হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম #নুুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_৩৭

0
437

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৭
নতুন ভোর সাথে রোদের লুকোচুরি। জানালার পর্দা সরে যাওয়া স্থান দিয়ে সূর্যিমামা তার কিরণ প্রবেশ করাচ্ছে। প্রিয়া চাদর পেঁচিয়ে ঘুমোচ্ছে। ওর চোখে-মুখে রোদ এসে পরছে বলে চোখ-মুখ কুঁচকে নিচ্ছে। জারিফের ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ। সে এখন প্রিয়ার মুখশ্রী থেকে রোদকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। বালিশের পাশ থেকে হাতরে ফোন নিয়ে সময় দেখে। সকাল ছয়টা বাজে। প্রিয়া হালকা স্বরে ডাকলো উঠার জন্য। প্রিয়া নড়েচড়ে আবার ওপাশ হয়ে শুয়ে পরলে জারিফ হেসে প্রিয়াকে সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু করলে প্রিয়া আচমকা উঠে বসে। গায়ের চাদর সরে যাচ্ছিল তা টেনে জড়িয়ে লজ্জা মুখ লুকিয়ে বসে রয়। জারিফ প্রিয়ার কান্ড দেখে নিঃশব্দে হাসে।

“উঠো। ফ্রেশ হয়ে নাও তারপর নাস্তা করে আমরা হিমছড়ি ঘুরে মহেশখালী যাব তো।”

প্রিয়া লাজুক কন্ঠে বলে,
“আরেকটু পর। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন তারপর আমি যাব।”

“উঁহু। উঠো।”

আচমকা জারিফ প্রিয়াকে কোলে তুলে নিলে প্রিয়া হালকা স্বরে চিৎকার করে উঠে। জারিফ বাঁকা হেসে বলে,

“এখন আমরা দুজনে একসাথে ফ্রেশ হবো!”

প্রিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে হড়বড়িয়ে বলে,
“এই না! নামান আমাকে। আমিই আগে চট করে ফ্রেশ হয়ে আসছি। একটুও লেট করব না প্রমিস।”

“এখন তো শুনব না। সময় বাঁচাতে এই পদক্ষেপ তো নিতেই হবে।”

অতঃপর উনারা এক ঘণ্টা লাগিয়ে ফ্রেশ হলেন!

________

পিহু ঢাকা যাবার জন্য প্রচুর উৎসাহী। গতকাল রাতেই যা লাগবে গোঁছানো শেষ। পিহুর মায়ের মন কাঁদছে। একটা মাত্র মেয়ে তার। বিয়ের পাঁচ বছর পর আল্লাহ্ তাদের সন্তান আশা পূরণ করেছিলেন। বহু ডাক্তার দেখিয়েছিলেন তার জন্য। আশেপাশের মানুষজন অনেক কথা বলতেন কিন্তু তার মানসিক শান্তি ও সাপোর্টে ছিলেন তার স্বামী, বাবার বাড়ির মানুষজন ও শ্বশুর-শাশুড়ি। ছোটো জালও মাঝেমধ্যে বাহিরের মানুষের প্ররোচনায় পরোক্ষভাবে খোঁটা দিতেন। সব তিনি সহ্য করেছেন তার কাছের মানুষদের ভালোবাসায়। আজ সে স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখী। স্বামীর চাকরিসূত্রে খাগড়াছড়ি এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে। শ্বশুর-শাশুড়ি গত হয়েছেন বছর পেরিয়েছে। তারা দুই ছেলের বাড়িতে ঘুরেফিরে থাকতেন।

পিহুর মা প্রান্তি বেগম ব্যালকনিতে স্বামীকে বসে থাকতে দেখে পাশে গিয়ে বসলেন।
“মেয়েকে যে অনুমতি দিলেন এখন কি থাকতে পারবেন?”

পিহুর বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
“পারতে হবে প্রান্তি। বোর্ডে ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করেছি। যদি আবেদন গ্রাহ্য হয় তবে আমরাও যাব। ”

“কিন্তু মেয়ে যে একটা ছেলের জন্য ঢাকা যাচ্ছে, যদি সেই ছেলেটার মনে পিহুর জন্য কিছু না থাকে? মেয়ে আমার ভেঙে পরবে।”

“অতোকিছু জানিনা। এক-দুই মাস সে কেমন মনম*রা হয়ে থাকত। আমাদের মেয়ে নিজে সবকিছু আমাদের সাথে শেয়ার করেছে। যদি ছেলে ভালো না হয় তবে ওকে আমি বুঝাব। আমার কথা সে শুনবে আমি জানি।”

আজকে সকালের বাসে পিহুকে নিয়ে ওর বাবা ঢাকা যাবেন। পিহুর খালার বাড়িতে পৌঁছে দিবে। পিহুর একটা খালাতো বোন ও ভাই আছে। খালাতো বোন এবার এইচএসসি দিলো আর ভাইটা স্কুলে পড়ে।

_______
হিমছড়ির পাহাড়ের উপর উঠে ছবি তুলছে প্রিয়া। তার ক্যামেরাম্যান জারিফ। রৌদ্রস্নাত সকাল। ঝলমল করছে চারিপাশ। পাহাড়ের উপর থেকে সবকিছু সবুজ সবুজ লাগছে আর সমুদ্রটাকে আরও সুন্দর লাগছে। নিচের ঝর্ণাটার পানি কমে গেলেও পাহাড়ের উপর থেকে সুন্দর লাগছে। সকাল নয়টার কিছু সময় বেশি বাজে। জলদি ফিরে যেতে হবে। প্রিয়া আর জারিফ সেখানে বসে কচি ডাব খেলো তারপর আচার খেতে খেতে প্রিয়া পাহাড় থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,

“এখান থেকে পরে গেলে কী হবে?”

জারিফ কপাল কুঁচকে বলে,
“পরে গিয়ে দেখো কী হয়!”

“না থাক! আমার তো নিচে তাকাতেই ভয় করছে। হিমালয় পর্বত তো এর থেকেও অনেক উুঁচু। সেখানে উঠার সময় নিচে তাকালে তাহলে কেমন লাগবে! আ*ত্মা বেরিয়ে যাবে আমার।”

জারিফ রম্যস্বরে বলে,
“নেক্সট হা*নি*মুন তবে নেপালে যাই চলো। হিমালয় পর্বতমালার কাছে গিয়ে এড*ভেঞ্চা*র হা*নি*মুন ট্রিপ করে আসি।”

প্রিয়া হড়বড়িয়ে বলে,
“না না। নেপালে ঘুরতে যেতে পারি কিন্তু এড*ভেঞ্চা*রের দরকার নাই। আমার একটুস খানি হৃৎপিন্ড!”

জারিফ হাসলো তারপর ওরা পাহাড় থেকে নেমে গিয়ে ঝর্ণাতে একটু হাত-পা ভিজিয়ে সমুদ্রপাড়ে হেঁটে মহেশখালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করলো। সেন্টমার্টিন ওরা আগামীকাল যাবে কারণ কক্সবাজার থেকে সরাসরি সেন্টমার্টিন যাওয়ার জাহাজ সকাল সাতটায়।
মহেশখালী যেতে বাঁকখালি নদীটাই বেশি পরে। শেষের দিকে সাগরের খানিকটা পরে তখনি কিছুটা বেশি ঢেউয়ের কবলে পরতে হয়। মহেশখালী যাওয়ার এই ভ্রমণটাই বেশি আকর্ষণীয়। সূর্যের প্রখর রোদে পানি নীল বর্ণের দেখায় তাছাড়া দূরের ম্যানগ্রোভ বনগুলোকে অনেক সুন্দর দেখায়। মহেশখালী পুরোটাই ম্যানগ্রোভ গাছগাছালিতে ভরপর। এই গাছগুলো মহেশখলী দ্বিপকে বড়ো ঢেউ ও ঝড় থেকে রক্ষা করে।

জারিফ প্রিয়াকে হাত ধরে স্পিডবোট থেকে নামায়। মহেশখালীর এই ব্রিজটা অনেক সুন্দর। ব্রিজে দাঁড়িয়ে বনের ভিতরে দেখা যায়। বনের মাঝে এই ব্রিজটা। ব্রিজের উপর অটো, সিএনজি দাঁড়ানো যাত্রী বহন করার জন্য। জারিফ প্রিয়ার মুগ্ধ দৃষ্টি বনের দিকে দেখে মুখ চেপে হেসে কানের কাছে ধীর স্বরে বলল,

“বনে যাবে?”

“ইশ যেতে ইচ্ছে করছে অনেক। কী সুন্দর লাগছে গাছগুলো।”

প্রিয়ার কন্ঠে উৎফুল্লতা। জারিফ প্রিয়ার হাত ধরে বলে,
“তবে চলো!”

প্রিয়া অবাক কন্ঠে বলে,
“আপনি কি আমাকে এই কাঁদার মধ্যে নামাবেন? না না। এই কাঁদাতে নামব না। যদি বোটে করে বা শুকনো পথে যাওয়া যায় তবে চলুন।”

“এমন করে যাওয়ার পথ আমার জানা নাই। গেলে এভাবেই। নাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে দেখো।”

জারিফ দূরবীন দিয়ে দূরে দেখতে লাগল। এরপর ওরা একটা সিএনজি ভাড়া করে এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলোর বাহির থেকে দেখে আসলো। ভ্রমণের পথে মহেশখালীতেই দুপুরের খাবার সেরে নিয়েছে। ঘুরতে ঘুরতে বিকেল হয়ে এলে ওরা বিকেলের আবহাওয়া উপভোগ করতে আবারও মহেশখালী ব্রিজে এসেছে। বিকেলে বাতাস থাকে প্রচুর। ঘোরাফেরা শেষে হোটেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। নামাজ পড়ে ও ফ্রেশ হয়ে সমুদ্রপাড়ে দুজন রাতের আকাশের নিচে হাত ধরে হাঁটছে। প্রিয়া ঝালমুড়ি খেতে খেতে হাঁটছে। প্রিয়া জিজ্ঞেস করে,

“আচ্ছা? ছুটি আর কতোদিন আছে?”

“ওরিয়েন্টেশন আর দুইদিন পর।”

“ওমা! আমরা কী তবে সেন্টমার্টিন একদিন থাকব? এটা ঠিক না। প্রবালদ্বীপে যাবো আর সেন্টমার্টিনে ঘুরব না?”

প্রিয়ার অভিমান মিশ্রিত কন্ঠস্বরে জারিফ প্রিয়াকে পেছোন থেকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে সমুদ্রপানে দৃষ্টি স্থীর রেখে বলে,

“কালকেই আমরা প্রবালদ্বীপ বাদে সব ঘুরে ফেলব তারপর পরশু প্রবালদ্বীপ দেখে দুপুর তিনটার জাহাজে কক্সবাজার ফিরে আসব। সেখান থেকে বাই এয়ার ঢাকা।”

প্রিয়া লজ্জা পেলেও অভিমানী কন্ঠস্বরে বলে,

“তাও। সেন্টমার্টিন নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ‘দারুচিনির দ্বীপ’ ও ‘রূপালী দ্বীপ’, মুভি ও বই পড়ে আমার আগ্রহ আরও বেড়েছে। কোন ছোটোবেলাতে বাবা নিয়ে গিয়েছিল ঠিক করে কিছু মনেও নাই। সেখানে তো হুমায়ূন আহমেদের বাড়িও আছে।”

প্রিয়ার অভিমান ভাঙাতে জারিফ বলে,
“তোমার চোখের তৃষ্ণা মেটানোর দায়িত্ব আমার মিসেস। সবকিছু তুমি উপভোগ করতে পারবে।”

প্রিয়া নিরব হাসলো। সারাদিন জার্নি করে ক্লান্ত তাই রেস্তোরাঁ থেকে রাতের খাবার খেয়ে ওরা জলদি হোটেলে ফিরে গিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল। সকাল সাতটার জাহাজ তো ধরতে হবে।

__________

সারাদিন পর রাতে মোবাইলে নেট অন করে মেসেঞ্জারে যেতেই ভার্সিটি ও ফ্রেন্ডদের গ্রুপ মেসেজ সাথে আরও মেসেজ আসতে লাগলো। পিহুর আইডি থেকে মেসেজ দেখল প্রায় সাত-আটটার মতো। মেসেজের সারমর্ম হলো, পিহু ঢাকা আসছে। রওনা হওয়ার আগে ও পৌঁছানোর পর মেসেজ। সাথে কোন স্টপে এসেছে এসব মেসেজ। আবার মেসেজ সীন করছে না বলে মন খারাপের মেসেজ। আয়ান এসব দেখে হাসলো। আজকে দেরি করে ঘুম থেকে উঠে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল সিরিজ দেখতে তারপর বিকেলে খেলতে যাওয়া, চায়ের আড্ডা। আয়ান পিহুকে লিখল,

“ওও। আমি সারাদিন নেটে ছিলাম না। সরি ফর লেট রিপ্লাই। জার্ণি করে এসেছ রেস্ট করো। ”

পিহু অনলাইনেই ছিল,
“আর কিছু বলবেন না? এটুকুই?”

“কী বলব? আমি এমনিতেও কম কথা বলি। পড়ালেখা, খেলাধুলা, মুভি, সিরিজ দেখেই সময় চলে যায়।”

আয়ানের মেসেজ দেখে পিহুর মন খারাপ হলো।
“আমি যে এতোদূর থেকে আসলাম?”

আয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“পড়াশোনা করো পিহু। ঢাকায় এসেছ বলে প্রতিদিন দেখা-সাক্ষাত হবে এমন না। এই শহরে পড়ালেখার প্রতিযোগিতা চলে। এতো প্রেশার যে তোমারও মনে হবে সময় কম। মাসে একবার তোমার আবদার পূরণ করতে পারি দেখা করার। এজন্যই তোমার ভাবা উচিত ছিল। অ্যাই অ্যাম সরি।”

পিহুর নয়নযুগল ভিজে উঠেছে। সংক্ষেপে লিখে,
“হুম। আচ্ছা বায়।”

বাচ্চামি তো সে করেছেই। আয়ানের প্রতি দুর্বল হয়ে এতোদূর চলে এসেছে। কতোকিছু ভেবে বসেছিল তার কাল্পনিক মন। কিছুক্ষণ নিরবে কেঁদে ফোনে দেখে আয়ানের একটা মেসেজ,

“টাইম ক্যান ফিক্স এভরিথিং। বি পেইশেন্ট।”

আয়ান মেসেজটা পাঠিয়ে নিউজফিড স্ক্রল করতে চলে গেছে। সে জানে পিহুর মন খারাপ এটাতে কিছুটা হলেও কমবে।

চলবে ইনশাআল্লাহ্‌,
ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here