বিষ_করেছি_পান(৩৫)

0
431

#বিষ_করেছি_পান(৩৫)

(কপি করা নিষেধ)
— সোহাগ? উঠুন। এটা আমার ভার্সিটি। সবাই দেখছে। কি হচ্ছেটাকি?
রিতী সোহাগকে ছোড়ানোর চেষ্টা করে। উপরি সোহাগ আরো রিতীকে চেপে ধরে নিজের সাথে। রিতী আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে। কেউ কিছু হয়তো বলছেনা তবে মুখ চেপে হাসতে হাসতে ক্রস করছে। রিতী রাগ দেখিয়ে সোহাগকে ধাক্কা দেয় ‌। ধাক্কাটা ঠিক ধাক্কা হয়ে উঠেনা। রিতী খেয়াল করে রিতী রাগ ও করতে পারছেনা। রিতীর রাগটাই আসছে না। অথচ সোহাগের কাজটা প্রচুর রাগের একটা বিষয়। শেষমেষ ছাড়াতে না পেরে রিতী থেমে যায়। নিজের থেকেই আপনাআপনি হাত দুটো সোহাগের ঘাড়ের উপর উঠে আসে। ধীরে সয়ে ডাক দেয়,
— সোহাগ? এই সোহাগ?
আচমকা সোহাগ রিতীকে ছেড়ে দেয়। দুপা পিছিয়ে এসে চুলে আঙুল চালিয়ে দেয়। শার্ট নিচের দিকে টেনে নিয়ে ভদ্র ছেলে হয়ে দাঁড়ায়। রিতী ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে সোহাগ কেই দেখে। ছেলেটা আরো ফর্সা হয়ে গিয়েছে। তবে চোখে গালের উপরে পড়েছে ছায়া আবরণ। তবুও যেনো ভালো লাগছে। হুটহাট রিতী একটা কথা জিজ্ঞেস করে,
— মদ খাওয়া হয়?
সোহাগ মৌন থাকে।‌ ঠোঁটের কোনে ভেসে উঠে অদ্ভুত হাসি। রিতীর বাজে লাগে হাসিটা। অপরপাশে ঘুরে রেলিং এ হাত রাখে। কঠিন গলায় বলে,
— মদারু গাজারু লোকদের আমি সহ্য করতে পারিনা। তারা সব সময় আমার থেকে দূরে থাকুক এটাই আশা করি।
— মদ খাওয়া ছেড়ে দিলে কি লেপ্টে থাকতে বলবে?
— আমি অতটা সস্তা নই।
— এটি টিউট দেখাচ্ছো?
— সত্যটা বললাম।
সোহাগ পাশে এসে দাঁড়ায়। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাইরের দিকে নজর ফেলে। কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
— পালিয়ে না গেলেও পারতে। আমি নিশ্চয় কিছু একটা করতাম। আমিও চাইনি তোমাকে বিয়ে করতে।
— সেটা আমার থেকে কে ভালো জানে?
— আমার তোমার সম্পর্কটা কেমন যেনো। একটা গানের মতো। একটুখানি গেয়ে শুনাই।
‘ মূখে বলি দূরে যা..
মন বলে থেকে যা..
দূরে গেলে বুঝি তুমি কত আপন…
পাগল তোমার জন্য রে.. পাগল এ মন.. পাগল। ‘
— আপনি আসলেই পাগল।
অভিমানে গাল ফুলিয়ে ক্লাসের দিকে হাটা দেয় রিতী। সোহাগ বড় বড় পা ফেলে ধরে ফেলে রিতীর হাত। টেনে নিয়ে যায় নিচতলার দিকে। রিতী চিৎকার করে,
— এই আমার ক্লাস আছে।
কে শুনে কার কথা। ক্যাম্পাসে দাঁড় করানো সোহাগের সাদা গাড়িটায় নিয়ে গিয়ে বসায়। রিতী বাঁধা দেবার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা।হাত দুটো সোহাগের হাতের মাঝে। মুখ খুলার আগেই সোহাগ মুখে পকেট থেকে বের করে রুমালটা বেঁধে দেয়। ভ্যাপ্সা পঁচা গন্ধে রিতীর পেট থেকে নাড়ি ভুড়ি ভেরিয়ে আসে। ওক ওক করতে থাকে। সোহাগের কান দিয়ে ঢুকে না। এক হাতে গাড়ি স্টার্ট দেয়। রিতী সোহাগের দিকে তাকিয়ে ভয়ে সিটিয়ে যায়। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে? কোন বিপদে পড়বেনাতো? এই বখাটে টা কি কোনদিন মানুষ হবে না? চোখের কোনায় জল জমে উঠে রিতীর।
সোহাগ রিতীর চোখের জল দেখে মিচকে হাসে। গাড়ির পাওয়ার স্লো করে দেয়। সামনে তাকিয়েই বলে,
— পাঁচ মাস আটদিন তোমার দেখা পাইনা পিরীতি। যেখানে তুমি জানো একদিন তোমাকে না দেখলেই আমি কেমন পাগল হয়ে যাই। সেখানে আমার সাথে এতোবড় একটা কান্ড করে গাল ফুলাও! আমি পাগল বল! পৃথিবীতে তুমি একটা মানুষ যে আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। তীলে তীলে বিষাক্ত ব্যথায় নুইয়ে পড়ছি আমি। এর প্রতিকার কী? মুক্তি চাই আমি। আমাকে এবার মুক্ত করো। কসম আমি তোমায় মুক্ত করে দিবো।
— ইউর টাইম ইজ ওভার। আমি কোন অনিশ্চিত জীবন চাইনা।
— আই হ্যাভ এ প্রপোজাল ফর ইউ।
— আপনি নেই তো?
— আমি নিজেকে ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবিনা।
— কোথায় যাচ্ছি?
— তোমার শ্বশুর বাড়ি।
— নো। নেভার। যাবোনা আমি। গাড়ি থামান। এই বিশ্রি রুমাল টা মুখ থেকে সরান। আর নিতে পারছিনা আমি।
সোহাগ রিতীর হাত ছেড়ে দেয়। রিতী মুখ থেকে রুমালটা খুলে গাড়ির জানালা দিয়ে দূরে ঢিল ছুড়ে। মুহূর্তে ই গাড়িটা কোন আবাসিক এলাকার গলিতে আবিষ্কার করে। কিছু বলতে না বলতেই একটা গেইট দিয়ে গাড়িটা ঢুকে পড়ে। রিতী মুখ বাড়িয়ে দেয় জানালা দিয়ে। বিশাল তিনতলা একটা বাড়ির সামনে এসে গাড়িটা থামে। বাইরে থেকে দেখেই রিতীর চোখ জুড়িয়ে যায়। বাড়ি দেখেই বুঝে যায় সোহাগরা কতটা বড়লোক! সোহাগ কিছু না বলেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এদিকে রিতী কি করবে কি করবেনা ভেবে উঠতে পারছেনা। আকাশ সম টেনশনে জমে গেছে। দু মিনিট পর সোহাগ বাড়ির ভেতর থেকে ফিরে আসে।হালকা হেলে রিতীর মুখোমুখি নিজের মুখটা নেয়।
— শ্বশুরবাড়িতে প্রথম পা রাখতে চলছো। তোমার শ্বশুর শাশুড়ি আমার মতো গর্দভ নয়। তারা যথেষ্ট এডুকেডেড আর সম্মানীয়। তাদের জায়গাটাকে সম্মান দিও।
— আমি পারবোনা। যাবোনা আপনার বাড়িতে। জোর করে ধরে এনে এ বাড়িতে ঢুকতে বললেই আমি শুনব নাকি? মগের মুল্লুক পেয়েছেন?
— জোর করে বিয়ে করার সময় মনে ছিলো না?
— বিয়ে মাই ফুট।
— তা বললে তো চলে না। বিয়ে করার বাতিক তোমার। আমার না। তুমি যেমন জোর করে বিয়ে করে রিসোর্টে নিতে পারো আমিও তেমন নিজের বউকে জোর করে ঘরে তুলতে পারি। সিন ক্রিয়েট করবেনা বেরিয়ে আসো।
— কি লাভ আপনার এসব করে?
— আমার যে এখনো তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়া বাদ পড়ে আছে।

— এই সর সর। সরে দাঁড়াও। আব্বা বউমাকে বেরোতে দাও।
মহিলার গলা শুনে ঝটপট চোখ ঘুরায় রিতী। হাস্যজ্জল লম্বা সুশ্রী একজন মাঝবয়সী মহিলাকে চোখে পড়ে। মুখে বিন্দুমাত্র বয়সের ছাপ নেই। একটু মুটিয়ে না গেলে হলফ করে বয়সটা ত্রিশের নিচে নামিয়ে আনা যেতো। সোহাগের সাথে মুখের দারুন একটা মিল। পেছনে পেছনে ছুটে আসছে আরো দুজন মেয়ে আর তিনজন ছেলে। তাদের বেশ বোশাক দেখে বুঝা না গেলেও রিতী অনুমান করে নিলো এরা এবাড়ির সার্ভেন্ট। বড়লোক বাড়ির সার্ভেন্টরা একটু পরিপাটি স্মার্ট হবেই। তবে এই মহিলা কে? সোহাগের মা? মনে হতেই রিতী জানালার বাইরে থেকে মুখ ভেতরে নিয়ে আসে। সামনে গ্লাসে দেখতে পায় স্বয়ং রমিজউদ্দিন বেরিয়ে আসছে। রমিজউদ্দিন কে রিতী চেনে। বেশ কয়েকবার দেখেছে। নামী দামী লোক তিনি। এমপি মিনিস্টার দের সাথে উঠবস। হাত পা কাঁপতে থাকে রিতীর। সেদিন তো বাবা এদের অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তাহলে কি এতোদিন পর এর বদলা নেবার জন্য রিতীকে ধরে এনেছে? কি করবে এরা? ঘরে বন্দি করে রাখবে? অত্যাচার করবে? গলা শুকিয়ে আসে রিতীর। সোহাগের আচরণ ও ঠিক ঠাক লাগছেনা। তার চেহারায় রাগ জেদ বিরক্তি কিচ্ছু নেই। কত স্বাভাবিক! জোর করে যে একটা মেয়েকে তুলে এনেছে কেউ ভাবতেও পারবেনা মুখ দেখে। মহিলাটি সামনে দাড়াতেই সোহাগ পিছিয়ে দাঁড়ায়। সোহাগকে এখন বাধ্য ছেলের মতো ব্যবহার করতে দেখছে। ফ্যামিলির কাছে সোহাগ এতো লয়্যাল! খানিকটা অবাক হয় রিতী। মহিলাটি দরজা খুলে রিতীকে ইশারায় নেমে আসতে বলে। রিতী একবার সোহাগের দিকে আরেকবার তার মায়ের দিকে তাকিয়ে নেমে আসে। সোহাগী ছেলে বউয়ের মুখখানা আজলা ভরে নেয়। মুচকি হেসে কপালে চুমু দেয়। মাশাআল্লাহ বলে দোয়া দেয়। কাঁধে হাত রেখে বলে,
— অবশেষে শ্বশুরবাড়িতে পা পড়লো আমার বউমার! আমি তোমার আম্মা হই। ভয় পেওনা। ঐ যে দেখো তোমার আব্বা। তাকে তো তোমার চেনার কথা। আর এরা হচ্ছে আমার হেল্পিং হ্যান্ড। বিয়ে করেছো সেই কবে! শ্বশুরবাড়ি পা রাখতে অনেক দেড়ি করে ফেললে। এরজন্য তোমার সাথে আমার কিঞ্চিৎ পরিমাণ অভিমান টা এখনো গলেনি। তবে আমি আমার বউমার কোন অযত্ন হতে দেবো না। এই দুধ মিষ্টি দে।
একজন হাতে মিষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তো একজন দুধ,পানি নিয়ে। শ্বশুড়ির কথার ধরনে আর ভাবসাবে রিতী অনুভূতি শূণ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন বউকে ঠিক যেভাবে নামানো হয় ঠিক সেভাবেই দুধ মিষ্টি জল খাইয়ে রিতীর অনামিকায় বড় সড় একটা গোল্ডের রিং পড়ানো হয়। রিংটা বের করে দেয় রমিজউদ্দিন। পরিয়ে দেয় সোহাগী।‌ এতো বড় রাজকীয় রিং দেখেই রিতী ঢুক গিলে। ততক্ষনে সোহাগ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে।
— সালাম করো।
বলেই সোহাগ ঝুঁকে পড়ে। রিতীও বাধ্য হয়ে সোহাগকে অনুসরণ করে পর পর সোহাগী এবং রমিজউদ্দিন কে সালাম করে। রমিজউদ্দিন প্রাণ ভরে রিতীকে দোয়া করে। রিতীর ভয়ার্ত মুখখানা সবার চোখেই ধরা পড়ে। রমিজউদ্দিন মাথায় হাত রেখে বলে,
— আমরা তোমার আরেক বাবা মা। নতুন এক পরিবার। এই বাড়ি, এই বাড়ির মানুষ গুলো তোমার আপনজন। এখানে ভয় পাবার মতো কিছু নেই। তবুও আমার বউমা কেনো ভয় পাচ্ছে শুনি?
রিতী আমতা আমতা করে। কি বলবে? এতো স্বাভাবিক আচরণ রিতী কখনোই আশা করেনি। রমিজউদ্দিন বিচক্ষন মানুষ। রিতীকে পড়তে তার সময় লাগলো না।
বরং রিতীকে আস্বস্ত করলো।
— আমি তোমার বাবার সেদিনের কথা কিছু মনে রাখিনী। তুমি আমার জন্য ইমপর্টেন্ট। তুমি আমার ছেলেকে বিয়ে করেছো আমার খারাপ ছেলেটার দায়িত্ব নিয়েছো তোমার বাবা নয়। আমার বাড়ির ভবিষ্যত এর চোখে মুখে ভয়ের ছাপ একদম মানায় না। মাথা উঁচু করে আমার সংসারে প্রবেশ করো। তুমি যদি চাও তোমার শ্বশুর একবার অপমানিত হয়েছে। প্রয়োজনে আবার তোমার বাবার কাছে অপমানিত হতে যাবে। তুমি শুধু আমার ছেলের দিকে খেয়াল রাখবে।

সোহাগী কে ডেকে বললো,
— সোহাগী। বউমাকে ঘরে নিয়ে যাও। তোমার হ্যাল্পিং হ্যান্ডদের রান্না চাপাতে বলো। নতুন বউকে ওয়েলকাম করার সব বন্দোবস্ত করো। আমি একটু বেরোচ্ছি।

রমিজউদ্দিন চলে গেল। সোহাগী এসে রিতীর হাত ধরলো। সোহাগীর সাথে সাথে রিতীও পায়ে পায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। সোহাগীর পেছন পেছন সোহাগ এসে দাঁড়ালো। রিতী বাড়ির ভেতর ঢুকতেই তার দিকে গোলাপের পাপড়ি ছুড়া হলো। প্রথমে মুখের উপর পাপড়ি পড়তেই রিতী হকচকিয়ে গেলো। পরে যখন বুঝলো নতুন বউকে ফুল ছিটিয়ে বরণ করা হচ্ছে তখন রিতী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সবাই রিতীকে নতুন বউ বউ বললেও রিতীর বউ বউ কোন ফিলিংস ই আসছেনা। বরং তার মাথায় হাজারো চিন্তা ঘুরছে। এই যে সে এই বাড়িতে ঢুকলো.. কত ঘন্টা থাকতে হবে? কত দিন? এরা যেভাবে তাকে আপন করে নিচ্ছে সহজে কি ছেড়ে দিবে? আর সোহাগ? সোহাগের কথা মনে হতেই রিতীর কান্না পাচ্ছে। এই লোকটাকে নিয়েই তার অশান্ত মনে যত অশান্তি। সোহাগের মুখের দিক তাকিয়ে রিতীর সত্যি সত্যি কান্না চলে আসে। উঠ ভেঙে কেঁদেও দেয়। আকষ্মিক বাড়িতে এতো খুশির মাঝে রিতীর কান্না সবাইকে নাড়িয়ে দেয়। রিতীকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। সোহাগ ও রিতীর সামনে এসে জিজ্ঞেস করে,– কি হয়েছে পিরিতি? কাঁদছো কেনো?
— আমি কাঁদছি না।
— আমি তো দেখতে পাচ্ছি তুমি কাঁদছো।
— আমি কাঁদছি না। আপনি কাঁদাচ্ছেন।
সোহাগী সোহাগের বাহু ধরে সরিয়ে দেয়।
— এই সর তো দেখি।
রিতীকে সোফায় বসিয়ে টলমল করে গড়িয়ে পড়া জল গালে হাত দিয়ে মুছিয়ে দেয়।
— তোমার কি খারাপ লাগছে আম্মা? কি মনে করে তুমি কাদতাছো? সোহাগ তোমারে কিছু বলছে? ঐ সোহাগ আসার সময় কি বলছোস সত্যি করে বলতো? নয়তো যে মেয়ে তোরে জোর করে বিয়ে করছে সে কেনো এতো ভয় পায় ? সে কেনো তোরে দেখে চোখের পানি ছাড়ে?
সোহাগী ক্ষেপে উঠে সোহাগের উপর। সোহাগ একহাত কোমড়ে রেখে বলে,
— আম্মা আমি কিছু কইনাই।
— তাহলে বউমা কাঁদে কেন? যা তুই সামনে থেকে সর। যা। আমি দেখতাছি কি হয়ছে।
— আম্মা আমার সাথে এইভাবে কথা চলবে না। তোমার ঘ্যাণঘ্যানানিতে ওরে আনছি। এখানে আমার কোন দোষ নাই। তুমি ওরে জিজ্ঞেস করো কাঁদে কেন?
— কি আজব!
রিতী আঙুল তুলে বলে,
— আম্মা আপনার ছেলেকে যেতে বলেন। আমার উনাকে দেখলেই কান্না পায়তেছে। আমাকে ভার্সিটি থেকে তুলে আনছে জানেন?
রিতীর কথায় সোহাগী মুচকি হাসি দেয়।
— তাতে কি হয়ছে আম্মা? তোমার কাপড় চোপড় কসমেটিকস সব পাইয়ে যাবা। তুলে আনা তো এ বাড়ির ঐতিহ্য! তোমার আব্বাও তো আমারে তুলে এনেই বিয়ে করছে। তো তোমার আব্বার পোলা হিসেবে তুলে নিয়ে বিয়ে না করতে পারলো বাড়িতে তো আনতে পারে! ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবো না?

শ্বশুড়ীর কথায় রিতী আরো কাঁদতে লাগলো। নিজের উপর নিজেরই রাগ বিরক্তি সব ছেকে ধরেছে। কি মনে করে শ্বশুড়ির কাছে নালিশ চাপালো আর কি উত্তর পেলো! যার পরিবারই এমন সে তো এরকম হবেই। না পারছে ছাড়তে না পারছে ধরতে। বিয়া করা স্বামী যে। নিজের বোরখা খামচে ধরে ফুফাতে লাগলো। তবে রিতী একটু হলেও নিশ্চিত হয়েছে। বাড়িতে নিয়ে এসেছে অন্য কোন জায়গায় তো নিয়ে যায়নি! তারমানে অন্য কোন বিপদ ও রিতীর উপর আসবেনা। আপাতত সেসব বিপদের ভয় ও পাচ্ছেনা। সোহাগ নামের বিপদটাযে এই বাড়িতেই খাড়া।
— ভাবীসাব। জুস নেন।
আহা! অরেঞ্জ জুস উইথ বরফ! এতো আপ্যায়ণ! রিতী সময় নিয়ে কান্না থামিয়ে দিলো। একচুমুকে গ্লাস সাফ করে গলা ভিজিয়ে নিলো। অমৃত! ভালো লাগছে। শ্বাশুড়ি ও নেই। সোহাগ ও নেই। রিতী আশেপাশে তাকিয়ে প্রাসাদটা দেখতে লাগলো। রিতীর দৃষ্টি অনুসরণ করে কাজের মেয়েটাও দেখতে লাগলো। খুশিতে গদ গদ করতে করতে বললো,
— মেলা সুন্দর বাড়ি,ভাবীসাব! তাই না?

সোহাগী বেগম সোহাগকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। ছেলেটাকে তো অনেক বলে কয়ে বউমাকে বাড়িতে আনলো। এবার একে আটকানোর পালা। বউয়ের জন্য তার ছেলে যে কতোটা ডেম্পারেট সেটাতো নিজের চোখেই দেখেছে এতো দিন। এখন আর ছাড়া যাবেনা। সংসারের প্রতি মায়া বাড়াতে হবে।পায়ে লাগাম পড়াতে হবে। বাউন্ডুলে জীবন তো আসলে জীবন না। বউছাড়া তো সম্ভব ও না। তাই যেই জানতে পেরেছে ছেলে রিতীর কাছে গিয়েছে ওমনি ফোন করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আল্লাহ দোহায় দিতে রিতীকে বাড়িতে আনতে রাজি করিয়েছে। কিন্তু ছেলে এখনো ত্যাড়ামি করে যাচ্ছে।
— আম্মা আমি সংসার টংসারে যাইতে পারমু না। আমারে জোড় করবানা।
— সুন্দর করে কথা বল আব্বা। বউমা আসছে ঘরে। পড়ালেখা করা মেয়ে। দেখছিস না আমি সুন্দর করে কথা বলতাছি।
— সুন্দর হয়তাছেনা আম্মা। আমিও সুন্দর করে কথা বলতে পারি।
— হ আব্বা। আমার কথাটা শোন। তুই তো ভালোবাসোস রিতীরে। তোর আব্বা আমারে ভালোবাসে। দেখছো না কত আদর সোহাগে রাখে আমারে। কোন মেয়ের দিকে তাকায়নাই তোমার আব্বা আমি ছাড়া। তোমার আব্বা পারলে তুমি কেন পারবানা?
— আমি কাউরে ভালোবাসিনা।
— এসব কয়না আব্বা। এমনে এমনে তো আর ঘুর নাইকা। সংসার করতে করতে ভালোবাসি ফেলবা।
— দেখো আম্মা। পিরীতিরে কেনো আনছি তুমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছো। তোমাদের বংশের নিয়ম নিতী নাকি আছে সব পালন করো। তারপর ওরে ওর হোস্টেলে দিয়া আসবো।
— এমন করে না আব্বা। সংসার জীবন খারাপ না। পিরিতি মেয়েটাও খারাপ না।
— আমি খারাপ আম্মা। পিরিতি আমারে সহ্য করতে পারেনা। আমিও তারে ছাড়তে পারিনা। ইচ্ছা হলে ধরতেও পারিনা। আমি খারাপ বলে ঐ মেয়ে আমারে নিজে থেকে ধরতেও দেয়না। আমার ভেতর অসহ্য যন্ত্রনা হয় আম্মা। এইযে ওরে না দেখতে পেয়ে যন্ত্রনায় ছটফট করলাম। আজকে ওরে দেখতে পেয়ে ইনসিকিউরিটি তে ভূগতাছি। ঐ মেয়ে সোজা মেয়ে না। আমারে ভেঙে দেবার মতো তার আছে অদ্ভুত ক্ষমতা।
— ঐগুলা তোমার বাজে চিন্তা ধারা। আব্বা! নিজে সহজ হও। বউরেও সহজ করো। দুইটা দিন অন্তত আম্মার কথা শুনো। সংসার এ মন দেও। বউয়ের যত্ন নেও। দেখবা এতোটা ইনসিকিরিটি আর থাকবো না।

কাজের মেয়েটার চিৎকার শোনা গেলো। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে,
— আম্মা! আইলেন না! রক্ততে বন্যা বয়ে গেলো গা।
সোহাগী সোহাগ দুজনেই দৌড়ে এলো। ড্রয়িংরুমে রিতীকে বসিয়ে রেখে গিয়েছিলো। ড্রয়িংরুমে রিতী নেই। চিৎকার আসছে দুতলা থেকে। সোহাগ পিরিতী? বলে দৌড় লাগায়। একেবারে এসে থামে নিজের রুমের সামনে।
— ভাবীসাব!
— সর সামনে থেকে।
দরজা থেকে মেয়েটাকে সরিয়ে সোহাগ রুমে ঢুকে পড়ে। রিতীকে কোমড় বাঁকিয়ে পা ধরে কাঁতরাতে দেখে মাথা নষ্ট হয়ে যায়। ফ্লোরে পা থেকে রক্ত চুয়ে চুয়ে পড়ে গোল হয়ে আছে। সারা ফ্লোর মদের বোতল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আছে। সোহাগী ধমক দিতেই কাজের মেয়েটা ভয়ের চোটে বলে উঠে,
— আমার কোন দোষ নাই আম্মা। ভাবীসাব বাড়ি দেখতে দেখতেই বলে ভাইজানের ঘরে যাবে। আমিও নিয়ে আসছি। খালিপায়ে পা দিতেই ভাবীসাব চিল্লায়ে উঠে। আমি কি জানতাম নাকি ভাইজান মদ খাইয়া সারা ঘর বোতল ভাইঙা রাখছে?
সোহাগ ঝটপট করে রিতীর কাছে গিয়ে পাঁজাকোলা তুলে নেয়। কাজের মেয়েটার উপর চেঁচিয়ে বলে,
— হাসানরে এক্ষন বলবি আমার রুম পুরো সাফ করতে।

চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here