কফিটা শান্তিতে আর খেতে পারব না। এখানে আরও থাকলে আরও অনেক কিছু হবে। এর চেয়ে ভালো আজ উঠি। সন্ধ্যা নেমে আসছে।

আহনাফও উঠে দাঁড়ায়। মাহিকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আহনাফ মসজিদের দিকে চলে যায় তারপর টিউশনে যাবে।
………….

সন্ধ্যার পর মারসাদ ও আদিরা একই রিকশায় যাচ্ছে। রিকশার প্যাডেলের শব্দ ব্যাতিত মাঝেমধ্যে গাড়ির হর্ণ কিন্তু ওদের দুজনের মাঝে বিস্তর নিরবতা। মারসাদ নিরবতা ভেঙে বলে,

–তো তোমার সিদ্ধান্ত কী?

আদিরা সাইডের দিকে এরেকটু চেপে বসলো অতঃপর কী বলবে ভেবে পেলো না। মারসাদ জবাব না পেয়ে বলে,

–জবাব হয়তো আমার জানা তবে তোমার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষা। সাহস সঞ্চারেই যুগ কাটিয়ে দিও না যেন!

আদিরা মুচকি হেসে এবার মুখ খুলল।
–আপনি তো আমার বাবা-মায়ের মত নিয়েই রেখেছেন! তাহলে এই ঘটা করে বলা না বলাতে কী এসে যায়?

মারসাদ চমকে তাকালো কিন্তু আলোক স্বল্পতার কারণে আদিরার মুখাবয়ব দৃশ্যমান হলো না। আদিরা নিজ থেকেই বলে,

–জানতে চান তাই না? যে আমি কী করে জানলাম? মাকে ফোন করেছিলাম। তখন মা আপনার কথা জিজ্ঞেস করল। এর আগে যে দুইদিন কথা বলেছি প্রতিবার আপনার কথা জিজ্ঞেস করেছে। তাই আজ আমিই তাকে জিজ্ঞেস করলাম কারণ। তখন বলতে না চাইলেও বলেছে যে আপনি নাকি এই একা শহরে আমার খেয়াল রাখতে পারবেন। আর কিছু বলেনি। যেখানে আমার মা আপনাকে এক দেখায় এতো ভরসা করে সেখানে আমি আপনাকে তার থেকে কিছুটা হলেও জানি।

মারসাদের অধরে খেলে যায় পরিতৃপ্তির হাসি। না বলেও ভালোবাসা যায়।

________

কাজী অফিসের ভেতর থেকে নিলয় ও রাত্রি বের হলো। রাত্রির চোখে-মুখে লাজুকতা। তারা আজ বিয়ে করেছে। বিয়ের খবরটা আপাততো গোপন রাখবে। রাত্রির কান্না ও জোরাজুরিতে বিয়েটা হলো। নিলয় অনেক ভেবে-চিন্তে রাত্রির সাথে সম্পর্ক শেষ করতে চেয়েছিল। নিলয় রাত্রিকে বলেছিল, ওদের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ক্ষয়-ক্ষতির কারণ হতে পারে তাছাড়া ওরা দুজন একেঅপরের শত্রু পক্ষের। তাই সমাপ্তি সময় থাকতে করা উত্তম।
কিন্তু চাইলেই কী এতো সহজে এক লহমায় ভালোবাসা ভুলা যায়? রাত্রির সাথে নিলয় টানা এক সপ্তাহ কোনো যোগাযোগ করে নি। এদিকে রাত্রি কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে হোস্টেলে পরে ছিল। সুমি ও মৌমিরা রাত্রির অবস্থা দেখে খুবই বিচলিত হয়ে পরেছিল। মারসাদদের জানালে আফসোস ছাড়া কীইবা করবে! তারপরেও ওরা সবাই রাত্রির মন ভালো করতে ঘুরতেও গিয়েছিল কয়েক জায়গায়। নিলয় এক মেয়ের মাধ্যমে রাত্রির খবর জানতে পেরে রাত্রিকে ফোন করে। রাত্রি ফোন হাতে নিয়ে সুমি ও মৌমির সামনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। কান্নার জন্য সে কথাও বলতে পারছিল না। সুমিরা বুঝিয়েছিল মুভ অন করতে কিন্তু এতোদিনের ভালোবাসা ভুলতে পারছে না রাত্রি। রাত্রি স্বভাবত নরম মনের। এরপর দুই-তিনদিন পর রাত্রির কান্না ও জোরাজুরিতে হার মেনে নিলয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা বিয়ে করবে কিন্তু দুই পক্ষের কারও বন্ধুদের জানাবে না। আর আজ ওদের বিয়ে হলো।

নিলয় রাত্রির বামহাত নিজের ডানহাতে মুঠোবন্ধি করে রাত্রির লাজুক হাসি দেখে চলেছে। কতোটা মুগ্ধতা এই হাসিতে। কিন্তু সে নিজের কর্মের কারণে এই হাসি স্লান হওয়ার কারণও হতে পারে। নিলয়ের নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। কেনো সে ভালোবাসা নিয়ে খেলতে গেল! আর খেলতেই যখন গেল তখন এতো গভীরভাবে মায়ায় কেনো পড়ল!

“পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না।”

নিলয় চাইলেও পারছে না সব ছেড়ে চলে আসতে। সাগর অনবরত তাকে হু*মকি দিচ্ছে। কেনো রাত্রির সাথে ফিজিক্যাল হয়ে ভিডিও বানিয়ে তা এডিট করে মারসাদের নাম খারাপ করছে না? কেনো এত সময় নিচ্ছে?
এতসব প্রশ্নের নিলয়ের কাছে কোনো জবাব নেই। কীইবা জবাব দিবে? অভিনয়ের বেড়াজাল থেকে কখন সে অভিনয়ের বাহিরে চলে গেছে নিজেও সে বিষয়ে সন্দিহান। নিলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিলয় ভাবে, সাগরকে বলতে হবে যে রাত্রি ওসব খারাপ কাজের জন্য একদম রাজি হয়নি বলে সে রাত্রির সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। আরও ভাবে, সে এখন থেকে বাড়ি থেকে এসে ক্লাস করবে এবং সাগরকে বলবে, তার বাড়িতে এই সময় থাকাটা জরুরী।

রাত্রি অনেকক্ষণ যাবত নিলয়কে অন্যমনস্ক দেখে হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলে,
–এই কী হয়েছে তোমার?

নিলয় রাত্রির দিকে চেয়ে কৃতিম হেসে মা*থা নাড়ায়। তারপর বলে,
–রাতপাখি শোনো, তোমার সাথে আমি ক্যাম্পাসের ভিতর খুব একটা দেখা করব না। আমি এখন থেকে আমার বাসায় থাকব। তুমি তো সব বুঝো। আমি তুমি এখন বিবাহিত। আমাদের সম্পর্ক সবার সামনে আসলে আরও বিপদ। তোমাকে এটুকু তো বুঝতে হবে।

রাত্রি মন খারাপ করে বসে আছে। এতো লুকোচুরি তার ভালো লাগে না। নিলয় রাত্রির হাতে চুমু দেয় আর রাত্রি আবারও লাজুকলতার ন্যায় নুইয়ে পরে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here