শুভ্রময়_পরঁজন পর্ব_১১

0
212

#শুভ্রময়_পরঁজন
পর্ব_১১
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

১১.
গন্তব্যহীন নদীর পথে ট্রলার দ্রুত ছুটে চলছে। উদ্দেশ্য কীর্তনখোলা নদীর স্বকীয় রূপ-চারুত্ব নদীর বুকে ভেসে ভেসে সচক্ষে দেখা। খোলা নীল চাদর আচ্ছাদিত আকাশ যেনো শৈবালিনীর নীল-সবুজ মিশ্রিত নদীর সঙ্গে সবার সন্তর্পণে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলায় নিয়োজিত। আশেপাশে আরও কিছু ট্রলার মাথা ধরে যাওয়া ধিম ধিম শব্দ উৎপন্ন করে চলছে। সেই সঙ্গে ভেসে চলছে ছোট-বড় জাহাজ। তাদের দেখে মনে হচ্ছে, বিশালাকার পাংশুবর্ণ বক নদীর নির্মল নীরের উপর ভাসমান। স্বচ্ছ জলধারা তাকে চতুর্দিক থেকে চক্রাকারে গ্রাস করে যেনো নিজের বুকে লুফে নিতে চাইছে। আর সেই অতিশয় ধূসরাভ বক তার বিশাল পা দ্বারা ঠেলে অবরোধ করে ঠিক সময়ে তীরে ভিড়ার চিন্তায় চিন্তিত।
নদীর চঞ্চল ঢেউ পাড়ের কিনারায় মৃদু আঘাত হানছে। কিনারা ঘেঁষে স্থিতাবস্থা বৃক্ষরাজির মেলা দৃষ্টি মেলে পাড়ে এসে ভিড়া পথযাত্রীদের অবলোকন করায় ব্যস্ত। যাত্রী তার গন্তব্যে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে মাথা হেলিয়ে নৃত্য করে, সবুজ পাতার ঝরঝরে বারিপাত ঘটিয়ে, সুরভিত বায়ুপ্রবাহ দ্বারা স্বাগতম জানাচ্ছে। যতদূর দেখা যায়, ততদূর শুধু সবজেটে দিগন্ত। তারূণ্যপূর্ণ বৃক্ষ-লতাবিতানের দিগন্ত যেনো নীল আকাশের দিকচক্রবালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। নীল আকাশে বিচরণকারী মেঘ এই সবুজ রাজ্যের পিছনে আছড়ে পরে বাসস্থান গেঁড়ে মেঘের রাজ্য বানিয়েছে। টিন, ইটের পর বদলে সবুজের সঙ্গে একাকার হয়ে শুভ্র পরশের তিমিরাচ্ছান্ন মেঘ বসতি স্থাপন করেছে। আচ্ছা, এই মেঘের রাজ্যে বসবাসের অনুভূতি কেমন হবে? আবেগে আবেশে কী চোখ থেকে জল বিসর্জিত হবে?

ট্রলারে থাকা আট-নয়জন তরুণ-তরুণীর আনন্দ-স্ফূর্তি তাদের চাঞ্চল্যযুক্ত প্রাণবন্ত হাসিতে প্রকাশিত হচ্ছে। তাদের লাফালাফিতে ট্রলার খানিক দুলে ওঠলো। দানীন মাহবুবকে ঝাপটে ধরে। মাহবুবও মুচকি হেসে দানীনকে ট্রলারের সাইড থেকে মাঝখানের পাটাতনে বসায়। মাহবুব তার হাত শক্ত করে ধরে এক দৃষ্টিতে তার মুখপানে তাকিয়ে থাকে। দানীন লজ্জা উপেক্ষা করতে সেই গাঢ় আঁখির চাহনি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আশেপাশে নজর বুলাতে থাকে।
“ওহে চড়ুই পাখির জোড়া! এদিকে তাকা, হাত ধরা অবস্থায় ছবি তুলি।”
দানীন মাথা ঘুরিয়ে ট্রলারের অপর মাথায় অবস্থিত তরুণ-তরুণীদের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গেই ক্লিক ক্লিক শব্দে মাহবুবের ক্লাসমেট প্রিয়া আপু তাদের দুজনের বেশকিছু ছবি তুলে ফেললো। প্রিয়া আপুর এতো এতো ছবি তোলার ধৈর্য দেখে দানীন অবাক হয়।
হুট করেই মাহবুব ও তার বন্ধুরা প্ল্যান করলো কীর্তনখোলা নদীতে ঘুরতে যাবে। মাহবুব দানীনকে ছাড়া যাবে না। তাই দানীন রানিয়াকেও বগলদাবা করে সঙ্গে নিয়ে আসলো।

“দানীন।”
“হ্যাঁ, বলো।”
মাহবুব অপরপাশে বসে থাকা রানিয়াকে ইঙ্গিত করে বললো,
“তোমার ফ্রেন্ডের চেহারা যে একদম চুপসে আছে। মারামারি করে নিয়ে এসেছো নাকি?”
দানীন হাসলো।
“একে মারতে হয় না। এ নিজেই গ্যাস গলাধঃকরণ করে বেলুনের মতো ফুলে ওঠে। নিজেই সেই বেলুনমাখা চেহারা সু্ই দিয়ে গুঁতো মেরে ফুটায়। তার তো খুব রাগ আমি রিলেশনে কেন গেলাম। আর ওকে মুখ ঠেসে এতো এতো নোট দিয়ে বসিয়ে রাখি।”
“তাহলে আমার কোনো ফ্রেন্ডের সঙ্গে সেটিং করিয়ে দেই। আবিরের সঙ্গে সেটিং করিয়ে দেবো?”
“এই না! একদম না। রানিয়াও যদি কখনো এইসব চিন্তাভাবনা করে ওকে কীর্তনখোলার পানিতে চুবিয়ে নিয়ে যাবো।”
মাহবুব ভ্রুয়ে ঢেউ খেলিয়ে বললো,
“নিজের ক্ষেত্রে সব জায়েয, অন্যের ক্ষেত্রে সব নাজায়েজ?”
দানীন দুষ্টু হাসির রেখা অধরে এঁকে চুল কানে গুজে বললো,
“এটা তো বিশ্বজনীন কথা।”
মাহবুব আলতো করে দানীনের গাল টিপে বললো,
“তাই না?”

প্রখরতায় মাথা নত করিয়ে দেওয়া সূর্য প্রখরত্ব হ্রস্বীভূত করে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। আতপে মস্তিষ্ককে বিহ্বলতা দানকারী গোধূমবর্ণ সূর্যালোক সকাল-সন্ধ্যা রঙ পালাবদলের খেলায় অংশগ্রহণ করেছে। হাসিমুখে প্রজ্জ্বলিত রক্তিম রূপধারণ করেছে। তবে এখন সূর্যি মামার নির্গত স্নিগ্ধতাপূর্ণ দীপ্ত নৌযান করে চলা যাত্রীদের উপর তীর্যকভাবে পড়ে তাদের প্রদীপ্ত করে তুলছে। দিগন্তরেখায় সূর্য তার তেজস্বী রঙ এবং স্নিগ্ধ জ্যোতি বিচ্ছুরিত করে পশ্চিম আকাশ ধীরে ধীরে অলক্তবর্ণে পরিণত করছে। গাঢ় নীল সাগরের মতো আকাশে ভাসমান শুভ্র মেঘ যেনো রক্তমাখা কাপড় মাথায় বেঁধে সূর্যকে বেষ্টিত করে রেখেছে।

দিবালোকের দীনতা প্রকাশ পেতেই সবাই তীরে পৌঁছানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কারও বাড়ি ফিরতে হবে, কারও হলে পৌঁছাতে হবে।
ট্রলার থেকে নেমে দানীন মাহবুবের হাত ছেড়ে রানিয়ার দিকে এগিয়ে হলো। দানীন কাছে আসতেই রানিয়া মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
“কোনো নাটক ফাটক করবি তো ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দেবো। সেই সঙ্গে তোর প্রেমিকেও ফেলবো।”
“আমার এই প্রেমিক নিয়ে সবার এতো জ্বলে কেন বল তো? এতোদিন ইউসরা ছিল, আর এখন তুই।”
“আমার মোটেও জ্বলে না। আমি শুধু তোর বিশ্বাসঘাতকতা দেখে হতভম্ব। সবসময় বলতি রানিয়া বেপি রানিয়া বেপি, পড়াশোনা করো। পড়াশোনা শেষ করে স্বামীর সঙ্গে জমিয়ে প্রেম করবো। দরকার হলে প্রবাসী ভুড়িওয়ালা হাতি বিয়ে করবো। দুজন দুই দেশ থেকে জমিয়ে প্রেম। লং ডিসটেন্স প্রেম। কিন্তু তুই কাউকে কিছু না বলেই ছক্কা মেরে চাল ফেলে ফুরুৎ।”
দানীন কোমরে হাত রেখে বললো,
“ইশশ! নিজেই তো আমাকে কুপথে চালনা করেছিলেন। পিছনে দাঁড়িয়ে ভ্রমরার মতো পিছন ডান-বাম নাচিয়ে হ্যাঁ বল দানীন, হ্যাঁ বল দানীন বলেছিলেন। আমি কী ভুলে গিয়েছি এসব?”
রানিয়া আবার মুখ গুমোর করে কনুই ভাজ করে নদীর নির্মল জলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।
“আচ্ছা যা, মন খারাপ করিস না। আমার একটা দেবর আছে বুঝলি। তুই চাইলে তার সঙ্গে তোর একটা হতে পারে।”
রানিয়া এক চোখ ছোট করে প্রশ্ন করলো,
“ননদ নেই?”
“উহু, শুধু একটা দেবর।”
রানিয়া হঠাৎ ভয়ার্ত গলায় বলা শুরু করলো,
“দোস্তো জানিস, আমার এক মামা বলে যেই মেয়ের ননদ নাই সে মেয়ের কপাল নাকি মন্দ। অর্থাৎ তোর কপালও ফেটে-ফুটে চৌচির। তোর এই কপাল তো দেশের সব সেলাই মেশিন দিলেও দেঁড়ে করা যাবে না দোস্তো।”
দানীন কয়েক সেকেন্ডের জন্য বোকা বনে গেলো। পরক্ষণেই রানিয়ার বাহুতে এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় দিতে লাগলো,
“এইজন্যই তুই কোনো ছক্কা টক্কা মারতে পারিস না। মারবি কি করে? তোর এসব ভয়ানক চিন্তাভাবনা শুনে তো প্রেমিক বা স্বামী যে-ই হোক মাটি নখ দিয়ে খুঁড়বে আর বলবে,‘ধরণী দ্বিধা হও।’”
“তাহলে তোর সাহসী প্রেমিককেই দিয়ে দে না। এতো আগুপিছু করে আর কাউকে খুঁজতে হবে না।”
দানীন তাকে চোখ রাঙিয়ে বললো,
“সে আমার নিজস্ব সম্পদ। তুই বরং আমার দেবরকে বিয়ে করে আমার ছোট জা হয়ে যা। দেবরের বউকে তো জা বলেই সম্বোধিত করা হয়, তাই না?”
“তো কি করে তোর দেবর? কোন ক্লাসে পড়ে?”
দানীন লজ্জাবতী গাছের মতো লাজুক হেসে বললো,
“আপাতত কিছু করছে না। শ্রীঘ্রই করবে। এই তো চতুর্থ শ্রেণীর কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটিয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে।”
রানিয়া আচমকা দানীনের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালো যেনো বাপ্পারাজের মতো চিৎকার করে বলে ওঠবে, “এ আমি বিশ্বাস করি না।”
“বাহ, দোস্ত! জামাই দিচ্ছিস নাকি বাচ্চা? লালন-পালন করে বড় করার পর তো আমার পায়ে পড়ে বলবে, ‘ওহে জননী জাহানারা, থুক্কু রানিয়া। আপনি আমার জন্য অনেক কষ্ট-ক্লেশ মোকাবেলা করেছেন। আপনার কষ্টের পরিমাণ কিঞ্চিৎ কমানোর প্রয়াসে আপনার জন্য পুত্রবধূ নিয়ে আসতে যাচ্ছি। বর প্রদান করুন জননী, বর প্রদান করুন।’”
দানীন রানিয়ার কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠলো। দানীনের সুললিত হাসি মাহবুবের কানে যেতেই সে তার দিকে এগিয়ে এলো।
“কি ব্যাপার ম্যাডাম? বাসায় যাবেন না? সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে যে। রানিয়া আপুকেও তো হলে ফিরতে হবে। ইতোমধ্যে সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে।”
“ইয়েস স্যার। যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছিলাম। রানিয়া নাকি এখানেই বাসস্থান গেঁড়ে থাকতে চাইছে। তাই তো ওকে বুঝাচ্ছিলাম।”
রানিয়া দানীনের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো।
“আচ্ছা, চলো তাড়াতাড়ি। তোমাকে পৌঁছিয়ে আবার হলে ফিরতে হবে।”
দানীন বাঁধা প্রদান করলো,
“না না, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে না। অনেকখানি দেরি হয়ে যাবে। তুমি বরং রানিয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। দেরি হলে আবার হলে ঢুকতে না দিলে? আমি আতিয়া আপুর সঙ্গে চলে যাই। তার পথ তো আমার যাওয়ার পথেই।”
“তুমি শিউর তো? কোনো সমস্যা হবে না তো?”
“উহু, কোনো সমস্যা হবে না।”
মাহবুব আচ্ছা বলে খানিক এগিয়ে গেলে রানিয়া মন খারাপ গলায় বলে ওঠলো,
“মাহবুব তোর খুব কেয়ার করে তাই না?”
দানীন রানিয়ার মন খারাপ ভাবটা ধরতে পারলো না। মুচকি হেসে বললো,
“হুম, খুব বেশিই কেয়ার করে। যাওয়ার পথেই দেখবি কয় হাজার কল করতে করতে যাবে।”
দানীন মাহবুব থেকে বিদায় নিয়ে আতিয়া আপুর সঙ্গে বাড়ির পথে অগ্রসর হলো। আর মাহবুব রানিয়াকে নিয়ে হলে ফিরার জন্য রিকশার জন্য দাঁড়ালো।
হঠাৎ রানিয়া বলে ওঠলো,
“আপনি আমাকে রানিয়া আপু বলবেন না। শুধু রানিয়া বলে ডাকবেন। আর আপনি আপনি করে আমাকে বুড়ি বানাবেন না। তুমি করে বলবেন।”
রানিয়ার কণ্ঠে স্পষ্ট অনপেখিত অভিমান।
মাহবুব যেনো একলহমায় সেই অভিমনী কন্ঠস্বর অনুধাবিত করতে পারলো। নরম স্বরে বললো,
“ঠিক আছে রানিয়া। আর এতোদিন তোমাকে বুড়ি বানানোর জন্য দুঃখিত রানিয়া।”
এরমধ্যেই রিকশা এসে উপস্থিত হলো। দুজন পাশাপাশি উঠে বসলো। কীর্তনখোলা নদীর তীর থেকে ববির হলে পৌঁছতে ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট লাগবে। পুরোটা সময় তারা দুজন হরেকরকম গল্পে মেতে থাকলো। দানীনের কথা অনুযায়ী তাকে হাজার বার করে কল দিয়ে আজ আর কেউ খোঁজ নিলো না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here