এক_শহর_প্রেম💓 লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_৩৯

0
665

#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৯
মারসাদের বুক কেঁপে উঠল। একে তো মাহি কাঁদছে তারউপর বাবা বলে থেমে আছে। মারসাদ ভীত কন্ঠে সুধালো,

–কী হয়েছে বাবার?

মাহি ঢোক গিলে বলে,
–বাবার… বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে মনে হচ্ছে। আমি..আমি একটু আগে স্টাডিরুমে গিয়ে দেখি..

মারসাদ যা বুঝার বুঝে গেছে। গ্রীষ্মের গরমেও তার হাত-পা কেমন জমে যাচ্ছে। শরীর বেয়ে শীতল স্বেদধারা নেমে গেল। মারসাদ কোনোমতে হসপিটালের ঠিকানা নিয়ে দ্রুতবেগে বেড়িয়ে গেল। আহনাফ, মৃদুলরা ব্যাপারটা না বুঝে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কী এমন হলো যার জন্য এই ক্ষিপ্রতা! আহনাফরা হুট করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মারসাদের পেছোনে ছুটে হোস্টেলের দারোয়ানকে জিজ্ঞেসা করলে দারোয়ান মারসাদ কোন দিকে গিয়েছে জানিয়ে দেয়। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে তা জানার জন্য আহনাফ আদিরাকে ফোন করল। আদিরা এতো রাতে আহনাফের ফোন দেখে অবাক হলো খানিকটা। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোন রিসিভ করলে আহনাফ দ্রুত বলে,

–একটু আগে তুমি মারসাদকে ফোন করেছিলে? এই পাঁচ মিনিট আগে?

আদিরা বিচলিত স্বরে বলল,
–নাতো। কেনো কী হয়েছে ভাইয়া?

আহনাফ কথা কা*টানোর জন্য হাসার চেষ্টা করে বলল,
–আরে না। কিছু না। এমনিই। রাখি। আল্লাহ হাফেজ।

ফোন রেখে দিলে আদিরা ভাবনায় পরে গেল। হুট করে কী এমন হলো যে আহনাফ ভাইয়া তাকে ফোন করে জানতে চাইল? উনার কন্ঠও কেমন অগোছালো শোনাচ্ছিল।
আহনাফ এবার মাহিকে ফোন করলে রিং কয়েকবার বাজার পর শেষ সময়ে মাহি ফোন রিসিভ করলে আহনাফ মাহির কান্না জড়িত “হ্যালো” শুনে বিচলিত হলো প্রচণ্ড। আহনাফ উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,

–কী হয়েছে তোমার? কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো? মারসাদকেও দেখলাম দৌঁড়ে চলে গেল। কী হয়েছে বলো?

মাহি ফুঁপিয়ে উঠল। আহনাফ ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
–কী হয়েছে বলবে তো? কান্না থামাও? কী হয়েছে? দাদীর কিছু হয়েছে? আঙ্কেলের কিছু নয়তো?

মাহি নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। কান্নামাখা কন্ঠে বলল,
–বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আমি হসপিটালে আছি। দাদীও কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল তাই তাকে ঘুমের ইন*জে*কশন দেয়া হয়েছে।

আহনাফ বেশি কথা না বাড়িয়ে হসপিটালের ঠিকানা নিয়ে মৃদুলদের নিয়ে বেরিয়ে পরল।

_________

মারসাদ হসপিটালের রিসেপশনে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করে,
–আমার বাবা কোথায়? মানে মিস্টার আরসাদ খান কোথায়?

রিসিপশনিষ্ট তাকে আইসিউর দিক দেখিয়ে দিলে মারসাদ ছুটে যায়। আইসিউর বাহিরে কান্নারত মাহিকে দেখে। মাহি মারসাদকে দেখে দৌঁড়ে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে,

–দাভাই! দাভাই! বাবাও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? বল না?

মাহি প্রশ্ন করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মিসেস মনিকা মলিন দৃষ্টিতে বেঞ্চে বসে মাহি ও মারসাদকে দেখছে। মিস্টার আরসাদ বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা নিয়েও গাড়িতে যতক্ষণ জ্ঞান ছিল তখন বলেছিল,

“আমার জীবনটাকে বিষাদময় করতে তুমি অন্যতম মনিকা। তোমার স্বার্থপরতা আমায় নরকতূল্য যন্ত্রনা দিয়েছে।”

মিসেস মনিকা তারপর থেকে একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে। তার ২২ বছরে করা সবকিছু তার চোখে ভাসছে। মানুষটা তাকে সুস্থ অবস্থায় সারাদিন বাজে বললেও সে গায়ে মাখে না কিন্তু গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বলা কথা গুলো তার ভাবান্তর করাচ্ছে। সে কী সত্যি স্বার্থপর হয়ে গেছে? নিজেকে নিজের কাছে খুব হীন লাগছে। এই লোকটাকে ভালোবাসেন তিনি। নয়তো বিয়ে করতেন কেনো! কিন্তু নিজের মধ্যে স্বার্থপরতার বিজ কবে গাছে পরিনত হয়েছে তা সে বুঝতেই পারেনি তখন। তার নিজের মেয়েও তাকে এই দুঃখের দিনে আশ্রয় ভাবে না। মিসেস মনিকা পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। তার দৃষ্টিতে কোনো ভাষা নেই।

ডাক্তার বের হলে মাহি ও মারসাদ তার কাছে যায়। ডাক্তার হতাশ স্বরে বলেন,
–দেখুন, মিস্টার আরসাদের হার্টে দুইটা ধমনিতে অনেকটা ব্লক ছিল। সে মেডিকেশন নিচ্ছিল। এখন ব্লক আরও বেড়ে গেছে। আমরা এনজিওপ্লাস্টি করব। কিছুটা রিস্ক আছে। আশকরি আল্লাহর রহমতে ঠিক হয়ে যাবে।

রাত বারোটার মতো বাজে। মারসাদ পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে আদিরা ও আহনাফদের অনেকগুলো মিসডকল। সাইলেন্ট থাকার দরুন শুনতে পায়নি। ফোন কিভাবে সাইলেন্ট হলো সে নিজেও জানে না। আহনাফরাও এসে পৌঁছাল। ওরা এখন মাহি ও মারসাদের পাশে আছে। আদিরার অনবরত ফোন করা দেখে মারসাদ তাকে ফোন করে সবটা জানাল। আদিরা চাইছিল এখুনি আসতে কিন্তু মারসাদ মানা করল। রাতের বেলা আসার দরকার নেই। কাল সকালে মারসাদ আনতে যাবে।
মারসাদের বাবার খবর শুনে মারসাদের ফুপিরাও চলে এসেছে। মারসাদের দাদীকে তো ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে।

সকাল বেলা আদিরা রাস্তায় জনমানবের সমাগম শুরু হতেই নিজেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে। ঠিকঠাক চিনে না বিধায় রিকশায় উঠে ঠিকানা বলে দিয়েছে। পথিমধ্যে ঘটে এক দুর্ঘটনা। এক মাইক্রো রিকশাটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে গেছে। আদিরা রিকশার ভেতরে থাকায় হুকে লেগে হাতে অনেকটা কে*টে গেছে আর মাথার বাম পাশে কিছুটা ব্যাথা ও পায়েও ছিলে গেছে কাত হয়ে পরাতে। রিকশাওয়ালা পায়ে ব্যাথা পেয়েছে। আশেপাশের লোকজন জড়ো হয়ে আগে আদিরাকে উঠায় তারপর রিকশাটাকে সোজা করে। সামনে কিছুটা দূরে হসপিটালে এক মহিলা আদিরাকে নিয়ে যায়। আদিরা রিকশাওয়ালাকে তার নায্য ভাড়ার সাথে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে আসে। রিকশাওয়ালাকে বলেছিল সাথে আসতে কিন্তু তিনি আসলেন না।

হসপিটালে পৌঁছানোর পর আদিরাকে যিনি নিয়ে এসেছেন তিনি নার্স ডেকে আদিরার ড্রেসিং করিয়ে দিতে বলেন। মারসাদ তখন করিডরে হাঁটছিল হঠাৎ আদিরার মতো কাউকে দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখে ওটা আদিরাই। আদিরার সামনে যেতেই তার রাগ উঠে গেল। এতোটা কেয়ারলেস কেনো এই মেয়ে! একটা কথাও শোনেনা। মারসাদ পেছোন থেকে রূঢ় শব্দে বলে,

–তোমাকে মানা করেছিলাম না? একা আসতে গেলে কেনো? আর অ্যাকসিডেন্ট কিভাবে করেছ? একটুও কেয়ার নেই নিজের প্রতি!

আদিরা ভড়কে গেল। এক সপ্তাহ আগেও একটা অ্যাকসিডেন্ট হতে হতে বেঁচেছে সে। মারসাদ সেদিন দূর থেকে দেখে দৌঁড়ে এসেছিল আর আজ তো হয়েই গেল। আদিরা আমতা আমতা করে বলে,

–না মানে। মানে আমার কোনো দোষ ছিল না সত্যি। আমিতো রিকশায় ছিলাম। মাইক্রোটা ধা*ক্কা দিয়ে চলে গেল। আমি তো আর জানতাম না এটা হবে।

রাগে মারসাদের নাক লাল হয়ে গেছে। আদিরা ব্যান্ডেজ করা হাত উঠিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই মারসাদ বলে,

–একটু পর আমি গিয়ে তোমায় নিয়ে আসতাম তো। তাই না? কাল বলেছিলাম তো? কিন্তু না! তুমি তো নাছোড়বান্দা! আমার কথা কী তুমি শুনবে! নিজের মনে হয়েছে চলে এসেছ সাথে হাত-পায়ের বেহাল দশা করে বসেছ।

আদিরা মিনমিন করে বলে,
–সরি। আমি বুঝিনি। আর হবে না। সরি।

মারসাদ পাশের চেয়ারটাতে বসে হাত দিয়ে নিজের মুখমণ্ডল ঢেকে রেখেছে। আদিরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভীরু কন্ঠে সুধায়,

–বাবা কেমন আছেন? ডাক্তার কী বলেছে?

মারসাদ প্রতিউত্তর করল না। গতকাল রাতে এনজিওপ্লাস্টির পর ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল। মাহি মারসাদকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে আদিরার এঅবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে তাড়াহুড়ো করে এসে বলে,

–কিভাবে হলো এসব? তুই অ্যাকসিডেন্ট করলি কী করে?

আদিরা শান্ত স্বরে সবটা বলে মাহিকে। মাহিও মারসাদের মতো আদিরাকে ব*কাঝ*কা করে। মাহি এবার ওদের বাবার ঘুম ভাঙার কথা বলে। মিস্টার আরসাদ প্রথমেই মারসাদের নাম বলেছে। মারসাদ এটা শুনে দৌঁড়ে চলে যায়। বাবার কেবিনের সামনে গিয়ে হাত দিয়ে ভালো করে চোখ মুছে ভিতরে ঢোকে। কেবিনে নাকে নল, হাতে ক্যানুলা লাগানো সাদা বেডে শোয়া অবস্থায় নিজের জন্মদাতাকে দেখে মন কেঁদে উঠছে বারবার। দুইটা বছর এই মানুষটা খবরও নেয়নি সে। মনে মনে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে বারংবার। অভিমানের পাল্লাটা ভারীই ছিল। মারসাদকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মারসাদের বাবা ছেলেকে আস্তে ডাক দিলেন,

–মারসাদ!

মারসাদ লম্বা শ্বাস নিয়ে বাবার বেডের কাছে টুলে বসে। মিস্টার আরসাদ ছেলের হাত ধরার জন্য হাত উঠাচ্ছিলেন তৎক্ষণাৎ মারসাদ তার হাত ধরে ফেলল। তিনি আস্তে আস্তে বললেন,

–আর কতো শাস্তি দিবি বাবা? এবারও কী মাফ করা যায় না? আমিও হয়তো কিছুদিন পর তোর মা ও আপিলির কাছে চলে যাব।

মারসাদের বুক ধক করে উঠল। সে তৎক্ষণাৎ বলল,
–না। একদম না। তুমি কোথাও যাবা না। আমার সাথে থাকবে। আমাকে ক্ষমা করে দেও। তোমাকে এতোদিন অনেক কস্ট দিয়েছি বাবা। সরি ফর এভরিথিং।

মিস্টার আরসাদের নেত্র কোন বেয়ে নোনাজল গড়ালো। মারসাদ তার বাবাকে আলতে জড়িয়ে ধরল। দরজার বাহির থেকে আদিরা, মাহি, আহনাফ, মৃদুলরা ও মারসাদের ফুফি এই দৃশ্য দেখে নিজেদের চোখ মুছল। বাবা-ছেলের মনমালিন্য দূর হলো অবশেষে।

________

সামিরা নিজের ঘরের ভিতর উচ্চস্বরে পাগলের মতো হাসছে। অস্বাভাবিক সেই হাসি। ফোনের অপরপাশে থাকা সাগরও সামিরার হাসিতে খানিকটা ভড়কে গেল। সামিরা হুট করে হাসি থামিয়ে ভয়ংকর স্বরে হিসহিসিয়ে বলে,

–আজকেরটাও জাস্ট ট্রেইলার ছিল। পরেরবার আমি নিজে ওকে গাড়ি চাপা দিবো। আমার চোখের সামনে ওর মৃ*ত্যু দেখতে চাই আমি। হা হা হা!

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ইদ মোবারক। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here