ঘূর্ণ্যমান_তিক্ততা ৪র্থ পর্ব

0
397

#ঘূর্ণ্যমান_তিক্ততা

৪র্থ পর্ব

খুব সকালে মোহর ছাদে চলে গেলো। পুরো বাড়িতে ছাদই একমাত্র জায়গা যেখানে মোহর একটু স্বস্তি পাই। ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে চারপাশের দৃশ্য দেখতে লাগলো সে। পাশেই একটা পার্ক। সেখানে কয়েকজন বাচ্চা খেলাধুলা করছে। মোহর এক দৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বাচ্চা গুলোকে দেখে যেন তার প্রাণ জুড়িয়ে যাই। তার ভালোই লাগে রোজ ছাদে এসে বাচ্চাদের আনন্দের দৃশ্য গুলো উপভোগ করতে।

ওহীর ও সেই সময়ে ঘুম ভেঙে গেলো। তার পানির প্রচণ্ড পিপাসা পেয়েছে। পাশে থাকা সার্ভেন্ট কে কয়েকবার ডাকলো সে কিন্তু মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। ওহী খুব কষ্ট করে কোনো মতে বসে পড়লো। যখনি গ্লাসে পানি ঢালবে ঠিক তখনি গ্লাসটি মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেলো। গ্লাসের শব্দে সার্ভেন্ট জেগে উঠলো।

>>আরে আপামণি কি হয়ছে? পানি খাবেন নাকি?

>>জি।

সার্ভেন্ট অন্য একটি গ্লাস এনে সাবধানে ওহীকে পানি খাইয়ে দিলো। গ্লাস ভাঙা কাঁচ গুলো পরিষ্কার করে তারপর মোহরকে ডাকতে চলে গেলো।
ওহী বোঝার চেষ্টা করছে এই মানুষ গুলোর উদ্দেশ্যটা কি?
একজন তার সাথে জানোয়ার এর মত আচরণ করেছে। আর বাকিরা তার খেয়াল রাখছে। এর কারণ টা আসলে কি হতে পারে?

সার্ভেন্ট জানে এই সময়ে মোহর ছাদে থাকে। তাই ছাদে চলে গেল মোহর কে ডাকতে।

>>আপা।

>>জি দিনা বলো।

>>আপামণি ঊঠে গেসেন।

>>আচ্ছা যাও আমি আসছি।

মেয়েটা চলে গেলো। মোহর আর এক পলক বাচ্চা গুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেও নেমে আসলো।
মোহর ওহীর কাছে এসে দেখলো ওহী নিচে নামার চেষ্টা করছে। মোহর ওহীর হাত শক্ত করে ধরলো। তারপর তাকে দাড় করিয়ে নিয়ে এক কদম দু কদম হাটতে সাহায্য করলো। ব্যাথায় ওহীর পা গুলো যেন অসাড় হয়ে আসছিলো। তাও সে মোহরের উপর ভর দিয়ে হেটে ব্যাল্কুনির দিকে গেলো।

>>এখানে বসবে?

ওহী মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। মোহর ওহীকে বসিয়ে দিলো ব্যাল্কুনির কাউচে। তার পিঠের নিচে কুশন দিয়ে দিলো যাতে তার কোন সমস্যা না হয়।

>>সকালে চা খাও নাকি কফি?

>>যে কোন একটা হলেই চলবে।

>>তাহলে তুমি একটু বসো আমি চা করে আনছি।

>>আচ্ছা।

মোহর চা আনতে চলে গেলো। ওহীর সামনে এখনো একটা প্রশ্ন বোধক চিহ্ন। সবার আচরণই তাকে ভাবাচ্ছে।

আনাস সাহেবের মোবাইলে রাতে একটি ভিডিও এসেছিলো। তিনি সেটি সকালে খুললেন। ভিডিও টা ছিলো ওহীকে মারধর করার। ওহীকে কে যেন খুব জঘন্য ভাবে পেটাচ্ছে বেল্ট দিয়ে। আবার মাথায় কি দিয়ে যেন আঘাত করছে। ওহীর সারা শরীর রক্তে মাখামাখি। ওহীর গায়ে করা প্রতিটা আঘাতের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সেই সাথে ওহীর গগনবিদারী চিৎকার। আনাস সাহেব এক চিৎকার করে অগ্নিকে ডাকলেন। অগ্নি এসে দেখলো আনাস সাহেব মেঝেতে পড়ে আছে আর হাতের মোবাইলে একটি ভিডিও চলছে।
সে মোবাইলটি হাতে নিয়ে ভিডিও টি দেখলো। তার যেন অন্তর আত্তা কেঁপে উঠলো। সে তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স ডেকে আনাস সাহেব কে নিয়ে দ্রুত হসপিটাল চলে গেলো।

ওহী হেলান দিয়ে বসে আছে। মোহর দু’কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। এককাপ ওহীর হাতে দিয়ে অন্য এক কাপ নিজের কাছে রাখলো। ওহী গরম চায়ে ফু দিয়ে চুমুক দেয়ার চেষ্টা করছে। মোহর ওহীর দিকে তাকিয়ে আছে। ওহী অনেক টা বাচ্চাসুলভ দেখতে। আর চেহেরা টা যেন মায়ায় ভরা। কিন্তু ওহীর সেই মায়াময় মুখে ক্ষত গুলো বড্ড বেমানান।

>>আস্তে ধিরে চা টা খাও নাহয় জিহ্বা পুড়ে যাবে।

মোহর এই কথা টি শুনে ওহী কিছু টা লজ্জা পেলো।

>>হুম।

>>তা বলো কিসে পড়ো তুমি?

>>অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে।

>>ফ্যামিলি তে কে কে আছে তোমার?

>>বাবা আর হাসবেন্ড।

>>তুমি বিবাহিত?

>>জি।

>>জানতাম তো।

>>এক বছর হতে চললো।

>>ওহ আচ্ছা।

>>আচ্ছা আপনি আমার ব্যাপারে কতটুকু জানেন?

>>তেমন বেশি না। অল্পসল্প জানি।

>>যেমন?

>>যেমন তুমি ওহী আনাস। পুলিশ ইন্সপেক্টর হায়দার আনাসের একমাত্র মেয়ে। এইটুকুই।

>>ওহ আচ্ছা। আমাকে কবে থেকে চিনেন?

>>বছর তিনেক আগে থেকে।

>>কিন্তু আমি আপনাদের কাউকেই চিনি না।

>>তুমি হয়তো আমাদের চিনো না কিন্তু আমাদের আপন কেউ তোমার অতী পরিচিত ছিলো।

>>মানে?

>>মানে কিছুনা। আচ্ছা বলো চা টা কেমন লাগলো?

>>হ্যাঁ ভালোই হয়েছে খেতে। আপনি করেছেন?

>>হ্যাঁ।

>>বেশ ভালোই চা করেন।

>>হ্যাঁ তূর্য আর ছোটু আমার চায়ের অনেক বড় ফ্যান।

মোহর এই কথাটি বলে কেমন যেন থমকে গেলো।

>>এরা কারা?

>>তূর্য আমার হাসবেন্ড আর ছোটু আমার দেওর।

>>আমাকে যিনি মেরেছেন উনি কে ছিলো?

>>আমার হাসবেন্ড তূর্য।

>>উনি তো অমানু…

ওহীকে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে মোহর বলে উঠলো,

>>আচ্ছা সেসব কথা বাদ দাও। আমি স্যুপ করে আনছি তোমার জন্য তুমি বসো।

মোহর চলে গেলো। আসলে মোহর পালিয়ে গেলো। ওহীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া টা তার জন্য অনেক কঠিন।
মোহর ওহীর জন্য স্যুপ করতে কিচেনে যাচ্ছিলো। তূর্য তখন ডাইনিং এ বসে ব্রেকফাস্ট করছিলো।

>>তা বান্ধুবির সাথে চা খাওয়া কেমন উপভোগ করলে?

তূর্যের সাথে মোহরের তেমন কথা হয়না বললেই চলে। কিন্তু ইদানীং ওহী আসার পর থেকে তূর্য মোহরকে শুধু খোঁচা মেরে কথা বলে। যা মোহরের মোটেও পছন্দ নয়। মোহর একরাশ বিরক্তি নিয়ে তূর্যকে বললো,

>>তুমি এভাবে খোঁচা মেরে কথা বলো কেনো?

>>আমি খোঁচা কই মারলাম। সিম্পল একটা প্রশ্ন করেছি।

>>এনাফ তূর্য। আমি শুধুই ওহীর খেয়াল রাখছি এর বেশি কিছুনা।

তূর্য হঠাৎ করে উঠে মোহরের গাল চেপে ধরলো। প্রচন্ড রেগে গিয়েছে ও।

>>উফহ এত ভালোবাসা এত কেয়ার। এই কয়দিনে সব ভুলে গেলে? এত আদর যত্ন তাও খুনি দের। বাহ ভালোই।

>>তূর্য প্লিজ ছাড়ো আমার লাগছে।

>>তিন বছরের জ্বলন্ত আগুন বুকে নিয়ে ঘুরছি আমি। আমাকে বাধ্য করোনা মোহর নাহয় এই আগুনে আমি তোমাকে ঝলসাতেও দ্বিধাবোধ করবো না।

তূর্যের এভাবে চেপে ধরায় মোহর বেশ ব্যথা পেয়েছে। তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। তূর্য মোহরকে ছেড়ে দিয়ে চেয়ারের উপর থেকে কোট টা পড়ে বের হয়ে গেলো।
মোহর এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কিছুক্ষণ এভাবে কেঁদে নিজেকে সামলে নিলো যে। বেসিনে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো ভালোভাবে। আয়নায় নিজের দিকে তাকাতেই দেখে তূর্যের চেপে ধরায় তার গাল গুলো কেমন যেন কালচে-লাল হয়ে গিয়েছে। তূর্যের যা দেহ তার শক্তি কম নয়। আর তূর্য যখন রাগে তখন নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে। মোহরের মাথায় হঠাৎ ওহীর কথা এলো। তূর্যের আঘাত গুলো কতটা জড়ালো ভাবে ওহীর গায়ে লেগেছে আসলে সেটা শুধু ওহী আর তার আল্লাহই ভালো জানে। ওহী যে এখনো বেঁচে আছে এর জন্য আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।

চলবে…..

#Razia_Binte_SuLtan

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here