#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৩
হাসি-ঠাট্টা মুখর পরিবেশ দেখে সাগরের সহ্য হচ্ছে না। সে ফোঁস ফোঁস করছে দুই হাত মুঠোবন্দি করে। এদিকে নিলয় একধ্যানে রাত্রির রোদের মতো উজ্জ্বল হাসি ঠিকরে পরা মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করে চলেছ। হৃদয় গহ্বরে এক অতিমাত্রায় সুখ কাজ করছে সাথে অজানা এক অস্থিরতা। নিলয়ের হাঁসফাঁস লাগছে। মনে হচ্ছে সে পা*গল হয়ে যাবে। নিলয় চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–সাগর, আমার একটু কাজ আছে। আমাকে এখনি বাড়িতে যেতে হবে।
সাগর কিছু বলল না। সেও এখান থেকে চলে গেল। নিলয় ওর বাড়ির জন্য চলে গেলো।
আহনাফ তীক্ষ্ম নেত্রযুগল কুঁচকে মাহিকে পর্যবেক্ষণ করছে আর খাচ্ছে। মাহি এরকম পরোটা ভাজি আগে খেতো না কিন্তু এখন খাচ্ছে। মেয়েটার অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। মারসাদের নজর ফোনের দিকে। আজকে নতুন ভিপি ঘোষনা হবে। আশিক ভাই তাকে আধঘণ্টার মধ্যে যেতে বলেছে অডিটোরিয়ামের কাছে। মারসাদের এতে কোনো চিন্তা নেই। ভিপি যে সেই হবে তা কাল রাতেই জানা হয়েছে। আদিরা খাওয়ার ফাঁকে আড়নজরে মারসাদের দিকে তাকাচ্ছে। সে যে কয়েকদিন ধরে নিজের মনে একটা অস্থিরতা উপলব্ধি করতে পারছে! যা মারসাদকে দেখলে তার হৃদকুটিরে প্রকাণ্ড বিস্তৃত ঝরের সূত্রপাত হয়। নজর মেলাতে তার নজর ঝুঁকে আসে। আদিরার আড়চোখে তাকানোর মাঝে মারসাদ ফোনের স্ক্রিন থেকে নজর সরিয়ে নেত্রযুগল আদিরার সলজ্জ আঁখিযুগলে শুভদৃষ্টি ঘটায়। আদিরা ধরা পরে অতিসত্তর দৃষ্টি নিচু করে। মারসাদ মুচকি হাসে।
খাওয়া-দাওয়ার পর্বের সমাপ্তির পর ওরা সকলে এখন যার যার ক্লাসে যাবে তখন রাফিন বলে,
–আহ! আজ পেট আমার শান্তি। তোমরা পারলে প্রতিদিন এমন করে খাবার আনবে হ্যাঁ?
সকলে হেসে উঠে রিন্তি কিছুক্ষণ যাবত রাহিনের খাওয়ার ধরন দেখে কিছু বলতে চাইছিল। বলা বাহুল্য যে রাহিন একটু পেটুক টাইপ। রিন্তি মুখ ফসকে বলেই ফেলে,
–এরকম রা*ক্ষসের মতো খাওয়ার জন্য আপনাকে বলবো!
রাহিন চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে সচকিত দৃষ্টিতে তাকায়। রিন্তি সাথে সাথে নিজের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে। বিড়বিড় করে বলতে যেয়ে জোরে বলে ফেলেছে সে। রিন্তি ব্যাপারটা ঘুরাতে আদিরাদের তাড়া দিয়ে বলে,
–এই জলদি চল। নোট করতে হবে আর ক্লাস শুরু হবে। চল চল।
রিন্তি সবার আগে সেখান থেকে সটকে পরে। রাহিন আহনাফদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টায়। মৃদুল হেসে রাহিনের পেটে খোঁচা দেয়।
_______
নিলয় নিজের বাড়িতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হাঁপাচ্ছে। তার বাড়ি থেকে ইউনিভার্সটির দূরত্ব দেড় ঘণ্টার মতো তাও সে সেকেন্ড ইয়ার শেষে হোস্টেল নিয়েছে। তারপর থেকেই সে সাগরের সাথে অতিমাত্রায় মিশতে মিশতে বদলে গেছে। আগেও ফ্রেন্ডশিপ থাকলেও সে বর্তমানেরর নিলয়ের মতো ছিল না। সাগর কলেজ থেকেই ঝামেলাত জড়ানো স্বভাবের তবে নিলয় ঠিক তার উল্টোটা। কিভাবে সে সঙ্গদোষে খারাপ পথে ধাবিত হলো সে কয়েকদিন ধরে সেটাই উপলব্ধিতে আছে। তার হুট করে এই উপলব্ধির কারণ তার বোন নিহা।
ছুটির মধ্যে একদিন রাত তিনটা বাজে নিহার রুমের বাইরে দিয়ে পানি খেতে যাবার সময় নিহার ফিসফিস কন্ঠে কথা বলার আওয়াজ পায়। নিহা একটা ছেলের সাথে প্রেম করে আর ছেলেটার জন্য এই রাত তিনটা বাজে জেগে হেসে হেসে কথা বলছিল। নিলয়ের তখন মনে পরলো, রাত্রিও তার সাথে এভাবে কথা বলে। রাত্রিও তার বোনের মতো আশায় বুক বাঁধে। তাহলে সাগরের কথায় রাত্রির সাথে ধোঁকা খেলাটাতো ঠিক না। তখন সে কীসব ভাবতে ভাবতে রাত্রির সাথে দুইদিন যোগাযোগ করে নি। ফোন বন্ধ করে রেখেছিল। তৃতীয়দিন ফোন অন করে রাত্রির শখানেকের বেশি মেসেজ ও মিসডকল দেখে তার বুক ধক করে উঠে। কেনো সে নিজেও জানেনা। সে রাত্রিকে তৎক্ষণাৎ ফোন করলে রাত্রি কেঁদে কেঁদে কথা বলে। তারপর থেকেই সে রাত্রির প্রতি নিজেকে অনেক দুর্বলতা বুঝতে পারে। নিলয়ের মাঝে মাঝে মনে হয় যদি তার বোনকেও কেউ এভাবে কষ্ট দেওয়ার পরিকল্পনা করে থাকে? এক ভীতু মনের ভাই সে। নিজের সদ্য কলেজ পড়ুয়া বোনকে নিয়ে তার ভয়ের শেষ নেই।
“পৃথিবীর প্রতিটা ভাই যদি সময় থাকতে তার বোনের সাথে নিজের প্রেমিকা বা স্ত্রীর মানসিক অবস্থার তুলনা করে তাহলে সমাজ সুস্থ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।”
_______
শ্রাবণ মাসের আর দুইদিন বাকি। আজ সারাদিন গুড়ি গুড়ি হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির হালকা ছাঁট গায়ে লাগলেও তার অতিমাত্রায় কম। ভার্সিটির ছুটির পর আদিরা টিউশনে যাচ্ছে। সে রাতের টিউশনটার দুইদিন যে বিকেলে পড়ায় সেটাতেই। আদিরা সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হচ্ছে তার পেছোনে কেউ আসছে। আদিরা পেছোনে ঘুরে দেখে এক ছোটো বাচ্চা মেয়ে একহাত ভরতি কদম ফুলের গুচ্ছ আর আরেকহাতে একটা ডালা যেটাতে কাঠগোলাপ ও বকুল ফুলের সমাহার। আদিরা এতো সুন্দর ফুল দেখে হা করে তাকিয়ে রয়। আদিরাকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চা মেয়েটা আদিরার কাছে এসে কদম ফুলগুলো আর ফুলের ডালাটা দেয়। তারপর দৌঁড়ে চলে যায়। আদিরা এই কান্ডে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়। ডালাটার উপর এক শুভ্র রঙের কাগজ প্রজাপতির মতো করে শেপ করা। আদিরা কাগজটা হাতে নিয়ে খুলে দেখে,
“এই যে মেয়ে, শুভ্র আভায় ফুলগুলো দিয়ে তোমাকে আমন্ত্রণ। শরতের নিমন্ত্রণ রইলো।
‘মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী,
দেব খোঁপায় তারার ফুল।’
[কাজী নজরুল ইসলাম]
তারার মতো বকুলের ঘ্রাণে তোমার হৃদয় বিমোহিত হোক শুধু আমাতে।
‘কাঠগোলাপের সাদার মায়ায় মিশিয়ে দিয়ে ভাবি,
আবছা নীল তোমার লাগে ভালো।’
[গা’ন]
হলুদাভ সাদা রঙে রাঙুক আজ তোমার মনের ধরণী। রঙিন কাঠগোলাপের অভ্যর্থনা তোমাকে দিতে আজ আমি অপরাগ।
‘এক সূর্য কুসমে বহু শুভ্র ঝালর!
মনে হয় বর্ষা তার রূপ ঢেলে দিয়েছে।’
_____তিথী
কদম ফুলের সিক্ত অভ্যর্থনা। ”
আদিরা বড়ো আকারের প্রজাপতি আকারের কাগজটার লেখাগুলো পড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। এতো ফুল নিয়ে তো স্টুডেন্টের বাড়িতে যেতে পারবে না তাই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে স্টুডেন্টের মাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো রাতে পড়াতে আসবে। এখন আদিরা চিন্তায় পরে গেলো এসব কে তাকে পাঠালো? তবে ফুলগুলো অতিমাত্রায় সুন্দর। মন ভালো করার ক্ষমতা রাখে। আদিরার মন বলছে হয়তো মারসাদ! আবার নাও হতে পারে। আদিরা ফুলগুলো নিয়ে হাঁটছে। আবারও তার সিক্সথ সেন্স বলছে কেউ তাকে আড়ালে অনুসরণ করছে। আদিরা পেছোনে ঘুরে কাউকে দেখতে পেলো না। আদিরা ভাবলো সে এবার অন্য উপায়ে পর্যবেক্ষণ করবে। হুট করে হো*চট খাওয়ার ভঙ্গিমায় পরে যেতে নিয়ে ফাঁকা রাস্তার সাইডে বসে পড়ে। তারপর পা ধরে হালকা চিৎকার করে। ফুলের ডালা থেকে দুয়েকটা ফুল ভূমিতে ছড়িয়েছে। আদিরা সেগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
আড়ালে দাঁড়ানো মানুষটি তার প্রেয়সীর আচমকা চিৎকারে দৌঁড়ে আসে। তারপর পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত দিতে নিলে আদিরা পা সরিয়ে নিয়ে থতমত কন্ঠে বলে উঠে,
–আপনি? আপনি এখানে কেনো?
মারসাদ আদিরার পা সরিয়ে নেওয়া দেখে গম্ভীর কন্ঠে ধমক দিয়ে বলে,
–এতো প্রশ্ন কেনো? চুপচাপ পা দেও। দেখি কোথায় মোচড় লেগেছে।
আদিরার পা জোর করে টেনে নিয়ে মারসাদ দেখতে লাগলো আর আদিরা নিরব হাসলো। তার সন্দেহ সঠিক ছিল। কিন্তু এই ত্যাড়া মানবটি তো নিজ মুখে স্বিকার করবে না। আদিরা কিছু একটা ভেবে বলল,
–সব দোষ এই ফুলগুলোর! এগুলো কে দিলো তা ভাবতে ভাবতে আমার পায়ে মোচড় লেগেছে। লাগবে না এই ফুল! আমি সামনের ডাস্টবিনে ফেলে দিবো। এখন আমি হাঁটবো কী করে!
মারসাদ মাথা তুলে আদিরার মুখের দিকে তাকালো। তারপর পায়ের থেকে হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত গুজে গম্ভীর স্বরে বলল,
–অভিনয় খুব ভালোই আয়ত্ত করেছ। তোমার পায়ে কোনো মোচড় আসে নি। আমি যদি খেয়াল না করে আরেকটা উলটো মোচড় দিতাম তবে তুমি সত্যি সত্যি হাঁটতে পারতে না।
আদিরা ধরা পরে গিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো। মারসাদ বাঁকা হাসলো। আদিরা উঠে দাঁড়িয়ে ফুলগুলো নিয়ে মাটি থেকে তুলে নিয়ে বলল,
–মোচড় না খেলাম তবে নখে তো ঘষা লেগেছে! আর এই ফুলগুলো কে দিলো তাই ভাবুন আপনি। আমার ভয় হচ্ছে অনেক। আমি ফেলে দিবো এগুলো।
মারসাদ ধ*মক দিয়ে বলে,
–ফুলের কী দোষ? তোমাকে তোমার কোন প্রেমিক ফুল দিয়েছে তার জন্য তুমি এই ফুলগুলোর অসম্মান করবে? চুপচাপ এগুলো নিজের কাছে রাখো।
আদিরা মুখ ফুলিয়ে মারসাদের দিকে চাইলো। মারসাদ নিজে দিয়েছে সেটা স্বিকার না করার খুব ভালো পন্থা অবলম্বন করেছে। আদিরা অসন্তোষ কন্ঠে বলল,
–যদি ফুলগুলো আমায় দেলোয়ার দিতো তখন? তখনও কী এভাবে রাখতাম? শোনেন, ফুলের পবিত্রতা সর্বত্র হলেও যখন কেউ সেটা কাউকে দেয় তখন তার মনের উপর ফুলের পবিত্রতার তারতম্য হয়। অশুভ হাতে ফুলের পবিত্রতা অসম্মানিত হয়। তাই যে দিবে তার নিয়তের উপর সবটা নির্ভর করে।
মারসাদ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। বোকা বোকা মেয়েটার মুখে এখন দারুন বুলি ফুটছে যে সে মারসাদকেও মাত দিতে প্রস্তুত। মারসাদ একরোখা স্বরে বলে,
–তুমি কী জানো? যে দিয়েছে সে খারাপ উদ্দেশ্যে দিয়েছে? চুপচাপ নিজের কাছে রাখো। আর চিরকুটে তো সব বলাই আছে!
আদিরা হুট করে খিলখিল করে হেসে উঠলো। মারসাদ হাসির মানে না বুঝে কনফিউজড হয়ে চেয়ে রইল।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।