শুভ্রময়_পুরঁজন পর্ব_১০

0
223

#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_১০
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

১০.
দানীন শাড়ি কোলে নিয়ে বসে আছে। দিলরুবা খাতুন নাকিদের বউ থেকে খয়েরি রঙের একটা শাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। নাকিদের বউ অর্থাৎ দানীনের ভাবী এসেই ইনিমিনি করছে। তার নতুন ভাঁজ ভাঙা শাড়ি। ভাঁজ ভেঙে একবার মাত্র গায়ে জড়ানো হয়েছে। তার সঙ্গে সান্ত্বনামূলক বাণীও আওড়াচ্ছে যে এই শাড়িতে দানীনকে বেশ লাগবে। আবার তার এই কালো রঙে মানানসই।
তার মা শাড়ি পরিয়ে দিতে উদ্যত হলে দানীন শাড়ি ঠেলে সরিয়ে দিলো।
“আমি এই শাড়ি পরবো না।”
“ওমা! কিল্লাই পরবি না?”
“কারণ বিশ্লেষণ করতে পারবো না মা। পরবো না বলেছি মানে পরবো না।”
দানীনের ভাবী দানীনের উদ্দেশ্যে ঠেস মেরে বললো,
“এতো চেতা ভালো না দানীন। মেয়ে মানুষের শরীরে এতো বিষ মানায় না। এক তো গায়ে গতরে কালো। বিয়া হবে তারও ঠিক নাই। তাই মাথা একটু নীচা করে রাখাই ভালো।”
দিলরুবা খাতুনের চট করে মাথাটা গরম হয়ে গেলো। ইচ্ছে করছে তার ছেলেকে ডেকে এনে গালে চড়-থাপ্পড় দিয়ে লাথি মেরে বের করে দিতে। ছেলেটাও বউ পেয়ে জানোয়ারে পরিণত হয়েছে। এই মেয়েলি ছেলেকে হাতে চুড়ি পরিয়ে বউসহ বিদায় করতে পারলে ঘরের পূর্ব শান্তি ফিরে আসতো। অবশ্য দোষ তারই। ছেলেকে সুশিক্ষা দিতে পারেননি। মানুষের রূপে জন্ম দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানুষ করতে পারেননি। দুধে-ভাতে রেখে মস্তিষ্ক জমিয়ে ফেলেছেন। চিন্তাভাবনা, মন-মানসিকতা তাই উন্নত হওয়ার বদলে নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
আর দানীনটা, ছোটবেলা থেকে এই গায়ের রঙের জন্য আজাইরা মানুষের নানা আজাইরা কথা শুনে এসেছে। নানা ঔষধপত্র, ক্রিম, এমনকি কবিরাজের কাছে গিয়ে বিশ্রী উপায়ে শরীর ফর্সা করার পরামর্শ দিতেও পিছপা হয়নি। বিন্দুমাত্র লজ্জিত হয়নি। মাঝেমধ্যে দানীনের উপর ঐসব মানুষের সেই রাগ দেখাতো। কিন্তু মানসিক কষ্ট ও অত্যাচার মেয়েটিকে বিগ্রে দিতে পারেনি। সুষ্ঠু সমাজ নামক বিকৃত সমাজের খারাপটা বর্জন করে ভালোটা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে সে। এই মেয়েটিকে দিলরুবা খাতুন অন্যান্য ছেলেমেয়ে থেকে একটু বেশিই ভালোবাসেন।

দানীন তার ভাবীর উদ্দেশ্যে মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
“কালো হলেও যার তার কাপড় আমি গায়ে নিই না ভাবী। আসলে হয়েছে কি, এখন অবধি যতো ত্বকের রোগী দেখেছি যেমন– দাদ, পাঁচড়া, একজিমা, চর্মরোগ সবই তোমার মতো এরূপ ধবধবে ফর্সা। তারা অতি সুন্দরের ঠেলায় ঠিক মতো গায়ে সাবানও মাখে না। চূড়ান্ত খাইশটা মেয়েলোক! আমরা তো কালো তাই শরীরের যত্নও নিই বেশি। এইজন্য ফকফকে সাদা মানুষের জিনিসপত্র ধরতে নাক ছিটকাই। তুমি আবার রাগ করো না কিন্তু ভাবী।”
দানীনের ভাবী কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই দানীনের সুরাইয়া খালা দরজার নিকট হতে খেঁকিয়ে উঠলেন,
“তুমি তোমার ঘরে যাও তো। মা-মাইয়ার কথার মাঝে তোমার হান্দানের কি দরকার? কাপড়ের অভাব পড়লে লইয়া যাও। এই দানীন দিয়া দে তো। কাপড় ছুইড়া মার।”
সবাইকে অবাক করে দানীনের ভাবী গলাবাজি করে ঝগড়া-বসচা না করে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো।
দিলরুবা খাতুন ভ্রু সঙ্কুচিত করে তার বোনের উদ্দেশ্যে বললেন,
“এসব কওনের কি দরকার আছিলো? এখন হুদাই এই ছেরি ঘরে অশান্তি করবো।”
“করলে করবো। এসব বউরে বিয়ার পরপরই টাইট দিতে হয়। বেলাইনে কিছু কইলেই তাওয়া গরম করে পাছায় লাগায় দেওন দরকার।”
“এখন কি পোলার বউরে পিটাইতে বলতাছো?”
“বউ যদি মানুষ হয় তইলে তো পিটাইয়া মানুষ করন লাগে না। বিয়া হইতে না হইতেই জামাইডারে নিজের সম্পত্তি মনে করে। যেনো নিজে কষ্ট কইরা কো কো কইরা হাসপাতালের বেডে হুইয়া পয়দা করছে। ছেরির ঘরে ছেরি! নিজের ভাইগো বেলা তো বত্তিরিশ আনা বুঝোস! ভাইয়েরে এক্কেরে ভিত্তে ভইরা রাখোস। পারলে ভাইয়ের বউরে নিজে তালাক দিয়া দেস। বেশরম! বেলাজা! আমানুষের জাত!”
দিলরুবা খাতুন বিরক্ত হয়ে বোনের দিকে তাকালেন। আর দানীন তার খালার কথা শুনে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। হাসতে হাসতে চোখের কোণায় জল চিকচিক করছে। মেয়েটির হাসি অনেক। অল্প কিছুতেই হেসে কুটিকুটি হয়ে যায় যেনো সল্প সময়ের পরিসরে বারবার হেসে উঠা জানান দেয় তার মতো সুখকর জীবন আর কেউ যাপন করে না। তার এই হাসিটি এভাবেই সবসময় রক্ষিত থাকুক।
“হইছে, তোমারে আর হাইসা খালার লগে তাল মিলাইতে হইবো না। তাড়াতাড়ি তৈওর হও। এদিকে আহো।”
“উহু, আমি তোমার শাড়ি পড়বো।”
দিলরুবা খাতুন রাগান্বিত স্বরে তাকে ডেকে ওঠেন,
“দানীন!”
“আহ! তোরটা পরবার চাইছে পরাবিইনা।”
বোনের কথা উপেক্ষা করে দিলরুবা খাতুন শাড়ির ভাঁজ ভাঙতে ভাঙতে বললেন,
“আইজ পইরা নে।”
দানীন হঠাৎ ঠোঁট উল্টিয়ে অশ্রুমোচন কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“আমি খুব নার্ভাস মা। মনে হচ্ছে তোমার শাড়ি গায়ে দিলে সব ভালো হবে। অন্যথায় সব খারাপ হবে।”
মেয়ের এরকম বাচ্চামী কথা শুনে দিলরুবা খাতুন হেসে দিলেন। কপালে চুমু খেয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“কিছুই হইবো না। আল্লাহ যা করবো ভালোর জন্যই করবো। আল্লাহ ভরসা।”
অবশেষে দানীনকে তার ভাবীর শাড়িই পরিধান করে তৈরি হতে হলো।
ইউসরা আর ফারিহ তাকে দেখে উল্লাসিত হয়ে চিৎকার করে ওঠলো।
ফারিহ আমোদজনক কণ্ঠে লাফাতে লাফাতে বললো,
“ইউ আর লুকিং সো গর্জিয়াস কিউটু।”
পরক্ষণেই আফসোসের স্বরে বলে ওঠলো,
“এখন মনে হচ্ছে ইউসরার সঙ্গে সহমত হওয়ার দরকার ছিলো। এই কিউটু, তুমি মাহবুব ভাইকে ছেড়ে আমাকেও তো বিয়ে করতে পারো।”
ইউসরা কোমরে হাত ঠেকিয়ে দুই ভ্রুয়ে ঢেউ খেলিয়ে বললো,
“হাঁহ! তোমায় বিয়ে করার থেকে ঐ মাহবুব ভাইকে বিয়ে করা অনেক ভালো। তোমার মতো সাদা পাংখাওয়ালা বাদুড় গলায় না ঝুলিয়ে এর চেয়ে চুলে জট পাকিয়ে, তাবিজ ভর্তি পোটলা গলায় ঝুলিয়ে পাহাড়-পর্বত ঘুরাঘুরি করা ভালো।”
দানীন হতাশ চোখে তাকালো। এই দুই ব্যক্তির গলাবাজি অব্যাহত রাখার ধারণক্ষমতা সত্যিই অসাধারণ।
খানিক বাদেই দানীনকে নিয়ে তার ভাবী পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে উপস্থিত হলেন। তার খালা সুরাইয়া খাতুন ধমকে ভাবীকে তার সঙ্গে পাঠালেন। এই একজন মানুষের মুখঝামটাই ভাবীর শঙ্কা।
মাহবুবের সঙ্গে মা-বাবা, খালা-খালু, মামা-মামীসহ আরও কয়েকজন এসেছেন। তার ভাই নাকিদ ও বাবা নাইমোল্লাহ তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। এরমধ্যেই তার ভাবী তাকে নিয়ে প্রবেশ করলো।
দানীন মাহবুবের দিকে একবার তাকিয়ে দাঁত-মুখ খিঁচে মাথা নত করে বসলো। মাহবুবের সঙ্গে সঙ্গে অচেনা মুখ তাকে ডাগর ডাগর অক্ষি দ্বারা পর্যবেক্ষণ করছে। ব্যাপারটা চিন্তায় খেলে যেতেই তার অস্বস্তি হচ্ছে। সামনে রাখা পানি ভর্তি জগে টুপ করে ডুব মেরে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা, সোফার তলায় ঢুকে পড়লে কেমন হয়? মাথাটা নাগরদোলার মতো গ্যাড়গ্যাড় শব্দ তুলে ঘুরছে কেন। পড়ে যাবে নাকি? নাস্তা রাখা টেবিলটি তার সামনে। এর ওপর পাশেই মাহবুব। যদি মাথা ঘুরে নাস্তাপাতি সহ ধুপ্পুড় করে পড়ে যায়! শাড়ি পরা উচিত হয়নি, বোরকা পরা উচিত ছিল।
ইউসরা তখন হুট করে তার পাশে এসে বসলো। এর মাঝেই একজন প্রশ্ন করলো মেয়েটি কে।
দানীনের বাবা নাইমোল্লাহ বললেন,
“ওর নাম ইউসরা। দানীন তো ভার্সিটির জন্য তার ফুফুর বাসায় থাইকা পড়ে। ও হেই বিল্ডিংয়েই থাহে।”
ইউসরা কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন করলো,
“আপনি কে আন্টি?”
এরূপ কাঠিন্য গলায় করা প্রশ্নে মহিলা অবাক চোখে তাকালো। মূহুর্তেই নিজেকে সামলে বললো,
“আমি ছেলের মা।”
দানীন চমকে মাথা তুলে দেখলো মাহবুবের মা-ই। সে তাকে ছবিতে দেখেছে, মাহবুবই দেখিয়েছিলো। উনাকে তো ছবির থেকে বাস্তবে বেশি ভয়ঙ্কর লাগছে। দানীনের মাথাটা আবার ঘুরে ওঠলো।
অন্যদিকে, ইউসরা ভালো মতো উনাকে পর্যবেক্ষণ করায় ব্যস্ত। এতো বড় দামড়া ছেলের মা ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক, গোলাপি রঙের চোখ বিঁধানো শাড়ি, পুরো কান জুড়ে ঝুমকো। ইউসরা সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঠোঁটের কোণা ডান পাশে বাঁকিয়ে মহিলাকে ভেঙচি কাটলো।
হুট করে এই মহিলা দানীনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন নিক্ষেপ করলো,
“তো তোমার গায়ের রঙ এতো কালো কেন? পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে তো যায় না।”
দানীন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। এই প্রশ্ন সে এই জীবনে বহুবার শুনেছে। কিন্তু আজকে? ভালোবাসার মানুষের কাছের মানুষ থেকে! তা কিভাবে মোকাবেলা করবে? মাহবুবের মা কী তাকে অপছন্দ বলে চলে যাবে? মাহবুব তো বলেছিলো দেখতে আসাটা জাস্ট ফরমালিটি। সবকিছু ফাইনালাইজ করতে মূলত আসা।
মাহবুব পরিস্থিতিতে সামলালো। তার মাকে বললো,
“আমিও তো কালো মা।”
“তুই মোটেও কালো না। টকটকে ফর্সা না ঠিক। ছেলে হিসেবে এই রঙকেই ফর্সা বলে। কিন্তু ছেলের থেকে মেয়ের গায়ের রঙ দুমে..ব্যাপারটা কেমন না?”
“বাবাও তো তোমার থেকে কম ফর্সা। বাবার জন্যই আমি তোমার মতো লাল সুন্দরী হতে পারলাম না। তোমার তো উচিত বাবাকে এখন ত্যাজ্য করে দেওয়া।”
মাহবুবের এই কথা সবাই সশব্দে হেসে ওঠলো।
“হ্যাঁ, বুঝেছি। মেয়ে তোমার পছন্দ হয়েছে তা বলো।”
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর ছেলে মেয়েকে আলাদাভাবে কথা বলতে পাঠানো হলো। দানীনের ভাবী তাকে ও মাহবুবকে গেস্ট রুমে নিয়ে গেলো। তার ভাবী তাদের বসিয়ে সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন।
মাহবুবই প্রথম শুরু করলো। বললো,
“ভালো আছেন ভাবী? আসুন, পাশে এসে বসুন।”
উনি উদ্ভ্রান্ত চাহনি দিয়ে হাসলেন।
“না ঠিক আছে। আপনারা কথা বলুন।”
মাহবুব ফের একই ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো,
“ভাবীর শরীর ঠিকঠাক তো? ঠিকঠাক খাবার খান তো?”
“জি জি, ঠিকঠাক খাচ্ছি।”
“কি খান?”
উনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা খানিক কাত করে প্রশ্নটা বুঝার চেষ্টা করলো। এরপর বিভ্রান্তিকর কণ্ঠে বললো,
“ভাত খাই।”
“ওহ, আমি বিরিয়ানি খাই। কিন্তু বিরিয়ানি সামনে থাকা অবস্থায় এলাচের উপস্থিতি যে কি বিরক্তিকর ভাবী গো ভাবী।”
এ পর্যায়ে দানীন সশব্দ হেসে ফেলেছিলো। হাসি থামাতে জোরে জোরে কিছুক্ষণ কাশলো।
“জি, আপনারা দুজন কথা বলুন।”
মাহবুব মাথা নাড়িয়ে বললো,
“আপনি আছেন, আগে আপনার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সারি। মেয়ের সঙ্গে না হয় পরে আলাদা করে কথা বলে নেবো।”
উনি এতোক্ষণে মাহবুবের এরূপ কথা বলার ধরণ বুঝতে পারলো। তৎক্ষণাৎ বড় বড় লাফ মেরে রুম ত্যাগ করলো। ভাবী যাওয়ার পর দানীন মাহবুব একসঙ্গে শব্দ সহিত হেসে ওঠলো।
কিছুক্ষণ বাদে দানীন তার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলো,
“ছাদে যাবেন?”
মাহবুব মাথা হেলিয়ে সম্মতি প্রদান করলো।
ছাদের দরজা অতিক্রম করে সিমেন্টের খর্খরে মঁচের উপর পা ফেলতেই মাহবুব পিছন থেকে দানীনকে দুই হাতের বাহুডোরে বন্ধ করলো।
দানীন মৃদু স্বরে চিৎকার করে ওঠলো,
“এই কি করছেন! ছাড়ুন!”
দানীন ছুটতে চাইলে মাহবুব বাহুবন্ধন আরও দৃঢ় করে তাকে ধরে বললো,
“আগে এই আপনি থেকে তুমিতে কনভার্ট হও। এরপর ছাড়াছাড়ি।”
“এসব তুমি টুমি বিয়ের পর, এখন না।”
“তাহলে আমিও ছাড়ছি না। এভাবেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকবো।”
মাহবুবের ছাড়ার কোনো লক্ষণ না দেখে দানীন বললো,
“আচ্ছা, বলছি। তুমি তুমি।”
মাহবুব দানীনকে ঘুরিয়ে তার আরও নিকটে এনে বললো,
“তুমি কি?”
“তুমি মানুষ।”
মাহবুব হেসে দিলো।
“শাড়িতে তোমাকে কল্পিত পরীর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি নিজের রঙধনুর রঙে রাঙানো ডানায় ভর করে চৌচির মৃত্তিকায় পদচিহ্ন দ্বারা তাকে সৌভাগ্যশালী করলে।”
মাহবুব আবেশিত কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠলো। তার দুই আঁখিতে গভীর ঘোর, আবেগের ভাবাবেশ। যেনো এই কালো আঁখি দু’টো দানীনকে আহ্বান করছে নিজের খোলস ভেঙে নিজেকে সপে দিয়ে ঐ আঁখিদ্বয়ের নির্দেশকারী পথে মিশে যেতে, সব দুর্ভেদ্য প্রাচীরগাত্র ভেঙে মনোদিগন্তে হারিয়ে যেতে। মাহবুব তার ঠোঁট দানীনের কপাল স্পর্শ করতে যাবে তখনই স্টিলের দরজার ক্যাচক্যাচে শব্দে দুজন স্প্রিংয়ের মতো দুই দিকে ছিটকে দাঁড়ালো।
তাকিয়ে দেখলো ইউসরা আর ফারিহ। সঙ্গে আরেকটি বাচ্চা ছেলে।
ফারিহ দাঁত কেলিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আমরা কী প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে মনের কথা জাহির করা টুনটুনির মধ্যে প্রবেশ করতে পারি?”
দানীন না বুঝার ভান ধরে বললো,
“প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে চাস, ভালো কথা তো। আয়, তোদের সঙ্গে আমরাও প্রকৃতির রূপ উপভোগ করি।”
ইউসরা এর মাঝে বলে ওঠলো,
“আপু, তোমার দেবরকে আমার পছন্দ হয়েছে।”
ফারিহ তার দিকে ঘেঙচানো চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,
“ক্লাস ফোরের ছেলেকে তুমি কিভাবে ঐসব নজরে দেখো ইউসরা? তোমাকে ঠাহর করেই তো বেচারার পাকস্থলী, নাড়ীভুড়ি সব শুকিয়ে যাচ্ছে। নাউজুবিল্লাহ বলো, তওবা পড়ো ইউসরা।”
ফারিহ’র এরূপ অঙ্গবিক্ষেপে বলা কথায় সবাই হো হা করে হেসে ওঠলো। শুধু বাচ্চাটি ছাড়া। সে অসহায় মুখে ভাইয়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। দানীন তার হাত ধরে কাছে টেনে এনে জিগ্যেস করলো,
“তোমার নাম কি বাবু?”
ভয়ার্ত মুখমণ্ডলে একবার ভাইয়ার দিকে আরেকবার দরজার নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন ছেলে-মেয়েকে দেখলো। আসার পর থেকে এই দুজন তাকে খুব জ্বালাতন করেছে। গাল টিপে গাল ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম। তবে সামনের শাড়ি পরিহিত রমণীটিকেই তার নিরাপদ মনে হচ্ছে।
সে দানীনের গলা জড়িয়ে গালে গাল ঠেকিয়ে বললো,
“মুগ্ধ।”
ইউসরা বিরক্ত স্বরে বললো,
“আমি এতো আদর করে নাম বলতে বললাম, আর এই পিচ্চি মুখে কুলুপ এঁটে চুপচাপ বসে ছিলো। এই পিচ্চি, আমাকে পছন্দ হয়নি? না হলেও কিছু করার নেই। গুন্ডা ভাড়া করে তুলে নিয়ে যাবো কিন্তু। এখন তো শুধু একটা বাক্য জপ করবে, তুমি আমার, আমি তোমার। এই যে তোমার ভাই তথা আমাদের মাহবুব দুলাভাই তোমার ভাবীর উদ্দেশ্যে বলে, সেরকম।”
ফারিহ দ্বিগুণ বিরক্তিকর স্বরে বললো,
“মরণ!”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here