#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩২
খাবার টেবিলে খাবার খাওয়ার সাথে যুক্ত হয়েছে আড্ডা। আহনাফের মা, ভাবি ও আদিরা খাবার পরিবেশন করছে। হাসি আড্ডাতে ছেলেদের খাবারের পর্ব শেষ হলে ওরা আহনাফের রুমে যায় তারপর আদিরা, আহনাফের মা, ভাবি ও বোন ওরা একসাথে খেয়ে নেয়।
বিকেলের একটু আগে, সূর্যের তেজ আজ অন্যদিনের তুলনায় কম। আহনাফদের ছাদে অনেক গাছ-গাছালি টবে লাগানো আছে। বাড়িটা তিনতলা বিশিষ্ট হলেও উপর ও নিচ তলা ভাড়াতে দেওয়া। বাড়ির পাশে দুয়েকটা বড়ো বড়ো আম ও কাঁঠাল গাছ আছে। ছাদে একটা দোলনাও লাগানো। আদিরা দেখেছিল, আহনাফের ভাবি তার মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন তাছাড়া সে অনেকটাই ক্লান্ত। আহনাফের মাও ঘুমোচ্ছেন। আসরের আজান হতে আরও ঘণ্টাখানেক বাকি। আদিরা টুক করে ছাদে উঠে গেল। অর্ণিকে আসতে বলেছিল কিন্তু অর্ণি ম্যাথ মিলাচ্ছিল বলে আসতে পারেনি। ছাদে গিয়ে গাছে ঝুলে থাকা লেবু, করমচা, আমরুজ এসব ধরে ধরে দেখছিল। বিমোহিত চিত্তে উপভোগ করছিল সব। অন্যদিন রোদের তেজে এসময় ছাদে আসাই যায় না। আদিরা একটা পাঁকা করমচা ছিঁড়ে নিল। গাছগুলো আহনাফদের এটা সে জানে।
হুট করে নিজের চোখের উপর কারও হাতের স্পর্শ বুঝতে পেরে মুচকি হাসল আদিরা। পেছোনে চোখ ধরে রাখা মারসাদ অপেক্ষা করছে আদিরার ভীত কন্ঠস্বর শোনার জন্য। কিন্তু মারসাদকে হতাশ করে আদিরা বলে,
–আপনার স্পর্শ আমায় ভীত করে ঠিক কিন্তু সাথে লাজুকতা ভর করে।
মারসাদ আদিরার চোখ ছেড়ে দিয়ে ওকে নিজের দিকে ঘুরায়। দুজনের চোখে অন্যরকম হাসি। যেন দুজনেই দুজনকে নিজেদের ঊর্ধ্বে অনুভব করতে পারে। মারসাদ আদিরার অবাধ্য চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলে,
–আমার এলোমেলো জীবন গুঁছিয়ে নিও। বড্ড এলোমেলো এই আমি। তোমার পদচারণায় আমার মনের শহরে আরও তোলপাড় হয়েছে। এখন সবকিছু তোমায় ঠিক করতে হবে মনোহারিণী!
আদিরা বিনিময়ে চমৎকার হাসে। তার মনে যা একটু সংশয় কাজ করছিল সেগুলোও খাবার টেবিলে কে*টে গেছে। মারসাদরা সেখানে পুরো ঘটনার বিশদ আলোচোনা করেছিল। মারসাদ বলে,
–একটা দুই রুমের ফ্লাট নিয়েছি। ফ্লাটটা এক মাস ধরে ফাঁকা ছিল। দেয়ালের রঙ করিয়েছিল বলে ভাড়াটে ছিল না এক মাস আর এই মাসেও কেউ উঠেনি। মাসের প্রায় মাঝামাঝি চলে এসেছে তাও প্রয়োজনে যে পেয়েছি ওটাই অনেক। আঙ্কেল-আন্টি, আহাদকে নিয়ে সেখানে ওঠো। বড়ো ফ্লাট পাইনি। বিকেলে মাহি আসবে। মাহি আমাকে ভার্সিটিতেই কতক্ষণ কি*ল, ঘু*ষি দিয়েছে তাকে না জানিয়ে বিয়ে করার জন্য।
এটা বলে মারসাদ হাসতে থাকে। আদিরা বলে,
–আমাকেও এসে কতোগুলা দিবে নয়তো মুখ ফুলিয়ে থাকবে। আচ্ছা, আহনাফ ভাইয়ের সাথে মাহি তো সেইদিনের পরে আর কথাই বলল না। আমি কী মাহিকে কিছু জিজ্ঞেসা করব? আমার মনে হয় মাহি আহনাফ ভাইয়াকে পছন্দ করে।
মারসাদ হতাশ স্বরে বলে,
–তোমার আমার ভাবনা মিথ্যেও হতে পারে। আমি আমার বন্ধুর লুকানো হতাশা অনুভব করতে পারি। তবে সবচেয়ে বড়ো সত্য আমি একজনের ভাই। ভাইয়ের সম্পর্কের সাথে বন্ধুর মতো ভাইয়ের সম্পর্কটা একই ধাঁচের কিছুটা। একটা রক্তের আরেকটা আত্মার। আমি তাই ওদের বিষয়ে কিছুই বলব না। সময় নিক। টাইম কেন হিলস এভরিথিং।
আদিরা কিছু বলল না। মারসাদ এবার কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে বলে উঠে,
–ও আচ্ছা শোনো, তোষক আপাততো একটা অর্ডার দিয়েছি যেটা আজ রাতেই দিবে। উনারা তো ম্যাট্রেসে ঘুমাতে পারবে না। তাই কিনি নি। তবে ম্যাট্রেসটা ভালো হতো। তোমার জন্যও কী তোষক আনব? ম্যাট্রেস আনি? আমার ওটাই ভালো লাগে।
আদিরা বুঝলো মারসাদের ম্যাট্রেস বেশি পছন্দের। তাছাড়া ওরা বিবাহিত তাই এখন মারসাদ চাইলেই আদিরা সাথে এসে থাকতে পারে। আদিরার ম্যাট্রেসে ঘুমানোর অভ্যাস নেই কিন্তু মানুষকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভ্যাস গড়তে হয়। আদিরা মারসাদকে হ্যাঁ বলে দিল। মারসাদ বলল,
–তাহলে নিচে চলো। তোমার ননোদিনী একটু পরেই চলে আসবে। আমিও বিকেলে বেরিয়ে যাব। তুমি আজকে রাতটা এখানেই থাকো। আমরা পাঁচ বন্ধুও রাতে এখানে থাকব। তোমার বাবা-মা মনে হয় আসতে আসতে অনেক রাত হবে কারণ ওরা এখনও রওনাই করেনি। ঝামেলা মিটিয়ে রওনা করবে। আর কী কী নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস লাগবে বলে দিও।
আদিরা কিয়ৎ ভাবে। তারপর বলে,
–নিত্য প্রয়োজনীয় কিছুই লাগবে না এখন। আপনি তো আমার মাকে চিনেন না। সে আমাকে যদি মেসে উঠার জন্য হাড়ি-পাতিল, কড়াই, প্লেট সব একটা একটা করে দিয়ে দেয় তাহলে নিজেরা আসার সময় নিশ্চয়ই নিয়ে আসবে। আপনাকে অযথা খরচ করতে হবে না। এমনিতেও ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া অনেক। আমি ভাবছি ভাড়া আমি দিব। কারণ ওরা আমার বাবা-মা। আমার দায়িত্ব বেশি।
মারসাদ আদিরাকে বাধা দিয়ে বলে,
–ওয়েট ওয়েট। কী বললে তুমি এসব! তুমি আমার বউ। তোমার সবকিছুর দায়িত্ব আমার। আর তোমার বাবা-মায়ের জন্য এটুকু আমি করতে পারব না?
আদিরা মুচকি হেসে মারসাদের হাত ধরল। মারসাদ ভ্রুঁ কুঁচকে আদিরার দিকে তাকিয়ে আছে। আদিরা বলে,
–আমি আপনার বউ তাই একমাত্র আমি আপনার দায়িত্ব হতে পারি কিন্তু আমার বাবা-মায়ের দায়িত্ব আমি নিতে চাই। আর আপনি তো আমার বাবাকে আমার দেনমোহর দিয়েই দিয়েছেন। আমার খুব ইচ্ছে আমার বাবা-মাকে আমি নিজের উপার্জনে রাখব। আপনি রাগ না করে আমার দায়িত্ব নেন আর আমি আমার পরিবারের। দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিলে কোনো কিছুই বোঝা মনে হবে না।
মারসাদ তো আদিরার বলা, “আপনি তো আমার বাবাকে আমার দেনমোহর দিয়েই দিয়েছেন।” ওখানেই আটকে আছে। আদিরাকে তো সে বলেনি। মারসাদের হতভম্ব মুখশ্রী দেখে আদিরা হেসে বলে,
–এটাই ভাবছেন তো আমি দেনমোহরের ব্যাপারে কিভাবে জানলাম? সকালে পুলিশ ওখানে যাওয়ার পর মা আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল তারা ঠিক আছে আর জিজ্ঞেসা করেছিল, দেলোয়ার আমাকে কিছু করেছে কীনা? তখন আমি বিয়ের কথাটা বলে দিয়েছি। মা তখন আমাকে দেনমোহর দিয়ে কর্জ চুকানোর কথা বলেছে। দুপুরে তো আপনি বললেনই কীভাবে সব ঠিক করেছেন। এরপর আমি বুঝতে পারলাম, আপনি কীভাবে বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়েছেন।
মারসাদ এবার আদিরার গাল দুটো টেনে দেয় তারপর বলে,
–দেখেছ, কতো বুদ্ধিমান আমি! শ্বশুর-শাশুড়ির মন জয় করে নিয়েছি আগেই।
মারসাদ আদিরাকে নিজের প্রশস্ত বুকের সাথে উষ্ণ আলিঙ্গন করল। হঠাৎ হাসি রোলে আদিরা ও মারসাদ একে অপরের থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল। ছাদের দরজার কাছে মারসাদের চার বন্ধু, আহনাফের ভাবি, মাহি, অর্ণি, রিন্তি ও সাবিহা দাঁড়িয়ে হাসছে। মাহি তীক্ষ্ম নজর দিয়ে মারসাদদের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
–একে তো না জানিয়ে বিয়ে করেছিস! আবার এখন লুকিয়ে লুকিয়ে দিনের আলোয় খোলা ছাদে বাসরও করছিস! দাভাই তুই দিন দিন লজ্জাহীন হয়ে যাচ্ছিস সাথে আমার ভোলাভালা বান্ধুবীটাকেও বানাচ্ছিস।
মারসাদ মাহির মাথায় ঠোকা দিয়ে বলে,
–এই বা*চাল! তুই কখন এলি? এলি যখন ছাদে কেন এলি! ভাই-ভাবি নতুন বিয়ে করেছে একটু রোমান্স করবে না! নিজে লজ্জাহীন হচ্ছিস আর দোষ দিচ্ছিস আমাদের।
মাহি হা করে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে মারসাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফের ভাবি এসে হাসতে হাসতে বলে,
–ভাই তোমার রোমান্স করার ইচ্ছে হলে বলতে। আমি নিজে তোমাদের একটা রুম খালি করে দিতাম। তাও ছাদে তো যেকেউ চলে আসতে পারে।
আদিরা এমন লজ্জাজনক অবস্থায় পরবে আশা করেনি। চোখ মুখ খিঁচে মাথা নিচু করে রেখেছে। আদিরাকে এমনভাবে থাকতে দেখে মাহি ওর হাত ধরে বলে,
–ভাবিবান্ধুবী! তোকে আমি এখন কোনটা বলব বুঝতেছি না। নাম ধরে বললে যদি তোর বর রাগ করে!
মারসাদ মাহিকে বলে উঠে,
–তোকে এতো ফর্মালিটি করতে হবে না। ওকে আগে যেভাবে ডাকতি তেমন করেই ডাকিস।
মাহি মুখ বাঁকা করে বলে,
–ইশ! তোর কাছ থেকে ট্রিট নেওয়ার এখন আদিরারাই উৎস। তাই আমি ওকে ভাবি বলেও ডাকব যখন তোর থেকে কিছু নেওয়ার হবে।
মারসাদ মাহিকে দৌঁড়ানি দিলে মাহিও ছুটতে থাকে। ওদিকে একজন মলিন দৃষ্টিতে মারসাদ ও মাহির খুঁনশুটি দেখছে। সেই একজনটা আহনাফ। মাহি এখনও তার সাথে কথা বলেনি বলে সে মলিন দৃষ্টিতে তার প্রেয়সীকে দেখছে। মাহি দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আহনাফের ভাবির পেছনে এসে থামে আর ভাবিকে বাঁচাতে বলে। মাহি পেছোন দিকে ব্যালেন্স হারাতে নিলে আহনাফ ধরে ফেলে। দুজন দুজনকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পরে। মারসাদ আহনাফ ও মাহিকে একত্রে দেখে থেমে যায়। ওদের দুজনের মধ্যে কথাবার্তা হোক মারসাদ চায়।
অপ্রস্তুত হয়ে মাহি সরে আসে তারপর বলে,
–আদু চল। আমরা আড্ডা দিব। ভাবি ও আন্টিও আমাদের জয়েন করবে। চল চল।
এটা বলে সে খুব ব্যাস্ততার সাথে আদিরাকে টেনে নিচে নিয়ে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
বোনাস পর্ব আসতে পারে রাতে। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।