শুভ্রময়_পুরঁজন পর্ব_১৫

0
220

#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_১৫
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

১৫.
ভারী শাল গায়ে জড়িয়ে নাক আর চোখ দুটো বের করে নীহারিকাবেষ্টিত ভোর ঠেলে ফুলার রোড দিয়ে সামনের দিকে হেলেদুলে হেঁটে চলছে। বুয়েটের পাশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য চত্বর থেকে শুরু হয়ে নীলক্ষেত পর্যন্ত পৌঁছেছে এই রাস্তা, ফুলার রোড। এই রাস্তাটির পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের ছোট্ট ছিমছাম কলোনী। আরেকপাশে ঢাবির হল। অরূণোদয় হতে আরও দেরি। মসৃণ পাকা রাস্তার দুই ধারের চিরহরিৎ বৃক্ষরাজি তার তেজস্বী, উদ্যমী হরিদ্বর্ণ রূপ হারিয়েও মাথা উঁচিয়ে আছে। বিরল ও বয়স্ক গাছগুলো মোটা ডালপালা প্রসারিত করে কুয়াশার চাদরে আবৃত ভোরকে শোভাময় করার প্রচেষ্টায় রত। নিঝুম কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরকে বিবর্ণ-মলিন হয়ে যাওয়া পাতার ছায়ায় পথকে যেনো আগলে রাখতে চাইছে।
বরিশালে থাকাকালীন দানীন প্রায়ই লুকিয়ে হাটতে বের হতো। শিশির ভেজা ঘাস পায়ের নমনীয় স্পর্শ দ্বারা আদর করতো। হাতের শুষ্ক আদরনীয় সংস্পর্শে লাল-গোলাপী প্রর্তুলিকারা নৃত্য পরিবেশনে উদ্যোগী হতো। দানীনের শীতকাল সবচেয়ে বেশি প্রিয়। এই কুয়াশার মতো তার জীবনটাও কেমন ঝাপসা, নিশ্চুপ ও অস্পৃশ্য। গ্রীষ্মকালের তপ্ত রোদের প্রখরতা যেমন চারপাশ ঝলসে উজ্জ্বল করে দেয়, তেমনই যেনো তার গায়ের রঙকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহিত স্পষ্ট করে তুলে। আর এই তাচ্ছিল্য থেকে বাঁচার প্রযত্নে কুয়াশার মতো নিবিড় চাদরে নিজেকে মোড়িয়ে সে যেনো ক্ষান্ত হয়। খানিক নীরবে স্বস্তির দম ফেলে।

বিবর্ণতা ঝাঁপিয়ে রহস্যময়ী করা ফুলার রোডে হাটতে হাটতে আচমকা দানীন সজোরে কোনো বস্তুর সঙ্গে ধাক্কা খায়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়। শীতের প্রকোপ গ্রামাঞ্চলের মতো অত্যাধিক না হলেও গাঢ় কুয়াশার জন্য ঢাকার রাস্তাঘাটে দুই হাত সামনে ব্যতীত কিছু দেখা যায় না। আর এই কাক ডাকা ঊষাকালে তার মতো পথঘাট বিচরণ করার চিন্তা স্মরণে নিশ্চয়ই কোনো সুস্থ মানুষ আনবে না।
যদিও সে অত্যাধিক সুস্থ-সবল মানুষ।

প্রথমে ভাবলো দেওয়াল বা গাছের সঙ্গে ধাক্কার মাধ্যমে তার দেহ কোলাকুলি করলো নাকি। কিন্তু এতো নমনীয় ধাক্কা! হাত মেলে সম্মুখে উপস্থিত বস্তুকে স্পর্শ করে এক কদম অগ্রসর হতেই পরিলক্ষিত হলো এক জোড়া চোখ। পূর্ণ নেত্রপল্লব মেলে উপলব্ধি হলো শুভ্র ন্যায় ঝলমলে চেহারার এক সুদর্শন পুরুষ। উচ্চতা ছয় ফুট বা এর কাছাকাছি হবে। যার ফলে পাঁচ ফুটের আশেপাশে দানীনকে হা করে মাথা উঁচু করে তাকাতে হচ্ছে। প্রথমে ভয়ই পেলো। পরক্ষণেই বিষ্ময়াবিষ্ট হয়ে ব্যক্তিটির গাল থেকে হাত গুটিয়ে নিলো। কাটা কাটা চেহারা নিয়ে ভিতর তীক্ষ্ণতায় ঘা করে দেওয়ার মতো চাহনি নয় যা আকর্ষিত করে এবং একই সঙ্গে ভীতি প্রদর্শন করে। দানীন জানতো সুদর্শন পুরুষ এরকমই কাটা কাটা চেহারার অধিকারী হয়।
কিন্তু এই ব্যক্তিটির? কি শুভ্রময় চাহনি যা সমস্ত পুরঁজনকে পুলকিত করে তুলে!
পুরুষ মানুষ এতো ফর্সা কেন হবে? না, তার অভ্যন্তরীণ শুভ্রতা এই কুয়াশাচ্ছন্ন উষসী তুলে ধরেছে? আকর্ষিত করে বা ভিতর দেবে দেওয়া বস্তু দানীনের বড্ড অপছন্দ। তবে কী দানীনের পছন্দ-অপছন্দ অবলোকন করে এই পরিবেশ, এই প্রকৃতি পুরুষটির নিজস্ব গড়ন-রূপ বদলে আলাদাভাবে এই চেহারা, এই চাহনি তৈরি করেছে? চাহনি কি স্নিগ্ধ, আর কি গভীর আঁখিজোড়া! এই নয়নে যেনো উপচে পড়া মমতা, নির্বাক নিশ্চয়তা, নিয়ন্ত্রিত আবেগ প্রাণোচ্ছলে সাতার কাঁটছে। যে কেউ শান্তির খোঁজে হাতছানি দিয়ে ওই চোখের নিগূঢ়তত্ত্বে সেচ্ছায় পতিত হবে।

ছেলেটির এরকম তাকিয়ে থাকায় দানীনের ভ্রু কুঁচকে এলো।
“কি আশ্চর্য!”
ছেলেটি তার প্রশান্তিদায়ক হাসি থেকে ঠোঁট আরও বিস্তৃত করে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
দানীন খানিক অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ঢোঁক গিলে সালামের উত্তর প্রদান করলো,
“ওয়াআলাইকুমুস সালাম।”
“এই কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে একা হেঁটে চলছেন? এখনও তো নিঝুম রাতের মতোই চারপাশ নিষ্ক্রিয়। কেউ যদি হাত-পা বেঁধে কুন্ডলী পাকিয়ে বস্তায় ভরে তুলে নিয়ে যায়?”
দানীন এবার বিরক্ত হচ্ছে। প্রচন্ড মাত্রায় বিরক্ত।
অতীতের শান্তশিষ্ট দানীন বর্তমানে অনেক রুষ্ট এবং ধৈর্যচ্যুতি মুহূর্তেই হয়ে যায়। সোজাসুজি ছাড়া ভঙ্গিমা করে কথা বললেই সামনে থাকা ব্যক্তিটিকে ঠাডিয়ে গাল-চাপায় লাগাতে ইচ্ছে করে। আর সে তার স্টুডেন্টদের ঠাস-ঠুস লাগায়ও। টিচার প্রফেশনে যোগ দেওয়ার পর থেকেই দানীনের এই হুটহাট মেজাজ খারাপ হওয়ার বাতিক হয়েছে। এখন যেনো তা তরতর করে বাড়ছে।
দানীন চোখ পাকিয়ে বললো,
“তুলে নিয়ে যাবে মানে? আমি তো আর বলবো না, ‘বাবু আয়। এই নে হাত, এই ধর ঠ্যাং। এবার স্টার প্লাসের সাপের মতো নাগিন ডান্স দে। আর আমি কুমিরের মতো হাবুডুবু খেয়ে বস্তায় ঢুকি।’ ননসেন্স!”
দানীন বিরক্তি ভরা চাহনি দিয়ে অন্যদিকে ফিরলো। পরক্ষণেই ভিতরে ভিতরে আঁতকে উঠে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করলো,
“আপনি তুলে নেবেন?”
ছেলেটি সশব্দে হেসে ওঠলো। দানীন বোকার মতো প্রশ্ন করেছে উপলব্ধি করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।
তখন ছেলেটি নিজের কোমরে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“দেখে কি মনে হয়? আমার এই কোমরের নাগিন ডান্সে কী আপনার আকর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে? দড়ি হবে? থাকলে একটু কোমরটা মেপে দেখতেন। চিকন তো করা যাবে না। শক্তপোক্ত নাগিন দেহের নাচুনি দেখতে চাইলে প্যান্টের ভিতর তেনা-তুনা ঢুকিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে।”
দানীন আশ্চর্যান্বিত হয়ে চোখের আকৃতি কুঞ্চিত করে জিগ্যেস করলো,
“তেনা-তুনা কি?”
ছেলেটি দ্বিগুণ আশ্চর্যান্বিত হওয়ার অঙ্গবিক্ষেপ করে দুই গালে হাত ঠেকিয়ে বললো,
“ওমা! চিনেন না? ঐ যে রান্নার তেলকুচা পাতিল তেনায় ধরে তুনায় রাখে। ঘর মোছা, হাগাখানা মোছার কাজেও এই তেনা-তুনা ব্যবহৃত হয়।”
দানীন হতবুদ্ধি চোখে চোখ পিটপিট করে ঠান্ডা নাকটা খানিক ঘষলো। শহরে কী জ্বীনের আনাগোনা সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। সে যেমন বরিশাল থেকে এখানে এসে থাকছে। এই তেনা-তুনা বিশেষজ্ঞ জ্বীনও নিশ্চয়ই ভুলবশত এখানে এসে জুটেছে। জ্বীন না হলে এতো সুন্দর হবে কেন? জ্বীনটা কী গে? না হলে কোমর ঢুলিয়ে ডান্স দিতে চাইবে কেন। ইয়া আল্লাহ! দানীন অভ্যন্তরীণ অনপেখিত ভয় অভ্যন্তরেই ঠেসে রাখতে চাইছে। এমন সুদর্শন একটা জ্বীন গে! কিন্তু গে হলে তাকে তো তুলে নেবে না। তবে কী মিশেল টাইপ জ্বীন? গে-লেসবিয়ান একই সঙ্গে প্রদর্শিত হয়? হায় হায় খোদা!

“কি হলো ম্যাডাম? তেনা-তুনা পছন্দ না? আপনার শরীরে প্যাঁচানো ওই সাত মণ ওজনবিশিষ্ট শাল দিয়ে চলবে?”
দানীন রোবটের মতো নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,
“আপনি আমাকে কোথা থেকে ফলো করছেন? আমার ফ্ল্যাটের কাছের ঐ তেঁতুল গাছটি থেকে?”
পরক্ষণেই কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
“বিশ্বাস করুন, বিছার জন্য ওটাকে আমি কাটতে বলেছিলাম। আপনার বাসস্থান জানলে জীবনেও নজর দিতাম না। আচ্ছা আপনি কী ওই বড় মগডালে থাকেন? ওটা অনেক দাপাদাপি করে তো, হে হে।”
ছেলেটির ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। আর দানীন ভয়ে আধামরা। ওর ইচ্ছে করছে এক্ষণই রাস্তায় পা ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বিলাপ জুড়ে দেয়। লোকজন না আসা অবধি ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। কিন্তু তেনা-তুনা বিশেষজ্ঞ জ্বীন বাবাজি রাগান্বিত হয়ে থাপ্পড় মেরে দিলে? মায়ের কথা আর কখনো অমান্য করবে না। চাকরি-বাকরি ছেড়ে মা তার কাছে থাকতে বলেছে, মায়ের কাছেই থাকবে। চাকরি-বাকরি গোল্লায় যাক। কে জানতো রাজধানীর মতো একটা জায়গায় সে এমন সুদর্শন কোনো জ্বীনের কবলে পড়বে।
ছেলেটির অবাক হওয়া কণ্ঠ দানীনের কানে এলো। সে বলছে,
“আমি কেন আপনাকে ফলো করবো? আমার তো মনে হচ্ছে আপনি আমাকে ফলো করছেন। ফলো করতে করতে নীলক্ষেত রোডে চলে এসে সজোরে ধাক্কাও মারলেন।”
সৌমদর্শন গে-লেসবিয়ান মিশেল জ্বীনের আফসোস করা থেকে বের হয়ে দানীন দুই ভ্রু সঙ্কুচিত করে জিগ্যেস করলো,
“আপনি মানুষ?”
“কি আশ্চর্য! এতো সুন্দর শারীরিক গঠন নিয়ে মানুষ না হয়ে তো আর ভুত-প্রেত হবো না।”
তৎক্ষণাৎ দানীনের অভ্যন্তরীণ কাঁপাকাঁপি বন্ধ হয়ে গেলো। পুরো মুখ জুড়ে ভর করে এক আকাশসম রাগ। সে সত্যিই ভয় পেয়েছিলো। কিন্তু এই অসময়ে কোনো পুরুষের এমন অযাচিত ঠাট্টা উপলব্ধি করে মাথাটা ফের দপদপ করে গরম হচ্ছে। ঠাডিয়ে দুইটা চড় সঙ্গে বিশেষ জায়গায় কষে.. পরবর্তী ইচ্ছাটা গুরুত্ব দিলো না।
শালে আবৃত দানীনের অমর্ষিত মুখায়ব ঠাহরে অপারগ ছেলেটি একবার তাকে চক্কর দিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“ওখানে কিন্তু আরও তিনজন আছে সুন্দরী। ঐ যে পিছনে মাইক্রোবাস, চাইলে আমরা সবাই তোমাকে একেকজন একেকরকম নৃত্য পরিবেশন করে দেখাবো। তুমি খুশি হয়ে টাকা উড়াবে। তুমি হবে আমাদের ছেলে ধরা সংস্থার লিডার। কি হলো সুন্দরী? শব্দহীন কেন?”
চক্রাকারে ঘুরে ছেলেটি দানীনের খুব কাছে দাঁড়ালো। হুট করেই আপনি থেকে তুমিতে কনভার্ট; তার উপর এরূপ শীতল কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই দানীনের শিরদাঁড়া বরাবর শীতল স্রোত প্রবাহিত হলো। উঁকি মেরে ছেলেটির পিছনে দেখার চেষ্টা করলো। কুয়াশার জন্য নীলক্ষেত রোড না কোন রোডে এসেছে বুঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ছেলেটি যে তেনা-তুনা জ্বীন না হলেও তেনা-তুনা ছেলে ধরা ডাকাত তাতে আর এক শিশির বিন্দু পরিমাণও সন্দেহ রইলো না দানীনের।
এরূপ মিষ্টি হাসি, মিষ্টি কথার তোড়েই তো মানুষ চুরি করে হয় ফুরুৎ! ফারিহ’র ছোটো বেলার বলা মানুষ চোর।
দানীন তীর্যক দৃষ্টিতে চারপাশে লাঠি খুঁজলো। এখনই যদি চার-পাঁচজন লোক এই লোকটার সঙ্গে এসে দাঁড়ায় কি করবে সে? এক কাজ করা যায়। কুয়াশাচ্ছন্ন পথে সজোরে দৌঁড়ে ছুটলে ধরতে কষ্টকর হবে।
দানীন ছেলেটির উদ্দেশ্যে সৌজন্যমূলক হাসি নিক্ষেপণ করে বিসমিল্লাহ উচ্চারণ করলো।
ছেলেটি ভ্রু নাচিয়ে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই নাক চেপে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠলো। কারণ দানীন ছেলেটির নাক বরাবর ঘুসি মেরেছে। এরপর উল্টোপথে ভোঁ দৌঁড়!
দানীন চোখ বন্ধ করে অন্ধ বাবা হয়ে দৌঁড়াচ্ছে আর উচ্চ স্বরে বলছে,
“যা যা, জাহান্নামে যা ছেলে। তোর এই সুন্দর মুখ নষ্ট হয়ে যাক। অবিবাহিত থাকবি তুই ছাগল!”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here