#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_১২
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১২.
দানীন ও মাহবুবের সম্পর্ক হয়েছে দেড় বছর হতে চললো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসার তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে তীব্রতর হলো অবহেলা, বিরক্তি, অনিশ্চয়তা এবং ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ও ছেড়ে যাবার শঙ্কা।
এক্সপেক্টেশন! এই জিনিসটা যার যতো বেশি সে-ই চাহিদার মাত্রার সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তি, অসুখিতে পতিত হয়।
‘এইম’ নামক অধ্যবসায় দ্বারা আশাতীত লক্ষ্য এবং ‘এক্সপেক্টেশন’ নামক লোভ, অতিরিক্ত অযাচিত আকাঙ্ক্ষা, অবৈধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ– এই দুই শব্দের মধ্যে মানুষ পার্থক্য বুঝে না। বুঝলেও মাছি তাড়ানোর মতো উড়িয়ে দিয়ে অসুখীর পথে পা ফেলে। কারণ কষ্টকর কিন্তু সুখময়, অনাড়ম্বর কিন্তু স্বস্তিকর জীবন মানুষের অতি অপ্রিয়; আরাম-আয়েস, ধোঁকাবাজি দ্বারা বেষ্টিত কিন্তু অসুস্থময়, চাকচিক্যময় কিন্তু নোংরা, নষ্টামি-কুকুরের মতো বস্ত্রহীন খোলামেলা জীবন বড়ই প্রিয়। বৈধ জিনিস থেকে অবৈধ জিনিস বা পথে মানুষ বেওয়ারিশ কুত্তার মতো হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এগিয়ে আকড়ে ধরতে চায়। আশ্চর্য মানুষ!
দানীন মাহবুবকে কল করে যাচ্ছে। যেখানে রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করতো, সেখানে নয়-দশবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করে তেতো কথা বলে।
দানীন রানিয়াকে কল করলো। ওয়েটিং দেখাচ্ছে। দুইবার ট্রাই করার পর সে কল ধরলো।
ওপাশ থেকে রানিয়া হ্যালো বলতেই দানীন কান্নার বাঁধ ভেঙে ফুফিয়ে ওঠলো,
“ওর এসব অবহেলা আমার একদম সহ্য হচ্ছে না রানিয়া। সে কেন এরকম পরিবর্তন হচ্ছে? আমি তো ওকে এভাবে সহ্য করতে পারবো না।”
রানিয়া ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
“আমি তোকে সেই কবে থেকেই বলছি ব্রেক আপ করে ফেল। এইসব রিলেশন ফিলেশন এরকমই। দুদিন মাজ-মস্তির পর আর মজা লাগে না। বিরক্তিকর ঠেকে।”
“ব্রেক আপ? আমি তো ওর গার্লফ্রেন্ড না যে ব্রেক আপ করবো। বিয়ে ঠিক হয়ে আছে আমাদের। কিছুদিন বাদে যে তার বউ হতে যাচ্ছে সে তার সঙ্গে এরকম বিহেভিয়ার করবে? মা-বাবা মাহবুবকে কতো পছন্দ করে জানিস! আমার থেকে বেশি ওকে ভালোবাসে। আমার প্রতি করা তার এসব আচার-আচরণ সম্পর্কে জানলে কতো কষ্ট পাবে জানিস?”
“বিয়ে তো আর হয়ে যায়নি। বিয়ে হওয়ার পর যদি এরকম করে তখন তো পরিশেষে বিচ্ছেদই ঘটবে। তার চেয়ে বরং এখনই ঝামেলা-ঝঁঝাট থেকে বের হয়ে আয়। মাহবুবকে এখনই কল করে সবকিছুর সমাপ্তি কর। এভাবে আর কতো? প্রয়োজনবোধে সামনাসামনি সম্পর্কের ইতি টান। ওর সঙ্গে মিট কর।”
বলেই রানিয়া কল কেটে দিলো।
দানীন মেঝেতে বসে পড়লো। মাহবুবের সঙ্গে সম্পর্কের পরিসমাপ্তি সে ঘটাতে পারবে না। বিয়ে ভাঙলে তার মা-বাবা সত্যিই খুব কষ্ট পাবে। মেয়ের বিয়ে ভাঙ্গা থেকে বেশি কষ্ট পাবে আশেপাশের মানুষজনের অসহনীয় কথার তোড়ে। কৃষ্ণকায় বড় বোনের পূর্বে রূপবতী ছোট বোনের বিয়ে সম্পন্ন হওয়ায় এভাবেও নানা কথার বাণী দাঁত খিঁচে কর্ণপাত করতে হয়েছে। সম্ভব হলে প্রতিবেশীরাই এই কৃষ্ণবর্ণের জন্য দানীনের গলায় পা দিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলতো। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও নানা কথা, এমন ছেলে কোথায় পেলো কতো টাকা দিয়ে পেলো। এখন মাহবুব যা-ই করে থাকুক বিয়ে ভাঙা যাবে না।
সমাজ বসবাসের কারণে সামনে থাকা পোকামাকড় ভর্তি আগুনের লাভাযুক্ত গর্তে আমাদের চোখ বন্ধ করে লাফ দিতে হয়। পিছন ফিরে সুন্দর রাস্তা ধরে রাজপ্রাসাদ অভিমুখে আমরা অগ্রসর হতে পারি না আশেপাশের ব্যক্তিবর্গের জন্য। পোকায় খেয়ে, আগুনে ঝলসানোর পর বলতে হয়, “এই দেখো সমাজবাসী! পুড়েছি আমি, জ্বলেছি আমি। নিস্তব্ধ হয়ে নিস্তেজ হৃদয়ে কুড়াল দ্বারা অভিঘাত হেনেছি। আমার এই পোকা খাওয়া দেহে চিকিৎসা দাও, ঝলসে যাওয়া গাত্রে পানি দাও।” তখন সেই সমাজবাসী নাক সঙ্কুচিত করে বললে, “ঐ যে পাশে ডোবা আছেরে মেয়ে। ডুবে মরে ক্ষান্ত দে। তবুও তোকে সুখ রাজ্যের অমৃত জলে অবগাহন করতে দেবো না। সুন্দর ভুবনে অসুন্দর হয়ে জন্মে তুই পাপ করেছিস, মহাপাপ!”
দানীনের ফোন কেঁপে ওঠলো। মাহবুব কল করেছে। দানীন সব চিন্তাচেতনা, অভিমান ত্যাগ করে রিসিভ করে কাতর কণ্ঠে মাহবুব বলে ডাকলো।
প্রত্যুত্তরে মাহবুবের কষাটে কণ্ঠস্বরের কষাটে বাণী উপহার পেলো,
“কি সমস্যা দানীন? কল পিক আপ না করলে বুঝো না যে ব্যস্ত আছি? অনবরত কল দিতেই থাকো। কোনো কাজ নেই তোমার? পড়াশোনা ছেড়ে দেউলিয়া হওয়ার পরিকল্পনা করছো নাকি?”
দানীন প্রত্যুত্তরে নিঃশ্চুপ রইলো। তীব্র অভিমান তাকে আবারও ঘিরে ধরলো। এই মুহূর্তে মাহবুবের তার সঙ্গে সত্যি সত্যি সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে ইচ্ছে করছে। বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আর কখনো তোমার মুখ দেখবো না মাহবুব। কখনো না! তোমার দেওয়া সব স্মৃতির উপর থুথু ফেলবো আমি।’
কিন্তু তা সে বলবে না। এই যে সবার অন্তরালে এই মানুষটিকে নিয়ে রঙধনুর রঙে পরিবেষ্টিত ছোট-বড় স্বপ্নের স্তূপ গড়েছে তা কি করে একলহমায় ভষ্মীভূত করবে? মানুষটা যে তাকে স্বপ্নের জাল হাতে ধরিয়ে দিয়ে মনের অভিলাষে আঁটতে উদ্যত করেছিলো। তবে কী সেই জালের সুতো অল্প মূল্যের ছিলো? তার প্রতি দেখানো অনুভূতি অগভীর ছিলো? এর কৈফিয়ত তো ভালোবাসার মানুষটি থেকে প্রত্যাশা করতেই পারে।
মাহবুব ফোনের ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে ওঠলো,
“কি সমস্যা? এখন কোনো কথা বলছো না কেন!”
“তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই মাহবুব।”
“কিন্তু আ..”
মাহবুব কথা শেষ করার আগেই দানীন দৃঢ় কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“প্লিজ! আর কখনো অহেতুক আবদার করবো না। আজকে আসো প্লিজ।”
মাহবুব কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,
“আমি খানিক ব্যস্ত। তোমাকে হল অবধি আসতে হবে।”
দানীন নীরবে হাসলো। সময় নাকি সব ক্ষতকে অদৃশ্য শুশ্রুষা প্রদান করে সারিয়ে তুলে। কিন্তু সময়ও যে জখমকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত ও সারা জীবনের জন্য দাগের উলকি এঁকে দেয়। পূর্বে মাহবুব দানীনকে এক পলক দেখার জন্য হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতো। কিন্তু এখন? সে ব্যস্ত, মহা ব্যস্ত।
যন্ত্রণার নিশিত দীর্ঘশ্বাস নির্গত হওয়ার পূর্বেই দানীন তা গলাধঃকরণ করে বললো,
“বাস স্টোপেজ অবধি খানিক এগিয়ে আসতে পারবে?”
“আচ্ছা।”
দানীন কল কেটে ফোনটা কার্পেটের উপর রেখে মেঝেতে বসেই বিছানার উপর মাথা রাখলো।
(চলবে)