শুভ্রময়_পুরঁজন পর্ব_১৩

0
206

#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_১৩
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

১৩.
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস স্টোপেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো। কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এখানে সেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা হেঁটে চলছে। হাতে হাত রেখে গভীর চাহনি প্রদান করে গমনাগমনকারী কপোত-কপোতীদের উপস্থিতিও দেখা যাচ্ছে।
দানীন হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে আঙ্গুলের ফাঁকে আকাশের পানে চাইলো। তীর্যকভাবে রোদ তার চেহারায় এসে পড়ছে। রোদও যেনো তাচ্ছিল্য করে রৌদ্রজ্জ্বলে তার কালো অবয়ব দুনিয়ার সামনে তুলে ধরতে চাইছে। সবাই তার সঙ্গে এরকম করে কেন?
দানীনের এক কলেজ শিক্ষিকার কথা মনে পড়লো। সে দানীনকে প্রায়ই বুঝাতো বাহ্যিক গঠন, রূপের দাম অতি নগণ্য। মানুষের অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছ গঠন, মন-মানসিকতা ও সদাচারণটাই আসল। অথচ সেই ম্যাম তার দেবরের তৃতীয় বিয়ের সময় ফকফকা সুন্দরীর খোঁজ করছিলো। বাচ্চা যদি কালো হয়? এই কালো বাচ্চা তো আর তাদের বংশের সঙ্গে যেতে পারে না।
কিন্তু দানীন বুঝে না কালো বাচ্চা জন্মালে সমস্যা কোথায়? ‘সমস্যা’– তা চোখে সুঁচ ফুটিয়ে কারা বুঝায় যে, “কালো বাচ্চা অনেক সমস্যা। এর জন্ম অতি ক্ষতিকর”? কারা এই ধ্যানধারণার বিস্তৃত দান করে? আমাদের প্রতিবেশের শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ যারা নৈতিক শিক্ষা প্রদান করে, তারাই আড়ালে অন্তরালে নীতি বহির্ভূত কাজ করে! স্কুল-কলেজে মানবিকতা, নৈতিকতা শিখিয়ে তারাই এই শব্দসমূহের গলা টিপে সুন্দরী ও প্রিন্সেসের মতো কোমরের অধিকারী রমণী খোঁজে। মূর্খ মানুষ তো মূর্খই হয়। এই মূর্খের শূন্য মস্তিষ্কে যুগ থেকে যুগান্তর ধরে শিক্ষিতরাই নানা কালো, ভ্যাপসা গন্ধযুক্ত চিন্তাচেতনা সিরিঞ্জ দ্বারা ঢুকিয়ে ব্রেইন ওয়াশ করে রাখছে। এতে অতি শিক্ষিত পরিজনদের কার্যও হাসিল হলো, দোষারোপ থেকেও মুক্তি মেললো।

“দানীন।”
মাহবুবের কণ্ঠস্বর কানে যেতেই সেসব শিক্ষিত মনীষীদের অন্তরের গভীর হতে ধিক্কার জানিয়ে ঘুরে তাকালো।
মাহবুবের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে খুব অনিচ্ছার সঙ্গে এসেছে। চোখ-মুখে বিরক্ত হওয়ার ছাপ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। এই বিরক্ত কী তার জন্য? সব সম্পর্কেই কী এই সাময়িক মান-অভিমান, অবহেলা সৃষ্টি হয়?
দানীন তার চেহারায় পূর্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশ্ন নিক্ষেপ করলো,
“তুমি আমাকে আর চাও না মাহবুব? অন্য কাউকে পেয়ে গেছো? নতুন কেউ.. সে কী খুব রূপবতী?”
মাহবুব আকস্মিক রেগে বলে ওঠলো,
“এসব ননসেন্স কথাবার্তা বলার জন্যই ডেকেছো দানীন! কি সমস্যা তোমার? কি চাও তুমি?”
সে ভেবেছিলো তার কুপিত কণ্ঠে দানীন দমে যাবে। কিন্তু দানীন উল্টো রেগে গেলো।
“সেটাই তো! কি চাও তুমি? ভালো লাগে না আমাকে আর? ধীরে ধীরে সরে যেতে চাইছো? তোমার গুণের সঙ্গে রূপ দরকার তা আগে কেনো বললে না? টাইম পাস করার মনোভাব থাকলে শুধু তা-ই করতে। বিয়ে নামক মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার তো কোনো প্রয়োজন ছিল না। তখন তোমার সময়ে ব্যাঘাত ঘটেনি মাহবুব! তখন তোমার কাজ তোমার ঘাড় চেপে ধরেনি! আমি তো আমার কালো রঙ নিয়ে খুব খুশিই ছিলাম। যে মেয়ে সর্বক্ষণ বই মুখী হয়ে থাকতো তোমার জন্য যে সে কতো সময় অপচয় করেছে সেই ক্ষতিপূরণ দেবে না? সেই কৈফিয়ত ও ক্ষতিপূরণ তোমাকে তো অবশ্যই দিতে হবে মাহবুব! সময়ের মাপকাঠি, প্রয়োজনীয়তা শিখাচ্ছো তো আমায়। আমার ক্ষতিপূরণটুকুও করো দেখি এবার!”
মাহবুব স্তব্ধ হয়ে গেলো। আমতা আমতা করে কিছু বলার প্রচেষ্টার পূর্বেই দানীন নমনীয় কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“মাহবুব, তোমার যদি অন্য কাউকে মনে ধরে থাকে তবে বলো। আমি তো আমার দুর্বলতা জানি। তোমার মতো সুপুরুষের সঙ্গে যে রূপবতী মেয়ে যায় সেই সমন্ধে আমি সম্পূর্ণ অবহিত। অন্তত আমাকে কোনো আঁধারে রেখো না। কাকে পছন্দ? খুব বেশিই মনে ধরে গেছে?”
মাহবুব এবার ফু করে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো,
“তুমি কিন্তু এবার অতিরিক্ত ভাবছো দানীন। অহেতুক কথাবার্তা শুনাচ্ছো। পারিবারিকভাবে সমস্যা বলে উপর দিয়ে স্ট্রেস যাচ্ছে। তাই তোমার সঙ্গেও উল্টোপাল্টা বিহেভ করে ফেলেছি।” “পারিবারিক কি সমস্যা? আগে তো সবকিছু শেয়ার করতে। আর এখন কেমন আছো জিগ্যেস করলে তার প্রত্যুত্তরেও কিছু বলতে নারাজ।”
“আসলে.. মা তোমাকে নিয়ে ঘরে ঝামেলা করছে।”
“আমাকে নিয়ে?”
“মা তোমার রঙের জন্য তোমাকে শুরু থেকেই পছন্দ করতে পারছিল না। কিছুদিন যাবত এই নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে ঘরে তর্কাতর্কি চলছে। তাই ডিপ্রেসড ছিলাম।”
দানীন অশ্রুমোচন কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“তার মানে তুমি সত্যিই আমাকে ছাড়তে চাও?”
“আহ দানীন! আমি কি একবারও এই কথা বলেছি? ঘরে সমস্যা চলছে আর তুমি কষ্ট পাবে বলে তোমাকেও জানাতে চাচ্ছিলাম না। তার উপর পড়াশোনা, চাকরি সবকিছু মিলে মাথা এতো গরম হয়ে থাকতো যে তার রেশ ধরে তোমাকে আঘাত করতাম।”
মাহবুব দানীনের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বললো,
“আমাকে এতো অবিশ্বাস কেন করছো তুমি? একটু বিশ্বাস রাখো। সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে। একটু সময় দাও।”
এর মাঝে মাহবুবের ফোনে মেসেজ টোন বেজে ওঠলো। মাহবুব তাড়াতাড়ি দানীনের হাত ছেড়ে মোবাইল বের করলো। স্ক্রিনে চোখ বুলাতেই কিছুক্ষণ পূর্বের বিরক্তি ভাব কেটে অধরের কোণায় মিষ্টি হাসি ফুঁটে ওঠলো।
দানীন সঙ্গে সঙ্গে তার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বললো,
“কে টেক্সট করেছে..”
মাহবুবও সঙ্গে সঙ্গেই হেঁচকা টান মেরে ফোন তার হাতে নিলো।
দানীন এবার কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে দিলো,
“এই বিশ্বাস মাহবুব! তুমি এই বিশ্বাস রাখার কথা বলছো। এসবের কারণেই তুমি আমাকে দিনের পর দিন অবহেলা করছো, দূরে সরে যেতে চাইছো?”
মাহবুব ডান হাতের আঙ্গুল দ্বারা কপাল চেপে ধরলো।
“টেক্সট সে করেছে দানীন, আমি না।”
“সে কেনো তোমাকে এসব টেক্সট করবে! যে ধরণের কথাবার্তা আমাদের মাঝে হয় সেরকম করে সে কেনো তোমায় ডাকবে?”
দানীন মাহবুবের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো। তার শার্টের কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে ওঠলো,
“কি সম্পর্ক তার সঙ্গে তোমার? তার জন্যই আমাকে এখন আর মনে ধরছে না? ছেড়ে যেতে চাইলো বলো আমি নিজে চলে যাবো। সবার জীবন থেকে চলে যাবো!”
মাহবুব দানীনের দিশেহারা কণ্ঠ শুনে তার মাথা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরলো,
“তুমি আমাকে ভুল বুঝছো দানীন। আমাদের মাঝে এরকম কিছুই নেই। ফ্রেন্ড হিসেবে জাস্ট নরমাল কনভার্সেশন।”
দানীন মাহবুবের বুকে মাথা রেখেই বললো,
“আমি জানি না কিছু। কিচ্ছু জানি না আমি! তুমি ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখবে না। তুমি এখনই ওকে ব্লক করবে। তার সঙ্গে কোনো কথাবার্তা বলার প্রয়োজন নেই। কোনো ফ্রেন্ডশিপের প্রয়োজন নেই। আতিয়া আপু, সাবিত ভাই, তুর্য ভাই, অনয় ভাই, প্রিয়া আপু– তারা আছে না! তবে সে কেনো তোমার বন্ধু হবে? সে তোমার কোনো বন্ধু না, কোনো বন্ধু না! কোনো কথা বলবে না!”
মাহবুব দানীনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“বলবো না, আর কখনো কথা বলবো না। তুমি একটু শান্ত হও প্লিজ।”
দানীন শান্ত হতে পারলো না। হেঁচকি তুলে কান্না করা শুরু করলো। প্রিয় মানুষগুলোকে কী সে এভাবেই হারাবে? অন্তরে এক আকাশসম ঘৃণা অব্যাহত রেখে? কাছের মানুষকে হারানোর চেয়ে তাদের ঘৃণা করার যন্ত্রণা যে আরও তীব্র, তা কী তারা জানে?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here