দিন_বদলের_হাওয়ায় [১৮] #তানজিলা_তিহা (লেখনীতে

0
471

#দিন_বদলের_হাওয়ায় [১৮]
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)

শাশুড়ির কথা শুনে রুনা আপা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন শাশুড়ির দিকে। আমিও অবাক। আমি আর রেদোয়ান একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছি অবাক দৃষ্টিতে! তিনি আমার পক্ষে সাফাই গাইছেন কেন?

রুনা আপা আম্মাকে বললেন, তুমি আমাকে এগুলো বলতে পারলে মা?

হ পারলাম। আমি একটুকু কওয়ায় তোর কষ্ট লাগতাছে ওই মাইয়াটারে যে এত্তোগুলা কইলি ওর কেমন লাগতাছে?

রুনা আপা কিছু বলতে পারলেন না। তার চেহারায় এখনো বিস্ময়ের ছাপ। আমার শাশুড়ির এই ব্যবহার হয়তো আশা করেন নি। আমিও অবাক হয়ে আমার শাশুড়িকে দেখছি। শাশুড়ি আবার বললেন, আমার কথায় কষ্ট পাইলে পাইছ কিন্তু এই মাইয়াটার বাপ মায় এনে উপস্থিত তাগো সামনে তুই মাইয়াটারে এতগুলা কথা কেমনে শুনাইলি?

রুনা আপা চুপ থাকলেন। শাশুড়িও নীরব রইলেন কিছুক্ষণ। এরপর বললেন, রেদোয়ান আমগোরে গাড়ি দেইখা দে তো। আমরা যাই গা। আমার সরম লাগতাছে এহন। এই মাইয়া নিয়া আমি এন থেকে যাই গা। নাক কাটা যাইতাছে আমার‌।

ভীষণ অবাক আমি। রেদোয়ান আম্মাকে বললো, এখন কেন যাবে? এসেছো দুদিন থাকো। তবে ঝগড়াঝাঁটি করো না। আমার বাড়িতে আমার ভাই বোন মা বাবা আসবে থাকবে আমি নিষেধ করি নি। কিন্তু আসার পরে মিথ্যে অভিযোগে কেন ঝগড়া শুরু করবে?

শাশুড়ি কিছু বললেন না। রুনা আপা চুপসে আছেন। আমি শুধু দেখছি তাদের অবস্থা। রেদোয়ান আর কথা বাড়ালো না। সবাই নীরব হয়ে গেলো।

সন্ধ্যা বেলা আমি রান্নার জন্য রান্না ঘরে গেলাম। তরকারি কাটা শেষ করে পিঁয়াজ কাটছিলাম। হঠাৎ আমার শাশুড়ি আমার কাছে গিয়ে বললেন, বউ মা আমারে দাও আমি কাটি। তুমি তরকারি ধুইয়া লও।

আমি ভীষণ অবাক হলাম। বললাম, না থাক আম্মা আমি পারবো। আপনি যেয়ে বিশ্রাম করেন।

সারাদিনই তো বইসা ছিলাম। এখন দাও তো।

না আম্মা আপনি বেড়াতে এসেছেন। আপনার আর কাজ করতে হবে না। আপনি ঘরে গিয়ে বসেন।

আমার শাশুড়ির হাসি মাখা মুখটা মলিন হয়ে গেলো। বললেন, দূরে সরায়া দিতাছো তাই না? জানো ওনে একলা একলা আমার ভাল্লাগে না। তোমগো কথা মনে পড়ে। কাম কাইজ যা আছে একলাই করি। রথে আর কুলায় না।

শাশুড়ির কথায় মায়া হলো। তাকে একবার ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম। আগের মতো তেজ আর শরীর তার নেই। কথাবার্তা অনেকটাই নরম হয়ে এসেছে। শরীরের অবস্থাও আগের মতো নেই। কেমন যেন রোগা রোগা দেখা যাচ্ছে তাকে। আগের মতো কথাবার্তাও বলেন না তিনি। তার পরিবর্তন কেমন যেন লাগছে।

আমার ভাবনার মাঝে শাশুড়ি বললেন, কি হইলো মা?

কিছু না আম্মা। আপনি ঘরে যান। ওখানে তো সব কিছু আপনার নিজের করেই খেতে হয়। এখন না হয় আমি করি আপনি বিশ্রাম করেন।

আচ্ছা কিছু যেহেতু করতে দিবা না আমি এনেই বইসা থাকি। রুমে ভাল্লাগে না।

শাশুড়ি বসেই রইলেন। আমি আমার কাজেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মাঝে মাঝে আমার শাশুড়ি দুই একটা প্রশ্ন করতে থাকলেন। আমিও তার উত্তর দিলাম। এক সময়ে শাশুড়ি ঘরে চলে গেলেন।

রাতে তাদের তিন মা মেয়ে ছেলেকে একসাথে খাবার দিলাম। শাশুড়ি মাকে তাদের সাথে খাওয়ানোর জন্য জোর করেছেন কিন্তু মা রাজি হন নি। আমার শাশুড়ি বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন। রুনা আপা তেমন খাচ্ছেন না। তার চেহারায় রাজ্যের অন্ধকার। রেদোয়ান খাচ্ছে আর তার মায়ের খাওয়া দেখছে। আমার শাশুড়ি সেটা হয়তো খেয়াল করলেন। রেদোয়ানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি হেসে বললেন, এমনে চাইয়া আছোছ কেন বাবা? অনেক দিন পর এমন স্বাদের খাওন খাইলাম। ওনে নিজে ঠিক মতন রানতে পারি না। শরীরে কি আর আগের মতন জোর আছে? করতে পারলে খাই আর না করতে পারলে খাই না। আজকে অনেক দিন পর মন ভইরা দুইটা খাইতাছি।

শাশুড়ি তাঁর কথা শেষ করলেন। কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো। সেখানে একা থাকতে ওনার খুব কষ্ট হয়। ঠিকই তো বুড়ো মানুষ আর কতটুকু করতে পারে? ওনাকে রান্নাবান্না নিয়ে খুব ঝামেলায় পড়তে হয়। রেদোয়ানের চেহারায় মলিনতা খেয়াল করলাম। রেদোয়ান ভাত নড়াচড়া করতে থাকলো। কোন রকমে খাওয়া শেষ করে আস্তে উঠে গেলো সে। আমি সবকিছু পরিষ্কার করে নিলাম। আমি আর মাও খেয়ে নিলাম।

রাতে শোয়া নিয়ে পড়লাম আরেক ঝামেলায়। বাসায় ঘর দুটো। একটায় আমার মা বাবা আছেন। আরেকটায় শাশুড়ি আর ননদকে দিলাম। কিন্তু এখন আমরা কোথায় শোবো? নিচে যে বিছানা করে শোবো তারও কোন উপায় নেই। কোন ঘরে বিছানা করবো? যেখানেই ঘুমাবো সেখানেই লজ্জায় পড়তে হবে। শেষে রেদোয়ানকে শাশুড়ির ঘরে নিচে বিছানা করে দিলাম সে সেখানেই ঘুমালো। আর আমি মায়ের কাছে রাতটা কাটিয়ে দিলাম। মা আর আমি কেউই ভালো করে ঘুমাতে পারলাম না রাতে। দুজনেই বসে রাত কাটালাম। বিভিন্ন কথায় রাত কাটলো মা মেয়ের।

ফজরের সময় উঠে নামাযটা পড়ে নাস্তা তৈরি করে নিলাম। রেদোয়ানকে ডাক দিয়ে উঠালাম। রাতে মা বলেছেন গ্রামে চলে যাবেন। ডাক্তার আবার পনেরো দিন পর দেখা করতে বলেছেন। তখন এসে ডাক্তার দেখাবেন। আমি আর মাকে কিছু বলি নি। কোন মুখে আবার থাকতে বলবো আমি? এখানে থেকে অপমান সহ্য করার থেকে নিজের বাড়ি চলে যাওয়াই তাদের জন্য উত্তম।
আমি রেদোয়ানকে সবটা বললাম। সে নীরবে শুনলো। এরপর আমায় বললো, গতকালের ঘটনার জন্য কি তারা চলে যেতে চাচ্ছে আয়ু? প্লিজ রাগ করো না আমার বোনের হয়ে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।

না সে কারণে যেতে চাইছেন না। পনেরো দিন তো অনেক দেরি। বাড়িতে পায়রা একা। তাই মা চলে যেতে যাচ্ছেন।

মিথ্যে বলছো তুমি।

মিথ্যে কেন বলবো আমি রেদোয়ান? একটু পরে তারা বের হবে। তুমি মা বাবাকে একটু গাড়িতে উঠিয়ে দিতে পারবে?

রেদোয়ান কিছুক্ষণ আমার দিকে নীরব তাকিয়ে থাকলো। এরপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই নিয়েছে তখন আর কি বলবো আমি। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

রেদোয়ান চলে গেলো। আমি বাবা মাকে নাস্তা দিলাম। শাশুড়ি ননদ এখনো ঘুম থেকে উঠে নি। মা বাবা নাস্তা শেষে তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। রেদোয়ানও চলে গেলো। তাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে রেদোয়ান অফিসে যাবে। তারা বের হওয়ার পর আমি কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লাম।

আটটার দিকে আমার শাশুড়ি আমাকে ডাক দিলেন। আমি ঘুম থেকে উঠলাম। তিনি আমাকে বললেন, বউ মা তোমার আম্মা আব্বা কই? তাদের দেখতাছি না যে।

তারা চলে গেছে আম্মা।

শাশুড়ি বিস্মিত হলেন। বললেন, কি কও? গেছে গা মানে?

তারা তাদের বাড়িতে চলে গেছে। সকালেই বের হলো।

কেন মা? রুনার কথায় কি তারা বেশি কষ্ট পাইছে? রাগ কাইরো না মা। ওরে মাফ কইরা দাও।

না আম্মা। গতকাল বাবাকে ডাক্তার দেখালাম না? ডাক্তার পনেরো দিন পর দেখা করতে বলেছেন। তাই ওনারা চলে গেছেন।

শাশুড়ি কিছুক্ষণ শান্ত থেকে বললেন, রেদোয়ান কই?

ওনাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে অফিসে যাবে বলেছে।

শাশুড়ি কিছু বললেন না। আমি বললাম, আম্মা আপনি মুখ হাত ধুয়ে আসুন। আমি নাস্তা দেই। আপা ঘুম থেকে উঠেছে?

হ উঠছে।

ঠিক আছে। আমি তাহলে নাস্তা দেই।

নাস্তা করে আমার শাশুড়ি আর ননদ বেরিয়ে পড়লেন। তারা রুশা আপার বাড়িতে যাবেন বলেছেন। বিকেলে আসবেন বলেছেন। আমি কথা বাড়াই নি। ওনারা চলে যাওয়ার পর নিজের সব কাজ শেষ করে কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লাম আমি। গতকাল রাতে ভালো ঘুমাতে পারি নি আমি। একটু ঘুমিয়ে নিলাম।

আমার ঘুম ভাঙলো মোবাইলের রিংটোনে। মা ফোন করেছেন। তারা বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছেন। মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে উঠে গেলাম আমি। গোসল সেরে নামায পড়ে বসলাম।

কিছুক্ষণ পরই দেখলাম আমার ছোট জা এসেছে। ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা হলো। ও শাশুড়ির কথা জিজ্ঞেস করলো। রুশা আপার বাড়ি গেছে তা বললাম আমি। ও গল্পটল্প করে বিদায় নিলো।

শাশুড়ি আর ননদ সন্ধ্যা নামার পর বাড়িতে এলেন। শাশুড়ি আসার পর রুশা আপার বাসার গল্প শুরু করলেন। আমি নিরবে শুনছি। মাঝে মাঝে দুই একটা কথার উত্তর করছি। নিশি আর নিহালের দুষ্টুমি নিয়ে অনেক কথা বললেন শাশুড়ি। রুনা আপা চুপ করেই রইলেন। তিনি গোমড়া মুখেই বসে রইলেন। রেদোয়ান আসা পর্যন্ত গল্প করলেন শাশুড়ি। রেদোয়ান আসলো। সবাইকে খাবার দাবার দিলাম। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ কথা বলে ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমার ননদ আর শাশুড়ি মোট সাত দিন আমাদের বাড়িতে থাকলেন। এর মধ্যে জুলি আমাদের বাড়ি দু বার এসেছে। শান্তিও একবার এসেছিলো। আমার শাশুড়ি বেশ পরিবর্তন হয়েছেন। আগের থেকে অনেক নরম হয়ে গিয়েছেন। আগের তেজী ভাব তার শরীরে নেই। এখন ভালো করেই কথা বলেন আমার সাথে। আজ তারা চলে গিয়েছেন। রেদোয়ান তাদের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছে বিকেলে।

রেদোয়ান বাসায় আসলো সন্ধ্যায়। আসার পর থেকেই তাকে কেমন মনমরা দেখাচ্ছে। চেহারা ভীষণ মলিন। অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তাকে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে তোমার? এমন মনমরা হয়ে আছো কেন?

রেদোয়ান হকচকিয়ে গেলো। ভাবনার দুনিয়া থেকে বের হলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপই থাকলো সে। আমার কথার কোন উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে বসে থাকার পর সে বললো, আয়ু মাকে আমাদের সাথে রাখলে কি তোমার কোন আপত্তি আছে? যত অন্যায়ই করুক সে তো আমার মা। দেখেছো আমার মায়ের কি অবস্থা হয়েছে ওখানে থেকে? আমার মায়ের এই অবস্থা আমার অন্তরকে ক্ষ-ত-বি-ক্ষ-ত করে দিচ্ছে। আমার মাকে তোমার সাথে রাখবে আয়ু?

চলবে………

(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমা করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here