নীল চিরকুট #লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা ৩৩.

0
917

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৩৩.

চিঠি হাতে নম্রতার মোহাচ্ছন্ন অবস্থাতেই অন্তু এসে দাঁড়াল পাশে। চোখদুটোতে রাত জাগার ক্লান্তি। নীরা তাকে দেখেও দেখল না।

‘ তোর সাথে কথা আছে নীরা। একটু এদিকে আয়।’

নীরা অন্যদিকে তাকিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। অন্তু চোয়াল শক্ত করে বলল,

‘ আমি তোর সাথে কথা বলছি নীরা।’

নীরা এবারও উত্তর দিল না। তাকাল না পর্যন্ত। অন্তুর মেজাজ খিঁচড়ে গেল। প্রতি পদে পদে নিজেকে ছোট করতে করতে এবার সে ক্লান্ত। অন্তু মুখ ফুলিয়ে শ্বাস টেনে নীরার ডানহাত ধরে হেঁচকা টানে সামনের দিকে পা বাড়াল। অন্তুর এমন কাজে মোহভঙ্গ হলো নম্রতার। চিঠি আর বইটা ব্যাগে পুড়ে নীরাদের পেছনে ছুঁটল। নীরদের কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই বামহাতে অন্তুর গালে কষে চড় বসাল নীরা। অন্তু থমকাল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য পা আটকে গেল নম্রতার। হতভম্ব চোখে নীরার দিকে তাকিয়ে থেকে দৌঁড়ে গিয়ে ওদের পেছন দাঁড়াল। চোখে-মুখে তার আতঙ্ক। অন্তুর কালো মুখ প্রচন্ড রাগে আরও কালো হয়ে উঠল। নীরার ডানহাতের কব্জিটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

‘ সমস্যা কী তোর? কথায় কথায় হাত চলার কারণ কী? কিছু বলছি না মানে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবি? দোষ আমি করেছি, মানছি। তুই দোষ করিসনি? আমার জীবনটা নরক থেকেও জঘন্য করে তুলেছিস। তোর তো এই একটাই দেমাক, কেন তোকে ভালোবাসলাম? আরেহ! ভালোবাসাটা যদি নিজের হাতে থাকত তাহলে তোকে ভালোবাসার প্রশ্নই আসে না। না পারছি ভালোবাসাতে, না পারছি ভুলতে। আই জাস্ট হেইট ইউ!’

শেষের কথাটা চেঁচিয়ে বলল অন্তু। নম্রতা অসহায় চোখে এদিক-ওদিক তাকাল। ডিপার্টমেন্টের জুনিয়ররা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। যাদের মধ্যে এতো ভালো বন্ডিং তাদের আজ এই পরিণতি? কৌতূহল তো থাকবেই। নম্রতা নীরার বামহাতের কনুইয়ে হালকা স্পর্শ করে বলল,

‘ অন্তু যখন কথা বলতে চাইছে তখন কথা বললে সমস্যা কী? নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করে কী লাভ? চল অন্য কোথাও গিয়ে বসি, সবাই দেখছে। অন্তু প্লিজ দোস্ত, রাগারাগি করিস না।’

অন্তু চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। ঠিক তখনই আয়েশী চালে পাশে এসে দাঁড়াল নাদিম। কপাল কুঁচকে বলল,

‘ সবাই চোখ-মুখ কালা কইরা দাঁড়ায় আছিস কেন? সবাই চাইয়া আছে, নাটক দেখাইতাছিস নাকি? কি হইছে?’

নম্রতা চোখের ইশারায় কিছু বোঝাল। নীরা কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,

‘ আমি কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নই। কোনো জঘন্য মানসিকতার মানুষের সাথে তো কখনোই নয়।’

নীরার কথাটা শেষ হতেই সজোরে চড় পড়ল তার গালে। নম্রতা দুইহাতে মুখ চেপে হতভম্ব চোখে চেয়ে রইল। নাদিমও বিস্মিত। অন্তুকে সবল হাতে ধাক্কা দিয়ে ধমকে উঠে বলল,

‘ তোর সাহস কেমনে হয় ওর গায়ে হাত তোলার? হিরোগিরি দেখাও?’

অন্তু ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নাদিমের নাক বরাবর ঘুষি ছুঁড়ল। নাদিমও পিছিয়ে নেই। ডানহাতের পিঠ দিয়ে নাকটা মুছে নিয়ে অন্তুর চোয়াল বরাবর ঘুষি লাগল। নম্রতা ছুঁটে এসে নাদিমের হাত ধরে আটকাল। সেই সুযোগ আরও দু-চার ঘা লাগিয়ে দিল অন্তু। তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বলল,

‘ শুধু আমার দোষটাই দেখিস তোরা? সবার কাছে শুধু আমিই দোষী। জীবনের প্রথম বাপের সাথে ঝামেলা হয়েছে। বাপের মুখের উপর কথা বলেছি শুধু এই মেয়েটার জন্য। কি করি নাই আমি ওর জন্য? আর এখন আমার মানসিকতা জঘন্য? সব ভুলে গিয়ে, এতো বেয়াদবির পরও শুধুমাত্র আমার কথা ভেবে আব্বায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল বাসায়। আর ও কী করেছে জানিস? মুখের উপর না করে দিয়েছে। এতো দেমাক!’

নাদিম ফুঁসে উঠে বলল,

‘ না করছে তো জোর করিস কেন? জোর করে বিয়ে করতে চাস? শালা জচ্চুর।’

অপমানে ভেতরটা থমথমে হয়ে গেল অন্তুর। এতোটা অসম্মান। এতোটা অপমানের সম্মুখীন আদৌ কখনও হতে হয়েছিল তাকে? অন্তু তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল,

‘ আই স্পিট অন ইউর ফ্রেন্ডশিপ। কখনও আমার পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করেছিলি কেউ? এতোগুলো বছর ধরে পুড়ছি তখন তোদের বন্ধুত্ব কই ছিল? বন্ধুত্ব শুধু ওর জন্য? ও মাইয়া বলেই এতো টান? সুন্দরীদের প্রতি গদগদ টান তো থাকবেই!’

‘ মুখ সামলায় কথা বল অন্তু।’

‘ এতোদিন তো কিছুই বলি নাই। কিছু না বলেও দোষী হয়েছি। নতুন করে আর দোষের কী? আব্বায় আমার জন্য আম্মার গায়ে হাত তুলছে। কতটুকু জ্বলছে আমার ধারণা আছে তোর? শুধু মাত্র এই মেয়েটার জন্য….’

কথাটা বলে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল অন্তু,

‘ বাপ-মায়ের মর্যাদা তুই কী বুঝবি? বাপ-মায়েরে ঠিকঠাক চিনিসই না তো তুই। একমাত্র বোনের খোঁজ খবর নিস না প্রায় চার বছর। এখানে এসে মূল্যবোধ শেখাতে আসিস? সুন্দরী মেয়ে বলে মূল্যবোধ! শালা ফ্রড!’

ক্ষুব্ধ নাদিম আবারও তেড়ে এলো। পুরো ভার্সিটির সামনে বন্ধুত্বের এক নগ্ন মৃত্যু ঘটে গেল। নম্রতা মাথায় হাত দিয়ে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়াল। টলমলে চোখে দেখতে পেল বন্ধুত্বের মাঝে তীব্র এক কম্পন। ভয়াবহ এক ধস। এই ধসের ক্ষতিপূরণ করার সাধ্য কী তাদের আছে?

দুপুরের কড়া রোদ এসে ঝিলিক দিচ্ছে কাঁচের দরজায়। ভেতরে এয়ার-কন্ডিশনারের মৃদু ঝিমঝিম শব্দ। রঞ্জন-পূজা রেস্টুরেন্টের টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে। পূজার গাঁয়ে বাদামি আর খয়েরীর মিশেলে সালোয়ার-কামিজ। ঘন কালো চুলগুলো হাত খোপা করা। রঞ্জনের গায়ে কালো পলো শার্ট। চোখে-মুখে বিস্তর হাসি।

‘ মেশমশাই আমার উপর বিরাট চেতে আছেন মনে হলো।’

‘ তো? চেতবে না? তুমি সব সময় ওমন নাস্তিকদের মতো কথাবার্তা বল কেন? ওসব কথা যত বলার আমার সাথে বলবে। বাবার সাথে কেন?’

রঞ্জন হাসে।

‘ তোমার প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা আসছে আজ।’

পূজা ভ্রু কুঁচকায়। এই ছোট্ট কথাটিতেই লজ্জায় রাঙা হয়ে আবেগে গলে যায়। মুখ টিপে হেসে ভ্রু নাচিয়ে বলে,

‘ কথা এড়াচ্ছ!’

রঞ্জন হুহা করে হেসে উঠল,

‘ আরে ধুর! সত্যিই। ‘তোমাকে ভালোবাসি’ এই কথাটা ভেবেই প্রচন্ড সুখ সুখ লাগছে। আর মেশমশাইকে এড়ানোর কী আছে? আমি আর মেশমশাই দু’জনেই জানি বিয়ের পর আমাদের শ্বশুর-জামাইয়ের হেব্বি ফাটবে।’

পূজা হেসে ফেলল। গালে হাত দিয়ে রঞ্জনের ফর্সা সুন্দর মুখটির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে উপভোগ করতে লাগল রঞ্জনের প্রাণোচ্ছল সব কথা। পূজাকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখ টিপল রঞ্জন। পূজা আবারও হাসল। লজ্জা রাঙা মুখ নিয়ে বলল,

‘ তবুও তুমি একটু সামলে চলো। বাবা যদি একবার রেগে যায় তো সর্বনাশ।’

‘ চিন্তা করো না। তোমার বাবা আমায় পাত্র হিসেবে বেশ পছন্দই করেন। তবুও যদি বাগড়া দেয় তাহলে শশুরমশাইকে ডিরেক্ট কিডন্যাপ করে নিব। তারপর তোমার বাড়ি গিয়ে তোমাকে বিয়ে করব। তুমি তো আর পালিয়ে বিয়ে করবে না। আমিও পালিয়ে বিয়ে করব না। তাই যারা যারা ভিলেন হবে সব সাময়িক সময়ের জন্য কিডন্যাপ। প্ল্যানটা ভালো না?’

পূজা খিলখিল করে হেসে উঠল। পূজার ডানহাতটা আলতো ছোঁয়ায় নিজের হাতে তুলে নিল রঞ্জন। মাখনের টুকরো ছুঁতে যেমন সাবধানতা ঠিকই তেমনই সজাগ তার স্পর্শ। পূজাও হাসি হাসি চোখে রঞ্জনের দিকে তাকাল। রঞ্জন গাঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করল,

‘ আমার মহারাণী কী চায়?’

‘ তোমাকে চাই।’

‘ আমি তো একযুগ আগে থেকেই তোমার নামে দলিল হয়ে আছি মহারাণী। এর বাইরে কি চাও? আমি তোমাকে স্পেশাল কিছু দিতে চাই। স্পেশাল কিছু চাও।’

পূজা নির্দ্বিধায় উত্তর দিল,

‘ তোমাকে চাই।’

‘ তারপর?’

‘ তোমাকেই চাই।’

‘ তারপর?’

‘ তোমাকেই চাই।’

রঞ্জন হঠাৎ-ই গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ আমি যে সামনের মাসেই তোমার তুমিকে নিয়ে উড়াল দিচ্ছি, দূর দেশে। কষ্ট হবে না?’

পূজার মিষ্টি মুখটিতে মুহূর্তেই কালো মেঘ হানা দিল। পরমুহূর্তেই হেসে উঠে বলল,

‘ উহু। হবে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। যার অর্থ, আমি তোমার পুরোটাকেই ভালোবাসি। তোমার অভ্যাস, তোমার স্বপ্ন, তোমার ইচ্ছে, তোমার ভালোলাগা,তোমার পরিবার এবং বন্ধুমহল সব নিয়ে যে রঞ্জনটা তাকেই ভালোবাসি। তুমি ইউএস যাচ্ছ তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য। নিজের স্বপ্ন পূরণ করে যখন আমার কাছে ফিরবে তখন তোমার চোখে থাকবে তৃপ্তি। মনে থাকবে পরিপূর্ণতা। আমি তোমার সেই তৃপ্তিটা দেখতে চাই। তোমার সব স্বপ্ন পূরণে আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। তোমার চোখে চিকচিক করা খুশিটা দেখতে চাই। আহ্! ভেবেই কী শান্তি লাগছে জানো?’

রঞ্জন হাসল। চোখদুটোতে ঝলমল করে উঠল মুগ্ধতা। পূজার ধরে রাখা হাতে আলতো চুমু দিয়ে বলল,

‘ দেটস মাই লেডি! আমায় এতো বুঝো কেন বল তো?’

পূজা হেসে বলল,

‘ তুমি এতো ভালোবাসো কেন বল তো?’

‘ তোমায় যদি আরও অনেক বেশি ভালোবাসতে পারতাম!’

‘ তুমি আমায় যতটা বুঝো, আমিও যদি তোমায় ততটাই বুঝতে পারতাম!’

তারপর নিশ্চুপ,নিস্তব্ধ কিছু সময় চোখে চোখে কথা হয় তাদের। দুজনের চোখেই খেলে যায় একে অপরের প্রতি সীমাহীন আকুলতা। একটা সময়, ছোট্ট শ্বাস টেনে নীরবতা ভাঙল পূজা,

‘ অর্নাসটা শেষ করে গেলে হতো না?ওখানে গিয়ে মাস্টার্স করে নিতে।’

রঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ দাভাই এখনই যেতে বলছে। বাবাও রাজি। পাসপোর্ট, ভিসাও হয়ে গিয়েছে। দাভাই সেখানকার ইউনির্ভাসিটির ফর্মালিটিসও শেষ করে নিয়েছে প্রায়। হাফ স্কলারশিপ পাচ্ছি। ভালো ভার্সিটি। সুযোগটা লুফে নেওয়াই উচিত।’

এটুকু বলে থামল রঞ্জন। পূজার উৎসাহী চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ বিয়ে করতে চাও?’

‘ কেন? এখন তো বিয়ের কোনো প্ল্যান ছিল না।’

‘ তোমার যদি আমাকে নিয়ে ভয় থেকে থাকে তো…’

‘ আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। কোনো সম্পর্কের বাঁধনে টেনে হিঁচড়ে আমার সাথে বেঁধে রাখতে চাই না। তুমি যেমন আমায় উড়তে দিচ্ছ, আমিও তোমায় তেমনই উড়তে দিতে চাই। আমি তোমার পিছুটান নই।’

‘ তবুও। তুমি চাইলে আমি বাসায় জানাতে পারি। পারিবা…’

‘ আমি যেমন পৃথিবী ফেলে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। আমি জানি তুমিও পৃথিবী ফেলে আমার কাছেই ছুটে আসবে। এসব ভেবো না তো। জাস্ট ফোকাস অন ইউর ক্যারিয়ার। আমিও নিজের ক্যারিয়ারটা গুছিয়ে নিই।’

রঞ্জন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পূজার ডানহাতে হালকা চাপ দিয়ে বাঁকা হাসল। বলল,

‘ আমার আবারও তোমাকে ঝাপিয়ে পড়ে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। পাব্লিক রেস্টুরেন্ট বলে পারছি না।’

পূজা কথাটা না-শুনার ভান করে বলল,

‘ তুমি যে ইউএস যাচ্ছ। বন্ধুদের জানিয়েছ?’

‘ আজই তো কনফার্ম হলাম। এখনও জানানো হয়নি। ওদের ছেড়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হবে।’

পূজা কিছু বলবে তার আগেই ম্যাসেজ টুন বাজল। নম্রতার পাঠানো ম্যাসেজটা দেখেই কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল রঞ্জনের। পূজার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

‘ জান এখন উঠি? ওখানে একটু ঝামেলা হয়ে গিয়েছে।’

প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে নম্রতা। এই জানালা দিয়ে এক ফালি আকাশ দেখা যায়। অন্ধকারে ঢাকা নিকশ আকাশ। তার মাঝে ছড়ানো ছিঁটিনো কিছু তারা। তারাগুলোকে মাঝে মাঝে মুক্তোর মতো মনে হয় নম্রতার। একটা একটা করে সুতোয় গেঁথে বিশাল এক মালা মানাতে ইচ্ছে হয়। নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভার্সিটিতে হয়ে যাওয়া বড়সড় ঝামেলাটা বড্ড ভাবাচ্ছে তাকে। অন্তু আর নাদিমের মধ্যে মন কষাকষি স্পষ্ট। বন্ধুত্বটাতে ফাটল ধরবে না তো এবার? নম্রতার ভয় হয়। প্রচন্ড ভয়ে অস্থির লাগে। নীরার প্রতি ঝিমিয়ে থাকা একটা রাগ ফুঁসে উঠে তাকায়। পরমুহূর্তেই নিভে গিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে অন্ধকার আকাশটির দিকে। ঠিক তখনই মনে আসে আরফানের চিঠিটির কথা। দ্রুত পায়ে ব্যাগের কাছে ছুঁটে যায়। ব্যাগ থেকে চিঠিটা খুঁজে নিয়ে আবারও জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। টিমটিমে আলোয় পড়তে শুরু করে দমবন্ধ অনুভূতির সেই চিঠি,

‘ শ্যামলতা,

আমার দুঃখী রাজরাণী। তোমার দীর্ঘ দুঃখ কথনে নামদাগা আসামী আমি। বড় নির্দয়, নিষ্ঠুর। কিন্তু আমার জ্বলনও খুব কম ছিল না তাতে। তুমি ভুক্তভোগী। অভিযোগ, অভিমান করেই রক্ষা তোমার। কিন্তু আমার যে রক্ষা নেই। তবে, অভিমান আমারও হয়েছিল। তোমার নামে অভিযোগও জমিয়েছিলাম অনেক। চার চারটা বছর অপেক্ষা করেছি। ছটফট করেছি। বাচ্চাদের মতো অভিমানও করেছি। এই বয়সে এসে কী এসব ছেলেমানুষী অভিমান মানায়? মানায় না। তবুও ফুলেফেঁপে উঠেছে অভিমানের বহর। চার বছর আগে শেষ চিঠি তো আমার ছিল। চিঠিতে যোগাযোগের নাম্বারটা লিখে দেওয়ার পরও কেন যোগাযোগ করলে না তুমি? কী দোষ ছিল আমার? কেন ঠকিয়েছিলে আমায়? ভীষণ ভারী এই প্রশ্নগুলোর বোঝা টানতে টানতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি শ্যামলতা। এই চারবছরে তবু তোমায় ঘৃণা করতে পারিনি। অভিযোগ, অভিমান নিয়েও ভালোবেসেছি। শুধু ভালোবেসেছি।

নির্ঘুম রাতগুলোতে তোমার গায়ের একটু পরশ পেতে ছটফট করেছি। বেলীফুলের সুগন্ধহীন অক্সিজেনটাকে বিষের মতো গ্রহণ করেছি। চারটা বছর ভীষণ ফাঁকা ছিল এই বুক। সেই ফাঁকা বুকের গল্প তোমায় চিঠিতে জানাব না শ্যামলতা। এই গল্প জানতে হবে তোমার নিজের প্রচেষ্টায়। তুমি যেদিন আমার ফাঁকা হাতটা ধরবে পরম নির্ভরশীলতায়। সব সংকোচ ভুলে আমার চোখে চাইবে। আমাকে বুঝবে। আমার চোখে চেয়ে জানতে চাইবে। সেদিন বলব। আমার একটা নির্ভরতা দরকার শ্যামলতা। তুমি শুধু এই আমিটাকে সামলাও। কথা দিচ্ছি, তোমার পুরো পৃথিবীটা সামলানোর দায়িত্ব হবে শুধুই আমার।

ইতি
তোমার ব্যক্তিগত নিষ্প্রভ

চিঠিটা পড়েই কপাল কুঁচকে গেল নম্রতার। চিঠিটা টানা চার-পাঁচবার পড়ল সে। নিষ্প্রভ চিঠি দিয়েছিল? কিন্তু নম্রতার কাছে তো পৌঁছায়নি সেই চিঠি। তবে কোথায় গেল সেই চিঠি?

# চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here