শুভ্রময়_পু্রঁজন পর্ব_৯

0
298

#শুভ্রময়_পু্রঁজন
পর্ব_৯
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

৯.
ইউসরা ডান হাতের কনুই টেবিলের উপর রেখে তালুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। অন্য হাতটি টেবিল জুড়ে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পরে থাকা অনার্সের বইয়ের উপর বিচরণ করছে। তার মধ্যে মুখ বাড়িয়ে আছে একটা-দুটো সপ্তম শ্রেণীর বই। সে দানীনের রুমে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে। দানীন কোথায় যেনো গিয়েছে।
ফারিহ একটু পরপর এসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দাঁত কেলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইউসরার চোখ রাঙানোতে ধারে ভিড়তে পারছে না। অবশেষে ফারিহ লম্বা লম্বা পা ফেলে ইউসরার কাছাকাছি আরেকটা চেয়ার টেনে বসলো।
“ইউসরা বেবি।”
ইউসরা একই ভঙ্গিতে বসে চোখ রাঙিয়ে বললো,
“বেবি মানে? নিজের বাচ্চা মনে হয়? আব্বা ডাকবো?”
ফারিহ থতমত খেয়ে গেলো। নিঃশ্চুপ হয়ে অন্যদিকে মুখে ফিরিয়ে নিলো।

ইউসরাই কিছুক্ষণ পর আহ্লাদী কণ্ঠে ডেকে ওঠলো,
“ফারিহ ভাইয়া, ওওও ফারিহ ভাইয়া।”
ফারিহ এবার ঘেঙচানো মুখমণ্ডলে বললো,
“হাঁহ, এখন ফারিহ ভাইয়া ফারিহ ভাইয়া। কেন মনা? এখন আব্বা ডাকো।”
“এমন করো কেন? শুনো না।”
“কি শুনবো?”
“এই যে তোমার একটা শান্তশিষ্ট, হৃতমান বোনটি প্রেম নামক টয়লেটের টাংকিতে ডুম্বুস করে পড়ে হলো। কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই?”
ফারিহ হাই তোলার ভঙ্গি করে বললো,
“মেয়ে বড় হয়েছে। প্রেম করবে। মনে অতিরিক্ত আনন্দ কুতকুত করলে বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবে। বগলে কলা নিয়ে বানরের মতো এক গাছ থেকে অন্য কাছে ঝুলাঝুলি করবে। আমাদের বাচ্চাদের তাতে কি?”
ইউসরা অবাক গলায় বললো,
“এতো প্রতিভাসম্পন্ন একটি মেয়ে প্রেম নামক লেইম একটা সম্পর্ক করে বেড়াবে? আপু শুধু পড়াশোনাই অসাধারণ। অন্যান্য ক্ষেত্রে চরম গর্দভ। আশ্চর্য! আপুর মতো একটা মেয়ে কি না প্রেম করবে। প্রেম কি ভালো মানুষজন করে? আর ঐ লোকটাও একটা..”
এতটুকু বলে ইউসরা থেমে গেলো।
ফারিহ দুই ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো,
“ঐ লোকটা কি?”
ইউসরা কিছু বলার পূর্বেই দানীনের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“তাই তো তাড়াতাড়ি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছি।”
কণ্ঠ অনুসারে দরজার দিকে ইউসরা ও ফারিহ তাকালো। দানীন দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে আজ হাসির ঝলক ঝিলিক দিয়ে ওঠছে। দানীন ঘরে প্রবেশ করে বিছানায় গিয়ে বসলো।
ইউসরা চেয়ার থেকে উঠে তার পাশ ঘেঁষে বসে বললো,
“তুমি ব্রেক-আপ করো আপু। ঐ ছেলেটা ভালো না।”
ফারিহ তাকে বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,
“ভালো না তা তুমি কিভাবে জানো? তোমার মামা লাগে মাহবুব ভাই?”
ইউসরা ফারিহ’কে কিছু বললো না। কয়েক সেকেন্ড ঠোঁট কামড়ে নিঃশ্চুপ থেকে অনুচ্চ স্বরে বললো,
“চেহারা দেখলেই বুঝা যায় কে কিরকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।”
ফারিহা এগিয়ে এসে কোমরে করতল ঠেকিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, তুমি তো এক্স-রে মেশিন। মানুষের ভিতরের সব বুঝে ফেলো।”
ফারিহ মাথাটা ঝুঁকিয়ে বললো,
“দেখো তো ইউসরা, আমার মাথায় কয়েকটা উকুন হয়েছে। তোমার এক্স-রে মেশিন দিয়ে চেক করে দেখো তো কোনটা কি লিঙ্গ। সম্ভবত মেয়েগুলোই বেশি কামড়াছে। দেখো তো তোমার রিপোর্টের সঙ্গে আমার মতামত মিলে কি না।”
ইউসরা বিছানার উপর থেকে বালিশ নিয়ে ফারিহ’র মুখে সজোরে মারলো।
“আগে মাথার এই পোকামাকড়ের বাসা নিয়ে সামনে থেকে দূর হও। আর ছেলে উকুনই কামড়াছে। ছেলেদের তো একমাত্র কার্যকলাপই এসব কামড়া-কামড়ি করা। যেমন এই মাহবুব ছাহবুব দানীন আপুকে কামড় মেরেছে।”
দুজন তুমুল ঝগড়া করে ঠোকাঠুকি করার পূর্বেই দানীন থামিয়ে দিলো।
ইউসরাকে পাশে টেনে বসিয়ে আহ্লাদি স্বরে বললো,
“মাহবুবের উপর বাচ্চাটার এতো রাগ? ব্রেক-আপই করে ফেলতে হবে?”
ইউসরা বাচ্চাদের মতো মাথা হেলিয়ে অভিমানী স্বরে বললো,
“হুম। লোকটাকে দেখে আমার মোটেও ভালো লাগে না।”
ইউসরাকে আরও কাছে টেনে প্রশ্রয়পূর্ণ কণ্ঠে বললো,
“শোন ইউসরা, মানুষ কি রকম তা তার মুখ পর্যবেক্ষণ করে বিচার করা যায় না। মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুঁটে উঠে তার দ্বারা সম্পাদিত কর্মের দ্বারা। অনেক রূপবান মানুষও তার কর্মের দ্বারা সবচেয়ে নোংরা মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার কুৎসিত দেখতে যেমন এসিড, আগুনে ঝলসে যাওয়া মানুষ তার কর্মের দ্বারা হাজার হাজার মানুষের হৃদয় জয় করে। অন্তর বশীভূত করে। বুঝলি? বাহ্যিক গঠন ও রূপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখায় অতি নগণ্য।”
ইউসরা মাথা ডান-বামে হেলিয়ে বললো,
“জানি না আমি, কিচ্ছু জানি না।”
ফারিহ ভেঙচি কেটে বললো,
“এখন কিছু জানে না।”
তখনই দানীনের জেসমিন ফুফু এলো। এসেই সবাইকে ধমকা-ধমকি করে ওঠলো,
“এই তিনটা একসঙ্গে থাকলে সারা দুনিয়ার গল্প নিয়ে বসে। দানীন তুই তাড়াতাড়ি তৈরি হতে যা তো। নাকি যাওয়ার ইচ্ছে নেই? আর ফারিহ তোকে যেনো বারবার ডাকতে না হয়। এক্ষণই আয়।”
দানীন মিষ্টি হেসে মাথা হেলিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, আসছি ফুফু। দুই মিনিট অপেক্ষা করো।”
ফুফু চলে গেলে ফারিহও তার মায়ের পিছন পিছন যাওয়ার জন্য দাঁড়ালো।
দানীন ইউসরার গাল টিপে বললো,
“তোর গালগুলো এতো মোলায়েম কেনরে ইউসরু? একদম তুলোর মতো তুলতুলে।”
ফারিহ এই কথা শুনে নিজের দুই গালে হাত ঠেকিয়ে মৃদু চিৎকার দিয়ে ওঠলো। টেনে টেনে বললো,
“ও-ও মা-ই-ই গ-গ-ড! এমন শলা চিংড়ির মতো দেহ, আহারে অনিহায় বুক-পিঠ চিতল মাছের মতো একসঙ্গে চ্যাপ্টা হয়ে লেগে যাওয়ার মতো মেয়ের গাল মোলায়েম? এর গাল তো হওয়ার কথা চুলোয় পুড়ে যাওয়া খর্খরে রুটির মতো।”
ইউসরার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে জিগ্যেস করলো,
“গালে কি মাখো ইউসরা বেবি? গোলাপ জল? গোলাপ জলের শ্রমে তোমার কাঁঠালের পিঠের মতো বন্ধুর কপোল এরূপ তুলতুলে?”
দানীন ফিক করে হেসে ফেললো। ইউসরা তার ‘খাইয়া ফেলমু’র মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপণ করে ফারিহ’র দিকে তেড়ে গেলো দানীন তাকে ধরে আটকালো। দানীনের বাহুবন্ধী হয়ে সে ফারিহ’র দিকে কটমট করে তাকালো।
তার কিছু ভালো লাগছে না। আজ তার বড্ড অগোছালো লাগছে। এতো রাগ উঠছে কেন উঠছে জানে না। শুধুই কী দানীন আপুর সম্পর্কের জন্য? সে বুঝতে পারছে না।

দানীন ফারিহ’র বাহুতে চাপড় মেরে বললো,
“যা তো তুই। বেচারীর পিছনে সবসময় লাগিস। যা গিয়ে রেডি হ। নাহলে তোকে ফেলে চলে যাবো কিন্তু।”
ফারিহ ইউসরার গালে তর্জনী আঙ্গুল দ্বারা গুঁতো মেরে তড়িৎ গতিতে রুম ত্যাগ করলো।
“ঐ! বেয়াদপ ছেলে!”
“হয়েছে ইউসরু, আর ঝগড়াঝাটি না। আমার কথা শোন।”
ইউসরা মুখ গুমর করে বললো,
“বলো বলো। তখন থেকে তো বলেই যাচ্ছো।”
দানীন এবার হুট করেই বিস্ময়কর একটা তথ্য শুনালো।
“মাহবুবের পরিবার আজকে আমাকে দেখতে আসবে।”
ইউসরা হতবিহ্বল হয়ে গেলো। পরক্ষণেই চিৎকার করে ওঠলো,
“হোয়াট! দেখতে আসবে? ঘটনা তবে এতোদূর অবধি গিয়েছে? বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তবে?”
“এখন শুধু আংটি বদল। এই যে সারাদিন ঘেনর ঘেনর করে প্রেমের অপকারিতা সম্পর্কে শুনাচ্ছিস, এই তোর জন্যই কিন্তু তাড়াতাড়ি আংটি পাংটির কার্যক্রম সম্পূর্ণ করা হচ্ছে।”
ইউসরা দানীনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
“যাক, এতক্ষণে তবে অধরে হাসির দেখা মেললো। আচ্ছা, এবার তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। তুইও আমাদের বাড়িতে যাচ্ছিস।”
ইউসরা মন খারাপ করে বললো,
“কিন্তু আম্মু তো রাজি হবে না। আম্মু রাজি হলেও আব্বু জীব্বনেও দেবে না।”
“তোর আব্বু-আম্মু ইতিমধ্যে রাজি হয়ে আছেন। যখন বললাম আমার সঙ্গে তোকে নিয়ে যাবো তোর বাপ লাফিয়ে উঠে বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ মা নিয়ে যাও।”
“কিহ! ওয়েট আমি এক্ষণই তৈরি হয়ে আসছি।”
বলেই উঠে দৌঁড় লাগালো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here