প্রাণেশ্বরী #Writer_Asfiya_Islam_Jannat #পর্ব-০৭

0
442

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-০৭

আকস্মিক কারো আগমনে প্রাণ বেশ ভড়কে যায়, উৎকন্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কে?”

মুহূর্তেই একটি হাস্যজ্বল চেহেরা তার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। বলে, “স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে না-কি তোর? আমাকে চিনতে পারছিস না?”

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে প্রাণের সকল শান্তি উড়ে গিয়ে তিক্ততা জুড়ে বসে। এক রাশ বিরক্তি দেখা দেয় দৃষ্টির কোণে। বিতৃষ্ণায় মুখ কুঁচকে নিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সে, ভিতরকার অভিব্যক্তি প্রকাশ হতে না দিয়ে অধরে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলে, “প্রাণের স্মৃতিশক্তি এতও দূর্বল না যে অল্পতে সব ভুলে যাবে। তখন হঠাৎ করে পিছন থেকে এসে ধরলি যে তাই প্রথমে চিনতে পারিনি।”

জেসিকা গাল ফুলিয়ে বলে, “হুহ! যতসব তাল বাহানা। আমাকে যে ভুলে গিয়েছিস তা বুঝাই যাচ্ছে। কোন খোঁজ-খবর নিস এখন আর তুই আমার? নিজ থেকে তো একটাবার ফোনও করিস না। মেসেজও দিস না। কি নতুন কোন বন্ধু বানিয়েছিস না-কি?”

বন্ধু হিসাবে জেসিকার এমন চমৎকার অভিনয় দেখে প্রাণ বিমূঢ় না হয়ে পারলো না। কি সুন্দর মান-অভিমানের নাটক। যেন সে সত্যিকার অর্থেই প্রাণের প্রিয়তম সখী। একদিন কথা না বললে কোন কিছুতে মন বসে না। ভালো লাগে না। অথচ এর সবটাই মিথ্যে, লোক দেখানো। ভিতর দিয়ে দুমুখো,ছদ্মবেশীর চেয়েও নিম্ন শ্রেণির মানুষ একজন সে। সামনে সারাক্ষণ মুখে মধু নিয়ে ঘুরলেও সময়-সুযোগ বুঝে আবার পিছনে ছু’রি চালাতেও ভুলে না। এমন বন্ধু থাকা চেয়ে হাজার খানেক শক্র থাকাও শ্রেয়, এটাই এখন মনে করে প্রাণ। নিজের বিষাক্ত অনুভূতিগুলো বুকের ভিতর মাটি চাপা দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করতে করতে প্রাণ বলল, “আরেহ ধুর! এমন কিছুই না৷ এক্সিডেন্টের জন্য কতদিন ব্রেকে ছিলাম বলে এখন কাজের চাপ বেশি পড়ে যাচ্ছে আমার উপর। দম ফেলারও সুযোগ পাচ্ছি না রে, তাই যোগাযোগ করা হয়ে উঠছে না।”

জেসিকা এবার অভিমান ভেঙে চিন্তিত হওয়ার ভাণ করে বলে, “আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম এক্সিডেন্টের কথা। সে-বার যে ব্যথা পেলি, ইশশ! কাঁটা দাগগুলো আদৌ কি সেড়েছে তোর? কয়েকদিন পর না আরেক ফিল্মের শুট আছে? দাগ না গেলে বিশ্রি দেখাবে তখন। ক্রিম-ট্রিম ইউস করছিস না? আমার কাছে কিছু ভালো ক্রিমের নাম আছে, সাজেস্ট করতে পারি।”

এত ভালোমানুষি প্রাণের ঠিক হজম হলো না। অসহ্য লাগলো। তাই কথা কোনরকম কাটিয়ে উঠার জন্য বলে উঠলো, “নাহ! তার কোন দরকার হবে না। আমি ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ক্রিম ইউস করছি, দাগ প্রায় চলে গিয়েছে। চিন্তা করিস না তুই।”

জেসিকা বলে, “আচ্ছা! এখন নিচে চল৷ আমি তোর জন্য তোর পছন্দের স্প্যাগেটি রেঁধেছি, মিটবল দিয়ে। তাড়াতাড়ি চল, নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

প্রাণ নিচের জায়গায় ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে, “খাবারে আবার বিষ মিলাসনি তো? খেয়ে আবার মরে-টরে যদি যাই?”

অকস্মাৎ প্রাণের এমন কথার আক্রমণে হকচকিয়ে উঠে জেসিকা। চোখ দু’টো বড় বড় করে তাকায় প্রাণের পাণে। তড়িৎ বেগে মাথায় খেলে যায় নয়নের সেই প্রশ্ন, “প্রাণ কিছু জেনে যায়নি তো আমাদের সম্পর্কে?” কথাটা ভাবতেই সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে তার। ভাবনা এলো, আসলেই প্রাণ কিছু জেনে যায়নি তো? এভাবে কথা কেন বলছে সে? ভয়ে তটস্থ হয়ে জেসিকা আমতা-আমতা করে বলে, “কি যা তা বলছিস? আমি তোর খাবারে বিষ মিশাতে যাব কেন?”

প্রাণ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, “কে জানে? কোন শত্রুতা যদি থেকে থাকে।”

জেসিকা এবার পুরো দমে ঘাবড়ে যায়। কম্পনশীল কন্ঠে বলে, “মাথা গেছে নাকি তোর? তোর সাথে আবার আমার শত্রুতা থাকতে যাবে কেন? আজব তো!”

প্রাণ এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠে। প্রাণের হাসির দিকে তাকিয়ে জেসিকা যেন বোকা বনে যায়। গোলগোল নয়নে তাকাতেই প্রাণ বলে উঠে, “আরেহ ভাই আমি মজা করছিলাম। তুই দেখি কথাটা একদম সিরিয়াসলি নিয়ে কাঁপা-কাঁপিও শুরু করে দিলি। কি ব্যাপার? আসলেই কি খাবারে বিষ মিশিয়েছিস নাকি?”

প্রাণ মজা করছিল শুনে জেসিকা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, “তুইও না! ফাজিল মহিলা কোথাকার। তোর উদ্ভট সব কথা শুনে যে কেউ হার্ট ফেল করবে।”

কথাটা বলে প্রাণের বাম বাহুতে চাপর মারলো জেসিকা। প্রাণ হেসে খেলে বলে, “আমাকে বকা শেষ হলে এবার নিচে চল। আমার স্প্যাগেটি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তো। চল! চল!”

জেসিকাও সম্মতি জানিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলো।

__________

অরুণরাঙ্গা অন্তরিক্ষ জুড়ে পাখিদের ব্যস্ততা, নিজ নীড়ে ফেরার আকুলতা। বাতাসে দোলায়মান গাছ-গাছালির ফাঁকে ফাঁকে মাধবীলতার দল হেলে পড়ছে অলিন্দের দক্ষিণ দিকে। দৃষ্টি যতবারই সেদিকে যাচ্ছে ততবারই রঙবেরঙে মাধবীলতার স্নিগ্ধতা,কোমলতা আরাম দিচ্ছে দৃষ্টিকে। মনের অস্থিরতা নিঃশেষ করে দিচ্ছে নিমিষেই। প্রাণ বেশ কিছুটা সময় সেদিক তাকিয়ে থেকে মনকে স্থির করলো। অতঃপর মেকাপ আর্টিস্টদের আগমন ঘটতেই উঠে দাঁড়ালো সে, ফ্রেশ হয়ে তৈরি হতে শুরু করলো। আজ জিহানের বার্থডে, সেই উপলক্ষেই ‘প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল’-এ একটি পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। সেখানেই যাবে আজ সে।
নিজের মত সময় নিয়ে তৈরি হলো প্রাণ। মেকাপ আর্টিস্টরা চলে যেতেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার ভালো মত পর্যবেক্ষণ করে নিল। ল্যাভেন্ডার কালারের ফুল স্লিভসের একটি পার্টি গাউনের সাথে প্রয়োজনীয় সাজ, চুলগুলো ব্লো ড্রাই করে ছেড়ে রেখেছে, হাতে ‘টাইটান রাগ’-এর রিস্ট ওয়াচ, গলায় সিম্পল একটি পেন্ডেন্ট। ট্রেন্ডি লুকটায় বেশ ক্লাসি আর গ্ল্যামারাস দেখাচ্ছে তাকে। নিজের মন মতো সব হয়েছে দেখে ঠোঁটের কোণে আলতো এক হাসি ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলো সে। ড্রয়িংরুমে আসতেই চৈতিকে নজরে পড়লো তার। সাদা এক গাউনে, অল্প সাজে বেশ মানাচ্ছে তাকে। আজ তার সাথে পার্টিতে সেও যাবে। প্রাণের এসিস্ট্যান্ট হওয়ার সুবাদে জিহান তাকেও আমন্ত্রণ করেছে। প্রাণ চৈতির সামনে এসে বল, “চল! বেরুতে হবে আমাদের এখন।”

প্রাণকে দেখে চট করে দাঁড়িয়ে পড়লো চৈতি। মিহি কন্ঠে বলল, “ইয়েস ম্যাম! চলুন।”

প্রাণ কথা না বাড়িয়ে আশামাকে ডেকে তার থেকে বিদায় নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। বাহিরে এসে দুইজন গাড়িতে উঠে বসতেই, নিজ বেগে চলতে শুরু করলো গাড়িটি। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর প্রাণ লক্ষ করল চৈতি বারবার চোরাচোখে তার দিকে তাকাচ্ছে৷ তাই সে মন্থর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো, “কিছু কি বলবে আমায়? বারবার তাকাচ্ছ যে? কিছু বলার থাকলে নির্দ্বিধায় বল।”

চৈতি অপরিস্ফুট কন্ঠে বলে, “আসলে ম্যাম.. আপনাকে না আজ অত্যাধিক সুন্দর লাগছে। আমি মেয়ে হয়েও চোখ সরাতে পারছি না।”

কথাটা শুনে প্রাণ বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। অতি স্বাভাবিকভাবেই নিল ব্যাপারটা, যেন তাকে সুন্দর দেখানোটা কোন বিষয়ই না। স্মিথ কন্ঠে বলল, “থ্যাংকস! তবে তোমাকেও কিন্তু খারাপ লাগছে না, বেশ সুন্দর লাগছে।”

প্রাণের কথায় চৈতি অবাক হওয়ার পাশাপাশি লজ্জাও পেল। লজ্জা পাওয়ার কারণ তার প্রশংসা করায় আর অবাক হওয়ার কারণ প্রাণ তার প্রশংসার বিপরীতে অতি শীতল এক অভিব্যক্তি দিল যা কখনো কোন মেয়ে এমন এক অবস্থাতে দেয় না। তবে বিষয়টা গায়ে মাখলো না। এতদিনে চৈতি যতটুকু বুঝেছে প্রাণ একটি অন্য ধাঁচের মেয়ে৷ সবসময় শান্তশিষ্ট, গুরুগম্ভীর থাকাই তার বৈশিষ্ট্য। প্রাণোচ্ছল তাকে খুবই কম দেখা যায়। তবে যখন কথা আসে কাজের তখন নিজের সর্বস্বটা ঢেলে দেন তাতে। প্রত্যেকটা শর্ট তার এত ফ্লোলেস আসে যে মুগ্ধ না হয়ে পারাই যায় না। তাই আজকের ব্যবহার অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ঘন্টা খানেকের মধ্যেই প্রাণ এসে পৌঁছালো নিজের গন্তব্যে। গাড়ি থেকে নামতেই নিউজ রিপোর্টারের খপ্পরে পড়তে হলো তাকে। হরেক রমক প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে বসলো তারা, ছবি তুলার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। শত ফ্ল্যাশ লাইটের আলো হানা দিল অক্ষিকাচ বরাবর, জলসে গেল দৃষ্টি। প্রাণ কোনরকম সকলের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে, ছবি-টবি তুলে লাউঞ্জের ভিতর ঢুকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। সকলের প্রাইভেসির কথা মাথায় রেখে রিপোর্টারদের সীমিত সময়ের জন্য বাহিরের গার্ডেন পর্যন্তই এলাও করা হয়েছে, ভিতরে ঢোকা তাদের জন্য একেবারেই নিষেধ৷ সকল গেস্টরা এসে পড়লে তাদের বিদায় দেওয়া হবে৷ চৈতির কাছ থেকে উক্ত কথাটি জানতে পেয়ে প্রাণ স্বস্তি পেল কিছুটা। কেন না যতক্ষণ এই রিপোর্টাররা থাকবে সকলের জীবন অতিষ্ঠ বানিয়ে রাখবে। যদিও কোন এক কারণে ছোট থেকেই নিউজ রিপোর্টারদের একটুও সহ্য করতে পারে না প্রাণ কিন্তু ভাগ্য তাকে এমন পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে যেখানে প্রতিনিয়ত তাদের সম্মুখে এসে দাঁড়াতে হয়। কি এক কান্ড তাই না? মনে তীব্র বিতৃষ্ণা কাজ করা সত্ত্বেও অভিব্যক্তিতে কৃত্রিম আকর্ষণীয় ভাব এনে এবং দেহভঙ্গি দৃঢ় রেখে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। কয়েক কদম যেতেই জিহান এসে তাকে অভ্যর্থনা জানানো মাত্র প্রাণ তাকে বার্থডে উইশ করল৷ জিহান তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার রূপের খানিকটা প্রশংসা করলো। প্রাণও সবটা স্বাভাবিকভাবেই নিল। অতঃপর জিহান তাকে পার্টি ইঞ্জয় করতে বলে অন্যান্য গেস্টদের অভ্যর্থনা জানাতে ডানদিকে চলে গেল। জিহান যেতেই প্রাণ চারদিকে নজর বুলিয়ে দেখতে থাকলো। বামদিকে চোখ যেতেই সর্বপ্রথম নয়ন আর জেসিকাকে দেখতে পেল সে। দুইজনে একত্রে কোন এক প্রোডিসারের সাথে কথা বলছে। প্রাণ তাদের দেখেই বুঝে গেল আসলে তারা কি করার চেষ্টা করছে। বিরবির করে উঠলো সে, “শ্যামলেস পিপলস।”
কথাটি বলে বিমর্ষচিত্তে দৃষ্টিতে ঘুরিয়ে নিল সে। আপাতত তাদের সামনে ধরা দেওয়ার কোন ইচ্ছা নেই তার। যদিও বা তার জানা ছিল আজকের অনুষ্ঠানে নয়ন আর জেসিকাও আমন্ত্রিত। তবে তার আগমনের ব্যাপারে নয়ন এবং জেসিকা উভয়ের অজানা। সে ইচ্ছে করেই জানায়নি তাদের, এখানে আসার কথা। উপরন্তু তারা জানে যে, সে এরকম সোশাল গেদারিং পছন্দ করে না হয়তো ধরেই রেখেছে সে আসবে না।
প্রাণ এবার অন্যদিকে হেঁটে এসে নজর বুলাতে নেহাল শিকদার এবং তার স্ত্রী মেহরিমা শিকদারকে দেখতে পেল সে। মুহূর্তেই অধর জুড়ে শ্লেষের হাসি খেলে গেল তার। অতীতের কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যেতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বক্ষস্থল চিরে। মুখ ঘুরিয়ে আরেকদিক চলে গেল সে। এদের সামনে থাকলে ভয়ংকর স্মৃতিগুলো বারংবার হানা দিবে, পীড়া দিবে আর কিছুই না। এমনেও আজকের আয়োজন তার অপছন্দ মানুষদের দিয়ে ভরপুর। সময় যে কিভাবে কাটবে কে জানে?
চৈতি অন্যদিকে যেতেই একাকী সময় কাটাতে থাকে প্রাণ। মাঝে মধ্যে আসতে-যাওয়া মানুষের সাথে টুকটাক কথা বলে সে। ঠিক এমন সময় ‘উশা প্রোডাকশন হাউজ’-এর এক স্বনামধন্য ডিরেক্টর প্রাণের সামনে এসে দাঁড়ালেন। প্রশস্ত হেসে বললেন, “ইউ মাস্ট বি নুসাইবা আরা প্রাণ, এম আই রাইট? হাই! আ’ম রাজ সেন। উশা প্রোডাকশন হাউজের একজন ডিরেক্টর।”

প্রাণ লোকটিকে চিনতে পেরে হেসে উত্তর দিল, “আপনার আলাদা করে পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনাকে এখানের কে না চিনে বলুন?”

রাজ স্মিথ হেসে বলে, “তাই নাকি? আমার তো এরকম লাগে না। কেন না, এত চেনা-পরিচিতির পর আপনার মত মানুষের মনোযোগ নিজের উপর আনতে ব্যর্থ আমি।”

প্রাণ জানে রাজ সেন রসিক প্রিয় মানুষ হলেও ফ্লার্ট করার মানুষ না। সাথে, আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসা মানুষ তো একদমই না। কাজ,দক্ষতা,সুনাম সবদিক দিয়ে এগিয়ে থাকায় তার এটিটিউড ও ইগো অন্যান্যদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। তাই হঠাৎ তার সান্নিধ্যে এসে এরকম কথা বলার মানে খুঁজে পেল না সে। প্রাণ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “মানে? কিসের কথা বলছেন আপনি?”

রাজ হেসে বলে, “আপনাকে দেওয়া আমার লাস্ট অফারটার কথা বলছিলাম। থ্রিলার এক মুভিতে কাস্ট করতে চাচ্ছিলাম আপনাকে, বিকজ ইউ আর পার্ফেক্ট ফোর দ্যা ক্যারেক্টর ইন অল রেসপেক্টস। অন্য কেউ কিছুতেই ফিট হচ্ছে না এই চরিত্রে। তাই আমার অফার রিজেক্ট করার পরও, আমি সরাসরি আপনার সাথে কথা বলতে আসলাম। ”

প্রাণের কপালে এবার গাঢ় ভাঁজ পড়লো। কিসের অফার? কিসের রিজেকশন? কিসের কি? উশা প্রোডাকশন হাউজ থেকে আদৌ সে কোন অফার এসেছিল কি-না তাই তো তার অজানা, সেখানে সে রিজেক্ট করবে কিভাবে? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতেই শিলা ও নয়নের কারসাজির কথা মনে পড়ে গেল তার। বুঝতে বাকি রইলো না আসলে কাহিনীটা কি। উশা প্রোডাকশন হাউজ হচ্ছে বর্তমানে খুব জনপ্রিয় আর নামকরা একটি প্রোডাকশন হাউজ। এর বানানো সকল মুভি,সিরিজ,শর্টফিল্ম হিট,ব্লকবাস্টার হয়। এমন এক প্রোডাকশন থেকে অফার আসা মানে নিজের ক্যারিয়ারে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। এ গ্রেড নায়ক-নায়িকার তালিকায় নিজের স্থান পাকাপোক্ত করার সুবর্ণ সুযোগ। তাই হয়তো, প্রাণ যাতে এই খ্যাতি অর্জন কর‍তে না পারে বাকি আট-দশটা অফারের মত এটাও নয়ন তার অবগত হওয়ার পূর্বেই রিজেক্ট করে দিয়েছিল। বাহ! ভালোই তো। এত রা’গ’দ্বেষ,বিদ্বেষ তার প্রতি নয়নের? ঘৃ’ণার পরিমাণ এবার বেড়ে গেল কয়েকগুণ, প্র’তি’শো’ধের স্পৃহা ছড়িয়ে গেল রন্ধ্রে রন্ধ্রে৷ খু’ন করার তীব্র বাসনা জাগে চিত্ত জুড়ে। তবে রাজ সেনের সামনে নিজের ক্ষোভ প্রদর্শন না করে হাতে আসা সুযোগটা কাজের লাগানোর উদ্দেশ্যে অতি বিনয়ের সুরে বলল, “দুঃখিত! আমি আপনার অফারটার সম্পর্কে আগে জানতাম না, অন্যথায় কখনোই রিজেক্ট করতাম না। এটা বোধহয় ভুলবশত হয়ে গিয়েছে। আপনি আপনার নাম্বারটা দিন আমি পরবর্তীতে যোগাযোগ করব নে আপনার সাথে।”

রাজ সেন এবার খুশি হয়ে প্রাণকে নিজের নাম্বার দিলেন এবং কিছুক্ষণ কথা বলে জায়গাটা প্রস্থান করলেন। রাজ সেন যেতেই প্রাণ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। একটা মানুষ কতটা নিচু মন-মানসিকতার হলে এমন করতে পারে তা জানা নেই তার। চারপাশ এখন বিষাক্ত লাগতে শুরু করলো তার, শ্বাস নিতেও কষ্টবোধ করলো। অসহ্য রকম অনুভূতি নিয়েই বেরিয়ে আসার জন্য অগ্রসর হলো সে, দরজার কাছে আসতেই তার থেকে কয়েক হাত দূরে লিফটের কাছে নয়ন আর জেসিকা দেখতে পেল সে। লিফটের দরজা খুলতেই তারা ভিতরে ঢুকে পড়লো। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে লিফট উপরের দিকে উঠে তৃতীয় ফ্লোরে থামতে প্রাণের আর বুঝতে দেরি রইলো না এই জাঁকজমক,মনোরঞ্জনপূর্ণ পরিবেশ ছেড়ে তারা কি উদ্দেশ্যে উপরে গিয়েছে। অন্তঃকোণে তার ঠিক কি রকম অনুভূতি কাজ করছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। নিস্তেজ,নিশ্চল হয়ে পড়েছে যেন সকল অনুভূতি। বিরাগহীন,রঙহীন লাগছে সবকিছু। একটা মানুষকে ঠিক কতটা পরিমাণে ভে’ঙ্গে, চূ’র্ণ’বি’চূ’র্ণ করে ফেললে তার এমন অনুভূতি হতে পারে তা জানা নেই প্রাণের।
নিজেকে শান্ত করতে সোরগোলকে বেরিয়ে এসে প্রাণ বাগানের পিছন দিকে যেতে শুরু করে। আনমনে ভাবতে থাকে তার সাথে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনা সম্পর্কে। নিজের উপর এবার প্রচন্ড করুণা হলো প্রাণের, একটা মানুষ কতটা না বোকা হলে জেনে-বুঝে একরকম কালসাপগুলোকে নিজের আপনজন হিসাবে স্থান দিতে পারে? যদি কখনো ওর সব সত্যিটা জানতে খুব বেশি দেরি হয়ে যেত, তখন কি হতো? তার কি নিঃস্ব হওয়া ব্যতীত অন্য কোন পথ খোলা থাকতো? উত্তর মিলে না প্রাণের। শুধু ভঙ্গুর হৃদয়ের আর্তনাদ শোনা গেল। নিজের মধ্যে যখন প্রাণ পুরোপুরি মশগুল ঠিক তখনই তার ডান বাহুতে খুব জোরে টান পড়ায় ঘুরে দাঁড়ালো সে। ঘটনার আকস্মিকতা নিতে পারায় বেসামাল হয় মুখ থুবড়ে পড়ে কারো বলিষ্ঠ বুকে। পরমুহূর্তেই শুনতে পায় গাম্ভীর্যপূর্ণ এক পুরুষালি কন্ঠ, “চোখে দেখেন না আপনি? কিভাবে হাঁটছিলেন এতক্ষণ? আরেকটু হলেই তো চ্যাপ্টার ক্লোস হয়ে যেত আপনার।”

#চলবে

[রি-চেক করা হয়নি। কাল সকালে উঠে সংশোধন করে নিব নে আমি।]

[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here