কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্বঃ৩৩

0
467

#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্বঃ৩৩
কলমে: ইয়াসমিন

পশ্চিম আকাশে চাঁদ হেলে পড়েছে কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো টুপ করে ঢুবে যাবে। সমুদ্রের গর্জনে কান ভারি হয়ে উঠছে সেদিকে মায়াবী অর্ধমানব রূপি পাথরের হেলদোল নেই। কেনো ছুটছিল এই মূহুর্তে সেটাও মনে নেই। শুধু মনে হলো সামনে এগোতে হবে। অতোটা পথ অতিক্রম করার পরেও শরীর দুর্বল হলো না বরং আরও শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিক তীক্ষ্ম দৃষ্টির ফলে বহুদুরের সব কিছু ভালো ভাবে দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ বাধ্য পেয়ে ও থমকে গেলো। অদৃশ্য দেয়াল ওকে বাঁধা দিচ্ছে। শরীরের শক্তি সেই সঙ্গে কমতে শুরু করেছে। শরীর আবারও পরিবর্তন হচ্ছে। গায়ের লম্বা পশমগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। নক ছোট হয়ে মানব আকৃতি নেওয়ার আগেই ও অচেতন হয়ে বালুচরে পড়ে গেলো। সমুদ্রের নোনা জলের ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো ওর শরীরে উপরে। কিছুটা দূরে একটা অর্ধমানবের অবয়ব এক দৃষ্টিতে পাথরের রুপান্তুকে হতবাক নয়নে দেখতে থাকলো। তারপর যখন ধ্যান ভাঙলো ক্রমগত এগিয়ে আসলো পাথরের কাছে কিন্তু কাছাকাছি হওয়ার আগেই হাওয়ার গতিতে কিছু একটা এসে পাথরের নিথর শরীরটা নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। সামনে জনমানবশূন্য ধুধু প্রান্তর। চাঁদ ডুবে গেলো সেই ক্ষণে। শয়তানের শক্তি কমতে শুরু করেছে। আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির উপযুক্ত সময় চলে এসেছে। আশাহত হয়ে অবয়বটা উল্টোপথে দৌড়ে চলে গেলো।
***********
ধারা/লো খঞ্জ/রের আঘাতে চিৎকার করে প্রাসাদ মাথায় করে ফেলেছে আধার। পা থেকে ফোটা ফোটা র\ক্ত গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। খঞ্জ\রটা বিধে আছে বিধায় দগদগে ঘা ঠিক করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশে বেশ কিছু ভৃত্য অধির আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মধ্য বয়সী এক হাকিম ভেতরে প্রবেশ করলেন। হাতে নানারকম চিকিৎসা বিষয়ক গাছড়া ওষুধপত্র। উনি চিন্তিত হয়ে আধারের পাশে বসতে বসতে বললেন,
> খ/ঞ্জর চালানো ব্যক্তির নিশানা খুব খতরনাক। ওর উদ্দেশ্যে তোমাকে হ/ত্যা করা ছিল না। তোমাকে কষ্ট দিয়ে চেয়েছে তাই পায়ের দিকে লক্ষ করে ছুড়েছে। তাছাড়া সেই ব্যক্তি এটা ভালো করে জানে সামান্য খ/ঞ্জরে তোমার মৃত্যু হবে না। খান পরিবারের ধ্বং/স এতোটা সহজ না। খান পরিবারের ধ্বং/স আর সুলতান পরিবারের মুক্তি যে অঙ্গ আঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।
লোকটা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। পাথর চোখ রাঙিয়ে উত্তর দিলো,
> চিকিৎসা শুরু করুন অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে। আমি মা/রা যাচ্ছি আর আপনি প্যাচাল করছেন?

চিকিৎসক মাথা নত করে মৃদু হেসে ক্ষত স্থানে উত্তপ্ত গরল ঢেলে দিলেন। আধার চোখ বন্ধ করে আছে। ওকে কয়েকজন এসে চেপে ধরে রাখলো যাতে নড়াচড়া করতে না পারে। চিকিৎসক এই সুযোগে খঞ্জ/রটা বের করে ওষুধ লাগিয়ে দিলেন। কিছু তরল ওর মুখে ঢেলে দিতেই আধার অচেতন হয়ে গেলো। সব চিৎকার চেচামেচি মূহুর্ত্তের মধ্যে শান্ত হয়ে গেলো। চিকিৎসকের মুখে হাসি ফুটলো। আপাতত শান্তি নেমে আসলো কক্ষ জুড়ে। বাইরে ওয়াশিম খান চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। খ/ঞ্জরটা কে ছুড়েছে আধার কাউকে বলেনি কিন্তু উনি বেশ বুঝতে পেরেছেন এটা কোনো সাধারণত খ/ঞ্জর না। বারবার কেনো জানি কহিনুরের নামটা মাথায় আসছে যদিও উনি অবগত না মেয়েটার খ/ঞ্জর প্রাপ্তি ঘটেছে কিনা। কত বয়স হয়েছে তার,সতেরো নাকি আঠারো? এই বয়সে এমন শক্তি পাওয়া সম্ভব কিভাবে হতে পারে মাথায় আসছে না। হঠাৎ দক্ষিণ কোণের কক্ষ থেকে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ আসার জন্য উনি কিছুটা চমকে গেলেন। বহুকাল সেদিকে যাওয়া হয়না। উনি কিছু একটা ভেবে একপা দুপা করে এগিয়ে গেলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভৃত্যকে ইশারায় দরজা খোলার আদেশ দিলেন। মূহুর্তে দরজা খুঁলে দেওয়া হলো। বন্ধ কক্ষে হঠাৎ আলো প্রবেশের জন্য ধুলাবালির উড়াউড়ি দৃষ্টিগোচর হলো। উনি হালকা কেশে উঠে ভেতরে পা ফেলতেই কেউ একজন গর্জ/ন করে বলে উঠলো,
> ধ্বং/স হোন আপনি। ধ্বং/স হোক আপনার গড়া পাপের সম্রাজ্য। আমার থেকেও অধিক য/ন্ত্রণা নিয়ে আপনার মৃ/ত্যু হবে। বিধাতা কখনও পাপিকে ছাড় দেবেন না। আমি মনে মনে আপনার ধ্বং/স চেয়ে প্রার্থনা করি। একদিন ঠিক কবুল হবে।
ওয়াশিম খানের চক্ষু রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। উনি তেড়ে গেলেন ভেতরে। আবছা আধার পেরিয়ে ভেতরটা আলোকিত হয়ে উঠলো। দেখা গেলো সামনে শত শিকলের সঙ্গে বাঁধা আছে এক যুবক। যুবকের চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে। চুলগুলো কপালের উপরে আছড়ে পড়েছে। ফর্সা শরীরের উপরে ময়লার আস্তরণ তবুও যেনো রূপ তাঁর ছটা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মলিন আর কাঁটা ছেড়া ঠোঁট,হয়তো দাঁত দিয়ে কামড়ে রাগ মেটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ওয়াশিম খান সোজা গিয়ে উনার গলা চে/পে ধরে বললেন,
> প্রাণে বেঁ/চে আছো সহ্য হচ্ছে না বুঝি? ওর মতো তোমার প্রা/ণটা নিতে পারলে আমি শান্তি পেতাম কিন্তু পারছি না। নিজের সন্তানকে হ/ত্যা করতে আমি চাইছি না। ভালো হয়ে যাও আর খান পরিবারের ভালোর জন্য শয়/তানের উপাসনা করো। ন/র ব/লি দিয়ে আমার সঙ্গে উৎসব করো। দীর্ঘ জীবন পাবে সেই সঙ্গে মিলবে হাজারো রমনী। পৃথিবী তোমার হাতের মুঠোয় পেয়ে যাবে। কেনো আমার বিরোধীতা করছো? সামান্য মানুষের প্রেমে পড়ে তুমি অধম হয়ে গেছো। আমার সন্তান তুমি বিশ্বাস হয় না।
সিঁকলে বাঁধা যুবক হাসলো। সেই হাসিতে কত যে যন্ত্রণা মিশে ছিল সেটা শুধু সেই জানে। হাসি মুখেই উত্তর দিলো,
> ভালোবাসা ছাড়া ছন্নছাড়া দীর্ঘ জীবন নিয়ে তীলে তীলে যন্ত্রণা পেয়ে বাঁচার চেয়ে মৃ\ত্যু অধিক সুখের হবে। আমাকে এতোটা য/ন্ত্রণা না দিয়ে মে/রে ফেলুন। এইটুকু দয়া আমার জন্য করুন। আমার আত্মার মৃ/ত্যু তো অনেক আগেই ঘেটেছে শরীরটা শুধু নাম মাত্র। আমাকে রেখে আপনার লাভ হবে না। পিতার ধর্ম পালন করুন।

ওয়াশিম খান ছেলের কথা শুনে তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসলেন। উনার কেনো জানি খুব মজা লাগলো। তাই কপালে উপরে থাকা সাদা কালো চুলের গোছাটা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন,
> বাচ্চা আমার, এতো তাড়াতাড়ি নিজের মৃ\ত্যু কামনা করোনা। তোমার বেঁ\চে থাকার একটা কারণের মৃ\ত্যু হলেও আরও একটা কারণ যে এখনো জীবিত আছে। দেখবে তাঁকে? আমি যে দেখে নিয়েছি। খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের দেখা হবে তবে আফসোস তখন সে সম্পূর্ণ আমার হাতের পুতুল হয়ে উঠবে। আমি ওকে নিয়ন্ত্রণ করবো। তোমার মতো বেয়াড়া হওয়ার আগেই আমি রাশ টেনে ধরবো। ওর হাত ধরে খান বংশ আরও উন্নতি সাধন করবে। মহা বিপ্লব ঘটবে। অপেক্ষা করো ও এসেই তোমাকে মুক্তি দিবে।

ওয়াসিম খান একদমে কথাগুলো বলে থামলেন। ছেলেকে ভড়কে দিতে পেরে উনার ভালো লাগছে। ছেলটাকে উনি একদম পছন্দ করেন না। তবুও সহ্য করতে হচ্ছে। উনি আর কথা বলার সুযোগ দিলেন না। বেরিয়ে আসলেন কক্ষ থেকে। দরজা আবারও বন্ধ করা হলো। দরজার ওপাশে এক জোড়া চোখ ছলছল করে তাঁকিয়ে থাকলো।সেই চোখে প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার হাজারো আকুতি। আর এই বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা । বাবার বলা কথাটার মানে ওর জানা আছে কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না। কিভাবে সম্ভব এটা? না না হতে পারে না। সে তো নেই কবেই অভিমান করে পৃথিবী ছেড়েছে। কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতেই উনি কান্নাই ভেঙে পড়লেন। ভালোবাসা হয়তো স্বর্গ থেকে আসে কিন্তু স্বর্গে আর ফিরে যায় না বরং ভুক্তভোগীকে নরকে নিয়ে যায়। নয়তো ভালোবাসার ক্ষণেক্ষণে এতো সুখ আর পরবর্তীকালে এতো যন্ত্রণা কেনো?
***********
চুপচাপ বসে আছে জুবায়ের। অধরা ওর পায়ের উপরে মাথা রেখে শুয়ে আছে। মেয়েকে ছেড়ে একটা দিন পার হয়ে গেছে যদিও সাঈদ খবর দিয়ে গেছে তবুও শান্তি পাচ্ছে না। অধরার চোখমুখ ফুলে গেছে। জুবায়ের ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। দুদিন পরে যখন মেয়ে শশুর বাড়িতে যাবে তখন তো এভাবেই থাকতে হবে কিন্তু অধরা সেটা মানতে নারাজ। জুবায়ের কাজকর্ম ছেড়ে ওকে নিয়ে বসে আছে। আগে নিজের পরিবার তারপর অন্য কিছু। অধরা না খেয়ে আছে তাই ও নিজের মতো কফি আর ওমলেন করে নিয়ে এসেছে। যদি অধরা ডিম তেমন পছন্দ করে না। জুবায়ের ওর কপালে ওষ্ঠ নামিয়ে চুমু দিয়ে বলল,
> এভাবে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে। মেয়ে এসে যদি দেখে মায়ের এমন অবস্থা তখন কষ্ট পাবে না? তাছাড়া তুমি ভালো করে জানো তোমার মেয়ে কোনো সাধারণ মানুষ না? সাঈদ কি বলল শুনেছো? সে তাঁর শশুর বাড়িতেই আছে। যদিও বেচারারা কিছুই জানে না। মেয়ে না দেখে বিয়ে, ইতিহাসে এই প্রথমবার তাইনা?

জুবায়েরের কথা শুনে অধরা উঠে বসলো। ওর হঠাৎ রাগ হচ্ছে কথাটা শুনে। মেয়ের বিয়েটা সত্যি ভালো পরিবারের দিয়ে পারেনি বলে আফসোস হচ্ছে।মানুষ এতটা লোভী কিভাবে হতে পারে যে টাকার জন্য সব শর্ত মেনে নিলো। অধর ভ্রু কুচকে বলল,
> এই বিয়েটা আমি সময় হলে ভেঙে দিবো দেখে নিয়েন। কিছুতেই পাথর ছেলেটি আমার মেয়ের উপযুক্ত না। বিয়ের এতোটা দিন পেরিয়ে গেছে একবারও বউকে দেখার চেষ্টা করেছে নাকি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে? এ আবার কেমন বিয়ে আর মানুষ?
অধরা রাগে ফেটে পড়ছে। জুবায়ের ওকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় থুতনি রেখে বলল,
> পাগলামো করোনা। আমি মেয়ের ভালোর জন্য শর্ত রেখেছিলাম। সবটা তো আমার জন্য হয়েছে তাইনা? ছেলেটা সত্যিই ভালো নয়তো দেখতে এতদিন মেয়েটাকে নিয়ে টানাটানি পড়ে যেতো। ছাড়ো ওদের কথা এখন আমার দিকে নজর দাও। আমার চেহারা দেখেছো কতটা মলিন হয়ে গেছে? ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো কতশত সমস্যা হচ্ছে। খাবারে অরুচি হয়েছে। বরের দিকেই তোমার নজর নেই শুধু।

জুবায়ের শেষের কথাগুলো খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল। অধরা ঝট করে উঠতে চাইলো কিন্তু পারলো না। জুবায়ের ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। অধরা উঠতে না পেরে চিন্তিত হয়ে বলল,
> চলুন ডাক্তারখানাতে যেতে হবে। আপনার কিছু হলে আমার কি হবে? প্লিজ চলুন।
জুবায়ের শব্দ করে হেসে উঠলো বউকে বোকা বানাতে পেরে।ও আলগোছে অধরার হাতের কব্জিতে চুমু দিয়ে বলল,
> আরে ডাক্তার দিয়ে কিছু হবে না। আমার বেশি বেশি বউয়ের ভালোবাসা দরকার। আপাতত ভালোবাসা দিয়ে আমাকে ধণ্য করো।

অধরা মুখটা গোমড়া করে ফেলল। ভেবেছিল জুবায়েরের হয়তো সত্যি কিছু হয়েছে কিন্তু লোকটা যে মহা পাজি। সব সময় রোমান্টিক মুডে থাকে। অধরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জুবায়েরের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,
> আপাতত মজা নেওয়া বন্ধ করুন। ক্ষুধা পেয়েছে খেতে চলুন।
জুবায়ের হাসতে হাসতে ওকে কোলে তুলে নিলো। ডাইনিং টেবিলের উপরে খাবার গুলো পড়ে আছে। ট্রি টেবিলের উপরে ধোয়া উঠা কফির মগ থেকে ধোয়া উড়ছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে।
************
দীর্ঘ রাত পেরিয়ে চোখ খুললো পাথর। গায়ের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে উঠে বসতেই পরপর রাতের সবটা ওর মনে পড়ে গেলো। আশেপাশে তাকিয়ে হতভম্ভ হয়ে গেলো। ভালো করে মনে আছে ও যখন অচেতন হয়েছিল তখন ও সমুদ্রের তীরে ছিল সেখান থেকে ফার্ম হাউজে কিভাবে আসলো মাথায় ঢুকছেনা। প্রশ্ন জাগলো কেউ ওকে সাহায্য করছে নাতো? কথাটা ভাবতেই নূরের চেহারা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো। গতকাল যখন মায়াবী অর্ধমানবেরা ওর উপরে আক্রমণ করেছিল তখন মেয়েটা এসে ওকে বাঁচিয়েছিল। কিন্তু কিভাবে সম্ভব এটা? সামান্য বাচ্চা একটা মেয়ে ওকে এতগুলো পশুর থেকে বাঁচিয়ে দিলো। হজম হচ্ছে না। পাথর আর ভাবতে পারলো না। দ্রুত বেরিয়ে আসলো ফার্ম হাউজ থেকে। গেটের পাশে গাড়ি ছিল বেরিয়ে আসতে ওর সময় লাগলো না। বাড়িতে পৌঁচ্ছাতে ওর আধা ঘন্টার মতো টাইম লাগলো। হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে আশেপাশে খোঁজ করলো। ভৃত্যেরা খাবার তৈরী করছে আর আন্টি টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিচ্ছে। পাথর আন্টির পাশে গিয়ে বলল,
> আন্টি নূর কোথায়? তুমি দেখেছো ওকে?
পাশ থেকে আরিয়া উত্তর দিলো,
> নূর কে ভাইয়া?
পাথর থমকে গেলো প্রশ্ন শুনে। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে উত্তর দিলো,
> আমাদের বাড়িতে এসেছে সেই মেয়েটা কোথায়? আন্টি বলেছিলো নিউজ করতে হবে। মেয়েটার পরিবারের খোঁজ করা জরুরী।
আরিয়া জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল,
> মেয়েটার পরিবারের খোঁজ মিলেছে ভাইয়া কিন্তু ওতো অসুস্থ। ভীষণ জ্বর এসেছে। বললাম ডাক্তার ডাকতে কিন্তু ওর সঙ্গের ছেলেটা কিছুতেই রাজি হলো না। বলল ঠিক হয়ে যাবে।
পাথর আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুতগতিতে গেষ্ট রুমের দরজার সামনে এসে থামলো। কিছুক্ষণ ভেবে হুট করে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুঁলে ভ্রু কুচকে ফেলল। দেখলো নূর চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আর অচেনা একটা ছেলে সবুজ তরল জাতীয় কিছু চামুচে করে ওর মুখে তুলে দিচ্ছে। বিষয়টা দেখে ওর সহ্য হলো না। দ্রুতগতিতে এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার হাত থেকে বাটিটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিয়ে ঝাঝালো কণ্ঠে বলল,
> ওকে কি দিচ্ছ তুমি? তোমার জন্যই ওর এমন হয়েছে তাইনা? ওর আশেপাশেও তোমাকে যেন আর না দেখি। তাহলে কিন্তু খারাপ হবে বলে দিচ্ছি। দেখতে তো ভূতের মতো।

পাথরের রাগ হচ্ছে হিংসা হচ্ছে নূরের পাশে একটা অচেনা ছেলেকে দেখে। মনে হলো নূর শুধুমাত্র ওর। মস্তিষ্কের প্রতিটা কোষে নূরের নাম প্রবাহিত হচ্ছে। সাঈদ ভয়ে চুপসে আছে। লোকটার ভাবভঙ্গি ওর ভালো লাগছে না। ওষুধ না খাওয়ালে মেয়েটার শরীর আরও খারাপ হবে। লোকটা ওষুধ ফেলে দিয়েছে সেই সঙ্গে ওকে ভূত বলে অপমান করেছে। ও ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
> আমি ওকে শুভাকাঙ্খী কোনো শত্রু না যে ক্ষতি করবো কিন্তু আপনি কে?
পাথর ততক্ষনে নূরের কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা দেখে নিয়েছে। পাশে রাখা পানির পাত্র থেকে পানি নিয়ে আশেপাশে তাঁকিয়ে কিছু না পেয়ে সাঈদের টিশার্টটা ভিজিয়ে কহিনুরের কপালে বসিয়ে দিয়েছে। সাঈদের চোখ কপালে। গতকাল নতুন টিশার্টটা কিনেছে এখনো পরা হয়নি আর লোকটা কি করলো? একটা প্রশ্ন করেছে তার উত্তর পযর্ন্ত দিলো না। এ কেমন ত্যাড়া লোক? সাঈদ ছলছল চোখে বলল,
> এটা কি করলেন? আমার টিশার্ট !
পাথর নিজের কাজটাতে মনোযোগ দিয়েই বলল,
> তুমি না নূরের শুভাকাঙ্খী? এইটুকু ত্যাগ করতে অসুবিধা কোথায়? যাও বাইরে গিয়ে আন্টিকে বলো ডাক্তার ডাকতে। আর তুমি নিজের হাতে খাবার আনবে ঠিক আছে?
সাঈদ চোখ বড়বড় করে ফেলল। লোকটা ওকে অর্ডার করছে। পৃথিবীতে ও শুধুমাত্র কহিনুর আর মালকিনের কথা শুনে আর কারো না। বিড়বিড় করে বলল,
> হাই খোদা এমন কেমন মানুষ? হৃদয় নেই নাকি হৃদয়ও নামের মতো পাথর?
সাঈদের ভাবনার অবসান ঘটলো দ্বিতীয় দফায় ধমক শুনে। তাই আর অপেক্ষা করলো না। ছুঁটে চললো বাইরের দিকে।। ও বাইরে পা রাখতেই পাথর দরজা বন্ধ করে দিলো। চুপচাপ কহিনুরের মলিন মুখের দিকে তাঁকিয়ে ওর গালে হালকা করে থাপ্প/ড় দিয়ে বলল,
> নূর তুমি শুনতে পাচ্ছো? উঠে বসো তোমার থেকে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর জানার বাকি আছে। কথা বলো প্লিজ! গতকাল রাতে তুমি ছিলে তাইনা? বারবার আমাকে রক্ষা করছো তুমি তাইতো? আমি ধরে ফেলেছি তোমাকে। বলো তুমি কে?
পাথর প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলো কিন্তু কহিনুর চোখ খুঁললো না। ওর শরীরের তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে কমছে না। মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। পাথর পানিতে ভেজানো কাপড়টা ওর কপালে রেখে চোখ বন্ধ করলো। এই মেয়েটার মধ্যে কিছু একটা আছে যেটা ওকে খুব করে টানে।কি আছে খোঁজার চেষ্টা করলো। মেয়েটা যে অধিক সুন্দরী সেটা জানা আছে কিন্তু আরও কিছু আছে। একটা মায়া মায়া ভাব নাকি আত্মার টান? পাথর আর ভাবতে পারলো না। মেয়েটার দিকে তাঁকালে মনের মধ্যে ভয়ানক খারাপ ইচ্ছে গুলো উঁকিঝুঁকি কাটে। বাচ্চাদের উপরে এরকম নজরে তাঁকানো ঠিক না। পাথর দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। হাত দিয়ে ওর কপালে আসার চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নামতেই সাঈদ এসে হাজির হলো। সঙ্গে খাবার এনেছে কিন্তু কে খাবে? যার জন্য আয়োজন সে নিষ্ঠুর ভাবে চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে আছে। পাথর দাপট দেখিয়ে বলল,
> তুমি কি ওর বয়ফ্রেন্ড? নিশ্চয়ই বাবা মাকে না বলে ওকে নিয়ে পালিয়ে এসেছো? তোমাকে আমি পুলিশে দিবো। বেয়াদব ছেলে বাচ্চা মেয়েটাকে এভাবে ফাঁসিয়ে এনেছো তোমার এতো সাহস?

সাঈদ চোখ বড়বড় করে আহাম্মকের মতো বলল,
> বয়ফ্রেন্ড কি?
পাথর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> ওর বাবা মায়ের নাম ঠিকানা বলো আমি ইমেইল করবো। প্রশ্নের বাইরে একটা শব্দও যদি উচ্চারণ করেছো ছেলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।

সাঈদ ঢোক গিলে কহিনুরের দিকে তাঁকালো। বুদ্ধি বলতে মাথায় কিছু আসছে না। তাছাড়া মিথ্যা ও বলেনা তাই হড়বড় করে কহিনুরের বাবা মায়ের নাম বলে দিলো। পাথর পূনরায় জিঞ্জাসা করলো,
> ওর বাবার নাম কি বললে?
সাঈদ গাল ফুলিয়ে বলল,
> আল্লাহর আছেন আমি মিথ্যা বলছি না। সুলতানা জুবায়ের ফারুকীর একমাত্র কন্যা উনি। কহিনুর আমার বোনের ন্যায় অন্য কিছু না। আজকের দিনটুকু থাকতে দিন আমরা সন্ধ্যায় ফিরে যাবো।
পাথরের মাথার মধ্যে মূহুর্তে টনেডো বয়ে গেলো। মাথা ঘুরছে। বাংলাদেশ থাকতে বাঙ্গালী মেয়েকে বিয়ে করেছিল সে এখানে কিভাবে আসবে মাথায় ঢুকছে না। সুলতান পরিবারে শাশুড়ি মা আর তার একমাত্র মেয়েকে ছাড়া ও সবাইকে চিনে। সোসাল সাইটে বা ব্যবসার কাজে বহুবার দেখা হয়েছে। ঐশ্বর্যকে পযর্ন্ত চিনে। ওরা জার্মানিতে কিভাবে আসবে নাকি সবটা মনের ভূল? সবটা জানার জন্য ও বেরিয়ে আসলো কক্ষ থেকে। বাবা দুদিন হচ্ছে বাড়িতে নেই। এক সপ্তাহের ট্রিপে গেছে বন্ধুদের নিয়ে। অবসরের দিনগুলো বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ করে কাটানোর জন্য এই ব্যবস্থা। পাথর আন্টির সামনে গিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> আন্টি তুমি আমার বউকে দেখেছো? নাম কি ওর? ববা মায়ের নাম ঠিকানা বলতে পারবে?
পাথরের প্রশ্ন শুনে উনি হেসে ফেললেন। মুখে রুটির টুকরো পুরতে পুরতে উত্তর দিলেন,
> বিয়েতে কি আমাদেরকে নিয়েছিলেন তোমার বাবা? সেই তো নাচতে নাচতে বেলাল তুমি আর তোমার বাবা গিয়ে বিয়ে করে আসলে। বউয়ের একটা ছবি পযর্ন্ত নেই। অদ্ভুত বিয়ে। সুলতান জুবায়ের ফারুকীর সম্পর্কে যা যা শুনেছি সবটা সত্যি। মেয়েকে জামাইয়ের থেকে কিভাবে কৌশলে আলাদা করে দিলেন ভাবো? শশুর পেয়েছো কপাল গুণে। যাইহোক হঠাৎ তাদের কথা?

পাথর আন্টির পাশে বসে পড়লো। মুখে হাত রেখে বিড়বিড় করে বলল,
> তোমার বউমা নিজেই শশুর বাড়িতে পৌঁছে গেছে। শশুর সাহেবের এখন কি অবস্থা সেটাই ভাবছি।
> মানে কি?
পাথর সামনে থাকা গ্লাস থেকে পানি মুখে নিয়ে বলল,
> গতকাল যাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছো উনি সুলতান জুবায়ের ফারুকীর একমাত্র কন্যা মিসেস কহিনুর ফারুকী। বাকিটা জেনে তোমাকে বলবো। মাথায় হাজারো প্রশ্ন আর রহস্য খেলা করছে। পাগল পাগল লাগছে। আন্টি তুমি ডাক্তার ডাকো আমি ওর কাছে যাচ্ছি।

পাথর যেভাবে এসেছিল সেভাবেই ফিরে গেলো। কহিনুরকে এতদিন ও নূর বলে জানতো। গতকাল হোটেল কক্ষে এতো এতো প্রশ্ন করার পরেও মেয়েটা চুপচাপ ছিল এখন বুঝলো কতবড় ভূল করে ফেলেছে। বউয়ের সঙ্গে প্রথম আলাপটা বড়ই নির্মম আর নিষ্ঠুর বলে মনে হচ্ছে। পাথর আর ভাবতে পারলো না। চুপচাপ কহিনুরের পাশে গিয়ে বসলো। সামনে কি হবে ভেবেই ঢোক গিলল।

(চলবে)
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here