THE_BOOK #পর্ব_১৮

0
310

#THE_BOOK

#পর্ব_১৮

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

মৃত্যুকে সবসময় হাসিমুখে বরণ করা উচিৎ কারণ পৃথিবীর কেউ অমর নয়। মৃত্যু একদিন না একদিন হবেই তাই একে হাসি মুখেই মেনে নেয়া উচিৎ। লাবন্য সেভাবেই নিজের মৃত্যুকে মেনে নিলো। এখনই লোকটা এসে ওকে আঘাত করবে যার ফলে ওর মৃত্যু হবে। একদিকে লাবন্য খুব খুশি যে ও প্রিতমের কাছে যেতে পারবে। কিন্তু তারপর যে ওর জন্য বাকি বন্ধুদের ও মরতে হবে। একথা মনে পড়তেই লাবন্যর মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। শরীরে কোন শক্তি নেই মৃত্যু দূতের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার। লোকটা ওর কাছে আসতেই লাবন্য চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলল। কিন্তু লাবন্য অনুভব করছে যে কেউ ওর উপর আঘাত করছে না। কিন্তু এতো দেরি করার তো কথা না। লাবন্য চোখ মেলে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। বড়বড় চোখে তাকিয়ে রইল সামনে থাকা ব্যক্তিটির দিকে।
লোকটার হাতের ভারি হাতুরিটি একহাতে ধরে আছে তিন থেকে চার বছরের একটা মেয়ে যে হাওয়ায় ভাসছে।

লাবন্য চোখ পিটপিট করে ভালো করে তাকালো। নাহ সে ঠিক দেখছে। কিন্তু এটা যে অসম্ভব?? হঠাৎ লাবন্য কি যেন মনে করে পাশে তাকালো। ওর ছোট্ট মেয়েটা নেই। কোথায় গেল??একটু আগেও তো এখানে ছিলো!!পূর্ণাশা ওকে এখানেই শুইয়ে দিয়েছিলো তাহলে??লাবন্যর এসব ভাবনার মাঝেই রা’দ আর অভিনব হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ঢুকলো। ওরা অবাক হলো এসব দেখে। রা’দ দ্রুত গিয়ে পূর্ণাশাকে ধরলো আর অভিনব লাবন্যর কাছে গেল। বাচ্চাটা এখনো হাতুড়ি ধরেই আছে আর লোকটা অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা কিছু বলার আগেই বাচ্চাটি মুখ খুলল,”আমার মা’কে মারার ক্ষমতা তোর মতো কুৎসিত লোকের হয়নি। মা ঠিকই বলেছিল তোর চেহারা যেমন কুৎসিত তোর মনটাও তেমন কুৎসিত। তোর মতো পাপির বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই এই পৃথিবীতে। তোর মৃত্যু আজ আমার হাতে।”

কথা বলা শেষ হতেই বাচ্চাটি তার বামহাত লোকটার বুকের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। পুরো হাত ছুড়ির ন্যায় বুকের ভেতর ঢুকে গেল। একটানে লোকটার হৃদপিন্ডসহ কলিজাও বের করে ফেলে। লোকটা সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রক্তে সারা কেবিন তলিয়ে যায়। লাবন্যর গায়েও রক্ত ছিটকে লাগে। বাচ্চাটি হাওয়ায় ভাসমান থেকে মাটিতে নেমে আসে।
লাবন্য তো এখনও শকের মধ্যে আছে। বাচ্চাটা ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”আমায় কোলে নেবে না মা??”
এই কথাটা লাবন্যর হৃদয় ছুঁয়ে গেল। এতোই ভালো লাগছে মা ডাক শুনে। অভিনবের থেকে হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসতেই ওর মেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর বুকে। লাবন্যর সারা শরীরে যেন অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। শরীরের সব শক্তি ফিরে পেল। চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়াতে লাগলো।

পূর্ণাশার জ্ঞান ফিরে এসেছে। রা’দকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। লাবন্যকে খুশি দেখে ওরা তিনজনও খুশি। অভিনব গিয়ে লাবন্যর কাঁধে হাত রেখে বলল,”তোর মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে যাবি না??চল আজকে আমরা পার্টি দেব।তোর জীবন থেকে বড় ঝড় নেমে গেছে।”

লাবন্য মেয়েকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বলল,”কিন্তু এই লোকটার লাশ আর এতো রক্ত কি হবে?? পুলিশ কেস হয়ে যাবে তো??”
লাবন্যর কোলে থাকা মেয়েটা হাতে তুড়ি বাজিয়ে বলল,”এখন দেখো।”
লাবন্য অবাক হয়ে গেল। চোখের পলকে সব সরে গেল। কিছু নেই, কোথায় রক্ত কোথায় লাশ??
রা’দ এগিয়ে এসে বলল,”এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তুই বাড়িতে চল।”

সবাই একসাথে বাড়িতে গেলো। লাবন্য বসে বসে মেয়ের সাথে কথা বলতেছে। পূর্ণাশা মাথা চেপে ধরে সোফায় বসে আছে। ওর পাশে রা’দ আর অভিনব। হাসপাতাল থেকে ব্যান্ডেজ করেই এসেছে পূর্ণাশা। রা’দকে বলল,”তোরা ওই লোকটাকে ছাড়লি কেন??যদি লাবন্যর ক্ষতি হয়ে যেতো??”

রা’দ‌ বড় একটা শ্বাস ফেলে বলে,”আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে হাওয়ায় মিশে গেল হঠাৎ করেই। তাই আর ধরতে পারিনি। তারপর আমরা হসপিটালে চলে যাই।”

অভিনব লাবন্য আর ওর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,”কিন্তু এই বাচ্চাটার কি হবে??যদি পরে কারো ক্ষতি করে দেয় তো??”

রা’দ বলল,”আমার মনে হয় না। কারণ এটা তো দ্যা বুক এ লেখা ছিলো না। ওই লোকটা তো মরেই গেছে এবার পরের গল্প পড়তে হবে। তবে এই বাচ্চাটা যদি থাকে তাহলে আমাদের সাহায্য করতে পারবে।”

পূর্ণাশা সন্দিহান চোখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল,”কি জানি?? তবে আমার কেমন যেন গোলমাল লাগছে। বাচ্চাটা হুট করেই একদিন থেকে চারবছরের বাচ্চা হয়ে গেল অদ্ভুত। এরপর আর কি করবে কে জানে??আচ্ছা বইটা আমরা কবে পড়ছি??”

“খুব সম্ভবত তাড়াতাড়ি পড়বো। আমার বিশ্বাস আমরা জিতবোই।”

রা’দের কথায় বাকি দুজন ও সায় দিলো।

……………..

দু’দিন পর,,,,,,,,,,,

লাবন্য এতোটাই খুশি ওর মেয়েকে পেয়ে যা বলা বাহুল্য। ওর মেয়েকে দেখে কে বলবে যে দুদিনের শিশু?? কমপক্ষে চার বছরের বাচ্চা বলবে সবাই। মেয়েকে নিয়ে নানা কথা বলবে সমাজের মানুষ কিন্তু তাদের তো সব বললে বিশ্বাস করবে না। তাই লাবন্য বের হয় ও না। বাসার ভেতরেই থাকে। পূর্ণাশাও লাবন্যর সাথে থাকে।

আজকে রা’দ আর অভিনব এসেছে। রাতে সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করে মিটিং এ বসলো। আজকে বহুদিন পর আবার দ্যা বুক ওপেন করা হবে। না জানি এবার কার গল্প লেখা হবে ওই বইতে?? এনিয়ে পূর্ণাশা বেশ ভয় পাচ্ছে কারণ এখন ও আর রা’দ বাকি আছে। অভিনব ব্যাগ থেকে বইটা বের করলো। সাথে সাথে লাবন্যর মেয়েটার ঘুম ভেঙ্গে যায়। লাবন্য ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলো। কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভাঙল কিভাবে?? রুমের লাইট অফ চারিদিকে ক্যান্ডেল জ্বলছে। তার মধ্যে চারজন বসে আছে। হঠাৎ ওর মেয়েকে এখানে আসতে দেখে চারজনই অবাক হয়ে যায়।

বাচ্চা মেয়েটি একধ্যানে বুক এর দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে তার সন্তুষ্টির হাসি। লাবন্য পূর্ণাশা রা’দ অভিনব উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এখন কি হবে কারো তা বোধগম্য হচ্ছে না।

এই অল্প আলোতে মেয়েটার চেহারার উজ্জলতা আরো বাড়ছে। শরীর থেকে সাদা আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে যা ওদের চোখে সইছে না। আলোর তীব্রতা আরো বাড়ছে তার সাথে সাথে ছোট মেয়েটার শরীর ও বাড়ছে। আস্তে আস্তে মেয়েটা একটা সুন্দরী যুবতীতে পরিণত হলো ওদের চারজনকে অবাক করে দিয়ে। আলোর তীব্রতা এখন অনেকটা কমে গেছে। ওরা অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখছে। খুব সুন্দর মেয়েটা,দুধে আলতা গায়ের রং তার উপর কালো রঙের লম্বা পোশাক পড়েছে। খোলা লম্বা কালো কেশগুলো হাওয়ায় উড়ছে অথচ রুমে কোন বাতাস নেই। এ যেন প্রকৃতির অদ্ভুত খেলা। লাবন্য বারবার ঢোক গিলছে। ওর মেয়ে হঠাৎ করেই কি হয়ে গেল??চার বছরের বাচ্চার থেকে বিশ বছরের যুবতী হয়ে গেল কিভাবে?? কারো মাথা কাজ করছে না। লাবন্য কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,”ত তুমি,,,!!”

মেয়েটা মিষ্টি হাসি দিলো। এতে তার সৌন্দর্য যেন হাজার গুণ বেড়ে গেল। মেয়েটা বলল, “আমি জাহ্নুবি এই বইয়ের বন্দিনী। কিন্তু আজ থেকে আমি মুক্ত। আমি আবার আমার রাজ্যে ফিরে যেতে পারব আর সেটা সম্ভব হয়েছে তোমাদের জন্য।”

“ক কিন্তু আমার মেয়ে??”

“আমিই হলাম তোমার মেয়ে। কিন্তু এখন আর নই। আমি ব্ল্যাক প্রিন্সেস,জন্মের পর সুন্দর ভাবে জীবন যাপন করছিলাম কিন্তু আমাকে আমার রাজ্য থেকে তুলে এনে এই বইতে বন্দি করে দেয় বব হেনরি। এছাড়া আরও অনেক বন্দিনী এই বইয়ের ভেতরে রয়েছে। এরা বন্দি থাকতে থাকতে তিক্ত হয়ে গেছে। তাই যার তার উপর এরা আক্রমণ করে বসে। এবং আমিও সেরকম হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই গল্পতে আমাকে একটা বাচ্চার রূপ নিতে হয়েছে। তাই তোমরা আমার মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে আমাকে ভালোর পথে ফিরিয়ে এনেছো।তাই তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ।”

রা’দ বলে উঠলো,”কিন্তু আপনি বাচ্চা হয়ে লাবন্যর গর্ভে জন্ম নিলেন?? এটা কিভাবে সম্ভব??”

“ওই যে বইয়ের গল্প পূরণ করার জন্য। শুধু আমি না মৎস্যকন্যা রায়া ও গল্প পূরণ করার জন্য এসেছিল।”

অভিনব‌ মৎকন্যার কথা শুনে চমকে উঠল বলল,”মৎসকন্যা রায়া,,,,,সে কোথায় এখন??”
জাহ্নুবি হাসলো তারপর বললো,”সে তো মারা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা কি জানো??সে তোমাদের হাতে মরেনি সে অনেক আগেই মারা গেছে। তোমরা শুধু তার আত্মাকে মুক্তি দিয়েছো।”
জাহ্নুবির কথা শুনে সবাই চমকে গেলো। মৎস্যকন্যা আরো আগেই মারা গেছে!!জাহ্নুবি আবার বলতে লাগলো,”রায়ার সাথে এই বইতে থাকাকালীন আমার পরিচয়। বেঁচে থাকতে রায়া একজন মানুষকে ভালোবেসেছিল। এতোটাই ভালোবাসতো সেই মানুষ টাকে যার জন্য সবকিছু করতে রাজি হয়েছিলো। এমনকি নিজের রাজ্য ও। কিন্তু মানুষ,যারা সবসময় নিজেদের স্বার্থ খোঁজে। যার কারণে রায়াকে প্রাণ দিতে হয়। কিন্তু ওর আত্মা মুক্তি পাওয়ার আগেই বব হেনরি ওকে বন্দি করে ফেলে তারপর ওর জীবন কাহিনী নিয়ে গল্প সাজায়। তোমরা রায়াকে মুক্তি দিয়েছো। কিন্তু আমি জীবিত আমাকে তো ফিরে যেতেই হবে। আর ওই কুৎসিত লোকটা ছিল আমাদের রাজ্যের একজন। খারাপ মন থাকার কারণে ওর মুখটা ঝলসে যায়। এটা আমাদের রাজ্যের নিয়ম। আমাদের রাজ্য ব্ল্যাক কিংডম। কিন্তু সবার মন পরিস্কার। কারো মনে কাউকে হত্যা করার মতো জঘন্য পরিকল্পনা থাকে না। কিন্তু ওই কুৎসিত লোকটা এরকম জঘন্য পরিকল্পনা করে যার ওর মুখ ঝলসে যায়। আর ওকে ধরে এনে বন্দি করে বব হেনরি। তারপর আমাদের দুজনকে নিয়ে গল্প সাজায়। কিন্তু তোমরা সবকিছু ঘুরিয়ে আমাকে এই অভিশপ্ত বই থেকে বাচিয়েছো। এর আগেও কয়েকজন বইটা পড়েছিল তখন ভেবেছিলাম যে মুক্তি হয়তো পাবো কিন্তু না। তারাও মারা গেলো। কিন্তু তোমরা বুদ্ধির জোরে বেঁচে গেছো। আর আমিও, তোমাদের এই ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না। কিন্তু তোমাদের সাহায্য করতে পারবো। আর দু’জনের গল্প লেখা এখনও বাকি আছে। আমি দুজনের মধ্যে থেকে যেকোন একজনকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারি কিন্তু বাকি একজনকে তোমাদের বাঁচাতে হবে। কারণ বব হেনরির শক্তির কাছে আমার শক্তি নূন্যতম তাই একজনকেই আমি বাঁচাবো।”

রা’দ হাসিমুখে বলল,”আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বিপদে পড়লে অবশ্যই আপনাকে প্রয়োজন পড়বে আমাদের।”

“তাহলে আজ আমি আসি। বিপদে পড়লে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমাকে ডাকবে আমি তখনই হাজির হয়ে যাবো।”

জাহ্নুবি হাওয়ায় কালো ধোঁয়া উড়িয়ে মিলিয়ে গেল। সবাই একধ্যানে সেদিকেই তাকিয়ে রইল। লাবন্য মাথা নিচু করে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো। কারণ টা ও নিজেও বুঝতে পারছে না। ওর গর্ভে জন্ম নেওয়া জাহ্নুবির জন্য?? নাকি অন্যকিছু??পূর্ণাশা লাবন্যকে আঁকড়ে ধরে। আজকে অভিনবের মনটাও খারাপ হয়ে গেছে। তার প্রেয়সির নামটা যে আজকে জানতে পারলো কিন্তু রায়ার সম্পর্কে বলা কথাগুলো অভিনবের বুকে লেগেছে। মানতে পারছে না যে রায়া মারা গেছে এভাবে??একটা তিক্ত শ্বাস বের হলো অভিনবের মুখ দিয়ে।

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here