শুভ্রময়_পুরঁজন #পর্ব_১৪

0
211

#শুভ্রময়_পুরঁজন
#পর্ব_১৪
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

১৪.
রিভার ক্যাফেতে দুইজন মেয়ে একে অপরের সামনে বসে আছে। দানীনের দৃষ্টি রানিয়ার উপর নিবদ্ধ। সেই দৃষ্টি আজ বিদ্রুপপূর্ণ চাহনি নিয়ে রানিয়াকে তার কর্ম সম্পর্কে অবহিত করার প্রয়াসে সুস্থির। সেই চাহনি থেকে নিজের অভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনা আড়াল করতে রানিয়া এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। যে বন্ধু ছিলো নিত্যদিনের কথা বলার সঙ্গী, শত দুঃখ-কষ্ট আদান-প্রদানের সঙ্গী আজ তার দিকেই তাকাতে রানিয়ার বড় লজ্জা।
“এতো সুন্দর সম্পর্কটা এভাবে নষ্ট করার কি খুব প্রয়োজন ছিলো রানিয়া? এই সুন্দর বন্ধুত্বকে পিষে বন্ধুত্ব শব্দটা কলুষিত করা ময়লা শুধুমাত্র একজন পুরুষ মানুষের সান্নিধ্যের জন্য? বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ যা তুই ভালোবাসা হিসেবে অভিহিত করছিস; অন্য সব সম্পর্কের ভালোবাসা কী এই পুরুষ-রমণীর লীলাখেলা থেকে তুচ্ছ? এতো ঠুনকো বন্ধুত্বের সম্পর্ক?”
রানিয়া হকচকিয়ে গেলো। বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেলে দুই-একটা শব্দ উচ্চারণ করতে চাইলো।
নিজের ওড়নার কোণা খামচে ধরে দৃষ্টি নত রেখে বললো,
“যা হওয়ার ছিলো তা-ই হয়েছে…”
দানীন হতভম্ব কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,
“যা হওয়ার ছিলো তা হয়েছে! একজনের হবু স্বামীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলার প্রচেষ্টা, ল্যাপ্টাল্যাপ্টি করা হওয়ারই ছিলো? ভালো মানুষের রূপ ধরে একজনের বিয়ে ভাঙ্গার পরামর্শ প্রদান হওয়ার ছিলো রানিয়া?”
রানিয়া টেবিলের উপর দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখে শক্ত থেকে বলার চেষ্টা করলো,
“দেখ দানীন। তোর পড়াশোনা ছাড়া অন্য আর কোনো মুরদই নেই। কিন্তু বর্তমানে চলতে হলে গুণের সঙ্গে রূপেরও প্রয়োজন। কারণ রূপ জিনিসটা প্রত্যেককেই আকৃষ্ট করে। বর্তমান সমাজ-সংসার ও সমাজের ধ্যানধারণার সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে চলার জন্য গুণ-রূপ দুটোই আমার আছে। তোর উপলব্ধি হয় না মাহবুব তোর মতো মেয়ের থেকে বেশি কিছু ডিজার্ভ করে? মাহবুবের মতো ছেলের সঙ্গে তোর মতো মেয়ে কখনোই যায় না দানীন। তুই কালো একটা মেয়ে মাহবুবের সঙ্গে দাঁড়ালেই তোকে বড্ড বেমানান ঠেকে। আর সেখানে বউ? পড়াশোনায় ফাস্ট ক্লাস থাকলেই তো হয় না। তুই কালো, দেখতে দৃষ্টিকটু তা ভুলে যাস কেন?”
দানীন কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। শিক্ষিত কোনো ব্যক্তিই যদি এরূপ ধ্যানধারণা নিয়ে থাকে তবে বাকিরা কি করবে? তবে কী গরু-ছাগলের ন্যায় এক গাদা পড়া নামক খড়কুটো গলাধঃকরণ করেছে কিন্তু সুশিক্ষা হয়নি? এই যে সমাজ-সংসার, এর পুরোটা জুড়েই তো এই রূপ-গুণের ধ্যানধারণা বিস্তৃত। তবে কী এই বিশ্বাসে উপনীত হতে হবে যে সিংহভাগ মানুষই সমাজে বিচরণকারী গরু-ছাগল, কুকুর-বিড়াল?

“ছিঃ, রানিয়া! তোর চিন্তাভাবনা এতো থার্ড ক্লাস আর তুই এসব স্বাচ্ছন্দ্যে প্রকাশও করছিস। তুই এতো নিম্ন পর্যায়ে গিয়েছিস!”
রানিয়া সেই কথা তোয়াক্কা না করার মুখায়বে বলে ওঠলো,
“শোন, আমি বাংলাদেশে থাকি। এখানে রান্নাবান্না করার গুণের সঙ্গে সাদা চামড়াও ফ্যাক্ট করে। আর উভয়ই আমার অধিগত বস্তু। সেই অনুযায়ী তুই আমার থেকে নিম্ন পর্যায়ে। দেখিস না পৃথিবীতে যেই দল, সম্প্রদায় বা দেশ যতো শক্তিশালী তারাই রাজত্ব করে? আর দুর্বলকে দলিত করে। এই দেশের সংস্কৃতি ও সভ্যভব্যতা অনুসারে তুই হলি দুর্বল। বাংলাদেশে তোর মতো কালো মেয়ে আসলেই বোঝা। তাই তো রাস্তাঘাটে সব জায়গায় এতো লাঞ্ছিত হচ্ছিস। তবুও বুঝিস না? ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট হিসেবে এই দেশ সম্পর্কিত এতোটুকু জ্ঞান তো রাখবিই। আর সেই অনুযায়ী এই দেশে বসবাসকারী হিসেবে আমি হলাম শক্তিশালী। তোর মতো কালো মেয়ের জায়গা অন্যান্য দেশে যেখানে মানবিকতার বাণীতে রাস্তাঘাট টুইটুম্বুর। এভাবেও তোকে মাহবুবের মা মেনে নিতে পারছে না। লজ্জা তো তোর হওয়া উচিত। যেখানে রূপ প্রাধান্য বিস্তারকারী, সেখানে নিজের কালো বর্ণ নিয়ে অনধিকার চর্চা করতে চাইছিস।”
দানীনের শরীর বিকম্পিত হলো। তার হৃৎপিন্ডও যেনো আজ তাকে পরিহাস করছে। যার তার মুখ দ্বারা নিঃসৃত দুটো বাণীকে অগ্রাহ্য না করতে পারার জন্য বিদ্রুপাত্মক চাহনি নিক্ষেপণ করছে। কিন্তু হৃৎ-সিন্দুক কী অবগত এই হৃদয়ে এই মানুষটিকে কতখানি জায়গাজুড়ে স্থাপিত করেছিলো? সে তো শুধু বন্ধু নয়, বোন ছিলো! শুধুমাত্র রূপের জন্য, সাদা চামড়ার অগ্রাধিকার দেশে জন্মানোর জন্য দানীন আজ তুচ্ছ?
রানিয়া দানীনের শব্দহীন গতিবিধি অবলোকন করে বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“এটাই হওয়ার ছিলো এবং এটাই হয়েছে। যার মূল্য যেখানে, যার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা যেরকম। তুই আমাদের এই দেশ, এই দেশের সমাজের জন্য নস দানীন। যাইহোক, যদি তাড়াতাড়ি এসব মেনে নিবি ততো তাড়াতাড়ি আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। আগের মতো হবে। তোর দুর্বলতা সম্পর্কে তো তোকে উপলব্ধি করতে হবে দানীন। ডোন্ট বি অ্যা চাইল্ড।”
দানীন চেয়ারে শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে দিলো। ক্লান্ত চাহনি রানিয়ার উপর নিবদ্ধ করে অনুচ্চ কিন্তু তেজস্বী কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“যা হওয়ার তা হয়নি রানিয়া। তুই যেটাকে এই দেশের সংস্কৃতি, ধ্যানধারণা হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছিস তা হলো তোদের মতো কিছু নোংরা, গুবরে পোকায় খাওয়া মস্তিষ্কের ধ্যানধারণা। সমাজে মানুষ বসবাস করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের এই দেশে মানুষের থেকে অভুক্ত কুকুর-বিড়ালের আনাগোনা বেশি। তা-ও যেই সেই কুকুর না। যাদের জন্মটা সঠিক পদ্ধতি মা-বাবা সম্পূর্ণ করলেও কর্ম ও ঘৃণিত চিন্তার প্রসারের দ্বারা নিজেদের বেজন্মা হিসেবে তুলে ধরে। মূলত এই দেশটাই এসব কুকুরদের জন্য না, কিন্তু তারা নিশ্চিন্তে বসতি গেঁড়ে বসবাস করছে। এই যে তুই বিশ্বাসঘাতকতা করলি। নিজের রূপের অহংকার দেখিয়ে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলি তা তো হওয়ার ছিলো না রানিয়া। জীবনের অঙ্ক অনেক সহজ। কিন্তু সঠিক সূত্র বাছাই করে তা প্রয়োগ করা বড্ড কঠিন। একবার ভুল সূত্র প্রয়োগ করে ফেললে জীবনচক্রের খাতার মাঝপথে স্তব্ধ হয়ে অঙ্ক কষা থামিয়ে দিতে হয়; অন্যথায় এই ভুল সূত্র প্রয়োগের মাশুল জীবনের খাতার পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে দিতে হয়। তবুও উত্তরপত্রে তা কখনো সমাধান হয় না। আর সমাধানই হলো সুখ ও স্বস্তি। আর এই সুখ, স্বস্তির সমাধানে পৌঁছানোর পূর্বে স্কোয়ার, কিউবের গোলমাল হলো অহংকার, হিংসা, অধৈর্য, রাগ ও লোভ। তোর মধ্যে এই সবকিছু আমি দেখতে পাচ্ছি রানিয়া। সবাই কিন্তু দ্বিতীয়বার অঙ্ক কষার সুযোগ পায় না। থেমে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে নিশ্বাস ত্যাগ করতে হয়।”
রানিয়া বিরক্ত গলায় বললো,
“তবে তুই তোর কষ না দানীন। অন্যকে জ্ঞান দেওয়ার পূর্বে সেই জ্ঞান আগে নিজের মধ্যে প্রয়োগ করা ভালো নয় কী?”
দানীন মৃদু হেসে ওঠলো,
“আমার জ্ঞান আছে। আমার প্রয়োজনের সাপেক্ষে যেকোনো সময় প্রয়োগ করতে পারবো। নিজের মধ্যে স্ব-ইচ্ছায় প্রয়োগ না করতে না চাইলেও পরিস্থিতি প্রয়োগ করতে বাধ্য করাবে। কারণ জ্ঞান তো অন্তত আমার মধ্যে নিহিত আছে। আর যার সেই জ্ঞানটুকুও নেই? সে পরিস্থিতির গ্যাড়াকলে কিভাবে নিজের চক্র ঘুরিয়ে কিনারায় উঠবে রানিয়া? যা করছিস তা বন্ধ কর। তোর এই রূপ এই দেশের পোকামাকড় ও মাছিদের জন্য অবশিষ্ট রাখ। সবাই এসব খেতে চায় না। আর মাহবুবকে তুই যতোই কিছু বুঝানোর চেষ্টা করিস সে আমার, আমারই থাকবে। তুই মাঝপথে নিজের নোংরা মানসিকতার পরিচয় দিস না।”
“মাহবুব কাকে চায় এটা তো সময়ই বলে দেবে দানীন।”
এরপর দুজনই নীরব রইলো।

ঝাড়বাতির নিভু প্রভা ক্যাফের স্বচ্ছ কাচের দরজায় উপচে পড়ে রঙ-বেরঙের রেখা অঙ্কিত করছে। দানীন সেই অননুমোদিত নকশার মুগ্ধতা উপেক্ষা করে কাচ ভেদ করে বাহিরে তাকিয়ে রইলো। মাহবুবের জন্য অপেক্ষা করছে। আজ মাহবুবই এই অযাচিত পরিস্থিতির সমাধান করবে। তার জন্যই তো ছয় বছরের নিগূঢ় বন্ধুত্ব হাস্যোদ্দীপক হিসেবে ঠেকেছে। একলহমায় পাতলা কাগজের মতো নড়বড়ে ও ভঙ্গুর দর্পণের মতো রূপলাভ করেছে। দানীনের মনে গাঢ় অভিমান ঘিরে ধরছে। কার উপর এই অভিমান? মাহবুবের উপর যার সঙ্গে সে আসলেই যায় কিনা নিয়ে সংশয়ে আছে? রানিয়ার উপর যে তার এতো বছরের বন্ধুত্বকে, বিশ্বাসকে গলা টিপে হত্যা করেছে নাকি দেশের উপর? সত্যিই তো। বাংলাদেশে তো গুণের সঙ্গে রূপও জরুরি। বরং মস্তিষ্কে গোবর হলেও চলে কিন্তু কালো, মোটা, খাটো হওয়া যাবে না। মেয়েদের তো কখনোই না। এই দেশ কী সত্যিই তার জন্য নয়? যেখানে মানবিকতার ফলে মানুষ মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষ মনে করে, বাহ্যিক ত্রুটি প্রাধান্য না দিয়ে কাছে টেনে নেয়; সেখানে তার এই ত্রুটি নিয়ে জন্মানোর কি দরকার ছিলো?

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কাচের স্বচ্ছ দরজা ঠেলে মাহবুব প্রবেশ করলো। এসে দানীনের পাশের চেয়ারে চুপচাপ বসলো। দানীন দুজনের উপর চোখ বুলিয়ে মাহবুবের উপর দৃষ্টি স্থাপন করলো। অপেক্ষায় আছে মাহবুব রানিয়াকে কিছু বলবে। এসব পাগলামি বন্ধ করার কথা বলবে। বলবে সে শুধু দানীনকে ভালোবাসে, দানীন ছাড়া তার জীবনে অন্য কোনো রমণীর স্থান নেই। কিন্তু মাহবুব নির্বাক। দানীন চট করে উঠে দাঁড়ালো।
মাহবুব এবার তার দিকে ফিরে প্রশ্ন করলো,
“কোথায় চাচ্ছো?”
“চলে যাচ্ছি।”
মাহবুবও উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। আমরাও যেতে হবে। কাজ..”
দানীন মাহবুবের কাঁধ চেপে বসিয়ে দিলো। কণ্ঠে আঁচ এনে বললো,
“না মাহবুব, তোমাকে যেতে হবে না! আমি থাকলে তোমাকে যেতে হতো। বসো, আমার বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটাও। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করো।”
দানীন এরপর ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলো। এই যে সে প্রচন্ড অভিমান করে অভিমানী কণ্ঠে বললো মাহবুব কী তা বুঝতে পারলো?
তারা দুজন একা থাকুক। মাহবুব নিশ্চয়ই রানিয়াকে ঠিক মতো বুঝিয়ে শুনিয়ে আগের মতো করবে। তার সামনে মাহবুব রানিয়ার প্রতি কোনো কঠিন বাণী নিক্ষেপ করলে তার নিজেরই খারাপ লাগতো। এখনও যে তার কাছে সব দুঃস্বপ্ন বোধ হচ্ছে। সেই দুঃস্বপ্ন যা ঝমঝমে নিঝুম আঁধারে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ব্যক্তির রাতের মধুর ঘুম খানিকের জন্য হরণ করে। আর খানিক বাদে ঘুম ভেঙে অম্লবাণীতে দুঃস্বপ্নদাতাকে কঠিন মুখঝামটা দেয়। এরপর তলিয়ে যায় অতলস্পর্শী সুখশয়নে সুখস্পর্শের প্রয়াসে।

দিবালোকের অমর্ষ আলো দ্বারা অবগাহন করে বৃক্ষরাজির পথ অতিক্রম করে দানীন বাসার উদ্দেশ্যে ছুটে চলছে। রূপাতলি নয়, নলছিটি যাবে। মায়ের উষ্ণ কোলে মাথা রেখে কিছুক্ষণ অশ্রু বিসর্জন দেবে। সব উষ্ণতা, আতপ দেহের জন্য প্রদাহজনক হলেও মায়ের কোলের উষ্ণতা দান করে অদ্ভুত শীতলতা।

বাসায় এসে ব্যাগটা রেখেই মাকে পিছন থেকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। দিলরুবা খাতুন আকস্মিক হামলায় হকচকিত হলেন। মেয়ের স্পর্শ অনুধাবন করতেই কপট রাগ দেখিয়ে মৃদু ধমকে ওঠলো,
“আরে দানীন। এম্মে কেউ ডর দেহায়। দেহি সর। একা একা আইলি কিল্লাই? ফারিহ আহে নাই?”
দানীন নিশ্চুপ হয়ে রইলো। কেউ আসেনি। তার জীবনের প্রিয় দুটো মানুষ কর্পূরের মতো অজানা রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার পথে। তখনই দানীনের ফোন ব্যাগের ভিতরেই ঝংকার তুলে কেঁপে ওঠলো। দানীন মায়ের উষ্ণ স্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যাগের চেইন টেনে ফোন বের করলো। ফোনটি কানের সংস্পর্শে আনতেই ওপাশ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত বার্তা পেলো। তার হাত থেকে ফোন হাত ছিটকে পড়ে গেলো। দানীনের মা-বাবা ব্যতিব্যস্ত হয়ে দানীনের দিকে এগিয়ে এলো।
নাইমোল্লাহ সাহেব আতঙ্কিত হয়ে মেয়েকে ঝাঁকিয়ে জিগ্যেস করলেন,
“কি হইছে আম্মা? এমন করতাছো কিল্লাই? কিছু ঘটছে মা?”
দানীনের কণ্ঠস্বরও যেনো জমাট বেঁধে গেছে। কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আমার একটা ফ্রেন্ড হসপিটাল বাবা। সে আত্নহত্যা..”
দানীন আর কিছু বলতে পারলো। বাড়ির চৌকাঠ অতিক্রম করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছুটলো। পিছন পিছন তার বাবা নাইমোল্লাহ সাহেব তার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আসছেন।

হসপিটালে পৌঁছে দেখলো কেবিনের সামনে মাহবুব পায়চারি করছে। রানিয়ার মা-বাবা এমনকি মাহবুবের মা-বাবাকেও দেখা যাচ্ছে। দানীন ধীর গতিতে এগিয়ে গিয়ে কেবিনের সামনে দাঁড়ালো। বাইরে থেকে রানিয়াকে দেখা যাচ্ছে। তার ডান হাতে ব্যান্ডেজ। এই এতটুকু সময়ের মধ্যে কি হয়ে গেলো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না দানীন।
খানিক বাদেই ডক্টর এসে মাহবুবকে কেবিনে প্রবেশ করতে বললো। পেশেন্ট নাকি তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। মাহবুব হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে প্রবেশ করলে দানীনও তার পিছনে যায়।
মাহবুব গিয়েই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“আ’ম সো স্যরি রানিয়া। আর কখনো তোমাকে কষ্ট দেবো না। আর কখনো ছেড়ে যাবো না।”
দানীন মাহবুবের এসব কথা শুনে আঁতকে ওঠে। মাহবুব এসব কথা কেন ওকে বলছে? মাহবুব কী সত্যিই তার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাবে?
মাহবুব রানিয়ার কপাল, গাল, হাত চুমুতে ভরিয়ে তুলছে। আর দানীনের হৃদয়ে তা একেকটা তীরের মতো বিঁধছে। অদৃশ্য রক্তপাত যদি মাহবুবকে দেখানো যেতো, তবে দেখিয়ে বলতো, ‘এই দেখো মাহবুব, খুব কষ্ট হচ্ছে। এই ব্যাথার সাগরে ডুবে মরছি আমি। প্রথম যেভাবে হাত বাড়িয়ে এই কৃষ্ণকায় মেয়েটি আলিঙ্গন করেছিলে, আজও ক্লায়ক্লেশে রক্তাক্ত দেহকে টেনে তুলে বুকে আগলে রাখো। বিশ্বাস করো, ঐ বুকের উষ্ণতা ছেড়ে কখনো কোথাও যাবো না!’
দানীনের এই আর্তনাদ মাহবুব শুনতে পেলো না। স্বপ্ন ভাঙ্গার ছিলোই যখন স্বপ্নের সুখ রাজ্যে নিয়ে গেলো কেন!

“এরকম একটা পরীর মতো মেয়ে। তোর জন্য মরতে বসেছে। আর তুই কিনা এতোদিন অন্ধ হয়ে কিসে মজেছিলি মাহবুব। যা ওই মেয়েকে এখনই বিদেয় কর। পরে আবার কি ঝামেলা বাঁধায়।”
মাহবুবের মার ঝাঁঝালো কণ্ঠ। তিনি একজন নারী হয়ে কী আরেক নারীর কষ্ট বুঝবেন না?
দানীনের ইচ্ছে করছে মাহবুবের বুকে আছড়ে পড়তে। তখন নিশ্চয়ই তার এই মোহ-মায়া খন্ডিত হবে। দানীন যে সত্যিই তাকে কতখানি ভালোবাসে তা উপলব্ধি হবে। হবে না?
মাহবুব রানিয়ার কপালে চুমু খেয়ে দানীনকে বাহিরে আসতে ইশারা করলো। দানীনও এলো। দানীন জানে, মাহবুব এখন তাকে আশ্বস্ত বাণী শ্রবণ করাবে। রানিয়ার প্রতি তার আচার-আচরণ যে জাস্ট ফর শোয়িং তা স্বীকার করবে। সে এক্ষণই দানীনকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে সারাজীবন পাশে থাকার নিশ্চয়তা দেবে। দানীন ফুস করে নিশ্বাস ফেলে কেবিন ত্যাগ করলে।
বাহিরে আসতেই মাহবুব অন্যদিকে ফিরে বলতে লাগলো,
“আমি দুঃখিত দানীন তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। রানিয়া না থাকলেও তোমার সঙ্গে সম্পর্কের সমাপ্তি হতো। তোমাকে বিয়ে করা নিয়ে এমনিতেই ফ্যামিলিতে অনেক অশান্তি। আর আমি উপলব্ধি করলাম যে..”
মাহবুব দানীনকে এক পলক দেখে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললো,
“আমি তোমাকে ভালোবাসিনি। তুমি নিঃসন্দেহে ভালো মেয়ে দানীন। এতোদিন আমার শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে ছিলে তার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু বিয়ে.. তোমার সঙ্গে সংসারের মতো কিছু আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
দানীন অশ্রুমাখা কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,
“ভালোবাসো না তা আগে উপলব্ধি করোনি?”
মাহবুব অত্যন্ত কষাটে কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“আমি তোমার সঙ্গে অন্তত এই মুহূর্তে কোনো অহেতুক তর্ক করতে চাই না। তোমার সঙ্গে আরও আগেই সবকিছু শেষ করে দেওয়ার উচিত ছিলো। তাহলে রানিয়া আজকে এই বিপদে পড়তো না।”
বলেই মাহবুব তার সামনে থেকে চলে যায়। দানীন তার যাওয়ার পানে চেয়ে দেখে। সে-ও কী রানিয়ার মতো আত্নহত্যার প্রচেষ্টা করবে? মাহবুব কী তখন তার ভালোবাসা উপলব্ধি করে তার কাছে ফিরে আসবে?
খানিক দূরে দানীনের বাবা চুপচাপ বসে আছে। দানীন তার কাছে এগিয়ে যায়।
“বাবা চলো।”
“চইলা যাবি? তোর বন্ধুরে দেখছোস? মাহবুব এহানে কেরে? ওর কিছু হইছে দানীন?”
দানীন আচমকা তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে,
“তোমার মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে বাবা। তোমার এই মেয়ের আর কখনো বিয়ে হবে না। তার স্থায়ী গায়ের রঙের মতো জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের সব রঙও যে কালো। বাবা তোমার মেয়ে অপয়া।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here