#বিষ_করেছি_পান(৩৪)

0
428

#বিষ_করেছি_পান(৩৪)

(কপি করা নিষেধ)
সকাল বেলায় জানাজানি হয়ে গেছে কলোনীর ছানোয়ার স্যার তার পরিবার নিয়ে কলোনী ত্যাগ করেছেন। ছাদে দাঁড়িয়ে আশপাশ থেকে গুঞ্জন শুনছিলো বাঁধন। কিন্তু বুঝতে পারছিলোনা সঠিক ‌।নিচ থেকে কেউ একজন বড় গলায় বললেই বাঁধনের টনক নড়ে। বাঁধন দৌড়ে নিচে নামে। বীণাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে,
— মা? ছানোয়ার কাকারা নাকি চলেগেছে শুনছি?
— হ্যা। ভোরেই চলে গেছে। মেয়ের জন্য বাড়ি ভিটা ত্যাগ করতে হলো এবার।
— কোথায় গিয়েছে?
— বলে যায়নি।কেউ খোঁজ জানেনা।
— কিন্তু কেনো?
বীণা সবটাই বাঁধনকে খোলে বলে। সব শুনে বাঁধন স্তব্দ হয়ে আছে। এতো দিন সে ভাবতো এক আর হয়েছে এক! তাইতো বলি! ছুটি এখনো ছোট! ছুটির পেছনে কেনো ঐ বখাটেটা ঘুরবে? কিন্তু ছুটি গেলো কোথায়?
বাঁধন শার্ট নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে আসে। ছুটিদের বাড়িতে তালা ঝুলছে। গেইট টেনে বাঁধন ভেতরে ঢুকতেই ঝিমাকে দেখে। দরজার সামনে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। চোখ মুখ থমথম করছে। যে কোন মূহুর্তে ই আবরণ ভেঙে পড়তে পারে। হাতে পেচাচ্ছে বড় একটা খাতার কাগজ। মাঝখানের লেখা টুকু ছাড়া বাকিটা একটু একটু করে চিমটি কেটে কেটে ফেলে দিচ্ছে। বাঁধন গিয়ে ঝিমার সামনে দাঁড়ায়। সামনে অবয়বের উপস্থিতিতে ঝিমা মুখ তুলে তাকায়। চোখে টলমল করছে জল। এই বুঝি টুপ করে পড়বে। বোনের এই মুখখানা কতটা কষ্ট পেয়েছে তা প্রকাশ করে। বাঁধনের বুকের ভেতর খামচে ধরে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে দরজার উপর ঝিমার পাশে বসে পড়ে। একহাতে ঝিমার কাঁধ জড়িয়ে ধরে। হাত থেকে কাগজ টা নিতে গেলে ঝিমা হাত সরিয়ে দেয়। হাতের মুঠোয় কাগজটা কুচিমুচি করে ধরে। বাঁধন থেমে আবার হাত বাড়ায়।
— কি লেখা? দেখি?
— নাহ।
বাঁধন হাত সরিয়ে নেয়।
— ছুটি দিয়েছে?
— হু।
— কি লিখেছে?
— পার্সোনাল।
বাঁধন মৃদু হাসে। ছোট ছোট বাচ্চা কাচ্চার আবার পার্সোনাল!
— বেশী মন খারাপ করছে?
ঝিমা উত্তর দেয়না। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এবার আর বাঁধনের ভালো ঠেকে না। ঝিমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে শান্তনা দেয়।
— ছুটি ঠিক চলে আসবে তোর সাথে দেখা করার জন্য দেখিস। আর আমরা তো জানিও না কোথায় গেছে কত দিনের জন্য গেছে। যে তোকে নিয়ে যাবো। তাছাড়া ছুটি তোকে ছাড়া থাকতেই পারবেনা। ঠিক তোর সাথে দেখা করতে আসবে।
— আসলে তো সেই চলেই যাবে। থাকবেনাতো আর সারাজীবন আমার পাশে।
ঝিমার মনের অবস্থা বাঁধন বুঝতে পারে। ঝিমাকে তুলে ধরে বাড়িতে চলে আসে। নিজ রুমের দিকে যাবার সময় ঝিমা দাঁড়িয়ে পড়ে। কাতর চোখে তাকিয়ে বলে,
— ভাইয়া আমাকে যদি কেউ এমন ভাবে ভালোবাসতো যে আমি যা চাইবো যেকোন মূল্যে সে সেটা এনে দিবে তাহলে আমি হয়তো এটাই চাইতাম, এমনভাবে ছুটিকে চাইতাম যে একবারে আমার আপনজন করে।যতটা আপন হলে আর কক্ষনো দূরে যেতে পারবেনা।

বাঁধন থ ধরে বসে থাকে। ছুটির সেই চিঠিটা বাঁধনের হাতে। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে কয়েকটা লাইন লেখা। এই চিঠির মিনিং কী? উত্তর খুঁজতে গিয়ে বাঁধন নির্বাক হয়ে আছে। চিঠিটা ঝিমাকে দেওয়া হলেও পুরোটাই বাঁধনের জন্য লেখা। বাঁধন কেনো ছুটির চিঠিতে স্থান পেলো? বাঁধন কি তবে ছুটির জীবনের কোন অংশ জুড়ে ছিলো? বাঁধন গলা বাড়িয়ে ঝিমাকে ডাকলো। ঝিমা সামনে এসে দাঁড়ায়। বাঁধন অপলক চোখে ঝিমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঝিমা বাঁধনকে ধাক্কা দিতেই হুস ফেরে।
— ভাইয়া? কি দেখছো ঐভাবে?
বাঁধন যেনো নিজেই কিছুটা লজ্জিত হয়। ফুস করে শ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করে,
— তোর বয়স কত?
— ষোলো। কেনো?
— টিনেজ!
— হুম। কেনো? ভাইয়া? কি হয়েছে?
— কিছুনা । যা। আচ্ছা শোন। ছুটি পরিক্ষা দিবে কই থেকে?
— আমি ছুটির খবর জানিনা।
— কেনো জানবিনা? কোন হিন্স? কোথায় যেতে পারে?
— তুমি কি ছুটির কাছে যাবে?
— না।এমনি।

মুখে যাই বলুক বাঁধন চুপি চুপি ঠিকই ছুটির খোঁজ করে। ছুটিকে খুঁজে পাওয়াই এখন তার অবসরে কাজ। সুমির সাথে এখন আর দেখা করতে যায়না। দায়িত্ত্বের টান টুকুও ফিকে হয়ে আসছে। এই চিঠির কি মানে সে জানতে চায়। যাকে এতো ছোট ছোট করে সে যে চোখের পলকেই বড় হয়ে গেছে বাঁধন আমলে নেয়নি। এইযে সেদিন চোখের সামনে ই ভূমিষ্ঠ হলো ছুটি। বাঁধন তখন হাই স্কুলের ছাত্র। ঘরে ছোট একটা পুতুল। পাশের বাসায় আরেকটা পুতুল। দুই পুতুলে কি মিল! গুটি গুটি পায়ে যখন হাঁটতে শেখে এক দৌড়ে দুটোই বাড়ির বাইরে চলে আসে। গেইটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোলাকাত হয় তাদের। বাঁধন স্কুল থেকে ফেরে এমন অনেক পেয়েছে দুটোকে একসাথে। সবার চোখের আড়ালে রাস্তায় বসে ধুলো নিয়ে খেলছে। বা এইযে ধুলোতে যাবে। বাঁধন দক্ষ হাতে দুজনেই বগলদাবা করে ধরে নিয়ে আসে। ঘাড়ে তুলে বাজার থেকে ঘুরে আসে। কোলে তুলে নিয়ে সামলায় দুটোকে। আর আজ কত বড় হয়ে গেছে দুজনে। নিজের বোনটা কষ্ট পাচ্ছে। পরের বোনটা সেই কষ্টের ভাগিদার করে গেছে।

রিতীর শহর ছাড়ার ব্যাপারটা সোহাগকে প্রচন্ড অবাক করেছে। তার বাবা মা যেই স্টেপ ই নেক না কেনো সোহাগের ধারণা রিতী বা তার পরিবার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবে। ছুটিটা নিশ্চয় কিছু একটা করবে। ছানোয়ার স্যার ভাঙবে তবু মচকাবেনা। কিন্তু কে জানতো এরকম একটা স্টেপ নিয়ে সোহাগকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে যাবে? সোহাগ দমে গেছে। চুপচাপ হয়ে গেছে। প্রথম দিকে ঠিক থাকলেও আর পারছেনা। আজ কতটা দিন সে তার পিরিতি কে দেখে না। বুকের ভেতরটা ক্ষনে ক্ষনে হু হু করে উঠে। নিজের শরীর থেকে কোন অঙ্গ-পতঙ্গ যদি আলাদা করে রাখা হয় ঠিক যেমন কষ্ট হয় তার থেকেও যেনো এই ব্যথার গভীরতা অনেক। ভেতর থেকে ঘায়েল করে দেয়। এক প্রকার ঘর বন্দিই হয়ে পড়ে। ঢাবিতে গিয়েও রিতীকে খুঁজে এসেছে। রিতীর নাগাল পায়নি। রিতী কি পড়াশোনা ছেড়ে দিলো? ছুটিই বা কোথায়? ছানোয়ার ট্রান্সফার হয়েছে। কোথায় হয়েছে জানা যায়নি। বউ হারিয়ে সোহাগ সর্বশান্ত হয়ে গেছে। মদের বোতল,বিয়ার তার নিত্যদিনের সঙ্গী। এমনটা হবে কোনদিন ভাবতে পারেনি।

রমিজউদ্দিন নিজের উপর মহা বিরক্ত। ছেলের এমন ভাব সাব নিজের চোখে দেখে নিজেকেই দায়ী করছে। সোহাগীকে বললে সোহাগী গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরে। অভিযোগ করে রমিজউদ্দিন এর উপর
— আপনি আমার একমাত্র ধনটার সুখের জন্য কিছু করতে পারছেন না? এই আপনার ক্ষমতা? আমার মানিকের কিছু হোক। আমি সোহাগী আপনাকে ছাড়বোনা।
রমিজউদ্দিন অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয় সোহাগকে আবার বিয়ে দিবে। অনেক সুন্দরী মেয়েকে বউ করে আনবে। প্রস্তাবটা শুনেই সোহাগী আকাশ থেকে পড়ে। কি বলছে! বিয়ে মানে? এক বউকেই ঘরে তুলতে পারলো না আবার আরেকজন কে বউ করে ঘরে তুলবে? মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি? রাগে দুঃখে সোহাগের রুমের সামনে গিয়ে নক করে।
— এই সোহাগ দরজা খুল আব্বা।তোর আব্বায় তোর সর্বনাশ করতে চাইছে সেই খবর কি তুই রাখছোস? তাড়াতাড়ি দরজা খুল।
মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি তে সোহাগ দরজা খুলে। সোহাগী টেনে হেঁচড়ে ঐ গন্ধ যুক্ত রুম থেকে ছেলেকে টেনে বের করে। কাজের মেয়েটাকে ডেকে বলে রুমটা পরিষ্কার করতে। সোহাগ ঢুলছে। মায়ের এভাবে ধরে রাখাতে যে ফ্লোরে পড়ে যাচ্ছে না।সোহাগী সোহাগের মুখে লেবুর শরবত করে এনে ধরে। গলাটা ভিজিয়ে দিয়ে হাতের চউলে নিয়ে পানি নিয়ে মাথায় ঢালে। সোফায় বসিয়ে দিয়ে মুখোমুখি বসে।
— আব্বা আমার দিকে তাকাও। শুনছো তোমার আব্বায়ে কি বলছে?
— কি বলছে?
— তোমারে আবার বিয়ে দিবো। পাত্রী নাকি দেখা শুরু করছে।এখন তুমি আমারে কও তোমার কি আবার বিয়ে করার ইচ্ছা আছে?
সোহাগ ঘাড় বাঁকিয়ে রমিজউদ্দিনকে দেখে। রমিজউদ্দিন ও উৎসুক চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলে কি বলে শুনতে চায়। তাই নিজেই বলে,
— আমি অনেক সুন্দরী শুশ্রী লেখাপড়া জানা মেয়ের সন্ধান পেয়েছি। তোমার জন্য তারে ঠিক করছি। তুমি দেখলে না করার চান্স পাবানা। সাথে সাথেই বিয়া করে ঘরে তুলতে চাইবা।
সোহাগ মায়ের দিক তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
— আমার সুন্দরী বউ আছে।
— কিন্তু আব্বা তোমার বউতো তোমারে ছাড়ি চলে গেছে।
— তোমরা তাড়াইছো। আমার বউ আমার শহরেই ছিলো তোমাদের সহ্য হয়নাই।আমি বারণ করা সত্ত্বেও আমার সুখ আমার জীবনরে কাইড়া নিছো।
— আমরা তো তোমার ভালোর জন্যই…
— তোমরা তাড়াইছো। খুঁজে আনার দায়িত্ব ও তোমাদের। আমি শান্তি পাইতাছিনা। আব্বা…?
— কও আব্বা।
— তোমার ছেলের বউরে খুঁজ লাগাও। যে কোন মূল্যে আমার তারে চাই।
— তারা আমার সাথে বেয়াদবি করছে আব্বা। বউমার আব্বায় তোমার আব্বারে দাম দেয়নাই। তোমারে এরকম দেখতে আমার ভালা লাগেনা। আর বউমা তোমারে মানি নিবোনা। তাই তোমারে আমি আরো সুন্দরী মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চাই। তুমি তো আর বউমারে ভালোবাসো না!
শেষের কথাটা একটু টানিয়েই বলে রমিজউদ্দিন। সোহাগের ভ্রু কুঁচকে উপরে উঠে যায়।
— আমার বউ অনেক সুন্দর আব্বা। তারে যেভাবে তাড়াইছো সেইভাবেই আমার সামনে আনো।
— কিন্তু শোন…
— থামো তুমি।
সোহাগী থাকিয়ে দেয়।
— তুমি আমার বউমারে খুঁজে আনো। সে কয় আছে কি করছে আমি জানতে চাই। ছেলেরে বিয়া দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগছো যে বউ চলে গেছে তারে না খুঁজে। বেইয়ারের দোষ দেও! কোন বাপে তার মেয়েরে বিয়া দিতে চাইবো তোমার ছেলের কাছে? ছেলে আমাদের কাছে সোনার টুকরা হলেও অন্য মানুষের কাছে না। বউমা কি ইচ্ছা করে গেছে? বাপে যেখানে যাবো সেখানেই তো নিয়ে যাবো। বাধ্য হয়ে গেছে।
— অতবড় মেয়েরে বাধ্য করবো কেডা?
— তো তোমার ছেলেরে বাধ্য করার চেষ্টা কেনো কর? বউমা আমার নিজ ইচ্ছায় আমার ছেলেরে বিয়া করছে। এখন আরেকটা বিয়া করাইলে বউমা যদি এসে কৈফিয়ত চায় তখন আমি কোন মুখ নিয়ে দাড়ামু? মেয়ে হয়ে আরেক মেয়ের সংসার তো আমি ভাংতে পারমুনা।
— তো কি করমু?
— লোক লাগাও।

রিতীর সাথে দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সোহাগ। রিতী এখন রোকেয়া হলে থাকে জানতে পেরে সকাল সকাল ই সোহাগ ক্যাম্পাসে পা দিয়েছে। ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিতীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। এগারটা নাগাদ রিতীর দেখা মিলে। মেরুন রঙের এক বোরখা হিজাবে নিজেকে আবৃত করে রেখেছে। বের হয়ে থাকা ছোট্ট মুখমন্ডল খানি পদ্মের মতো ফুটে উঠেছে। মেয়েটা যেনো আরো সুন্দর হয়ে গেছে। এতো রূপ কেনো মেয়েটার? সারাজীবন তাকিয়ে দেখলেও যেনো চোখের তৃষ্ণা মিটবেনা। কিভাবে ছিলো এতো গুলো দিন সোহাগ পিরিতি ছাড়া? ক্লাসের সামনে আসতেই সোহাগকে চোখে পড়ে রিতীর। তৎক্ষণাৎ পা টেনে ধরে। থমকে দাঁড়ায়। হা হয়ে তাকায় সোহাগের দিকে। রিতীর সাহস নদীতে ভাটা পড়ে। বুক কেঁপে উঠে। নিজের স্থান অবলোকন করতেই আরো ভীত হয়ে উঠে। সোহাগ এখনো তার পিছু ছাড়েনি। ঠিক খুঁজে বের করেছে। এতোদিনের নরমাল লাইফ লিড করতে চাওয়া রিতীর জীবনে কি আবারো কাটা হয়ে দাঁড়াবে? রিতী সোহাগের চোখে চোখ রেখেই ধীরে ধীরে পিছিয়ে যায়। তাকে এখান থেকে যেতে হবে। উল্টো ঘুরে দৌড়ানোর প্রস্ততি নেবার আগেই সোহাগ যা করার করে দেয়। স্টুডেন্টসদের ভিড়ের মাঝেই ছুটে গিয়ে রিতীর বুকে মাথা ছেড়ে দেয়। দু হাতে নিজের সাথে রিতীর পিঠ চেপে ধরে। রিতী তাল সামলাতে না পেরে দু পা পিছিয়ে পিলারের সাথে নিজেকে ঠেকিয়ে ব্যালেন্স করে নেয়।

চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here