THE_BOOK #পর্ব_২১

0
226

#THE_BOOK

#পর্ব_২১

#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

চৌকির উপর দু’পা তুলে বসে আছে রা’দ। অনেকক্ষণ যাবত বসে আছে কিন্তু নূরজাহানের আসার কোন নাম গন্ধ নেই। সেই কখন বেরিয়েছে কিন্তু এখনো আসছে না কেন??রা’দ ভাবছে ও কি একবার বাইরে গিয়ে দেখবে??পরে আবার ভাবলো না থাক যদি নূর কিছু উল্টাপাল্টা ভেবে বসে??তার থেকে এখানে বসে থাকাটাই ভালো। রা’দ ঘাড় ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। কি ঘন জঙ্গল?? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নূর এই জঙ্গলে থাকে কেন??আর একাই থাকে নাকি সাথে আরো কেউ আছে?? কিন্তু আর তো কাউকে দেখছে না রা’দ। আর এই জঙ্গলে মেয়েটা একা থাকে ভয় লাগে না??এসব আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে নূরজাহান উপস্থিত হলো। দরজার শব্দ শুনে রা’দ সেদিকে তাকালো। নূরকে দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল সে। এই মেয়েটাকে দেখে যেন তার মন ভরে না।
রা’দ খেয়াল করলো নূরের হাতে কিছু লতাপাতা আর গাছের শেকড়। নূর ধীর পায়ে টেবিলের কাছে গেলো। টেবিল থেকে ছোট হাম্বল দস্তা নিয়ে তাতে লতাপাতা আর শেকড় দিয়ে পিষতে লাগলো। রা’দ উৎসুক হয়ে বলে,”আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন??”

নূর পিছনে না তাকিয়ে উত্তর দিলো,”আপনার জন্য ওষুধ আনতে গিয়েছিলাম।”

“এটার তো কোন দরকার ছিল না। আমি এখন সুস্থ আছি। শুধু শুধু আমার জন্য কষ্ট করলেন। আমি আপনাকে সমস্যায় ফেলে দিলাম।”
নূর নিঃশব্দে হাসলো বলল,”বিপদে পড়লে মানুষই তো মানুষের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। এটাই তো মানবধর্ম। তাছাড়া আমি সেইরকম নই যে বিপদে কাউকে ফেলে চলে যাব। আমার যদি কষ্ট হতো তাহলে আপনাকে এখানে নিয়ে আসতাম না। ওখানেই হায়েনাদের সামনে ফেলে আসতাম।”

রা’দ বড় একটা শ্বাস ফেললো বলল,”আপনি ওতো রাতে জঙ্গলে কি করছিলেন??আর এই গভীর জঙ্গলে আপনি একা থাকেন?? কেন?? আপনার ভয় করে না??আর এখানে থাকেনই বা কেন??”

নূরের ততক্ষণে ওষুধ বানানো শেষ। সে ওষুধ বাটিতে ঢেলে রা’দের সামনে এসে বসতে বসতে বলতে লাগলো,”এতো প্রশ্ন করলে আমি উওর দেব কিভাবে?? আপনি খুব প্রশ্ন করেন।”
রা’দ মাথা চুলকে বলে,”জানতে ইচ্ছে করছিলো তাই বললাম।”
নূর রা’দের মাথার ব্যান্ডেজ খুলতে খুলতে বলে,”ভয় থাকলে কি এখানে থাকতে পারতাম??আর হ্যা আমি এখানে একাই থাকি আমার সাথে থাকে আমার ময়ূর আর আমার ঘোড়া। ঘোড়ায় চড়ে আমি সারাজঙ্গল ঘুরে বেড়াই। শিকার করি, তবে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে জোৎস্না বিলাস করতে।কাল রাতেও বেড়িয়েছিলাম আর সেখানে আপনার দেখা। আমি সঠিক সময়ে না পৌঁছালে ওরা আপনাকে খেয়ে ফেলতো।”

“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য।”

নূর রা’দের মাথায় নতুন করে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো। তারপর কিছু ফল এনে দিয়ে বলল,”এর থেকে ভালো কিছু আপনাকে দিতে পারব না এটাই খেতে হবে আপনাকে।”

রা’দ তাকিয়ে দেখে কিরকম অদ্ভুত ধরনের সব ফল যার কোনটার নাম রা’দ জানে না। ও ভাবছে এগুলো খাওয়া কি আদৌ ঠিক হবে?? কিন্তু ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে। কাল সারাদিন রাত কিছুই খায়নি সে। তাই একটা ফল হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বলল, “কিন্তু আমার এর থেকে ভালো কিছু চাই।”

রা’দের কথা শুনে নূরের মুখটা মলিন হয়ে গেল। এর থেকে তো ভালো কিছু ও দিতে পারবে না। এই জঙ্গলে ফল আর পশু পাখিদের মাংস ছাড়া আর কিছু দেওয়া সম্ভব নয়। আর তাছাড়া কালকে কিছু শিকার করতেও পারেনি সে। নূরের মলিন মুখখানা দেখে রা’দের হাসি পেলো। এতেও নূরকে অপ্সরি লাগছে। রা’দ হঠাৎ করেই হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলে,”আপনার হাসি।”

নূরের ভ্রু যুগল আপনাআপনি কুঁচকে এলো। এর মানে সে রা’দের কথা বুঝতে পারেনি। তাই রা’দ আবার বলে,”এর থেকে আপনার হাসি আরো মিষ্টি তাই একটা মিষ্টি হাসি দিন এটাই আমার কাছে অনেক।” বলেই রা’দ আবারো হাসে। নূর এবার সবটা বুঝতে পারে। একটা ছেলে যে এভাবে মুখের উপর কোন নারীর সৌন্দর্যের ইতিকথা বলে দেয় তা নূরের ভাবতেই অবাক লাগছে। নূরকে ভাবতে দেখে রা’দ বলে,”আপনার সৌন্দর্য্যের রহস্য কি??”

রা’দের কথা শুনে নূর না হেসে পারলো না। শব্দ করে হাসতে লাগলো। রা’দ আবারো সেই হাসি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো। নূর হাসি থামিয়ে বলল,”আপনি এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন কোথায় পান বলুন তো??”
রা’দ প্রতিত্যুরে কিছু বলে না। নূর বলে উঠে,”পৃথিবীর কোন মেয়ে তার রুপের কারণ বর্ণনা করতে পারবে না। সৃষ্টিকর্তা কাউকে সুন্দর বানান তো কাউকে অসুন্দর। তাই এরকম করার উদ্দেশ্যে কেবল তিনি ছাড়া আর কেউই জানে না। তাই এটা বলা খুব মুশকিল। কিভাবে বলি বলুনতো??”

রা’দ সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলে,”কিন্তু আমার মনে হয় আপনার সৌন্দর্য্যের পিছনে একটা বড় রহস্য লুকিয়ে আছে। আমি বোধহয় কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি।”

“তো শুনি আপনি কি আন্দাজ করলেন??”

“আমাকে হার্ট অ্যাটাক করার জন্য আপনাকে সুন্দর বানানো হয়েছে।”
কথাটা রা’দ বুকে হাত রেখে বলল। নূর আবার অবাক হলো। ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি রেখে বলে,”আপনি সত্যি অদ্ভুত লোক। কোন কথাই যেন মুখে আটকায় না।”

বলতে বলতে নূর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। রা’দ ভাবতে লাগলো সে কি আদৌ লাগামহীন কথা বলে ফেলেছে?? কিন্তু এরকম তো রা’দ ছিলো না। মেয়েদের সাথে তো এভাবে কখনোই কথা বলতো না। তবে অন্যসব মেয়েদের সাথে নূরের তুলনা একদম হয় না।নূর সবার থেকে আলাদা,সবদিক থেকেই আলাদা। মেয়েটার চোখমুখে মায়া লেগে আছে যে কেউ দেখলেই তার মায়ায় পড়ে যাবে। ভাগ্যিস রা’দ এখানে এসেছে নয়তো অন্য কেউ এসে পড়লে কি হতো??

কিছুক্ষণ বসে থেকে রা’দ ঘর ছেড়ে বাইরে এলো। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে মাটিতে নেমে এসে হাঁটতে লাগল। যেদিকে চোখ যায় শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে রা’দ দেখতে লাগলো। হঠাৎ পানির আওয়াজে রা’দ চমকে তাকালো। খুঁজতে লাগল এই আওয়াজের উৎস। বাড়ির পিছনে একটা পুকুর সেখানে গোসলে নেমেছে নূর। রা’দ আস্তে আস্তে এগিয়ে পুকুরের ধারে একটা গাছের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। নূর একটা ডুব দিয়ে উঠেছে তখন। চুলগুলো তার মুখমন্ডল ঢেকে ফেলেছে। একহাতে নূর সেগুলো সরিয়ে দিতেই তার মুখটা দেখা গেলো। পানির কণাগুলো চিকচিক করছে তার মুখে। আর গায়ে সাদা পোশাকে তাকে আরো মানিয়েছে। মনে হচ্ছে পুকুরে কোন পরীকন্যা গোসলে নেমেছে। পুকুরে কয়েকটা রাজহংস ও আছে।
তারা মুখ দিয়ে পানি ছিটিয়ে নূরের গায়ে ছিটিয়ে খেলা করছে। নূর হাত দিয়ে পানির ঝাপটা আটকাচ্ছে আর হাসছে। সাথে নূরও খেলছে তাদের সাথে।

দূর থেকে রা’দ তা দেখছে। এসব দেখতে ওর ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে নূরের কাছে যেতে আলতো করে নূরের মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিতে। কিন্তু এসব কি ঠিক হবে??নূর যদি উল্টাপাল্টা কিছু ভেবে বসে??নাহ তার থেকে দূরে থাকাই ভালো হবে। কিন্তু নিজেকে সামলানো যে আস্তে আস্তে কঠিন হয়ে আসছে। রা’দ ওখান থেকে যেতে চেয়েও পারলো না। নূরের সৌন্দর্য তাকে আটকে দিল। তাই রা’দ ওখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নূরকে দেখতে লাগলো।

………………

নূরজাহান ঘরে এসে দেখলো জানালার পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রা’দ। ওকে দেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। রা’দ পিছনে না তাকিয়ে বুঝতে পারলো যে নূর এসেছে কারণ এক সুন্দর সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ছে নূর আসার সাথে সাথে। রা’দ নিঃশ্বাস টেনে বাতাসের সাথে সাথে সেই সুগন্ধি উপভোগ করছে। রা’দ বাইরে দৃষ্টি রেখেই বলল,”আপনার বাড়িটা অদ্ভুত ঠিক আপনার মতো।”

নূর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,”আপনার অদ্ভুত লাগতেই পারে কিন্তু আমি এতে অভ্যস্ত।”

নূর দেওয়ালে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রা’দ পিছনে ঘুরে নূরকে দেখতে না পেয়ে সেও বাইরে এলো। দেখলো সাদা রঙের ঘোড়াটার সামনে দাঁড়িয়ে তার গলায় হাত বুলাচ্ছে নূর। ঘোড়াটা হিস হিস শব্দ করছে নূরের হাতের পরশ পেয়ে। আর কচি ঘাস চিবুচ্ছে। নূর চামড়ার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলায় তারপর তীর ধনুক আর তীরের থলে নিয়ে যেইনা ঘোড়ায় চড়লো অমনি রা’দ বলে উঠলো,”কোথায় যাচ্ছেন??”

নূর রা’দের দিকে ঘুরে তাকালো বলল, “শিকারে যাচ্ছি। বাড়িতে অতিথি এসেছে একটু আপ্যায়ন তো করতেই হয়।” বলেই হাসলো সে। রা’দের আবারও হার্ট বিট মিস হলো। সাদা ঘোড়ার উপরে যেন একটা সাদা পরী বসে আছে। চুলগুলো তার লম্বা বেণুনী করা। ছোট ছোট চুলগুলো মুখের সামনে এসে পড়েছে। গায়ে আবারও সেই একই রকম সাদা পোশাক। রা’দ বিষ্ময়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে,”যদি কিছু মনে না করেন আমি যেতে পারি আপনার সাথে??”

নূর ঘাড়টা হালকা দুলিয়ে বলে,”আপনি যাবেন!! কিন্তু আপনি তো অসুস্থ??”

রা’দ স্নিগ্ধ হেসে বলে,”তাতে কি আপনি আছেন তো?? তাছাড়া এই জঙ্গলটা ও দেখা হয়ে যাবে।”

“আমার ফিরতে রাত ও হতে পারে!!”

“সমস্যা নেই আপনার সাথে চন্দ্র বিলাস ও হয়ে যাবে। এক সুন্দরী রমণীর সাথে চন্দ্র বিলাসের ভাগ্য ক’জনের হয়!!”

নূর মুচকি হেসে বলে,”হয়েছে আর বলতে হবে না চলুন।”

নূরজাহান এক হাত বাড়িয়ে দিলো রা’দের দিকে। নূরজাহানের হাত ধরে ঘোড়ায় চড়লো রা’দ। নূরজাহান পিছনে ফিরে রা’দকে বলল,”ঠিকমতো বসে থাকতে পারবেন তো??”

“যদিও ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস নেই আপনি যেহেতু আছেন তাহার ঠিক পারব।”

নূর আর কিছু বলে না। এই ছেলের সাথে সে কথায় পারবে না। কথায় কথায় ভালোই লজ্জা দিতে জানে সে। দড়িতে হাত দিয়ে ঘোড়া ছোটালো সে। ঘোড়া খুব দ্রুত গতিতে ছুটছে। রা’দ তাল সামলাতে না পেরে শক্ত করে নূরের কোমড় জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথে নূর খানিকটা কেপে উঠল। কিন্তু কিছু বলল না। কেন জানি ওর ভালোই লাগছে এই ছেলেটার সাথে থাকতে।

ঘন গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে দূরন্ত বেগে ছুটে চলছে সাদা রঙের ঘোড়াটি। তার উপর দুজন মানব মানবী বসে আছে। তারাও ঘোড়ার সাথে সাথে ছুটছে যেন। গাছগুলোকে পেছনে ফেলে ছুটে যাচ্ছে সামনের দিকে। মাঝে মাঝে নূর এদিক ওদিক তীর ছুঁড়ছে ঘোড়ার উপর থেকেই। রা’দ এতে অবাক হয়। একটা মেয়ের হাত এতো পাকা যে তীর কখনো ভুল জায়গায় রায় না। সোজা শিকারকে ধরে ফেলে।
খুব কাছ থেকে নূরকে লক্ষ্য করছে রা’দ। নূরের এতোটা কাছে এসে ভালোই লাগছে।রা’দ ভাবছে যে ও এতকিছু বলছে নূরকে অথচ নূর একটুও রাগ করছে না। সবসময় হাসি মুখে রা’দের কথার জবাব দিচ্ছে। তাহলে কি রা’দের মতো নূর ও রা’দের উপর দূর্বল?? হবে হয়তো!!রা’দের এটা ভেবে আনন্দ হচ্ছে।

কিন্তু এসব কিছুর মধ্যে সে তার বন্ধুদের কথা ভুলেই গেছে। মগ্ন হয়ে পড়েছে অজানা অচেনা এক সুন্দরী রমণীর নেশায়। বুদ হয়ে আছে তাতে। ও ভাবছে না যে অভিনব পূর্ণাশা আর লাবন্য কি আদৌ বেঁচে আছে?? নাকি প্রাণ দিয়েছে সেই উড়ন্ত ভাম্পায়ারের হাতে??
কিন্তু রা’দ তো এমন কখনোই ছিলো না। বন্ধুত্বের সম্পর্ক ওর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেই বন্ধুরা ওর প্রাণ ছিল আজ তাদের কথাই সে ভুলে গেছে এক নারীর জন্য যার সাথে কিনা একদিনের পরিচয়??

বন্ধুদের কথা বাদ দিয়ে রা’দ এখন নূরজাহান নামক মেয়েটির নেশায় বুঁদ। যাকে কি না প্রতিদিন সে স্বপ্নে দেখতো। কিন্তু স্বপ্নে দেখে কি কেউ কখনো ভালোবেসেছে??আর স্বপ্নে দেখা মানুষটি কিভাবে বাস্তবে আসতে পারে??এটা তো অবিশ্বাস্য!! তাহলে কি কোন রহস্য লুকিয়ে আছে। এই রহস্যের মায়াজাল ভেদ করে কি রা’দ বের হতে সক্ষম হবে?? নাকি চিরকালের জন্য এই মায়াজালে বদ্ধ হয়ে থাকবে??????

চলবে,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here