প্রথম_প্রেমের_উষ্ণতা #পর্বঃ০৪

0
460

#প্রথম_প্রেমের_উষ্ণতা
#পর্বঃ০৪
#ফারজানা_আক্তার

পুরো ঘর জুড়ে নিরবতা। কারো মুখে নেই কোনো কথা। সেকেন্ড পর পর এক গ্লাস করে পানি পান করে যাচ্ছে লিজা। সম্ভবত কিছু একটা মেনে নিতে পারছেনা সে, চিন্তার চাপ রিক্তার চোখেমুখে। রিক্তা ধীর কন্ঠে লিজাকে জিজ্ঞেস করে “কি হয়েছে রে হঠাৎ তোর? এতো অস্থির হয়েছিস কেনো হুট করে?”

“মায়া তোদের ঘরে কি করে? কি লাগে তোর?”
রিক্তার হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে লিজা। রিক্তা কি বলবে বুঝতে পারছেনা তাই সে কাঁচুমাচু করছে। নিজের স্বামীর এমন কুকর্মের কথা কিভাবে মানুষকে বলবে সে, তার যে ভীষণ লজ্জা করছে। লিজা আবার জিজ্ঞেস করতেই রিক্তা বলে “তুই কি মায়াকে চিনিস?”

“আগে তুই বল মায়া তোদের ঘরে কি করছে?”

“নিবিড় মায়াকে ভালোবাসে, আমার বিয়ের আগে থেকেই মায়ার সাথে নিবিড়ের সম্পর্ক। ”
এতোটুকু বলেই চুপ হয়ে যায় রিক্তা। আঁতকে উঠে লিজা। রিক্তার চুপটিতে লিজা বুঝে নেয় সব।

“তারমানে তোর স্বামী নিবিড় এই মায়াকে বিয়ে করে এনেছে তাইতো?”

লিজার প্রশ্নে রিক্তা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। মাথায় হাত দিয়ে বসে যায় লিজা।
তখন সেখানে উপস্থিত হয় জায়েদা সুলতানা।জায়েদা সুলতানাকে দেখে সালাম দেন লিজা। এতোক্ষণ তাদের বলা সব কথা শুনেছেন জায়েদা সুলতানা। তাই তিনি লিজার কাছে সব জানতে চাই মায়ার সম্পর্কে। লিজা বলতে না চাইলেও জায়েদা সুলতানার জোরাজুরিতে বলতে শুরু করলো

“আমার স্বামীরা দুই ভাই, একজন আমার স্বামী আর দ্বিতীয়জন আমার দেবর শিশির। শিশির আমাকে ভাবি কম বোন বেশি মানে। আমার বিয়ের পর পরই শিশির আমার সাথে ওর জীবনের একটা বিশেষ অংশের কথা শেয়ার করে আর সেই অংশের মূল চরিত্র মায়ার। মায়াকে ভীষণ ভালোবাসে শিশির। মায়ার সাথে শিশিরের প্রথম দেখা এক বিয়ে বাড়িতে, তখন থেকেই টুকটাক কথা হতো তাদের কিন্তু কিভাবে জানি মায়া শিশির কে নিজের মায়ায় আবদ্ধ করে ফেলে। শিশিরের এমন অবস্থা হয়েছিলো যে মায়াকে ছাড়া ওর নিঃশ্বাসও যেনো চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে তাই আমরা পুরো পরিবার আলোচনা করে আমার বিয়ের ৩মাসের মধ্যেই শিশির আর মায়ার বিয়ে করিয়ে দেয়। আচ্ছা রিক্তা তোর মনে আছে আমি তোর বিয়েতে আসতে পারিনি?”
রিক্তা আবার মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। মায়া আবার বলা শুরু করে

“হুম এই কারণেই আমি তোর বিয়েতে আসতে পারিনি, এক তো আমার নতুন নতুন বিয়ে হয়েছিলো তখন সবে তারপর একমাত্র দেবরের বিয়ে নিয়ে ব্যাস্ত। বিয়ের পর কয়েকমাস ভালোই ছিলো তারপর থেকে মায়ার ব্যবহার কেমন জানি চেঞ্জ হতে শুরু করলো খারাপ হতে লাগলো সবার সাথে, প্রথমে শুধু শিশিরের সাথে করলেও খারাপ ব্যবহার পরে পুরো পরিবারের সাথেও শুরু করলো। আমি তখন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। যেদিন সবাই জানতে পারে আমি মা হতে চলেছি সেদিন থেকে আমার শাশুড়ী আর ননদ এবং ঘরের সকলে আমার খুব খেয়াল রাখতে শুরু করলো,আমাকে নিয়েই মেতে থাকতো পুরো পরিবার যেটা মায়ার কিছুতেই সহ্য হতোনা। একসময় মায়া শিশির কে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু শিশির কিছুতেই আলাদা হবেনা বলে ঠাঁই ছিলো। তারপর একদিন শুনি বিয়ের ৫/৬মাস পর থেকেই মায়া পরকীয়ায় লিপ্ত আর সেদিন থেকেই শিশির আর মায়ার মধ্যে ঝগড়া হতো প্রতিদিন। শিশির ধীরে ধীরে মানসিক রোগী হয়ে উঠে তখন থেকে। এসবের মাঝে আমি কিছু বলিনি যেহেতু মায়া আমাকে একটুও সম্মান করতো না তাই। তবুও মায়া সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতি টা আমারই করলো”

শেষের কথাটা বলতেই লিজার গলা ধরে এসেছে, কিছুতেই সে আর কথা বলতে পারছেনা কান্নার জন্য। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ লাল হয়ে আসে লিজার। লিজার সাথে রিক্তাও কেঁদে ফেলে, চোখের সামনে কাউকে কাঁদতে দেখলে নিজের চোখের জল ধরে রাখা বড্ড দায়। জায়েদা সুলতানা লিজার মাথার উপর হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে একটু শান্ত হয়ে বলো বাকিটা তারপর লিজাকে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো তারা। চোখের জল মুছে অন্তরীক্ষে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কান্না জড়িতো কন্ঠে লিজা বললো “একদিন শিশির আর মায়ার মধ্যে প্রচন্ড ঝগড়া হচ্ছিলো আর সেদিন তারা ড্রয়িংরুমেই ঝগড়া করছিলো, সেদিন শিশির ভীষণ রেগে ছিলো কারণ ওইদিন শিশির নিজ চোখে মায়াকে তার প্রেমিকের সাথে খুব কাছাকাছি অবস্থায় দেখেছিলো। তো আমি সেদিন সোফায় বসেছিলাম, ওদের ঝগড়ার বেগ বাড়তেই আমার শ্বাশুড়ি মা আমাকে রুমে চলে যেতে বলেন তাই আমিও চুপচাপ উঠে দাঁড়ালাম রুমে যাওয়ার জন্য তখনই মায়া শিশিরের সাথে হাতাহাতি লাগিয়ে দিয়েছিলো। আমি পা বাড়াতেই মায়া হাতাহাতির উচিলায় নিজে নিজে আমার গায়ের উপর এসে পরলো আমি তাল সামলাতে না পেরে সোফার উপর পরে যায় আর সোফাটাও উলটে যায়, সোফা উল্টাতেই আমি সোফার উপর থেকে পরে গিয়ে যেয়ে ওয়ালের সাথে ধাক্কা খাই। পরে আমার অবস্থা সিরিয়াস দেখে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তার আমার বাচ্চাকে মৃত ঘোষণা করেন। বিশ্বাস কর রিক্তা সেদিন আমার মনে হয়েছিলো এই পৃথিবীতে প্রকৃত মানুষ চেনা সব চেয়ে বড় কঠিন কাজ। পরে মায়া সব শিশিরের দোষ দিয়ে দেয়, মায়া বলে শিশির নাকি ওকে ধাক্কা দিয়েছে কিন্তু এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিলো, আর কেউ না জানুক তবে আমি জানি মায়া সেদিন এটা ইচ্ছে করেই করেছে। আমার বাচ্চা মারা যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই শিশির মায়াকে তালাক দেয়। দেড়মাস হলো মাত্র ওদের ডিভোর্স হয়েছে আর এর মধ্যেই সে নিবিড় কে বিয়ে করে নিলো, ছি ওর মতো জগন্য মেয়ে আমি আর একটাও দেখিনি এই এক জীবনে। আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি ওর সম্পর্ক নিবিড়ের সাথেই ছিলো, জেনেশুনে একটা বিবাহিত মেয়ের সাথে সম্পর্ক কেনো করলো নিবিড় তাও ঘরে বউ রেখে মাথায় আসছেনা আমার।”

রিক্তা সব শুনে যেনো থমকে যায়, ভয় হচ্ছে রিক্তার যদি ওর সাথেও এমন কিছু করে ফেলে মায়া। রিক্তা হুট করেই জায়েদা সুলতানার হাত ধরে বলে উঠে “মা আমি এই বাসায় আর থাকবোনা প্লিজ, আমি চলে যাবো যেখানে কেউ আমায় চিনবেনা জানবেনা”।

রিক্তার এমন কথা শুনে অবাক হয় লিজা। চট করে প্রশ্ন ছুঁড়ে লিজা রিক্তার দিকে “কেনো? কিসের ভয়?”
তখন জায়েদা সুলতানা বলেন রিক্তা অন্তঃসত্ত্বা, আর এটা তারা শ্বাশুড়ি বউমা ছাড়া কেউই জানেনা। এখন যদি মায়া জানে তবে সে নিশ্চয়ই রিক্তার কোনো না কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে আর এই ভয়-ই রিক্তাকে ভেতরে ভেতরে নরম করে দিচ্ছে। সব শুনে লিজা বললো তার সাথে রিক্তাকে নিয়ে যাবে কিন্তু রিক্তা রাজি হলোনা এভাবে বান্ধবীর বাসায় যেতে আর জায়েদা সুলতানাও মত দিলেননা এই বিষয়ে। তারপর লিজা বললো মায়াকে ঘর থেকে বের করে দিতে কিন্তু সেটাও সম্ভব না। এবার বেশ চিন্তায় পরে গেলো সবাই। সাবধানে থাকতে হবে রিক্তাকে।
____________

লিজা বাসায় পৌঁছেই তার শ্বাশুড়ি ননদের সাথে শেয়ার করে সব। শিশিরের অবস্থা মোটেও ভালোনা, নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে ছেলেটা। লিজার সাথে যা হয়েছে সেই সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করছে শিশির। ভালোবেসে এভাবে ঠকবে ভাবেনি কখনো শিশির। শিশির রিক্তাকে ঘৃণা করে খুব কিন্তু ভালোওবাসে খুব করে এখোনো। লিজা তার ননদ মানহাকে জিজ্ঞেস করে শিশির কোথায়, সে বলে রুমেই আছে। তারপর লিজা রান্নাঘরে যেয়ে এক মগ কফি নিয়ে শিশিরের রুমের দিকে এগোই। কফি খেতে ভীষণ ভালোবাসে শিশির যেটা মায়ার খুব বিরক্তি লাগতো। একদিন এমন হয়েছিলো যে শিশির অফিস থেকে ফিরে খুব টায়ার্ড ছিলো আর মায়ার থেকে এক মগ কফি চেয়েছিলো সেদিন মায়া শিশিরের মুখের উপর বলে দেয় যে সেও সারাদিন ঘরের কাজ করে টায়ার্ড তাই পারবেনা সে কফি বানাতে আর শিশিরকে বলে নিজে বানিয়ে খেয়ে নিতে। অথচ মায়া ঘরের কোনো কাজ-ই করতো না। লিজা শিশিরের রুমের সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে যায়, অনেক ভেবে চিন্তে খানিক থেমে থেকে লিজা শিশিরের রুমের দরজা খুলে দেখে সম্পূর্ণ রুম অন্ধকার, লিজা রুমে আলো জ্বালাতেই এক পা পেঁছনে সরে যায় সে, আলো জ্বালিয়ে যেটা দেখেছে সেটা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা সে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here