#দিন_বদলের_হাওয়ায় [২]
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
দুর্ভোগ যখন আসে সব দিক দিয়েই আসে, আমারও তাই। চোখের পানি আর বাঁধ মানছে না তবুও আটকে রাখার চেষ্টা করছি। পায়রা আমার দো:ষের গান শুনাচ্ছে মায়ের কাছে। মা আমার দিকে অসহায়ের মতন তাকিয়ে পায়রাকে বার বার চুপ করানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু পায়রা মানছে না। আগের পায়রার সাথে এই পায়রার কোন মিল খুঁজে পাচ্ছি না আমি। গতবার ঈদেও এই বাড়িতে এসেছিলাম তখন সবকিছু ঠিকই ছিলো কারণ তখন আমার স্বামীর চাকরি ছিলো। মোটা অঙ্কের বেতন ছিলো। এখন তো আর এসব নেই তাই কেউ কিছু বলতে দ্বিধাবোধ করে না। পায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। কি নিষ্পাপ সেই চেহারা! এই মেয়েটা আমার সামনেই ছোট থেকে বড় হয়েছে। আমার কলিজার টুকরো বোন। আজ সেই বোনই কলিজায় আ:ঘা:ত দিচ্ছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ওকে আর কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমার এই ছোট্ট মিষ্টি বোনটাকে আমি বকবো কি করে? আমার বোনটা তো তাহলে অনেক কষ্ট পাবে! ভাবলাম ভুল করছে হয়তো একদিন সে নিজের ভুল বুঝতে পারবে। তাই ওকে বললাম,
‘ তোর ননদ যে বিষয়টাকে এতো দূর গড়াবে আমি বুঝতে পারি নি রে পায়রা। আমারই ভুল হয়েছে। তোরা থেকে যা। চলে গেলে মা বাবা দুজনেই মন খারাপ করবে।’
মা অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি মাথা নিচু করে চোখের জল মোছার চেষ্টা করছি।
মা ধমকের সুরে পায়রাকে বললেন, ‘তুই তোর বড় বোনের সাথে এমন করতে পারলি পায়রা?’
পায়রা মুখ ভেংচে বললো, ‘বড় তো কি হয়েছে ভুল করলে সবারই ক্ষমা চাইতে হয়।’
ভীষণ আশ্চর্য হলাম। তবুও চুপ করে রইলাম। ভাগ্য আর আমার সহায় নয়। পায়রা চুপ হয়ে গেলো। কিন্তু পায়রা দমে গেলেও পায়রার ননদ তৎক্ষণাৎ বললো, ‘আপনি আপনার কথা দিয়ে কি বোঝাতে চাইছেন? আমার জন্য সব হয়েছে? দেখেছো ভাবি তোমার বোন কি বললো! এইজন্যই এ বাড়িতে আমি আসতে চাই নি।’
পায়রাকে উস্কে দিয়ে ওর ননদ এবার বেজায় খুশি হলো বোধহয়। পায়রা আমাকে আরো কিছু কথা শুনিয়ে ওদের ঘরে চলে গেলো। মামির ডাকে মা রান্নাঘরে গেলেন। আমি একা উঠানে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলতে লাগলাম। শাড়ির আঁচলটা দিয়ে চোখের জল মুছে রেদোয়ানের কাছে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলাম। ও ঘরে একা একা কি করছে কে জানে। দেখলাম রেদোয়ান দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি মাথা নিচু করে ঘরে চলে গেলাম। রেদোয়ানও আসলো। চোখের পানি আটকাতে পারছি না। রেদোয়ান আমার দিকে তাকিয়ে থাকায় কাঁদতেও পারছি না।
আয়ু!
রেদোয়ানের ডাকে ‘হুম’ শব্দ করলাম।
এতো বড় অপমানটা সহজেই হজম করে নিলে কেন?
ওর কথায় হাসার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘পায়রা তো বাচ্চা মানুষ। সেদিনের মেয়ে। ভুল করেছে একদিন বুঝতে পারবে। আমি তো বড় মাফ করে দিয়েছি।’
‘তাই বলে নিজে…?’
‘জানো ছোট বেলায় যখন বাবা আমাদেরকে মেলায় নিয়ে যেতো তখন না পায়রা সবসময় একটা না একটা কিছুর জন্য জেদ ধরতো। বাবা রাগ করতো খুব কিন্তু আমিই ওর জেদগুলো পূরণ করতাম। সবসময়ই তো ওর জেদ পূরণ করে এসেছি। আজ ও একটা জেদ ধরেছে তা পূরণ না করে পারি বলো?’
‘তুমি সেই জেদের সাথে এই জেদের তুলনা করছো? পাগল হলে নাকি?’
‘থাক না। যা গেছে তা তো গেছেই। এমনটা করে যদি ও খুশি থাকতে পারে তাহলে থাকুক।’
রেদোয়ান আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। কিন্তু কিছু বললো না। আমিও চুপটি করেই বসে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর রান্নাঘরে গেলাম। মা রান্না করছেন পাশেই মামি বসে আছেন। আমাকে দেখে মা বললেন,
কিছু লাগবো তোর?
আমি ছোট আওয়াজে বললাম, ‘না।’
এরপর পাশেই একটা মোড়া পেতে বসে পড়লাম। মায়ের দুই একটা টুকটাক কাজে হাত লাগালাম। মা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম, এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
আয়রা তোর এতো ধৈর্য্য আসলো কবে থেকে?
মায়ের চোখে পানি। আমি হাসলাম কিছু বললাম না। মা বললেন, ‘তোর এবার অনেক কষ্ট হইতাছে তাই না?
কিসের কষ্ট হবে?
সবদিক দিয়াই তো। পায়রার ব্যবহারে অনেক কষ্ট পাইছোছ তাই না?
না।
আমার সংসারটা কেমন জানি এলোমেলো হইয়া গেলো রে মা। আমি কিছুই বুঝতাছি না। এগুলা কি হইতাছে আমার বাড়িতে?
আমি চুপ থাকলাম। পাশ থেকে মামি বললো,’আরে তুমি কি চিন্তা করো আপা ওরা বোনরা বোনরা মুখ কালাকালি করবো আবার ওরাই ঠিক হইয়া যাইবো। টেনশন কইরো না তো।’
আমাদের কথার মাঝেই পায়রা এসে মাকে ডেকে নিয়ে গেলো। আমি আমার মতো কাজ করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর রেদোয়ান আমাকে ডাকলো। তাকে গোসলের জন্য লুঙ্গি দিতে, নামাযের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি ঘরে গিয়ে লুঙ্গি বের করে রাখলাম। এরপর নিজের একটা শাড়ি বের করে নিজেও গোসলটা সেরে নিলাম। রেদোয়ান নামায থেকে আসতেই জামাইদের খাবার দিতে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলাম। কিন্তু পায়রার ঘর থেকে পায়রার জামাইয়ের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। তিনি বলছেন, ‘রোস্টটা দারুন টেস্ট হয়েছে।’
চরম অবাক হলাম। আমার স্বামীকে রেখেই ওরা খেতে বসে গেলো। মাকে দেখলাম গোমড়া মুখ করে পায়রার ঘর থেকে বের হচ্ছে। আমাকে দেখে অসহায়ের মতন বললো, ‘তহন পায়রা ডাক দিয়া বলছে ওর জামাইর খাবার ওর ঘরে দিতে। সায়রার জামাইরও নাকি প্রচুর খিদা লাগছে। তাই সেও বইসা পড়ছে।’
আমি আর কিছু বললাম না। চুপচাপ সেখান থেকে রান্নাঘরে চলে গেলাম। রেদোয়ানের জন্য খাবার বেড়ে আমাদের ঘরে নিয়ে আসলাম। রেদোয়ান শুয়ে ছিলো। খাবার দেখে উঠে বসলো। বললো,
‘এখানে একা খাবার দিচ্ছো কেন? শাহেদ, মাহবুব ওদের সাথে দাও। ওরা কি মনে করবে বলো? নিয়ে যাও খাবার। আমি পরে ওদের সাথে খাবো।’
মানুষটার কথা শুনে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এই মানুষটাকে আমি কি করে বলি সে যাদের অপেক্ষায় আছে তারা তাকে রেখেই ভুরিভোজ সেরে ফেলেছে? আমি নির্বাক। খাবার খাটের উপর রেখে বললাম, ‘তুমি খাওয়া শুরু করো।’
সে আবারো নাকচ করে দিলো। এবার কেন জানি মেজাজটাই বিগড়ে গেলো। বললাম, ‘যারা তোমার কথা একটাবারও ভাবলো না তাঁদের কথা তুমি ভাববে কেন বলো তো? ওরা তোমাকে রেখেই খেয়েছে। তুমি এবার খাও।’
রেদোয়ান কিছুক্ষণ হা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর নিঃশব্দে খাবারের প্লেটে হাত দিলো। আমি চুপচাপ তার খাওয়া দেখতে লাগলাম। খাওয়ার সময় আর একটা কথাও বললো না সে। হয়তো কষ্ট পেয়েছে প্রচুর।
বাবা ফিরলেন বিকেলে। আমাদের নানা বাড়িতে গিয়েছিলেন বাবা। সেখানে জমি সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র ঠিক করতে গিয়েছিলেন। এসেই বাবা আমার খোঁজ করলেন। আমি বাবার কাছে গেলাম। বাবা আমার হাতে দুটো প্যাকেট দিয়ে বললেন ঘরে নিয়ে যেতে। বললো প্যাকেট দুটো ঘরে নিয়ে খুলতে। আমি তাই করলাম। ঘরে আসার সময় পায়রার ননদকে বলতে শুনলাম, ‘দেওয়ার মুরোদ নেই কিন্তু নেওয়ার বেশ ভালোই আছে।’
বুঝতে পারলাম কথাটা আমায় বলেছে। কিন্তু কেন বলেছে তা এখনো অস্পষ্ট। ঘরে নিয়ে প্যাকেটটা খুলতেই পাঞ্জাবি, লুঙ্গি আর একটা শাড়ি পেলাম। এবার পায়রার ননদের কথাটা বুঝতে পারলাম। কান্না আসছে প্রচুর। রেদোয়ান পাশেই বসে আছে। বললো, ‘কাদছো কেন তুমি?’
প্রচুর রাগ হলো। বললাম, ‘কাদছি তো তোমার জন্যই। কি দরকার ছিলো নিজের টাকা অন্যকে দিয়ে এতো মহান সাজার? তোমার জন্যই আজকে আমার এসব শোনা লাগছে। আরো মহৎ সাজো। এখন তারা দেখছে না তোমায় ভালো করে?’
আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। রেদোয়ান আর কথা বাড়ালো না। নিশ্চুপ ভাবেই আমার পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকলো। কিছুক্ষণপর ঘর থেকে বেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেলো। আমি আর জিজ্ঞেস করলাম না কিছু। এমনিতেই শরীরে রাগ আছে।
সন্ধ্যা কাটলো রাত হলো। রেদোয়ান এখনো ফিরলো না বাসায়। বাবা দুইবার এসে ওর কথা জিজ্ঞেস করে গেছে। মায়ের ফোন দিয়ে তাকে ফোন করেছি। কিন্তু মোবাইল বন্ধ। এখন চিন্তা হচ্ছে অনেক। এতো রাত হয়ে গেলো এখনো বাড়ি ফিরলো না তাহলে সে গেলো কোথায়? বিকেলে কি বেশি বলে ফেলেছি। সে যা করেছে তাই তো বলেছি। তার তো কোনো কিছুই কমতি ছিলো না। ভালো চাকরি ছিলো সাথে মোটা অংকের বেতন। সংসার চালিয়ে বেজায় আয় পড়তো। কিন্তু নিজের উপার্জনে নিজের জমানো টাকায় ছোট দুই ভাইকে বিদেশ পাঠিয়েছে। নিজের কাঁধে ভর করে এতো দিন সংসারটা চালিয়েছে। আর যখন চাকরি চলে গেলো তখন তার সহায় কেউই হলো না। সবাই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে লাগলো। এটা বলাটা কি আমার অপরাধ হয়েছে নাকি?
বেশ করেছি বলেছি। মনে মনে নিজেকে শান্তনা দিতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পর রেদোয়ান আসলো। এসেই আমাকে বললো, গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে নাকি শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে দেখলাম। হেডস্যারের সাথে কথা বলে এসেছি।আগামীকাল বাড়ি গিয়ে নিজের সি.ভি. নিয়ে আসবো। যদি চাকরিটা হয় আরকি!’
‘এখানে চাকরি হলে থাকবে কোথায়?’
‘দেখি বাসা ভাড়া করে থাকবো। আগে হোক তো!’
ভীষণ কষ্ট হলো। নিশ্চয়ই মানুষটা আমার কথায় কষ্ট পেয়েছে। তাই তো আবার বের হলো চাকরির খোঁজে। আমি আর কিছু বললাম না। যদি চাকরি হয় তবে তো ভালোই। আমাদের দুজনের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে পারলেই হলো।
রাতের খাবারও পায়রা তার রুমে নিয়েই খেয়েছে। শাহেদ, বাবা আর রেদোয়ান একসাথে খেয়েছে। রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানায় গড়াগড়ি দিলাম মাত্র। চোখে ঘুম এসে গিয়েছিলো প্রায় কিন্তু হঠাৎই শুরু হয় বৃষ্টি। টিনের চালের ফুঁটো অংশ দিয়ে পানি ঘরের ভিতর আসছে। বিছানাসহ পায়ের দিকের অংশটা পানিতে ভিজে যাচ্ছে……
চলবে…..
(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমা করবেন।)
Next Part : https://www.facebook.com/100084809503127/posts/122284203941896/?app=fbl
এই রকম আরও গল্প পেতে পেইজটি Like এবং Follow করে পাশে থাকুন। #অবসেনツ