#বিষ_করেছি_পান(৩৬)
(কপি করা নিষেধ)
তুলোতে ঐষধ লাগিয়ে কাটার উপর রক্ত পরিষ্কার করছে সোহাগ। রিতী যন্ত্রনায় আহ! ইহ! অস্ফুট আওয়াজ করছে। সোহাগ রিতীর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার পায়ের দিকে নজর দেয়। মাথাটা নিচু করে ক্ষতের উপর ফু দিতে থাকে। আবার মাথা তুলে জিজ্ঞেস করে,
— খুব জ্বলছে?
— বরফ দেবো?
— কমেছে একটু?
— ব্যাথা কমেছে?
রিতীর উত্তর আসেনা। অভিমানে গাল ফুলে টম হয়। ব্যান্ডেজ করে দেবার পর। পা টা হাঁটুর উপরেই রেখে আলতো ভাবে ছুঁয়ে দেয়। সোহাগী এসে হায় হায় করতে করতে টিস্যু দিয়ে নাকের পানি চোখের পানি মুছে দেয়।
— ইসস!! কি করেছে আমার আম্মাটা কেঁদে কেটে। বোরখা খুলোতো আম্মা। ফ্রি হও। ইসস রে…
রিতীকে একটু তুলে বোরখাটা নিজেই খুলে দেয় হিযাপ সহিত। ওড়না ছাড়া রিতী লজ্জায় কুকরে যায়। হিযাপের ওড়নাটা টেনে ধরতে গিয়েও ফসকে যায়। সোহাগী তো নিজের মতে মতে বোরখা নিয়ে বেরিয়ে যায় নেড়ে দেবার উদ্দেশ্যে। এদিকে রিতী চট করে সোহাগের দিকে তাকায়। দেখে সোহাগ তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। রিতী আরেকটু কুকরে যেতেই সোহাগ রিতীর কাচুমাচু করার কারণটা বুঝে যায়। চোখ নেমে আসে রিতীর বুকের উপর। দুষ্টু সোহাগ বাঁকা হাসে। রিতীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
— এমন ভাব করছো মনে হয় ফাস্ট টাইম! পুরোনো বউকে নতুন বউ করার প্রক্রিয়া,এই যা!
রিতী মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলে। এখন আর কাচুমাচু করছেনা। বরং স্বাভাবিক অবস্থায় মুখ ফিরিয়েছে। অপমানে মুখ লালচে বর্ণে পা দিয়েছে। না হয় নিজে আগ্ৰাসী পণা দেখিয়েছিলো রিসোর্টে সেদিন তাই বলে এভাবে বলবে! আর পুরোনো বউ মানে কি? নতুনের স্বাদ না পেয়েই পুরোনো হয়ে গেছে? একটাও বাদ রাখবেনা। শ্বশুড় শ্বশুড়ি যত আপ্যায়ণ করতে পারে করুক। সব আদর যত্ন লুটে নিবে। এই সোহাগ টাকেও মুঠোয় নিবে। তারপর যা হবার দেখা যাবে।
পায়ের উপর আলতো ঠোঁটের ছোঁয়ায় রিতী ঘাড় ফেরায়। সোহাগ চুমু দিচ্ছে পায়ের ঠিক মাঝখানে। রিতী ঝটপট পা সরিয়ে নেয়।
— এতো সাহস!
সোহাগ ফের বাঁকা হাসে।
বিকেলের মধ্যেই খালি বাড়িটা একদম পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সোহাগের চাচা মামা খালা ফুপু কাজিনদের ফ্যামিলি বাচ্চা কাচ্চায় ভরে যায় ড্রিয়ং রুম। সকলের মধ্যমনি হলো রিতী। একে একে সবাই আসছে আর রিতীর মুখ দেখে হাতে টাকা গুঁজে দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার হাতে গলায় সোনা পরিয়ে দিচ্ছে। রিতীর এভাবে বসে থাকতে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। তবুও রিতী উঠছেনা। ঐ যে এক চুল ছাড় দিবে না…..!
রিতী সাবধানে পা ফেলে হাটে। তাকে সন্ধ্যায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে একটা রুমে। সেখানে অরেজ্ঞ কালার একটা বেনারসী হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে রিতীর মামী শ্বশুড়ি। বিছানায় আরো কয়েকটি ব্যাগ। রিতীকে টেনে বসিয়ে দেয় রিতীর এক ননদিনী। রিতী জিজ্ঞেস করতেই বলে,
— নতুন বউ থ্রি পিচ পড়ে থাকবে নাকি? শাড়ী পড়াবো তোমাকে। দেখবে আমাদের হাতের জাদু। এতো সুন্দর করে সাজাবো যে সোহাগ ভাই চোখ ই ফেরাতে পারবেনা। এমনিতেও যা শুনেছি ভাই তো এমনিতেই তোমার নেওটা।
সবাই মুখ টিপে হাসে। হাসেনা শুধু রিতী। সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। গহনা গুলো মেচ করার সময় কোনটা কোনটা পরবে প্রশ্ন করা হলে রিতী একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। তারপর বলে,
— সব গুলোই পড়ানো হোক।
একেবারে ফাইনাল টাচ দেবার পর একে একে সবাই এসে রীতীর সাথে সেলফি তুলে নেয়। নিজেদের পার্সোনাল একাউন্টে আপলোড করে, সেলফি উইথ মামনি, সুন্দরী ভাবী, কিউট বউমা! আরো কতো কী!
সোহাগী এসে বলে,
— এই দেখি তোমরা ভিড় কমাও। মুরুব্বিরা আসবে।বসার জায়গা দাও বিয়ে পড়ানো হবে।
সোহাগী কথায় রিতী আকাশ থেকে পড়ে। অদ্ভুত ভাবে ডাক দেয়,
— আম্মা!
রিতীর ডাকে সোহাগী রিতীর পাশে এসে বসে। হাসিমুখে রিতীকে বুঝিয়ে বলে,
— দেখো আম্মা! ঐ বিয়ের সময় তো আমরা ছিলাম না। বিয়ের কিভাবে না কিভাবে পড়িয়েছে, নিয়ম কানুন ঠিকঠাক পালন করেছে কিনা তাও জানিনা। তাই ঘরের বউ হয়ে যখন এ বাড়িতে এসছো শুনলাম তখনি তোমার শ্বশুর আব্বা আবার বিয়ের ব্যবস্থা টা করতে বললো। আত্নীয় স্বজনদের নিয়ে সল্প আয়োজনে একটা ফ্যামিলি টুগেদার করে ফেললাম। কাজী আসছে সুন্দর ভাবে কবুল বলবে। কনে সাঝে আমার আম্মাটাকে কি যে সুন্দর লাগছে!
সোহাগী রিতীর থুতনী ধরে চুমু খায়। নয়টার মধ্যে বিয়ে পড়ানো খানাপিনা শেষ করা হয়। কয়েকজন কাজিন থেকে গিয়ে বাদ বাকি সবাই দশটার মধ্যে যার যার বাসায় চলে যায়। রিতীর ননদিনীরা সারাবাড়ি দৌড়াদৌড়ি করছে। আইসক্রিম খাওয়া নিয়ে মেতেছে তারা। সোহাগী এসে ধমকে দিতেই ওরা চুপ হয়ে যায়। ইশারা পেতেই রিতীকে সোহাগের রুমের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। সবচেয়ে বড় যে ননদ সে প্রশ্ন করে,
— ভাবী এটাকি তোমাদের ফার্স্ট নাইট?
— হ্যা।
— এরজন্য ভয় পাচ্ছ তাইনা? তোমার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
— ভয় পাচ্ছি না।
— তাহলে কি কিউরিসিটি ফিল করছো? ফাস্ট নাইট উইথ আমাদের ভাই! কিভাবে মধুর মধুর বাক্য কুড়াবে! কিভাবে প্রথমে পাশাপাশি বসবে! কিভাবে হাতে হাত রাখবে! কিভাবে হাগ!! উপপপসসস…
— তোমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে হবে বুঝছো?
— প্লিজ ফুপিকে আমার হয়ে একটু বলে দিও না ভাবী। আমার বয়ফ্রেন্ড টা যে আর কতো ওয়েট করবে….!
— তোমাদের ভাই কোথায়?
রিতীর ঝটপট বিরক্তি মাখা প্রশ্নে মেয়েগুলো রিতীর মুখের দিকে তাকায়। রিতীর চেহারা দেখে তাদের মসকরা করার মুডে নোনতা জল পড়ে।
— ভাবী কি আমাদের সাথে থাকতে বিরক্ত হচ্ছো?
রিতী ঝটপট নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। এদের সাথে রাগ ঝেড়ে কি লাভ? শুরু শুরু খারাপ লোকের তকমা নেওয়া হবে। রিতী মুচকি হেসে টানিয়ে টানিয়ে বলে,
— না… ঐ আর কি! তোমাদের ভাই থাকলে ভালো হতো।
— আরে ইয়ার… ভাবীর তো দেখি তর সইছে না। আমরা আরো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলাম। রুক জারা, সবুর করো। আসবে আসবে। তোমার জামাই আসবে। তারপর তাকে আমরা খসাবো। তারপর তোমরা এক হবে।
— তেমন কিছু না।
— জানি জানি। এই ভাবী… ভাইয়া সামনে এলে তুমি কি লজ্জা পাবে? নাকি এতোক্ষনের বন্ধুবীনা প্রাণ বাঁচে না দহনে গিয়ে হ্যান্ডসাম ভাইটার উপর ঝাপিয়ে পড়বে?
— সেটা তোদের ভাবী ভালোই পারে। কিভাবে জামাইকে সিডিউস করতে হয়। টিপস লাগলে নিয়ে নিস। যখন তোদের লাগবে।
পেছন থেকে সোহাগের কথায় রিতী থেমে যায়। অপমানে আবার গা রি রি করে উঠে। ননদিনী দের ছেড়েই হন হন করে ঘরে ঢুকে পড়ে। তখনের নোংরা রুমটা এখন একদম পরিষ্কার। তাজা ফুলে সাজানো। বিছানার গোলাপ গুলোর উপর গিয়ে বসে।
রিতীকে এভাবে চলে যেতে দেখে সোহাগ ও যেতে নেয়। কিন্তু কাজিনরা আটকে দেয়।
— কোথায় যাচ্ছো ভাইয়া? এতো সুন্দর করে রুম সাজিয়ে দিলাম আমাদের পাওনাটা না বুঝিয়েই কি ভাবীর আদর খেতে যেতে পারবে? তা তো হতে দেবো না। আগে আমাদের আবদার মেটাতে হবে তারপর ভাবীর আবদার।
— কি চাই?
— তেমন কিছু না। জাস্ট একবার ক্রেডিট কার্ড।
— বুঝছি। কাল মিনিসো তদের জন্য ফ্রি। গিয়ে আমার কথা বলে যা ইচ্ছা নিয়ে নিবি।
— ইয়েএএএএএএ… সবাই লাফ দিয়ে উঠে। যে যার রুমে চলে যেতেই সোহাগ রুমে ঢুকে। দরজা বন্ধ করে রিতীর দিক এগিয়ে আসে। কনের সাঝে তিতকরলার মতো মুখটা করে বসে আছে। এতেও যেনো অন্যরকম সুন্দর লাগছে। রিতীর ফোনে বারবার টুং টাং সাউন্ড হচ্ছে। মেসেঞ্জার ভরে গেছে পরিচিতদের মেসেজে। অনেকক্ষন থেকে রিতী আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে ক্রল করতে করতে। চার পাঁচ জন কনগ্ৰাচুলেশনস জানিয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে আরো বাড়ছে। রিতীর মনে পড়ে তখন ছেলে মেয়েরা তার সাথে সেলফি নিয়ে আপলোড দিয়েছে। বিয়ে পড়ানো থেকে সব কিছু ইন্টারনেটে জায়গা করে নিয়েছে। হয়তো তাদের সাথে দু একজন পরিচিত এড আছে। তাতেই একেরপর একজন একজন করে নিউজটা ছড়াচ্ছে। রিতীর ডান পাশে ফুল পাওয়ারে এসি চলছে। রুমটা হিম ঘর হয়ে আছে। তবুও রিতী ঘামছে। মাথাটা চিনচিনে ব্যথা করছে। চোখ বন্ধ করলে ভেসে আসছে বাবার মুখ। রিতীর খবর কি বাবা জেনে যাবে? জেনে গেলে কি হবে? বাবা কি রিতীকে ক্ষমা করবে? একেরপর এক প্রশ্নে রিতী জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে। রিতী চোখ খুলে ফেলে। সামনে দেখে সোহাগ দাঁড়িয়ে। রিতীকে মুগ্ধ চোখে পলকবিহীন দেখে যাচ্ছে। চোখ খুলতে দেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। কয়েকসেকেন্ড সময় নিয়ে বলে,
— আমার পিরিতীর এতো রূপ! সব মুভমেন্টেই সুন্দর লাগে।
থুতনিতে আঙুল ছোঁয়াতেই রিতীর ভালোমানুষীর বাধ ভেঙে যায়। ধাক্কা দিয়ে সোহাগকে ফ্লোরে ফেলে দেয়। সমস্ত রাগ তার উপর আছড়ে ফেলে। ফুলের স্তুপের বিছানা টেনে নামিয়ে সোহাগের মুখে ছুড়ে ফেলে। রাগে দিশেহারা হয়ে চেঁচায়,
— কি চাই কি আপনার? আর কতো খেলবেন আমাকে নিয়ে? কি দোষ করেছি আমি ? কেনো করছেন আমার সাথে এরকম?
— পিরিতি! আস্তে প্লিজ! আমরা আমাদের বাড়িতে।
— আমিতো সেটাই বলছি। কেনো নিয়ে এসেছেন আমাকে আপনার বাড়িতে? হোটেল রুমের অভাব পড়েছে? টাকা নেই আপনার কাছে? আমাকে বলতেন। আমি দিতাম। আমার জীবনটা ছাড়খাড় না করে চলছিলো না তাইনা? বাড়িতে এনে আত্ত্বীয় স্বজন ঢেকে বিয়ে করলেন। বউ সাজালেন। বাসর ঘর সাজালেন। এখন বাসর করতেও এসেছেন। আপনার আসলে উদ্দেশ্য কি?
— তুমি।
— আমি না। আপনি আমার সাথে কোনদিনো যান না। আপনি একটা এডিক্টেড, জুয়ারু, মূর্খ, বখাটে মাতাল। অসুস্থ মস্তিষ্কের লোক। আমাকে এনে এসব করে বাঁধতে চাইছেন তাই না? সবাইকে এমনভাবে জানাতে চাঈছেন যেনো আমি আপনার নামের সাথে নিজের নামটা কোনদিনো ছাড়াতে না পারি। আপনি তো আমাকে এক রাতের জন্য ই চান। ঠিকই ছুয়ে দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিবেন। আপনার এই চাওয়া আমি পূর্ণ করিনি? করেছিতো। তাহলে কি চান আবার আপনি।
— পিরিতি.. আমার তোমাকে এখনো ছুয়ে দেওয়া বাকি।
— সেটা আপনার ব্যর্থতা। আপনার অপারগতা। আমার নয়। আগে নিজেকে ঠিক করুন তারপর কথা বলুন।
— তুমি আমাকে এতো বড় অপবাদ দিতে পারোনা পিরিতী।তুমি নিজেও জানো এই সোহাগ কি।
— জানিনা। জানতেও চাইনা। আপনার সাথে কথাও বলতে চাইনা। দূরে থাকুন আমার থেকে।
রিতী ঘর ছেড়ে বারান্দায় চলে যায়। দরজা বন্ধ করে রেলিং মাথা রেখে অঝোড়ে কাঁদতে থাকে। সোহাগের কানে কান্নার আওয়াজ যেতেই সোহাগ এসে দরজায় প্রেস করে। লক করা দেখে ঘাবড়ে যায়। বারান্দায় হাটু অব্দি রেলিং। তার উপর ফাঁকা। সোহাগ রিতীকে ডাকতে থাকে।
— পিরিতি! দরজা খুলো। পিরিতি! এই বউ ! এই!
মাথা তুলে চেঁচিয়ে উঠে রিতী।
— একদম আমাকে বউ ডাকবেন না।
— কি ডাকবো বউ! দরজা লাগিয়েছো কেনো? দরজা খুলো বউ !
চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা ~