#প্রথম_প্রেমের_উষ্ণতা
#পর্বঃ০৩
#ফারজানা_আক্তার
এতো নির্লজ্জ মেয়ে কেনো তুমি? কোন অধিকারে তুমি আমার স্বামী কে টাচ করতে আসো? নিবিড় এখন আমার স্বামী, শুধুই আমার। তুমি নিবিড়ের অতীত শুধুমাত্র। ”
রিক্তা ঔষুধ লাগানোর জন্য মাত্র নিবিড়ের হাত ধরতে যাবে ঠিক তখনই কোথায় থেকে মায়া এসে রিক্তাকে ধাক্কা লাগিয়ে দেয় আর উপরোক্ত কথাগুলো বলে। মায়া তো বুঝেই না যে ভালোবাসার কাছে সবাই-ই নির্লজ্জ হয়, নিজের ভালোবাসার গায়ে মানুষ সামান্য পরিমাণ আঘাত সহ্য করতে পারেনা আর এখানে তো রিক্তার ভালোবাসার মানুষের হাত রক্তান্ত। মায়া রিক্তাকে এতোগুলো কথা শুনালেও রিক্তা কিছু বলেনা শুধু অশ্রুসিক্ত চোখে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে একনজরে। নিবিড়ও কিছু বলেনি, নিবিড়ের চুপ থাকা টা যেনো মানতে পারছেনা রিক্তা। মায়া নিবিড়ের হাতে ঔষুধ লাগিয়ে দিচ্ছে আর সেই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিক্তা দেখছে, এর চেয়ে বড় অপমান আর বেদনার কি বা হতে পারে একজন স্ত্রীর জন্য। মায়া ঔষুধ লাগানোর ফাঁকে বাঁকা চোখে রিক্তার দিকে তাকাই। রিক্তা আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে আবার নিজের রুমের দিকে ছুটে যায়।
“রিক্তার মনে পরে যায় সেই দিনের কথা যখন রিক্তা আর নিবিড়ের নতুন নতুন বিয়ে হয়েছিলো। বিয়ের কয়েকদিন পর পরই একদিন ছোট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিলো নিবিড়ের, সেদিন খুব যত্ন করে রিক্তা নিবিড়ের হাতে ঔষুধ লাগিয়ে দিয়েছিলো মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছিলো নিবিড়কে।” সেসব দিনের কথা মনে পরতেই ফিক করে হেঁসে ফেলে রিক্তা নিজের অজান্তে। তখনই নিবিড় রুমে আসে ওর অফিসের কিছু কাগজপত্র ছিলো কাবাডে সেগুলো নিতে। রিক্তাকে হাসতে দেখে যেনো চমকে যায় নিবিড়, রিক্তা নিজেও অপ্রস্তুত ছিলো এমন মুহুর্তের জন্য। নিবিড় আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে রিক্তাকে “কি হয়েছে? এতো খুশি কিসের তোমার?”
“আমার স্বামী বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে ঘরে উঠেছে আজ, এটা তো খুব আনন্দের ব্যপার আমার জন্য তাই হাসতেছি”।
কিছুটা শক্ত গলায় বলে কথাটি রিক্তা। রিক্তার এমন জবাব পেয়ে আর কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছিলোনা নিবিড় তাই সে দ্রুত কাগজপত্র গুলো নিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। রিক্তা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছুক্ষণ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রিক্তা পা বাড়ায় রান্না ঘরের দিকে, যতদিন এই ঘরে আছে অন্তত ততদিন সবার জন্য রান্নাটা করতে চাই সে। রান্না ঘরে পা রাখতেই দেখে জায়েদা সুলতানা সব রান্না সেরে ফেলেছে। রিক্তাকে দেখে জায়েদা সুলতানা মুচকি হাসি দিয়ে বলে ” সারাদিন তেমন কিছু খাসনি, আমি এখন ভাত মেখে খাইয়ে দিবো তোকে, না করতে পারবিনা কিন্তু তুই।”
“নাহ মা, এশার নামাযের পর খাবো একেবারে”।
“এখন একবার খাবি এশার নামাযের পর আবার খাবি। মনে রাখিস এখন আর তুই একা নয়, তোর মাঝে এখন আরেকটা অস্তিত্বও বেড়ে উঠতেছে।”
জায়েদা সুলতানা কথা বলতেই রিক্তা উনার মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলেন। জায়েদা সুলতানা এর কারণ জানতে চাইলে রিক্তা কিছুক্ষণ আগের ঘটনার কথা বলে আর মায়া কেমন ধরনের মেয়ে সেটাও বলে। রিক্তা মায়ার অল্প কথায় বুঝে যায় যে মায়া খুব সুবিধার মেয়ে নয় তাই শাশুড়ী কে বলে যেনো নিবিড় ওর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কথা যেনো জানতে না পারে কোনোমতে কারণ নিবিড় জেনে গেলে মায়ার জানতে সময় লাগবেনা। রিক্তা ভয় পাচ্ছে কারণ রিক্তার মনে হচ্ছে মায়া জানলে সে তার সন্তানের ক্ষতি করতে চাইবে আর তাই সে তার ভয়ের কথা জায়েদা সুলতানা কেও বলে। জায়েদা সুলতানা রিক্তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। তারপর রুমে নিয়ে যেয়ে নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দেয় রিক্তাকে। শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে রিক্তা ভাবতে থাকে “এই মানুষটা তার জীবনে না আসলে হয়তো সে কখনো জানতেই পারতো না মা কেমন হয়। রিক্তার মনে হয় জায়েদা সুলতানা তার জীবনে এসে তার অসম্পূর্ণ জীবনটাকে পূর্ণতা দিয়েছে।
________________
রাতে খাবার টেবিলে বসে আছে মায়া আর নিবিড়। তখন রিক্তা আর তার শাশুড়ী খেয়ে ঘুমাতে চলে গিয়েছে। নিবিড় জায়েদা সুলতানা কে আওয়াজ দেয় কয়েকবার কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই উনার। এক পর্জায়ে নিবিড় রেগে গিয়ে মায়াকে বলে রান্না ঘরে যেয়ে দেখে আসতে কোনো খাবার আছে কিনা কারণ ডাইনিং টেবিলে কোনো খাবার রাখা ছিলোনা। নিবিড়ের রাগ দেখে মায়া কোনো কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। রান্না ঘরে যেয়ে মায়া ফ্রীজ হতে সব চেক করে নিলো কিন্তু কোথাও কোনো রান্না করা খাবার পায়নি সে। নিবিড়কে এসে বললে নিবিড় বুঝে যায় যে তাদের জন্য ইচ্ছে করে কোনো খাবার রাখা হয়নি তখন সে মায়াকে বলে দ্রুত কোনো খাবার বানিয়ে নিয়ে আসতে, রাত তখন ১১টা ৫০মিনিট ৪৬সেকেন্ড। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মায়া বলে “আমি তো তেমন কিছু রান্না করতে পারিনা আর এতোরাতে কি বা রান্না করবো আমি?”
মায়ার এমন কথায় কিছুটা রাগ হয় নিবিড়ের কিন্তু সে তেমন রাগান্বিত কিছু না বলে শান্তভাবে বলে যে যা পারে তা বানিয়ে আনতে। এই মুহুর্তে নিবিড়ের সব রাগ রিক্তার উপর কারণ রিক্তা জানে নিবিড় রাতের খাবারে কি খেতে পছন্দ করে তবুও সে ওর জন্য কোনো খাবার রাখেনি তাই। রিক্তা তার শাশুড়ীর সাথে নিবিড় আর মায়ার অবস্থা দেখতেছে আঁড়ালে দাঁড়িয়ে। শাশুড়ীর মুখে হাসি থাকলেও রিক্তার মুখে কোনো হাসি নেই কারণ নিবিড়ের প্রতি রিক্তার ভালোবাসা পবিত্র। মানুষ কখনোই তার ভালোবাসার কষ্ট সহ্য করতে পারেনা যা-ই হয়ে যাক না কেনো। নিবিড় রিক্তার সাথে এতোকিছু করার পরেও নিবিড়ের প্রতি রিক্তার এক অন্যরকম টান রয়েই গেছে, রিক্তা যে নিবিড়ের সন্তানের মা হতে চলেছে এটা তো আর মিথ্যা নয়। রিক্তার খুব ইচ্ছে করছে নিবিড় কে বলতে যে সে তার সন্তানের মা হতে চলেছে কিন্তু রিক্তা চাইলেও বলতে পারবেনা এখন আর, যে তাকে সন্তান জন্ম দেওয়ায় অক্ষম অপবাদ দিয়ে ছাড়তে চেয়েছে তাকে, তাকে রিক্তা কখনোই জানতে দিতে চাইনা এই সত্যি টা আর এখন তো মায়া নামের নতুন বিপদ আছেই এই ঘরে এখন তো মোটেও জানানো যাবেনা।
মায়া দীর্ঘ ১ঘন্টা পর নিবিড়ের জন্য খিচুড়ি রান্না করে নিয়ে আসে ডাইনিং টেবিলে। নিবিড়ের সামনে খাবার থাকলেও সে খাবার মুখে দিতে পারছেনা কারণ তার ডান হাত কাটা। নিবিড়ের মনে পরে যায় সেদিনের কথা যেদিন ওর হাতে বেন্ডেজ করা থাকাই রিক্তা তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছিলো। নিবিড়কে না খেয়ে বসে থাকতে দেখে মায়া বলে “কি হলো, খাওয়া শুরু করো। আগে তুমি খাবে তারপর আমি কারণ এই প্রথম কিছু রান্না করেছি আমি তোমার জন্য।”
নিবিড় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে “তুমি তো দেখতেই পারছো আমার হাতে বেন্ডেজ করা, তুমি কি আমায় খাইয়ে দিবে প্লিজ?”
মায়া মুখটা কিছুটা ভার করে আবার হালকা মুচকি হাসি দিয়ে নিবিড় কে খাইয়ে দেওয়ার জন্য বসে চেয়ার টেনে। এই মুহুর্তে রিক্তাকে বড্ড বেশি মিস করছে নিবিড়। রিক্তার কষ্ট হচ্ছে মায়ার এমন ব্যবহার দেখে নিবিড়ের প্রতি, মায়া নিবিড়কে মন থেকে ভালোবাসে না রিক্তার ধারণা।
মায়া এক লোকমা খাবার নিবিড়ের মুখে তুলে দিতেই নিবিড় খাবার টা মুখ থেকে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
“এতো লবন দিয়ে খিচুড়ি রান্না না করে শুধু লবন দিতে খেতে, এতক্ষণ সময় আর অপেক্ষা করতে হতোনা আমার”।
রাগান্বিত কণ্ঠে কথাগুলো বলে নিবিড় পা বাড়ায় নিজের নতুন রুমের দিকে। মায়া হা হয়ে তাকিয়ে আছে নিবিড়ের যাওয়ার পথে, মায়ার মনটাই খারাপ হয়ে যায় কারণ সে ইউটিউব দেখে অনেক কষ্ট করে রান্না টা করেছিলো।
রিক্তার মনটাও বেশ খারাপ হয়ে যায় কারণ রিক্তার বিয়ের পর থেকে কখনো রিক্তা নিবিড় কে না খেয়ে ঘুমাতে দেয়নি যদিও আজ সব অতীত শুধুমাত্র।
______________
জায়েদা সুলতানার শরীরটা বেশ অসুস্থ লাগতেছে তাই তিনি শুয়ে আছেন নিজের রুমে। আসরের নামায সেরে রিক্তা এক মগ কফি হাতে ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে বসে কোরআন তেলাওয়াত শুনতেছে। নিবিড় এখনো অফিস থেকে ফিরেনি, সন্ধ্যা ৬টার পর নিবিড়ের অফিস ছুটি হয়। মায়া নিজের রুমে তৈরি হচ্ছে, হয়তো কোথাও যাবে।
রিক্তা কফিতে চুমুক দিতেই কলিংবেল বেজে ওঠে। এই সময় তো কারো আসার কথা না, কে আসলো চিন্তা করছে রিক্তা। কলিং বেল দুইবার পরার পর রিক্তা রুমে যেয়ে নিকাব টা এনে মুখ ঢেকে নেয় যদি কোনো পুরুষ হয় দরজার বাহিরে তাই। রিক্তা দরজা খুলেই অবাক কারণ ওর সামনে দাঁড়ানো ওরই স্কুল জীবনের পুরোনো বান্ধবী ফাহারিয়া লিজা। লিজাকে দেখে কেঁদে ফেলে রিক্তা। প্রায়ই তিন বছর পর রিক্তার দেখা হয় লিজার সাথে। রিক্তার এমন অবস্থা দেখে লিজা খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রিক্তাকে। রিক্তা লিজাকে সোফায় বসিয়ে রেখে আরেক মগ কফি বানিয়ে নিয়ে আসে। পুরোনো বান্ধবী বলে কথা তাই অনেক কথা জমে আছে বলার। কথার কথায় রিক্তা জিজ্ঞেস করে ফেলে লিজাকে সে এই বাসা চিনলো কেমনে আর কিভাবে আসলো একা।
লিজা বলে “আমি তোদের বাসায় গিয়েছিলাম আমার ননদের বিয়ের দাওয়াত দিতে কিন্তু তোর সৎ মা খুব বাজে ভাবে কথা বলে আমার সাথে তাই আমি কিছু না বলে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়, তারপর পথেই তোর আব্বুর সাথে দেখা হয় আর উনার কাছ থেকে তোর ঠিকানা পায়।”
“কি বলিস আমার নাম্বার তো ছিলো তোর কাছে”।
” হুম ছিলো কিন্তু এখন নেই, আসলে আমার মোবাইল চু’রি হয়েছিল তাই সবার নাম্বার হারিয়ে গিয়েছে।”
লিজার কথা শুনে কিছুটা মন খারাপ হয় রিক্তার। রিক্তা আর লিজা বসে বসে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছিলো এমন সময় মায়া তাদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। মায়া কোথায় যাচ্ছে সেটা রিক্তা জিজ্ঞেস করতে যেয়েও জিজ্ঞেস করলো না। মায়া খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়েছে তাই সে লিজাকে খেয়াল করেনি কিন্তু লিজা খেয়াল করেছে মায়াকে। মায়াকে দেখে যেনো মুহুর্তেই থমকে যায় লিজা, হাত পা যেনো ঠান্ডা হয়ে আসছে লিজার। মাথার উপর ভোঁ ভোঁ করে পাখা চললেও একাধারে ঘেমে যাচ্ছে লিজা। লিজার পুরো শরীর কাঁপতেছে থর থর করে। লিজার এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায় রিক্তা।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ