#প্রথম_প্রেমের_উষ্ণতা
#সূচনা_পর্ব
#ফারজানা_আক্তার
তোমার সাথে সংসার করা আমার পক্ষে আর সম্ভব না, আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো। যে নারী তিন বছরেও আমায় একটা সন্তান দিতে পারেনি তাকে আমি আমার সংসারে চাইনা আর”।
আজকেই রিক্তা জানতে পেরেছে যে সে মা হতে চলেছে এবং আজকেই রিক্তার স্বামী নিবিড় তার হাতে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিয়ে বলে উপরোক্ত কথাগুলো। পারিবারিক ভাবেই রিক্তা আর নিবিড়ের বিয়ে হয়। তিন বছরের সংসার রিক্তা আর নিবিড়ের, হঠাৎ এমন কেনো করছে নিবিড় কিছুই বুঝতে পারছেনা রিক্তা। ডিভোর্স পেপার টা হাতে নিয়ে মুক্তির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিক্তা। চোখ বেয়ে ঝর্ণা গড়াচ্ছে রিক্তার। রিক্তার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে নিবিড়ের রাগ বেড়ে যায় দিগুণ, সে রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে পাশে রাখা চেয়ারে লা’ত্থি মেরে চলে যায় ঘর থেকে।
শব্দ শুনে রান্না ঘর থেকে ছুটে আসেন নিবিড়ের মা জায়েদা সুলতানা। জায়েদা সুলতানা রুমে প্রবেশ করতেই দেখে পুরো ঘর এলোমেলো হয়ে আছে আর ঘরের এক কোণে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে রিক্তা।
জায়েদা সুলতানা ভয় পেয়ে যান রিক্তার এমন অবস্থা দেখে, জায়েদা সুলতানা জানেন রিক্তা অন্তঃসত্ত্বা আর তাই তিনি রিক্তার জন্য রান্না করছিলেন। জায়েদা সুলতানা রিক্তার পাশে গিয়ে বসে রিক্তার কাঁদে হাত রাখতেই রিক্তা শ্বাশুড়ি কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো, ছোট বাচ্চাদের মতোই কান্না করছে রিক্তা।
জায়েদা সুলতানা অনেকক্ষণ বুঝিয়ে সুজিয়ে শান্ত করেন রিক্তাকে আর তারপর জিজ্ঞেস করেন কি হয়েছে এভাবে কান্না করছে কেনো? তখন রিক্তা হাতের কাগজটা দেখান শ্বাশুড়ি কে। যদিও তিনি কাগজটা প্রথমেই খেয়াল করেছিলেন কিন্তু কিসের কাগজ সেটা বুঝতে পারেননি। রিক্তার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে জায়েদা সুলতানা জিজ্ঞেস করেন
“এটা কিসের কাগজ মা”
রিক্তা কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে “এটা ডিভোর্স পেপার, আপনার ছেলে আমাকে ডিভোর্স দিতে চান”
এটা শোনা মাত্রই যেনো জায়েদা সুলতানার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলেন। নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছেননা কিছুতেই যে তার ছেলে এমন একটা কাজ করতে পারে। কোনোমতে রিক্তাকে শান্ত করে বলেন ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার না করতে বাকিটা তিনি দেখে নিবেন।
রাতের খাবার খেতে বসলে তখন জায়েদা সুলতানার সাথে অনেক তর্ক হয় নিবিড়ের। রিক্তা শাশুড়ীর পাশে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছে আর চোখ বেয়ে টুপটাপ জল পরছে। জায়েদা সুলতানা রিক্তার প্রেগ্ন্যাসির কথা বলতে নিলে খপ করে শাশুড়ীর হাত ধরে ফেলেন রিক্তা, সাথে সাথে ঢুক গিলে ফেলেন তিনি।
মায়ের সঙ্গে তর্ক করে খাবার না খেয়েই রুমে চলে গেলো নিবিড়। নিবিড় চলে যাওয়ার পর জায়েদা সুলতানা রিক্তার কাছে জানতে চাই যে সে কেনো নিবিড়কে সত্যি টা বলতে দেয়নি তখন রিক্তা বলে
“মা আপনাকে শাশুড়ী নয় নিজের মায়ের নজরেই দেখে আসছি বিয়ের পর থেকে। ছোটবেলা থেকে নিজের মাকে পায়নি, আপনার কাছেই মায়ের আদর স্নেহ শাসন পেয়েছি। আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি তাই আপনার কষ্ট সহ্য করতে পারবোনা ভেবে কিছু বলিনি এতদিন আপনাকে কিন্তু আজকে আপনাকে সব সত্যি জানতেই হবে, আমাদের বিয়ের আগে থেকেই আপনার ছেলের এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো কিন্তু আপনার ভয়ে উনি আপনাকে সেদিন বলতে পারেনি কিন্তু বিয়ের রাতেই আমাকে সব বলেছিলেন উনি, এবং আমাকে এটাও বলেছিলেন যে উনি আর মেয়েটার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবেননা তাই আমিও বোকার মতো সেদিন সব বিশ্বাস করেছিলাম। তারপর বিয়ের ৬মাস পর থেকেই লক্ষ করি উনি মাঝরাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলেন চুপিচুপি আর যখনই উনার ফোনে কোনো কল বা মেসেজ আসে তখনই উনি দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে পরেন তবুও কখনো কিছু বলিনি আমি উনাকে, আমি ধৈর্য ধরেছিলাম যে উনি একদিন না একদিন সঠিক পথে আসবেনই কিন্তু আমার বিশ্বাস ভুল ছিলো উনি সন্তানের অজুহাতে আমার থেকে মুক্তি চান তাই আমিও উনাকে মুক্তি দিয়ে দিবো ভাবছি, উনার বাড়ি ঘর জুড়ে আমি হলেও উনার জীবন হৃদয় জোড়ে অন্যকেউ। আপনিই বলুন মা কোনো স্ত্রী কি সহ্য করতে পারে তার স্বামী গভীর রাতে তাকে ছেড়ে অন্য মেয়েতে মগ্ন থাকলে সেটা? আমি সহ্য করেছি দিনের পর দিন রাতের পর রাত এবং আমি অনেক চেষ্টাও করেছি বিভিন্ন কৌশলে নিবিড়কে বুঝাতে কিন্তু শেষে ডিভোর্সের কাগজটা ধরিয়ে দিলো আমার হাতে। আমি চাইনা উনি জানুক আমি মা হতে চলেছি, আমি চাইনা এমন দুশ্চরিত্র বাবার আদর্শে আমার সন্তান বড় হোক। আমি একাই জন্ম দিবো আমার সন্তানকে আর আমার একার আদর্শেই বড় করবো মানুষের মতো মানুষ করবো।”
কথাগুলো বলতে বলতে রিক্তার গলা ধরে আসছিলো, শেষে শাশুড়ী কে জড়িয়ে ধরে দু’জনেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলেন। সেই রাতে রিক্তা শাশুড়ীর সাথেই ঘুমিয়ে গেলেন। সকালে আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় রিক্তার। ঘুম ভাঙ্গতেই রিক্তা হকচকিয়ে উঠে বসে, পাশে শাশুড়ী কে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিক্তা। যাকে তিনবছর ধরে প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসে আসছে তার এমন অবহেলা মেনে নিতে পারছে না রিক্তা তবুও মানতে হবে। যার কাছে আজ পর্যন্ত একটুও সম্মান পায়নি তার কাছে আর থাকতে মোটেও ইচ্ছে করছেনা রিক্তার। কিভাবে পারলো নিবিড় মুহুর্তে তিন বছরের সম্পর্ক শেষ করতে এভাবে একটা কাগজের টুকরো দিয়ে? ভাবছে রিক্তা।
চোখের জল মুছে ওজু করে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে যায় রিক্তা। নামায শেষ করে পাশে থাকাতেই দেখে তার শাশুড়ী জায়েদা সুলতানা নামায পড়ছেন, শাশুড়ী কে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে জায়নামাজ টা গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায় রিক্তা। বালিসের নিচ থেকে ডিভোর্স পেপার টা বের করে হাতে নেয় রিক্তা তারপর নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। রুমে যেয়ে দেখে পুরো রুম ফাঁকা, কোথাও নিবিড় নেই, ওয়াশরুম বেলকনি সব জায়গায় খুঁজেও নিবিড়কে কোথাও পেলোনা রিক্তা। খানিকক্ষণ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থেকে সকালের স্নিগ্ধ বাতাস উপভোগ করলো রিক্তা, নিবিড় হয়তো নামাযে গেছে রিক্তার ভাবনা। আকাশ অনেকটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছে, লাল হয়ে আছে পূর্ব আকাশ, সূর্যোদয় হচ্ছে ধীরে ধীরে। রিক্তা রুমে এসে টেবিলের উপর ডিভোর্স পেপার টা রেখে নিজের সব কাপড় ব্যাগে ভাজ করে নেয়। নিবিড়ের জন্য মনটা বড্ড চটপট করছে, ভালোবাসা ভালোবেসে বেঁধে রাখতে পারেনি রিক্তা তাই প্রচুর কান্না পাচ্ছে তার। কান্নাজড়িতো কন্ঠে ডুকরে ডুকরে রিক্তা বলে উঠে “কেনো করলে এমনটা? আমি তো মন থেকেই ভালোবেসেছিলাম তবে কেনো তুমি আমার পবিত্র ভালোবাসার মূল্য দিলেনা। কেনো এভাবে আমাকে চুরমার করে দিলে? তিন বছরেও কী তোমার মনে একটুখানি জায়গা করে নিতে পারিনি আমি?”
কথাগুলো বলে পেঁছনে তাকাতেই দেখে রুমে প্রবেশ করতেছে নিবিড়। নিবিড়ের প্রবেশ দেখে চোখের নোনা জল মুছে নিলো রিক্তা। বিছানার উপরে কাপড়ের ব্যাগ দেখে কিছুটা খুশি হয় নিবিড়। টেবিলের উপরে রাখা কাগজের দিকে তাকিয়ে নিবিড় ভারি গলায় বলে “আমি সন্ধ্যায় এসে যেনো ডিভোর্স পেপারে তোমার সিগনেচার দেখি”
কথাটা শুনেই যেনো রিক্তার বুকটা কেঁপে উঠে। সে আর এক সেকেন্ডও সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে যায় ছাঁদে।
ছাঁদে খোলা আকাশের নিচে প্রাণভরে নিশ্বাস নিচ্ছে রিক্তা কিন্তু বুকটা ভার হয়ে আছে প্রচন্ড। যে আত্মার সাথে মিশে গেছে তাকে ছাড়া বাঁচবে কি করে সেটা ভেবেই পৃথিবী ছাড়তে ইচ্ছে করছে রিক্তার। ভালোবাসা এভাবে কাঁদাবে জানলে কখনোই সে নিবিড় কে ভালোবাসতো নাহ। আচ্ছা স্বামী কে ভালোবাসা কি অপরাধ??? রিক্তার মনে হচ্ছে এটা অপরাধ। যে অপরাধের মাশুল তাকে সারাজীবন দিতে হবে। পেটে হাত দিয়ে অন্তরীক্ষের দিকে তাকিয়ে দু’ফোটা চোখের জল ফেলে বলে উঠে “এভাবে কাঁদাবে জানলে ভালোবেসে তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শিখতাম না নতুন করে, যদি মাঝ রাস্তায় একা করে চলে যাওয়া ছিলো তবে কেনো সে হাত ধরেছিলো? কেনো এভাবে অসহায় করে দিলো আমায়? আমি তো সৎ মায়ের সংসারে তৃপ্তিতে ছিলাম সব মানিয়ে নিয়ে”।
বিকালে ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার করে নিজের কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছে রিক্তা, পাশে শাশুড়ীও ছিলো। দু’জনেরই চোখ মুখ ফুলে আছে, হয়তো কান্না করতে করতে হয়েছে এমনটা। খানিক বাদে কলিং বেলের শব্দে বুকটা ক্ষেপে উঠে রিক্তা, জায়েদা বেগম দরজা খুলতে এগুলে রিক্তা শ্বাশুড়ি কে থামিয়ে নিজে গিয়ে দরজা খুলতে। দরজা খুলে রিক্তা থমকে যায়, আজকেই এমন দৃশ্য দেখবে তা কল্পনাও করেনি রিক্তা।
_________চলবে ইনশাআল্লাহ__________