নীল চিরকুট #লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা ৩৪.

0
880

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৩৪.

সেদিন রাতে বিছানায় যেতে যেতে ঘড়ির কাটা মধ্যরাতে গড়াল। নম্রতা চিঠিটা সযত্নে তুলে রেখে বিছানায় বসতেই খেয়াল করল, নীরার শরীর মৃদু কাঁপছে। বিশাল হলরুমটিতে ওরা দুজন ছাড়াও জুনিয়র চারজনের থাকার ব্যবস্থা। প্রশস্ত ঘরের সব আলো নেভানো। কোণার দুটো বিছানায় চার্জারের আলো জ্বেলে গুনগুন করে পড়াশোনা করছে দুজন জুনিয়র মেয়ে। রাত সাড়ে বারোটার পর রুমে আলো জ্বালানো মানেই সিনিয়রদের তোপের মুখে ভস্ম হওয়া। সিনিয়রদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো। প্রাইভেসি নষ্ট করা। সেই ভয় আর জড়তার জন্যই বিদ্যুতিক বাতির পরিবর্তে চার্জার ল্যাম্প নামক এই অযাচিত ব্যবস্থা। তাদের চার্জার ল্যাম্পের মৃদু আলোয় উল্টো হয়ে শুয়ে থাকা নীরাকে অস্পষ্ট বুঝতে পারল নম্রতা। টের পেল তার কম্পন। নীরা কী তবে জেগে আছে? নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। নীরার বিছানার পাশে গিয়ে বসতেই চমকে উঠল। নীরা কাঁদছে! নম্রতা সচেতন হলো। ডানহাতটা আলতো করে নীরার বাহুর উপর রাখল। তারপর তার থেকেও আলতো কন্ঠে বলল,

‘ নীরু?’

নীরার শরীরের কম্পন তীব্র হলো। ভেঙে গেল প্রতিরোধ। হেঁচকি তুলতে তুলতে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। আড়াল করতে চাইল নিজের কান্নাভেজা চোখ, ভেজা কন্ঠস্বর। নম্রতা জুনিয়র মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে গলা উঁচাল,

‘ জেরিন? নিপা?’

মেয়েদুটো তটস্থ ভঙ্গিতে মাথা তুলল।

‘ জি আপু?’

‘ তোমরা একটু বারান্দায় যাও তো আপু। বারান্দায় গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিবে। না ডাকা পর্যন্ত ভেতরে আসবে না।’

মেয়েদুটো অসহায় ভঙ্গিতে একে অপরের দিকে তাকাল। মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়াতেই নম্রতা গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,

‘ কাল তোমাদের সিটি আছে? বইটা সাথে নিয়ে যাও। বারান্দার আলো জ্বেলে দিলে পড়তে সমস্যা হবে না।’

মেয়ে দুটোর মুখ উজ্জ্বল হলো। বই আর নোট খাতা নিয়ে একবার আড়চোখে নম্রতার দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত পায়ে বারান্দার দিকে চলে গেল। নম্রতা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ কাঁদছিস কেন?’

নীরা উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ ঠাঁই শুয়ে থেকে কাঁদল। নম্রতা একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘ কাঁদলে কোনো সমাধান হবে না। অল্পতে কাঁদার মেয়ে তো তুই নস। তোর প্রতিরোধ শক্ত। আজ হঠাৎ এতো কাঁদছিস কেন?’

নীরা উঠে বসল। দুইহাতে চোখ মুছে নিয়ে বলল,

‘ তুইও আমায় দোষী ভাবিস না?’

নম্রতা বিরসমুখে বলল,

‘ না। তোর কী দোষ?’

‘ আমার জন্য নাদিম আর অন্তুর মধ্যে ঝগড়া হয়ে গেল। দু’জনেই গোঁয়ার। কেউই এই ঝগড়া মিটিয়ে নিভে না, আমি জানি।’

‘ রঞ্জন আছে। আমরাও আছি। কিচ্ছু হবে না।’

কিছুটা প্রাণহীন শোনায় নম্রতার কন্ঠ। নীরা দু’হাতে কপাল চেপে ধরে বলল,

‘ অন্তু পাগল হয়ে গিয়েছে। ওর এখন কিচ্ছু জ্ঞান নেই। নাদিমের সাথে নিজ থেকে কথা সে বলবে না। আর নাদিম তো কখনোই না।’

নম্রতা ক্লান্ত শ্বাস টেনে বলল,

‘ বুঝিসই যখন তখন কেন এতো গড়াতে দিলি? কী হতো একটু কথা বললে?’

নীরা হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেল। চোখ-মুখ ধীরে ধীরে শক্ত হলো।

‘ আমি জানি তুই আমায় দোষী ভাবিস। বাট আই এম নট দি কালপ্রিট। অন্তুর মধ্যে ন্যূনতম ম্যাচিউরিটি নেই। ওর বাবা-মা শখ করে বিয়েতে রাজি হয়নি। চাপে পড়ে রাজি হয়েছে। বিয়ের পর আমরা কেউ ভালো থাকব না। তাছাড়া, এতোকিছুর পর ওকে বিয়ে করা মানে লোকমুখে ছড়ানো মিথ্যাটাকে সত্য করে দেওয়া।’

নম্রতার ভেতরটা থিতিয়ে থাকা রাগে গনগন করে উঠে। মেজাজ খারাপ হয়। মনের কোণে উঁকি দেয় প্রশ্ন, ভালোবাসা কী সত্যিই এতো যুক্তি-তর্ক দিয়ে হয়? নীরা কী সত্যিই অন্তুকে ভালোবাসে? নম্রতা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থাকে নীরার চোখে। উপলব্ধি করতে চায় অন্তুর প্রতি তার আকুলতা। না! নেই। নীরার ভেতর বিন্দুমাত্র তরলতা নেই। এতো শক্ত নীরা! এতো শক্ত তার ভীত!

‘ আমি কখনই বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চাইনি। কিন্তু কিভাবে কী হয়ে গেল বল তো?’

নীরার কথায় চোখ ফেরায় নম্রতা। উদাস কন্ঠে বলে,

‘ কে কী চেয়েছিল আর কে কী চায়নি তা আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না নীরু। সত্যটা হলো, আমরা ভেঙে যাচ্ছি। নাদিম, অন্তু ভেঙে গিয়েছে। ভেঙে গিয়েছিস তুইও। রঞ্জন দেশ ছেড়ে যাচ্ছে । আর বাকি রইলাম আমি আর ছোঁয়া।’

এটুকু বলে থামল নম্রতা। নীরার দিকে হালকা চমকানো দৃষ্টিতে তাকাল। হঠাৎ করেই ভীষণ করুণ কন্ঠে বলল,

‘ ওদের ছাড়া কি করে থাকব বল তো? সারাজীবন একসাথে থাকার ওয়াদা কেউ করিনি। কখনো আলাদা হব সেই চিন্তাটাও ছিল না। অতীত-ভবিষ্যৎ কিচ্ছু জানতাম না। শুধু জানতাম, আমি বলে কিছু হয় না। যা আছে সবই আমরা। আজ হঠাৎ আমরা থেকে আমি হয়ে গিয়ে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে নীরু। অসহায় লাগছে।’

নীরা কথা বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। নম্রতার মনে ক্ষোভ জন্মায়। তীব্র ক্ষোভে হাসফাস করে। এই ক্ষোভটা আসলে কার উপর বুঝে উঠতে পারে না। এই ক্ষোভ বুঝি বিস্তৃত। ছয়টা প্রাণেই কত প্রগাঢ় তার অস্তিত্ব। নম্রতার হঠাৎই সব রাগ গিয়ে পড়ে নিষ্প্রভের ওপর। এই লোকটিই যত ঝামেলার মূল। এই লোকটি চলে যাওয়ার পর থেকেই নম্রতার এই বেহাল দশা। সেদিন থেকেই এই ক্ষোভ আর মন খারাপের পৃথিবীতে নম্রতার নিত্য দিনকার পদার্পন।

নম্রতা বিছানা ছেড়ে উঠে যেতেই ডানপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল নীরা। নির্নিমেষ চেয়ে রইল একটু দূরে জ্বালিয়ে রাখা চার্জার ল্যাম্পটার আলোয়। সেই আলোয় চেয়ে থেকেই নিজের অগোছালো জীবনটা নিয়ে ভাবল নীরা। ভাবল অন্তুর কথাও। অন্তুর সব কথায় নীরার জানা। কিন্তু অন্তুর পাগলামোকে মেনে নেওয়ার ভরসাও তার হয় না। নিজের আত্মসম্মান আর জেদটাকে পাশে রেখে ভাবলেও বড় ভয় করে নীরার। অন্তুর চাকরী নেই। অন্তুর বাবা বিয়েতে রাজি নয়। অন্তুর মাও ভীষণ ক্ষুব্ধ। সব থেকে বড় সমস্যা অন্তুর বাবার শর্ত। অন্তু তাকে বিয়ে করলে নীরার পড়াশোনা, খাওয়া-পরার যাবতীয় দায়িত্ব হবে অন্তুর। অন্তুর বাবা পরিবারের অতিরিক্ত সদস্যের জন্য একটা টাকাও খরচ করতে রাজি নন। তবে, অন্তু কোথায় পাবে সংসার টানার টাকা? অনার্স পাশের সার্টিফিকেট ছাড়া চাকরিই বা কোথায় পাবে সে? নীরার দায়িত্ব টানতে গিয়ে যদি অন্তুর স্বপ্নই ভেঙে যায়। পড়াশোনা থেমে যায় তাহলে কি হবে এমন ভালোবাসায়? দিনশেষে অন্তুর কী একটা আফসোস থাকবে না? পাগলামির বশে করা এই বিয়ের জন্য কী সে পস্তাবে না? নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বন্ধুমহলের নিষ্ঠুর বিচ্ছেদের কথা ভেবে অসহায়ত্বটা আরও গাঢ় হয় নীরার। বুক ভারী হয়ে আসে। কান্না পায়। ঢালা বর্ষনে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে সব ঝাঁঝ। সব রাগ।

ঘড়িতে দশটা কি এগারোটা বাজে। ভোরের রোদ মাত্রই কংক্রিট পেরিয়ে হাসপাতালের ঝকঝকে ফ্লোরে হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে। কোথা থেকে ভেসে আসছে ফিনাইলের উৎকট গন্ধ। হাসতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি এ্যাম্বুলেন্স থেকে আসছে স্বজন হারা মানুষের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। এমনই এক রৌদ্রজ্বল সকাল বেলায় নম্রতাকে হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। সাদামাটা সালোয়ার-কামিজের সাথে পিঠময় খোলা চুল। চোখে হালকা ল্যাপ্টে যাওয়া কাজল। করিডোর পেরিয়ে আরফানের চেম্বারের সামনে পৌঁছাতেই সাঈদকে চোখে পড়ল নম্রতার। আরফানের এসিস্ট্যান্ট ধরনের ছেলেটা, ফাইলে কি সব সিরিয়াল করছে। হাতের কলমটা নিয়ে দ্রুত হাতে কেটে চলেছে একের পর এক স্লিপ। নম্রতা সাঈদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে হালকা গলা খাঁকারি দিল। মানুষের সাড়া পেয়ে মাথা তুলে তাকাল সাঈদ। নম্রতাকে দেখে মৃদু হাসলও। নম্রতাকে সে চিনে। আরফানের সাথে নম্রতার যে ইটিশপিটিশ টাইপ কিছু চলছে সেটাও বেশ ধারণা করে ফেলেছে সে। নম্রতাকে চুপ থাকতে দেখে সে নিজে থেকেই বলল,

‘ কেমন আছেন আপু?’

‘ আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?’

‘ আপনাদের দোয়ায় ভালো।’

নম্রতার মনে হলো সাঈদকে সে আজই প্রথম হাসতে দেখছে। ইতোপূর্বে কখনো এতো হাসি হাসি মুখে কথা বলেছে কি-না মনে পড়ছে না নম্রতার। নম্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ নিষ্প্রভ আছে?’

‘ জি? নিষ্প্রভ?’

নম্রতা নিজের ভুলটা দ্রুত সামলে নিয়ে বলল,

‘ আরফান। ডক্টর আরফান আছেন চেম্বারে?’

‘ জি আছেন। তবে ব্যস্ত আছেন। ভেতরে ঢুকতে দেওয়ার অনুমতি নেই।’

নম্রতা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ভাবে। তারপর বলে,

‘ আমি ভেতরে যাব না। আপনি কী কাইন্ডলি উনাকে জানাবেন যে আমি এসেছি? উনার সাথে জরুরি প্রয়োজনে দেখা করতে এসেছি। আমার নাম নম্রতা মাহবুব। নাম বললেই চিনবে।’

সাঈদ ঠোঁট টিপে হেসে মাথা নাড়ল। নম্রতা বিগলিত কন্ঠে বলল,

‘ মাই গুডনেস। থেংকিউ।’

তবে নম্রতার ধন্যবাদটা যেন মাঠে মারা গেল। সাঈদ চেম্বারে ঢুকে আরফানকে খবর পৌঁছানোর আগেই অন্য কোথাও কাজের ডাক পড়ল তার। নম্রতাকে অপেক্ষা করতে বলে সেই যে হারাল, আধঘন্টার মাঝে তার টিকিটিরও সন্ধান পাওয়া গেল না। হতাশ নম্রতা বেশ কিছুক্ষণ করিডোরময় পায়চারী করল। অস্থির ভঙ্গিতে ঘড়ি দেখল কিন্তু সাঈদ ফিরল না। শেষমেশ অধৈর্য্য হয়ে দরজা ঠেলে নিজেই ভেতরে উঁকি দিল নম্রতা। প্রায় সাথে সাথেই তিন জোড়া চোখ তড়াক করে তার ওপর এসে পড়ল। আরফানের চোখদুটোতে বিষ্ময়। বাকিদুজনের চোখে কৌতূহল। কয়েক সেকেন্ড তীব্র অস্বস্তিতে কাটার পর নড়েচড়ে উঠল নম্রতা। এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিত ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। আরফান বিস্মিত ঠোঁটজোড়া হালকা ফাঁক করে বলল,

‘ আপনি?’

নম্রতা উত্তর খুঁজে পেল না। সামনে থাকা কৌতূহলী দৃষ্টিজোড়ার সামনে ভীষণ আগোছালো হয়ে পড়ল। থতমত খেয়ে বলল,

‘ সরি! আমি বরং আসি।’

আরফান ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

‘ দাঁড়ান।’

কথাটা খানিক গলা উঁচিয়ে বলল আরফান। নম্রতা দাঁড়িয়ে পড়তেই চোখদুটো সরিয়ে সামনের মানুষদুটোর দিকে তাকাল সে। লোকদুটোর চোখে অপার কৌতূহল। আরফান গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ ডক্টর মুহিব, আপনারা একটু বসুন। আই উইল ব্যাক ইন ফাইভ মিনিটস্।’

লোকদুটো ঠোঁট বাঁকিয়ে দুর্বোধ্য হাসল। বিনা পরিশ্রমে দুষ্প্রাপ্য কিছু আবিষ্কার করে ফেললে যেমন উত্তেজনা হয়। ঠিক তেমনই উত্তেজনায় চকচক করে উঠল তাদের চোখ। আরফান অবশ্য সে দৃষ্টিকে বিশেষ পাত্তা দিল না। চুপচাপ চেম্বার থেকে বেরিয়ে নম্রতার মুখোমুখি দাঁড়াল। পকেটে হাত রেখে মেরুদণ্ড সোজা করল। চোখদুটোতে তৃষ্ণার অনল নিয়ে নম্রতার আগাগোড়া নিরক্ষণ করল। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিবিলাস শেষে চোখ দুটো স্থির করল নম্রতার চোখে। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,

‘ হঠাৎ আমায় মনে পড়ল? কেমন আছেন?’

নম্রতা সে কথার জবাব দিল না। কপাল কুঁচকে বলল,

‘ ফ্রী হচ্ছেন কখন?’

‘ কেন?’

নম্রতার অকপট উত্তর,

‘ বিয়ে করব।’

আরফান চোখ বড় বড় করে তাকাল। পরমুহূর্তেই হেসে বলল,

‘ আচ্ছা? তো পাত্র কী আমি? নাকি সাক্ষী বানানোর চিন্তা?’

‘ ফাজলামো করবেন না তো। আমি একদমই ফাজলামোর মুডে নেই। কত চিন্তা আমার জানেন?’

আরফান মিটিমিটি হাসছিল। নম্রতার কথায় অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

‘ ছোট্ট একটা মাথায় অতো কিসের টেনশন?’

‘ টেনশনের মতো অনেক ব্যাপার ঘটেছে। আপাতত আমি আপনাকে নিয়ে টেনশন করছি। আপনাকে সর্বোচ্চ আধাঘন্টা সময় দেওয়া হলো। জলদি আসুন নয়তো খবর আছে।’

আরফান হেসে ফেলে বলল,

‘ এভাবে হয়?’

‘ তবে ফিরে যাব?’

আরফান এক পা এগিয়ে এলো। চারপাশটা দেখে নিয়ে মাথাটা হালকা নিচু করে মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ আপনার তো ফিরে যাওয়ার পথ নেই নম্রতা। বহু আগেই আটকে গেছেন নিষ্প্রভ নামক দেয়ালে। এই দেয়াল ভাঙবার নয়। আর আপনার মুক্তিও জুটবার নয়। একটু অপেক্ষা করুন। ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি।’

নম্রতার হৃদস্পন্দন দুই-তিন ডিগ্রি বাড়িয়ে দিয়ে ভদ্রপায়ে চেম্বারে ঢুকে গেল আরফান। নম্রতা বুকে হাত দিয়ে জোড়াল শ্বাস ছাড়ল। করিডোরের কোণার একটি চেয়ারে অলস বসে রইল। আধঘন্টা দশমিনিট পর সাঈদ এলো এক কাপ চা নিয়ে। নম্রতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ স্যার দিতে বলেছেন। আপনি আরও কিছু খেলে.. ‘

নম্রতা হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘ লাগবে না। আপনি চা-টাও নিয়ে যান। হসপিটালের পরিবেশে কিছু খেতে পারি না আমি।’

সাঈদ জোড়াজুড়ি করল না। মৃদু হেসে জায়গাটা থেকে সরে এলো। ছেলেটা আজ কারণে অকারণে হাসছে। কেন হাসছে কে জানে? ঠিকঠাক এক ঘন্টা অপেক্ষা করার পর চেম্বার থেকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলো আরফান। নীল স্ট্রিপের ভাঁজহীন শার্ট গায়ের মানুষটিকে এবার একটু চোখ মেলে দেখল নম্রতা। দীর্ঘকায় বিশাল চেহারার মানুষটি শ্যামবর্ণ। চেহারায় আলাদা এক মাধুর্যতা আছে। গালের সাথে ল্যাপ্টে থাকা চাপদাড়িগুলোও কেমন সবল, বলিষ্ঠ। চশমাহীন চোখদুটোতে প্রগাঢ় বুদ্ধির ছাপ। আরফান সতর্ক চোখে ঘড়ি দেখল। কুঁচকানো কপাল নিয়ে শার্টের হাতা ভাঁজ করতে করতে নম্রতার সামনে এসে দাঁড়াল। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

‘ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো, সরি। প্ল্যান ছিল না তো তাই… ‘

নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। মিষ্টি হেসে বলল,

‘ সমস্যা নেই। আমি জানি আপনি চেষ্টা করেছিলেন। ডাক্তারদের কত কাজ। আমারই অসময়ে আসাটা উচিত হয়নি।’

আরফান কিছু বলার আগেই আরফানের ডান বাহু জড়িয়ে ধরে তাড়া দিয়ে উঠল নম্রতা,

‘ চলুন।’

আরফান বিস্ময় নিয়ে নম্রতার হাতের দিকে তাকাল। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নম্রতার মুখের দিকে তাকাল। নম্রতার মুখে তেমন কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না। অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে রেখে বলল,

‘ এভাবে তাকিয়ে থাকলে লজ্জায় মরে যাব। চোখ সরান। হাসপাতালের মাঝে হাত ধরলে কী আপনার ডাক্তারগত প্রেস্টিজের কোনো ক্ষতি হবে?’

আরফান চোখ সরাল না। বিস্ময় ঠেলে হাসল। নম্রতার হাতটা বাহু থেকে সরিয়ে বলিষ্ঠ আঙ্গুলে আবদ্ধ করল। তারপর দ্রুত পায়ে হাঁটা দিয়ে বলল,

‘ চলুন।’

আরফান দ্রুত হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো। হাসপাতালের মাঝে প্রেমিকার হাত ধরে ঘুরে বেড়ানোটা বড় অস্বস্তির। প্রেমিকার এগিয়ে দেওয়া হাত ছেড়ে দেওয়া আরও বেশি অস্বস্তির। আর সে যদি স্বয়ং শ্যামলতা হয় তাহলে তো কথায় নেই। আরফানের বুক ঢিপঢিপ করছে। বাইরে থেকে বলিষ্ঠ দেখতে পাওয়া মানুষটির ভেতরটা ফেঁটে যাচ্ছে উত্তেজনায়। শ্যামলতার স্পর্শ! বহু আকাঙ্খিত সেই শ্যামলতা! কথাটা ভাবতেই সারা শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালের বাইরে থেকে রিকশা নিয়েই গম্ভীর কন্ঠে বলল আরফান,

‘ আপনি নিজ ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে শুধু ধরতে হয় বলেই আমার হাত ধরবেন না প্লিজ। নিজেকে সময় দিন। আমি ব্যাপারটা ওভাবে বুঝায়নি।’

নম্রতা উত্তর দিল না। মুখ গুজ করে বসে রইল। আরফান যে ফাঁকটা ধরে ফেলেছে বুঝতে পেরে সে অনুতপ্ত। নম্রতা জোড়াল শ্বাস ফেলল। সাথে সাথেই নাকে গিয়ে ঠেকল সেই সুগন্ধ। প্রতিটি চিরকুটে যে সুগন্ধ মেশানো থাকত ঠিক সেই সুগন্ধ। নম্রতার চারপাশটা এবার পরিচিত হয়ে উঠল। গাঁট বেঁধে থাকা শরীরটা ঢিলে হয়ে এলো। পাশে বসে থাকা মানুষটির হাতে আলতো হাত রাখল। এবার অভিনয় নয় সত্যিকারের অনুভূতি এসেই জমা হলো সেই স্পর্শে। নম্রতা প্রথমবারের মতো কোনোরূপ অস্বস্তি বোধ করল না। এই প্রথমবার তার মনে হলো, পাশে বসে থাকা মানুষটি অন্য কেউ নয় তার নিজস্ব মানুষ। তার সে। যার নাম নিষ্প্রভ। নম্রতা মাথাটা হেলিয়ে দিল আরফানের কাঁধে। আরফানের শরীরে থাকা সুগন্ধিটা আরও তীব্রভাবে এসে ঠেকল নাকে। নম্রতা দুইহাতে নিষ্প্রভের ডানবাহুটা জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করল। চার বছরের বিক্ষিপ্ত মন ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো। পাশের মানুষটিকে হঠাৎই ভীষণ কাছের বলে বোধ হলো। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলল নম্রতা। আরফানের কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে চুপচাপ চেয়ে রইল আরফানের শ্যামবর্ণ মুখে। খুব কাছ থেকে নিরক্ষণ করল তার কাটা কাটা চেহারা। শক্ত চোয়াল। মনের অস্বস্তিগুলো দূর হয়ে অবাধ্য মন স্বগোতক্তি করল, ‘ হ্যাঁ! এই মানুষটা আমারই। শুধুই আমার। যার জন্য বছরের পর বছর চিঠি লিখেছি। অপেক্ষা করেছি। কেঁদেছি পর্যন্ত।’ নম্রতার কাজে বেশ হকচকিয়ে গেল আরফান। বিস্ময়ের পর বিস্ময় খেলে যাচ্ছে তার চোখে। সবকিছু ধাঁধার মতো লাগছে। বুকে ধরাম ধরাম ঢোল পেটাচ্ছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হাত-পা কী মৃদু কাঁপছে না? সবকিছু ছাপিয়ে আরফান এতটুকু বুঝল, নম্রতা তাকে মেনে নিতে পারছে। তার ছোঁয়ায় আগের মতো দ্বিধা নেই। অস্বস্তি নেই। আরফানের বুকে অদ্ভুত এক খুশি ঠেলাঠেলি করে উঠল। সচেতন কন্ঠে বলল,

‘ পরিচিত লাগছে?’

নম্রতা হাসল। তার হাসিটা বড় মিষ্টি দেখাল এবার,

‘ খুউব।’

আরফান হাঁফ ছেড়ে বলল,

‘ বাঁচা গেল। এ কয়েকদিন কি ভীষণ টেনশনে ছিলাম।’

নম্রতা হঠাৎই সোজা হয়ে বসল। কিছুটা গম্ভীর দেখাল তার মুখ। ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ আপনি চিঠি পাঠালে আমি পেলাম না কেন? আপনি সত্যিই চিঠি পাঠিয়েছিলেন? কত তারিখ ছিল সেটা?’

‘ আপনি চিঠি দেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায়। যে চিঠিতে আপনি প্রশ্ন করেছিলেন, আমাদের কবে নাগাদ দেখা হবে। সেটার উত্তর পাঠিয়েছিলাম।’

নম্রতা অবাক হয়ে বলল,

‘ কিন্তু আমি তো উত্তর পাইনি। সেই চিঠির পর আরও একটা চিঠি দিয়েছিলাম। সেই চিঠিটা আপনি রিসিভ পর্যন্ত করেননি। টানা চার বছরের জন্য উধাও হয়ে গেলেন। আরেকটা চিঠি তো দিতে পারতেন!’

আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ ছিলাম না তো।’

নম্রতা ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ মানে? একটু ক্লিয়ার করে বলুন প্লিজ। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। ছিলেন না মানে কী? কোথায় ছিলেন?’

আরফান হাসল। শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ এতো অধৈর্য্য হচ্ছেন কেন? আগে রেস্টুরেন্টে পৌঁছাই। লাঞ্চ করতে করতে কথা বলি। আজ পুরো দিনটাই ছুটি। আপনার জন্য পুরো দিনটা ছেড়ে রাতের ডিউটি নিয়েছি ।’

নম্রতা জেদ ধরা কন্ঠে বলল,

‘ না। অত ধৈর্য্য আমার নেই। আপনি এক্ষুনি বলেন। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি।’

আরফান হেসে বলল,

‘ সেই জেদ। জেদটা এখনও কমেনি?’

‘ কমবেও না। বলুন জলদি।’

আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ দেশের বাইরে ছিলাম। ভাইয়া প্রায়ই ইউএস যেতো। ওর থেকেই সেখানকার একটা সীম জোগার করে আপনাকে নাম্বার দিয়েছিলাম। শুধুমাত্র আপনি ফোন করবেন সেই আশায় গোটা চারবছর দুই মিনিটের জন্যও অফ রাখিনি সেই সীম। যদি আপনি ফোনে না পান? ভয় হতো।’

নম্রতা অভিমান নিয়ে বলল,

‘ ইউএস যাচ্ছেন কখনও বলেননি কেন আমায়? এতোবড় একটা কথা চেপে গেলেন? আমি তো সব বলতাম।’

‘ লাস্ট চিঠিতে বলেছিলাম তো। স্কলারশিপের কথা জানার পাঁচ দিনের মাথায় চলে যেতে হলো। বলার সময় কোথায় পেলাম? তারওপর সেই দিনগুলো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়। আমি ম্যান্টালি খুব উইক হয়ে পড়েছিলাম। আমার আপনাকে খুব প্রয়োজন ছিল তখন।’

নম্রতা আদ্র কন্ঠে বলল,

‘ ভয়ঙ্কর সময় কেন বলছেন? কি হয়েছিল?’

‘ বাকিটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বলি? ব্যক্তিগত কথা বলার জন্য রিকশা খুব একটা সুইটেবল ভেহিকল নয়।’

নম্রতা উদ্বিগ্ন চোখে চেয়ে রইল। কপালে হালকা ভাঁজ। আরফানের হঠাৎ-ই নম্রতাকে কাছে টেনে তার কুঞ্চিত কপালে চুমু আঁকতে ইচ্ছে হলো। কয়েক সেকেন্ড নম্রতার উদ্বিগ্ন মুখটির দিকে তাকিয়ে থেকে অবাধ্য ইচ্ছেটাকে ঠেলেঠুলে বন্ধী করে রাখল ঠান্ডা গোপনীয়তায়। অবাধ্য ইচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে গর্জে উঠতে লাগল বুকে। দৃঢ় প্রতিবাদ জানাল। তবু আরফান সিদ্ধান্তে অটল। গর্জালে গর্জাক। প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিক শরীরের প্রতিটি কোষ। তবুও নিজেকে অতটা প্রশ্রয় দিতে রাজি নয় সে। তাও আবার এমন একটা পরিবেশে!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here