ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ০৫ #আসেফা_ফেরদৌস

0
209

#ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ০৫
#আসেফা_ফেরদৌস

ছেলেটা চলে যাবার সময় ফয়সাল মল্লিকা এলো এগিয়ে দিতে। করমর্দনের পর ফয়সাল বলল, জানি না আর কখনো দেখা হবে কিনা, তবে যেখানে যেভাবেই থাকো, ভালো থেকো আরফান!
আরফান আড়চোখে তাকাল মল্লিকার দিকে, মেয়েটার চেহারায় স্পষ্ট লেখা, প্লিজ এখানে, এভাবে, আর এসো না!
এরপর একটু হেসে ও বলল, ভালো থাকবেন ফয়সাল ভাই, আপনাদের জীবন সুখের হোক।
ফয়সাল তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে আলতো হাসি।
এমন সময় ঘরে এসে ঢুকল শামীম, মল্লিকার উদ্দেশ্যে বলল, খালামনি খালু কাছাকাছি চলে এসেছেন ভাবি, জানেন তো, আজ বিকেলে ছাদে ফুচকা পার্টি হবে।
আরে তাই নাকি? জানতাম না তো, ভীষণ মজা হবে তাহলে! ফুচকা কি খালামনি নিয়ে আসছেন? মল্লিকার কন্ঠে একটু যেন উচ্ছ্বাস
-হ্যাঁ তবে ছোটো ভাইয়ার রিকোয়েস্টে, আপনি ফুচকা খেতে ভীষণ ভালোবাসেন না, সেজন্যই আরকি!
মল্লিকা লজ্জা পেয়ে গিয়েছে, ফয়সাল যদিও নিশ্চুপ।
-ভাবি আপনি ঘরের গোছগাছটা একটু দেখুন, আমি আর ছোটো ভাইয়া ছাদে যাচ্ছি, ফাইজাও সেখানেই।
-জি, জি।
আরফান তাকিয়ে আছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না, এখানে সে কতটা অবান্তর। একটু অপেক্ষা করে ও বলল, আচ্ছা, ফয়সাল ভাই, আসছি।
ফয়সাল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, মল্লিকা তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। দেখতে দেখতেই ছেলেটা বেরিয়ে গেল।
বিকেলের শেষ প্রহর।
ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। সোমা খালা, খালু, ছোটো মামা, ফয়সাল, ফাইজা, শামীম সবাই আছে। মিসেস রেবা অবশ্য এ মুহূর্তে এখানে নেই, বাসায় গিয়েছেন। একটু পরেই চা খেতে নিচে নামবে সবাই, সন্ধ্যায় আবার হালকা নাশতার সাথে পুরোদমে আড্ডা হবার কথা। ফয়সালকে গান করার জন্য খুব করে ধরেছে শামীম, ছেলেটা যদিও রাজি হচ্ছে না।
ওর এক কথা, গাওয়া হয় না অনেকদিন, প্র্যাকটিসও নেই, এমন গলায় ভালো গান সম্ভব না।
মল্লিকা একটু দূরে দাঁড়ানো, সবার হাসি, আনন্দ, হৈচৈ দেখছে। এতক্ষণ মেয়েটাও একসঙ্গে বসে আড্ডা দিয়েছে। ও আর ফাইজা বসে আড্ডা দিচ্ছিল একপর্যায়ে মাথাব্যথার কথা বলে উঠে এসেছে মল্লিকা, সরে আসার সময় ফয়সালের সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে একবার,‌ কিন্তু কথা হয়নি। মল্লিকার মন জুড়ে অদ্ভুত বিষন্নতা, কিছুই কেন যেন ভালো লাগছে না!
মেয়েটা ভাবছে, আজ এতবছর পর কেন এভাবে অন্তরের সঙ্গে দেখা হলো? কেন মনটা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে! কত কথা, কত স্মৃতি, হাসি, কান্না, প্রেম, দীর্ঘশ্বাস, না পাওয়ার বেদনা, সেই প্রথম দিনের দেখা, কিংবা শেষ দিনের কান্না, এক এক করে মনে পড়ছে সবই, তাছাড়া, অন্তরের এলোমেলো জীবন, উদ্ভ্রান্ত চেহারা, যেন অন্য এক হাহাকারকে উস্কে দিয়ে গেল। সেদিন ছেলেটার অনুরোধ রাখলে আজ জীবনে সুখের সংজ্ঞা অন্য রকম হতো কি? জানা নেই! সত্যিই জীবনে কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলা ভার, কষ্টের কিছু গল্প বোধহয় আজীবনেও ভোলা যায় না!
আপন ভাবনায় হারিয়ে গিয়েছে মল্লিকা, এমন সময় মুকুল ছুটে এসে গায়ের উপর পড়ল। ওর হাতে একটা ব্যাডমিন্টন রেকেট, যার ধাক্কায় ব্যথা লাগল বেশ!
মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। মুহূর্তেই মল্লিকা ধমকে উঠে বলল, মুকুল! সবসময় এত বাড়াবাড়ি কেন? সারাক্ষণ দৌড়ঝাঁপ! দেখছ মার শরীরটা ভালো নেই, বললাম তোমাকে আমি, সাইকেলের বেল না বাজাতে, জোরে সাইকেল চালিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি না করতে! তোমার জন্য মিনি ভয় পেয়ে কান্না জুড়েছে, ফুপি সামলাতে পারছে না! তারপরও তুমি সমানে সাইকেলের বেল বাজিয়ে হৈচৈ করছ! এতো জোরে সাইকেল চালিয়েছ এতক্ষণ, এখন আবার ছুটোছুটি, সুযোগ পেলেই মিনিকে ভয় দেখাচ্ছ, কথা শোনো না কেন?
বোকা মিনিটার বুদ্ধি নেই মা! সাইকেলের বেল আর সামান্য হৈচৈ শুনলে কে ভয় পায়! আজ আমাদের বাসায় এত আয়োজন, এটুকু হৈচৈ না করলে কি চলে বলো?
ব্যাস! যথেষ্ট হয়েছে! এবার যা বলেছি শোনো, চুপচাপ গিয়ে দাদাভাইদের সঙ্গে বোসো তো, তোমার হুড়োহুড়িতে আমিও ব্যথা পেলাম!
মা শোনো না!
বলো শুনছি।
একটা মাত্র, একটা রিকোয়েস্ট!
বলো।
ঐ যে পেস্ট্রিগুলো ফ্রিজে রাখা আছে না, সেখান থেকে একটা খাই?
না! এর মধ্যে দুবার খেয়েছ তুমি, ওগুলো সবার জন্য আনা হয়েছে বাবা, সন্ধ্যায় যখন নাশতা দেয়া হবে তখন খেয়ো, এখন না।
প্লিজ মা! মাত্র এক পিস খাব!
না, মুকুল!
প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ!
কথাটা শোনো বাবা,
না শুনব না!
মুকুল! মুখে মুখে তর্ক করবে না!
ঠিক আছে! আমি নিচে যাচ্ছি, দাদুকে বললেই খেতে দেবে। তোমার দরকার নেই!
মল্লিকার মেজাজটা এমনিতেই খারাপ ছিল, কথাটা শুনতেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো ছেলের গালে।
মুকুল ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছে। রাগ করে বলল, তুমি আমাকে একটুও আদর করো না মা, সবসময় শুধু মারো!
বলতে গেলে ছুটে এসেছে ফয়সাল। স্নেহভরা কন্ঠে বলল, কী হয়েছে মুকুল?
বাবাকে জড়িয়ে ধরে একটু ধরা গলায় ছেলেটা বলল, মা মেরেছে!
কেন?
আমি পেস্ট্রি খেতে চেয়েছিলাম সেজন্য।
বাবা, ছোটো মামা, খালামনি, খালু সবাই আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছেন।
ফয়সালকে দেখে মনে হলো ও বেশ কষ্ট পেয়েছে। বিস্মিত চেহারায় তাকিয়ে দেখছে সে মল্লিকাকে। একপর্যায়ে বেশ একটু রেগে গিয়ে বলল, আবার হাত তুলেছ তুমি ওর গায়ে, নিষেধ করেছিলাম না?
এ পর্যন্ত দুবার পেস্ট্রি খেয়েছে। আবার খেতে চাইছে, বললাম, সন্ধ্যায় খেয়ো, না তাকে এক্ষুনি দিতে হবে। আমার একটা কথা শুনতে চায় না!
এবার ফয়সাল ফিরল মুকুলের দিকে। হাঁটু গেড়ে বসে ছেলেকে দু হাত ধরে বেশ একটু আদর করে বলল, মুকুল বাবা, মা যা বলে, তোমার ভালোর জন্যই বলে, কথা শুনবে কেমন, বেশি মিষ্টি খেলে দাঁত ব্যথা হবে, কষ্ট পাবে তুমি!
আমি একটা মাত্র পেস্ট্রি খেতে চেয়েছিলাম!
তুমি তো দুবার খেয়েছ!
মুকুলের মুখটা ছোটো হয়ে গেল। বাবার যুক্তিটা পছন্দ হয়নি সম্ভবত।
ফয়সাল হাসছে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। সন্ধ্যায় যখন আমরা সবাই খাব তখন খেয়ো, আমার সঙ্গে খেয়ো তুমি লক্ষ্মী বাবাটা! এখন নিচে যাও। গিয়ে দেখো তো, দাদু আসতে আর কতক্ষন লাগবে? আমিও আসছি একটু পর, যাও।
মুকুল বেরিয়ে যেতেই উঠে‌ দাঁড়াল ও। মল্লিকাকে বলল, ছেলেকে যদি তুমি সামলাতে না পারো, আমাকে বলবে! কথায় কথায় বাচ্চাদের সঙ্গে মেজাজ দেখানো কিংবা গায়ে হাত তোলা কোনো ভালো অভ্যাস না, এবং আমি এটা পছন্দ করি না!
আজ তো আমি সামনেই ছিলাম, তোমার মেজাজ খারাপ থাকলে পাঠিয়ে দিতে আমার কাছে, গায়ে হাত তুললে কেন?
মল্লিকা উত্তর দিতে পারছে না। সবসময় সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায় না। গত দু তিনদিনের ঘটনা প্রবাহ, আজ অন্তরের এ বাড়িতে আসা, তার উপর বাড়িতে এত কোলাহল, মুকুলের বাড়াবাড়ি সবকিছু মিলে মনের অবস্থা এ মুহূর্তে কেমন তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়! ও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
ফয়সাল বলল, নিজের ব্যবহারে আমাদের প্রতি একটু মায়া মমতা আনার চেষ্টা করো মল্লিকা, সবসময় তোমার আচরণের এই বাড়াবাড়িটাও নেয়া যায় না! ওর কন্ঠে স্পষ্ট রাগ।
কথাটা বলে আর দাঁড়াল না সে, হনহন করে বেরিয়ে চলে গেল।
একটু পর খালামনি বললেন, দ্যখো তো কী হলো ব্যাপারটা! কত হাসিখুশি পরিবেশ ছিল, হুট করে তুমি মুকুলকে মারতে গেলে কেন মল্লিকা? ফয়সাল কষ্ট‌ পেয়েছে ভীষণ! না, না, বউমা, বাচ্চাদের গায়ে এভাবে হুটহাট হাত তুলতে নেই! আর এমন ঘরভর্তি মেহমানদের সামনে তো মোটেও না, এসব ঘটনা শিশুমনে বিরূপ প্রভাব ফেলে!
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। লজ্জা লাগছে ভীষণ, মুরব্বিরা কেউ আর কোনো কথা বললেন না। ফাইজা মিনিকে নিয়ে একটু দূরে সরে গেল, শামীমও হাঁটতে শুরু করেছে। হঠাৎ করেই থমথমে হয়ে গেছে অবস্থাটা!
ভেতরে ভেতরে মল্লিকা বলতে গেলে হতভম্ব, ফয়সালের মেজাজ খারাপ হলে সে সবসময় একা ডেকে নিয়ে কথা বলে। সবার সামনে এভাবে কখনো সিন ক্রিয়েট করে না! অথচ আজ বাবা, মামা, খালা, খালু,‌ শামীম, ফাইজা সবার সামনে এমনভাবে কথাটা বলল যেন মল্লিকা সবসময়ই ফয়সাল আর মুকুলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে! এমন মারাত্মক কিছু তো হয়নি, তাহলে কথা নেই বার্তা নেই ও এভাবে রিঅ্যাক্ট করল কেন, ঘটনা কী!
দুদিন পর।
সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। নিজের রুম গোছাচ্ছে মল্লিকা। মুকুল রনিদের বাসায় গিয়েছে অনেক্ষণ, এক্ষুনি চলে আসবে হয়ত, তছাড়া, ফয়সালেরও আসার সময় হয়ে এসেছে।
আকাশের অবস্থা ভালো না আজ, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, চারদিক আঁধার করে মেঘ ডাকছে বারবার। মেয়েটা ফয়সালকে ফোন করে জলদি ফিরতে বলেছে বাসায়। এরকম আবহাওয়া ওর ভালো লাগে না, ভয় লাগে কেমন যেন। তার উপর আজ বিকেল থেকেই মনটা খচখচ করছে।
আসলে প্রায় তিনদিন হয়ে গেল ফয়সালের সাথে ওর ঠিকমতো কথা হয় না।
না কোনো মান অভিমানের জন্য নয়, পরিস্থিতিই এমন যে বসে আড্ডা দেয়া সম্ভব হয়নি। বাসায় অনেক কাজ! ফাইজা, শামীম, মিনি, ছোটো মামা সবাই আছে। সবার যত্নআত্তি, রান্নাবান্না, সঙ্গ দেয়া আরও হাজার রকম ব্যস্ততা! তাছাড়া, মিনি বাচ্চামানুষ, ওর দিকে একটু বেশি নজর দিতে হয়। ফাইজা বলতে গেলে মেয়েকে নিয়ে সারাদিনই ভাবির পেছন পেছন ঘোরে। এরমধ্যে আপু দুলাভাই কুয়াকাটা থেকে ঘুরে এসেছে,‌ মৌনী আপুর মুখে সারাক্ষণ সেই গল্প, কত সুন্দর সুন্দর সব ছবি। তাছাড়া, দু তিনদিনের মধ্যেই মল্লিকার কাজিনদের একসঙ্গে গেট টুগেদার হওয়ার কথা, ওখানেও যাওয়া হবে না হয়ত! কেননা, আগে থেকেই ফয়সাল সেদিন সবাইকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাওয়ার প্ল্যান করে রেখেছে।
সবমিলিয়ে মনটা বেশ খারাপই, এরমধ্যে কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ করে অন্তরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, ভীষণ মন খারাপের মধ্যে এমন অতীত সামনে এসে দাঁড়ালে মন ওলটপালট হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
এতকিছুর পর ঐদিন বিকেলে ফয়সাল যেভাবে রিঅ্যাক্ট করেছে এককথায় পুরো পরিবারের সামনে মল্লিকাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বদরাগী মায়ের তকমা দিয়ে দিয়েছে সে। আগপিছ ভেবে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। তবে ওভাবে সবার সামনে মুকুলের গায়ে হাত ওঠানোটা সম্ভবত ফয়সালকেও কষ্ট দিয়েছে ভীষণ। তাই ছেলেটা নিজের মতো আছে।
আজ দুদিন থেকে মল্লিকার পেছন পেছন ঘুরঘুর করে না ফয়সাল, যখন তখন ডেকে এনে গল্প জুড়ে দেয় না। সন্ধ্যার আড্ডায় সবার সঙ্গে এসে যোগ দেয়ার জন্য একটু পর পর এসে তাড়া দেয় না, কথায় কথায় মল্লিকার সঙ্গে ঠাট্টা করে না! তবে ওদের মধ্যে ঠিক মান অভিমান চলছে তা না, বলা যায় অদ্ভুত এক ধরনের স্থবিরতা জন্ম নিয়েছে। যে স্থবিরতাটা কাটাবার ইচ্ছে বা প্রচেষ্টা দুজনের মধ্যে কারোরই এবার নেই!

চলবে
কেউ লেখা কপি করবেন না।

আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1508207529694269/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here